'আমরাই ছিলাম কুশীলবের ভূমিকায়'

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম (জন্ম: ১ মে ১৯২৭, মৃত্যু: ৯ মে ২০১৮)
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম (জন্ম: ১ মে ১৯২৭, মৃত্যু: ৯ মে ২০১৮)

তরুণ বয়সে নাকি কিছুটা বাউণ্ডুলে স্বভাব ছিল তাঁর। ফুটবল খেলা, সাংগঠনিক কাজ বা রাজনীতি, যার টানেই হোক না কেন, অনেকবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। বাবার কাছে এর জন্য যে প্রচুর বকা খেতে হয়েছে, তাঁর আত্মজীবনী 'নিবেদন ইতি'তে তা লেখা আছে। কিন্তু বাস্তবে তিনি ছিলেন খুব নিয়মনিষ্ঠ। অভ্যাসটা করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা—প্রতিদিন ভোর চারটায় উঠে পড়তেন, বসতেন তাঁর টেবিলে। বাড়ির আর সবাই উঠবার আগেই সেরে ফেলতেন অনেক পড়া-লেখার কাজ।


নেশাও ছিল তাঁর প্রচুর। কেবল ছেলেবেলার ফুটবল খেলা বা যৌবনকালের রাজনীতিই নয়, পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা, গবেষণা, পত্রিকা বের করা আর টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপন করা, সবই ছিল একধরনের নেশা। সূচনা চল্লিশ দশকের শেষ প্রান্তে 'অগত্যা' পত্রিকা দিয়ে, যখন তাঁর বয়স মাত্র বাইশ কি তেইশ, আর সমাপ্তি ৯০ বছর বয়সে, মৃত্যুর এক বছর আগে, টিভিতে 'কথামালা'র শেষ অনুষ্ঠান দিয়ে। মাঝখানে বের করেছিলেন প্রচুর সমাদৃত পত্রিকা 'পূর্বমেঘ' ও 'সুন্দরম' আর টেলিভিশনে উপস্থাপন করেছিলেন জনপ্রিয় অনুষ্ঠান 'মুক্তধারা'।



নজরুল নেশা
একসময় 'নজরুল নেশা' পেয়ে বসেছিল তাঁকে। বাউণ্ডুলে, শৃঙ্খলহীন জীবন, অথচ অবিরাম সৃষ্টি করে যাচ্ছে একটি মানুষ। এবং কত অঙ্গনে তাঁর বিচরণ! তাঁর কাছে বোধ হয় এটিই ছিল রোল মডেল। 'তখন তো ভাবিনি যে কখনো বিয়ে করব, সংসার হবে', তরুণ বয়সের এই অভিব্যক্তির কথা কয়েকবার বলেও ছিলেন তিনি। সেই বাউণ্ডুলে অথচ সৃষ্টিশীল, সমাজসচেতন নজরুল নিয়ে একধরনের কাল্পনিক জীবনী লেখার আকর্ষণ একবার হয়েছিল। অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ফরাসি শিল্পী পল গগাঁকে নিয়ে লেখা সমারসেট মমের 'দ্য মুন অ্যান্ড সিক্স পেনস' এবং ডাচ শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘকে নিয়ে লেখা আরভিং স্টোনের 'লাস্ট পর লাইফ' থেকে। তার আত্মজীবনীমূলক বই 'নিবেদন ইতি'তে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম এভাবেই তার বয়ান দিয়েছেন:
কেন জানি মনে আসছিল—এই দেশে হয়তোবা আরেক আমাদের নজরুল। কিছু কিছু মিল খুঁজে পাই। এবং সৃজনের অঙ্গনে শিল্পী মহত্তম তো বটেই। কেমন এক কাকতালীয় যোগ, তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পই 'বাউন্ডেলের আত্মকথা'। গল্পের নামকরণটা লক্ষ করবার মতো। পত্রিকা বার করছেন 'ধূমকেতু', এবং উপন্যাস 'বাঁধনহারা'। এই সাথে অনুসরণ করে যাব। বাল্য-কৈশোর অবধি কেমন বেজায় গরহিসেবের চড়াই-উৎরাইয়ে তাঁর পথচলা। বুঝ্ জন্মাচ্ছিল ঐ নজরুলকে নিয়ে কাছাকাছি হলেও অমনতর ঢঙের 'একটা কিছু' করা যেত। অর্থাৎ কিনা তাঁর আরেক জীবন নিয়ে কথা ও কাহিনী দাঁড় করানো যেত।' (নিবেদন ইতি, উত্তর খণ্ড, পৃষ্টা ৪৯)


খুব বড় মাপের কাজ হয়তো হবে না, কিন্তু কিছু একটা করবার 'তাগিদটা বেজায় তাড়া করে ফিরছিল'। ছোটবেলাতেই দুয়েকবার নজরুলকে প্রত্যক্ষ দেখার সুযোগ হয়েছিল মুস্তাফা নূরউল ইসলামের। বাবা সা'দাত আলী আখন্দ পুলিশ অফিসার কিন্তু সাহিত্য প্রেমিক। তাঁর সঙ্গে নজরুলের সখ্য ছিল। বাবার কাছে নজরুলের গল্প শুনেছেন, তাঁর 'বারংবার বাড়ি থেকে পালানো, পথে পথে ঘুরে বেড়ানো; কখনো হারিয়ে যাওয়া, ভবঘুরে জীবন'-এর ইতিবৃত্ত। পরবর্তীকালে অন্যদের কাছেও শুনেছেন—কবি আব্দুল কাদির, কাজী মোতাহার হোসেন, মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন—যাঁরা জানতেন নজরুলের 'অন্তরঙ্গ জীবনের মেলা কাহিনি'। আর নজরুলের সময়কালীন বান্ধবদের স্মৃতিচারণমূলক লেখা তো ছিলই। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়, যখন তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের একমাত্র শিক্ষক, ঠিক তখনই মুস্তাফা নূরউল ইসলামের এই শখটি জেগেছিল। 'নিবেদন ইতি'-তে লিখছেন, 'তদর্থে অবশ্যই জীবনকথা নয়; প্রামাণ্য কেতাবি ডকুমেন্টেশন নয়; সৃজনকার্যের মূল্যায়ন, তাও নয়। কত যে নানান রঙের বর্ণিল আমাদের নজরুল; ব্যতিক্রমী একক “নজরুল”। তাঁকে নিয়ে কাজ করব—“এই পেয়ে বসা” ঝোঁকটা এই রকমের।'

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম

প্রস্তুতি শুরু হলো। সিদ্ধান্ত নিলেন 'সামনাসামনি বসে ইন্টারভিউ নেব তাঁদের, যাঁরা এক সময়ে নজরুলের অতি কাছের মানুষ ছিলেন। তা সক্রিয় রাজনীতির মাঠে-ময়দানেরই হোক, কি গানের ভুবনেরই হোক।' কাদের সঙ্গে কথা বলবেন, তার তালিকা তৈরি হলো, তাঁদের কী প্রশ্ন করবেন, তা-ও লিখে ফেললেন। অনেকেই কলকাতায় থাকেন, তাঁদের চিঠি লেখা হলো। কেউ জবাব দিলেন না। কেউ দিলেন, উৎসাহ জোগালেন, 'এসে পড়ুন কলকাতায়, নজরুলের ব্যাপার-কাণ্ড জানামতে বলবার অনেক রয়েছে।' করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই মাসের ছুটি বরাদ্দ হলো, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম হাজির হলেন কলকাতায়। উঠলেন বন্ধুবর রুহুল আমিন নিজামীর বাসায়। তাঁকে নিয়ে ঘুরলেন বিশাল শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।

দেখা হলো অনেকেরই সঙ্গে—সৌমেন্দ্র ঠাকুর, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, পরিমল গোস্বামী, বুদ্ধদেব বসু ও তাঁর স্ত্রী প্রতিভা বসু, সজনীকান্ত দাশ, কানন দেবী ও নজরুলের সহধর্মিনী প্রমীলা নজরুল। বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন 'চতুরঙ্গ' পত্রিকার সম্পাদক আতাউর রহমান। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিয়েছিলেন, নিজেও অনেক কথা বলেছিলেন। সাক্ষাৎকারগুলো সব সময় প্রীতিকর হয়নি, কেউ কেউ অনেক কথা জানলেও এড়িয়ে গেছেন, আবার কেউ কেউ অতিরঞ্জনও করেছেন। কিন্তু 'শনিবারের চিঠি', যে পত্রিকাটি একসময় নজরুলের চরম বিষোদ্‌গার করেছিল, তার সম্পাদক সজনীকান্ত দাশ অনেক কিছুই খোলাখুলি বলেছিলেন। এমনকি নজরুল-বিদ্বেষের মূল কারণটিও স্বীকার করেছিলেন, 'আসলে ঘটনাটা হচ্ছে মুসলমান ছোকরা নজরুলের হিন্দুঘরের কন্যাকে বিবাহ করা।'

নজরুলের গান শেখানোর অভিনব কায়দার বর্ণনা দিয়েছিলেন কানন দেবী। প্রতিভা বসুও গান শেখানোর কথা বলেছিলেন কিন্তু তাঁকে গান শেখাতে এসে একদিন রাতে পাড়ার হিন্দু ছেলেদের হাতে নজরুল নিগৃহীত হয়েছিলেন, সে কথাটি চেপে গিয়েছিলেন, যে কাহিনি পরে নজরুল-বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে জানা গিয়েছিল। আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রমীলা নজরুল আক্ষেপ করেছিলেন, 'জানো, কত বেলা আমাদের প্রায় অনাহারেই কেটেছে, ওঁর চিকিৎসার ওষুধ পর্যন্ত কেনবার সঙ্গতি হয়নি।…আর যত সব বাটপার জুটেছিল, ওঁর চিকিৎসার নামে কত যে নিরাময় সমিতি। সাহায্যের টাকাপয়সা তুলে সব ওরা লুটপাট করে খেয়েছে।' আতাউর রহমানও অনেকটা সেই সুরেই কথা বলেছিলেন, 'তখন মুসলিম কওমের ঝান্ডাধারী মুসলিম লীগের নেতা তাঁরা। কেউই তাঁদের এগিয়ে আসেননি। না মাওলানা আকরাম খাঁ, খাজা নাজিমুদ্দিন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কারুকেই দেখি না। “মুসলিম সাহিত্যে”র আর “মুসলিম রেনেসাঁ”র পান্ডারা, তাঁরাই-বা কোথায়, নজরুলের সেই দুঃসময়ে?'

শেষমেশ আকাঙ্খিত বইটি আর লেখা হয়ে ওঠেনি। পল গগাঁকে নিয়ে সামারসেট মম, বা ভিনসেন্ট ভ্যান গঘকে নিয়ে আরভিং স্টোন যেভাবে লিখেছিলেন, তার জন্য নজরুলের অন্তরঙ্গ জীবনের যে উপাদান দরকার ছিল, কলকাতার সাক্ষাৎকারগুলোতে তা যথাযথ বেরিয়ে আসেনি। তবে এই কাজের সূত্র ধরেই মুস্তাফা নূরউল ইসলামের মাথায় একটি চিন্তা এসেছিল। 'সমকালীন তাঁরা দেখছেন নজরুলকে—কোন চোখে, বিবেচনার কোন মাপে? এবং আরও ছড়িয়ে সেই সময়ের পটে নজরুল। এই রকমের কাজেও তো হাত দেওয়া যেতে পারে।…উপন্যাস-ঢঙের কাহিনি-কথা রচনা নয়, বরঞ্চ নজরুলে-সমকালে জড়িয়ে ইতিকথা বয়নের প্রয়াস পাওয়া যেতে পারে।”

কাজটি করেও ছিলেন। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় 'সমকালে নজরুল ইসলাম'।

নিবেদন ইতি
নিবেদন ইতি

বাঙালি মুসলমানের জীবন ও জনমত
উনিশ শ ষাটের দশক। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় শিক্ষকতা করছেন। পড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। 'পূর্বমেঘ' নামের একটি সাময়িকী সম্পাদনা ও প্রকাশ, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগঠিত করা ও তাতে অংশ নেয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে নাটকের আয়োজন করা, ইত্যাদি বিবিধ কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত, কিছুটা নেশাগ্রস্তও বলা যায়। কিন্তু সংসারজগতের চাহিদাও তো বেশি দিন উপেক্ষা করে থাকা যায় না। অবধারিতভাবেই সহধর্মিণী একদিন জানিয়ে দিলেন, তাঁর 'ক্যারিয়ার' নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে। আসলে 'সময় এসেছে' বললে কম বলা হবে। সময় চলে যাচ্ছে কিন্তু স্বামীর কোনো মাথাব্যথা নেই; ইরা ইসলাম বেশ চিন্তিত, কিছুটা অসন্তুষ্টও বটে!

তাই শুরু হলো পিএইচডি করা নিয়ে চিন্তাভাবনা। একটি ধারণা পাওয়া গেল তাঁর শিক্ষক-স্থানীয় সহকর্মী অধ্যাপক এনামুল হকের কাছ থেকে। আত্মজীবনীতে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম এভাবে তার বয়ান দিয়েছেন:

আমাকে আবিষ্কারের আকর্ষণে পেয়ে বসেছিল। পরামর্শটা দিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ এনামুল হক। তিনি তখন আমাদের এখানে বাংলা বিভাগের দায়িত্বে। একদিন কথা হচ্ছিল তাঁর 'বঙ্গে সুফী প্রভাব', 'মুসলিম বাঙলা সাহিত্য' এই বই দুটো নিয়ে। কথায় কথায় তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'ব্রজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের “সংবাদপত্রে সেকালের কথা” পড়েছ? বেশ দামি কাজ। তবে এখানে মুসলমান সমাজ অনুপস্থিত। এই লাইনে তুমি কাজ করতে পারো।' বুঝিয়ে বলেছিলেন, মুসলমান সম্পাদিত পত্রপত্রিকায় মুসলিম সমাজজীবনের ছবি, তাদের মানসভাবনা ইত্যাদি নানা দিক নিয়ে কাজ।

অতঃপর শুরু হলো অনুসন্ধান। ড. এনামুল হক সতর্ক করে দিয়েছিলেন, 'অনেক লম্বা রাস্তা, অনেক দিনের রাস্তা।' কিন্তু তিনি দমে যাননি। কেবল বড় শহরেই নয়, অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছুটে গেলেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, পুরোনো পত্রপত্রিকার সন্ধানে। সবখানেই যে সহযোগিতা পেলেন, তা নয়, আবার কখনো কখনো অপ্রত্যাশিতভাবেই পেয়ে গেলেন সোনার খনি। খবর পেলেন খুলনার ফুলতলা গ্রামে জনৈক চৌধুরী সাহেবের বাসায় আছে কিছু বিরল সংগ্রহ। চৌধুরী সাহেব নিরাশ করলেন না। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম লিখছেন, 'বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলাম, সে কী সমাদর! সোজা দোতলায় নিয়ে গেলেন। কয়েক আলমারিভর্তি বই-পুস্তক এবং পত্রপত্রিকার পাঁজা। দুপুরে ওখানেই আহার, বিকেলে চা-নাস্তা। সবকিছু আমার হাতে ছেড়ে দিলেন। কেবল একটাই শর্ত তাঁর, “দয়া করে ধার চাইবেন না।”' এভাবে সংগৃহিত মূল্যবান ও বিরল উপাত্তের ওপর ভর করে তৈরি তাঁর অভিসন্দর্ভ ১৯৭০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডির ডিগ্রির জন্য অনুমোদিত হয়। কাজটি দুই খণ্ডে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৯৭ ও ২০০৫ সালে, 'সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত' নামে।
বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে নিবেদিত বিভিন্নজন কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করেছিলেন। 'সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত'-এর ভূমিকায় মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সেই প্রশ্নগুলো সাজিয়েছেন এইভাবে: 'আমরা কী প্রথমত মুসলমান, অতঃপর বাঙালি?' 'আমরা কী প্রথমত বাঙালি, অতঃপর মুসলমান?' 'অভিন্ন সত্তায় আমরা কি শুধুই বাঙালি মুসলমান, অথবা মুসলমান বাঙালি, অথবা শুধুই বাঙালি?' 'বহির্বাংলায় ভারতীয় মুসলমানের সঙ্গে, এবং বিশ্ব মুসলমানের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা কতটা অব্যবহিত ঘনিষ্ঠ?' এবং বিশেষ করে 'প্রতিবেশী বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের চরিত্ররূপ কী—তারা আমাদের স্বদেশবাসী, একই ভাষাভাষী ভ্রাতা, অথবা প্রতিপক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী?'

এই কাজটির উল্লেখ করতে গিয়ে কিছুটা ইতিহাসের পানে তাকানো যায়। ১৯৩৭ সাল, মুস্তাফা নূরউল ইসলামের বয়স তখন ১০। সে বছর বাংলার রাজনীতিতে ঘটে একটি সুদূরপ্রসারী ঘটনা। ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান প্রদেশ বাংলায় প্রথমবারের মতো মুসলমান নেতৃত্বে একটি সরকার নির্বাচিত হয়। কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগের এই যৌথ সরকারের প্রধানমন্ত্রী (তখন পদটির নাম এ-ই ছিল) হন আবুল কাশেম ফজলুল হক। বাঙালি মুসলমানের আত্মবিকাশের যাত্রায় এটি ছিল অন্যতম প্রধান মাইলফলক।

এই স্থানে পৌঁছানোর পেছনে একটি ইতিহাস ছিল। এর শুরু আরও আগে হলেও তা বেগবান হয় বিশ শতাব্দীর উষালগ্ন থেকে। এখানে চারটি ধারা চিহ্নিত করা যায়, যেগুলো কিছুটা সমান্তরালভাবেই এগোচ্ছিল একটি পুরাতন স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে। প্রথমত, সর্বভারতীয় মুসলিম রাজনীতির স্রোতের পাশাপাশি, কিংবা বলা যায় বিপরীতে একটি বাংলাভিত্তিক ও বাঙালি পরিচয়ভিত্তিক মুসলিম রাজনীতির ধারা শুরু হয়। কৃষক প্রজা পার্টি তো বটেই, বঙ্গীয় মুসলিম লীগের একটি প্রগতিশীল অংশও এই ধারার বাহক ছিল। অপর পক্ষে ছিল বঙ্গের বাইরে অবস্থানকারী সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের নেতারা, বাংলায় বসবাসরত অবাঙালি মুসলমান রাজনীতিবিদদের অধিকাংশ এবং কিছু কিছু বাঙালি মুসলিম লীগার। দ্বিতীয় ধারাটির পরিচয় একটি অসাম্প্রদায়িক অবস্থানের মধ্যে, যেখানে একটি আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যায়, অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানদের অগ্রগতির লড়াইয়ের মধ্যেও হিন্দুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক ইস্যুতে জোর দেওয়া, বিশেষত জমিদার ও মহাজনদের দ্বারা কৃষকদের শোষণ, তা হিন্দু বা মুসলমানই হোক, তা রোধ করা। এ ধারার একটি নির্দিষ্ট দাবি ছিল জমিদারি বিলুপ্ত করা, কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়েই। চতুর্থ ধারাটি ছিল রাজনৈতিক সংগঠন বিষয়ে—সনাতনী, বড় শহরভিত্তিক, ওপরতলার রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা। রাজনৈতিক সংগঠনকে গণতান্ত্রিকীকরণ করার উদ্যোগ।

এই চারটি ধারা সমান্তরাল চললেও তা একে ওপরের পরিপূরক ছিল। যাঁরা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছিলেন, তাঁরাই রাজনৈতিক সংগঠনের গণতান্ত্রিকীকরণে উৎসাহী ছিলেন এবং একটি অসাম্প্রদায়িক অবস্থানে বিশ্বাসী ছিলেন। আবার তাঁদেরই অনেকের বাঙালি জাতীয়তাবাদে গভীর বিশ্বাস ছিল।

এই সব ধারা মূলত রাজনৈতিক ছিল। তার পাশাপাশি আরেকটি ধারা ক্রমশ জোরদার হয়, তা ছিল বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের অন্বেষা। এই সাংস্কৃতিক ধারাটির প্রকাশ ঘটে বিভিন্ন পুস্তিকায়, সাময়িকপত্রে এবং সভা-সমিতিতে। যুবক বয়সে তো বটেই, এমনকি বাল্যকালেও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম এর স্পর্শ পেয়েছিলেন। পুলিশ অফিসার, অথচ ইতিহাস ও সাহিত্যে প্রচণ্ড আগ্রহ, পিতা সা'দাত আলী আখন্দের কথা আগেই বলা হয়েছে। বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় অন্বেষার পুরোভাগে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা অনেকেই তাঁর বাসায় আসতেন, সেখানে আলোচনা হতো, বিতর্ক হতো, লেখালেখির প্রেরণা আসত। আরেকটু বড় হয়ে পিতৃ-পরিচয়ের সুবাদে, বা আর কারও মারফত, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই মুস্তাফা নূরউল ইসলামের দেখা হয়েছে, তাঁদের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে।

এই সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক ধারাটির ব্যাপারে তাই বলা চলে তাঁর অল্প বয়স থেকেই আগ্রহ জন্মেছিল। পরবর্তীকালে, চল্লিশ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে, এই ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত দুয়েকটি প্রখ্যাত পত্রিকার সঙ্গেও তিনি যুক্ত হয়েছিলেন তরুণ সাংবাদিক হিসেবে, যার মধ্যে ছিল আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত 'ইত্তেহাদ' ও কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সম্পাদিত 'মিল্লাত'। তাই ষাটের দশকে ড. এনামুল হকের ওই বিশেষ বিষয়টির ওপর কাজ করার প্রস্তাব যে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম লুফে নিয়েছিলেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কাজটিতে নেমে পড়েছিলেন তিনি অনেক আগ্রহ নিয়েই, পরিশ্রমও করেছিলেন বিস্তর। পাঁচ দশকজুড়ে একটি সময়, অর্থাৎ বিশ শতকের প্রথম অর্ধে, বাঙালি মুসলমানের আত্মানুসন্ধানের একটি বর্ণনা, একটি দলিল প্রস্তুত করতে উদ্যোগী হন।

স্বপ্নভঙ্গ…অগত্যা
উনিশ শ সাতচল্লিশ সাল। ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। আরও অনেকের মতো মুস্তাফা নূরউল ইসলামের মনও উদ্বেলিত একধরনের উত্তেজনায়, যে পাকিস্তানের জন্য এত সংগ্রাম, সেই প্রতিশ্রুত আবাসভূমি এখন আর স্বপ্ন নয়, তা বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু মনের কোণে কোথায় যেন একটু শূন্যতা। পাকিস্তান হবে অবিভক্ত বাংলাকে নিয়ে, সে আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। শেষ অবধি চেষ্টা করেছিলেন সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু, সঙ্গে ছিলেন আবুল হাশিম, কিরণ শংকর রায় প্রমুখ, বাংলা নিয়ে যাঁদের একধরনের স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন দেখেছিলেন তরুণ মুস্তাফা নূরউল ইসলামও। কেবল স্বপ্নই দেখেছিলেন, তা নয়, এই প্রচেষ্টা খুব কাছ থেকে অবলোকন করার সুযোগও পেয়েছিলেন। 'নিবেদন ইতি'-তে তিনি লিখছেন:

সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত
সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত

ওই ড্রইংরুমেরই এ মাথা ও মাথা সবটাজুড়ে নীচে বসে আমরা। সোফায় বসে সোহরাওয়ার্দী সায়েব, তাঁর ডান পাশে শরৎ বসু, কিরণ শংকর রায়, আর বাঁ পাশে আবুল হাশিম, মেয়র ওসমান, এঁরা। প্রধানতই কথা বললেন দুজনা—আবুল হাশিম এবং শরৎ বসু। একমাত্র মুখ্য বিষয় 'অখণ্ড বাংলা'। নানা সব দিক বিস্তারিত আলোচনায় এসেছিলো—দেশের ভূগোল-বৈশিষ্ট্য, ষড়্ঋতুর প্রকৃতি, বাসিন্দা মানুষের এথনিক বহমানতা, ভাষা সংস্কৃতি শিল্প সাহিত্য, হাজার হাজার বছরের বাঙালিত্ব ইত্যাদি সব অনেক কিছু। তাঁরা বলেছিলেন লোকায়ত বাংলার কথা, লালন রবীন্দ্রনাথ নজরুল কথা। নিবিষ্ট মুগ্ধতায় শুনে গেছি আমরা। তাই তো, এমন করে কি ভেবেছি কখনো? দিনাজপুরের আমাদের স্টাডি সার্কেলের সঙ্গে বেশ কিছু মিলে যাচ্ছিল। বুকে যেন আস্থা ফিরে পাচ্ছিলাম। বাংলা তাহলে ভাগ হবে না। আসমুদ্রহিমাচল 'বঙ্গ আমার জননী আমার' এক অখণ্ড থাকবে। আমাদের ভাবনাতে, বিশ্বাসে পাকিস্তান বটে, তবে অবশ্যই হিন্দু-মুসলমানে মিলে তা এক সত্তায় 'অখণ্ড বাংলা'।

কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাংলার সুবিধাবাদী নেতারা—হিন্দু মুসলমান উভয় পক্ষেই—গদি দখলের স্বপ্নে বিভোর; খণ্ডিত বাংলায় সে সুযোগ বেশি হবে, তাই তারা নাকচ করে দিলেন সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বসু ও আবুল হাশিমের প্রস্তাব। আর মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতাদের চাপ তো ছিলই। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক মনোভাব অনেকটা মাথাচাড়া দিয়েছে তত দিনে, বিশেষ করে ১৯৪৬-এর দাঙ্গার পর। 'অখণ্ড বাংলার' স্বপ্ন বিলীন হয়ে গেল।

বাবার কর্মস্থল দিনাজপুর থেকে বারবার নানান আকর্ষণে, মা-বাবাকে নিত্য দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়ে যে শহরে চলে যাওয়া, সেই পরিচিত কলকাতা এখন হতে যাচ্ছে বিদেশ। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু এখন থেকে হবে ঢাকা। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সেই উপলব্ধি ব্যক্ত করছেন এইভাবে: '৪৭-এর পালাবদল স্বভাবতই আমাদের নিশানার ঠিকানাও বদলে দিল। অতঃপর এখন থেকে আমাদের 'destination moon' দাঁড়ালো ঢাকা, নতুন বানানো এতদঞ্চলের রাজধানী। রাতারাতিই—প্রায় এক জেলা শহর থেকে প্রমোশন পেয়ে প্রদেশের রাজধানী।'

নতুন দেশকে নিয়ে উৎসাহ তো ছিলই। 'অখণ্ড বঙ্গের' স্বপ্ন নাহয় বাস্তবায়িত হয়নি, কিন্তু পুরো পাকিস্তানে না পারলেও পূর্ববঙ্গে গড়ে তোলা হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, একটি শোষণহীন সমাজ, একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা—সোজা কথায় একটি আদর্শ দেশ, যেখানে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে কি তা হবে? সন্দেহ জাগছিল ১৯৪৭-এর আগস্ট মাসের আগে থেকেই। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম লিখছেন, 'কী সব কানে আসছিল, খবরের কাগজে পড়তাম, “বাবায়ে উর্দু” উপাধির একজন আব্দুল হক; আরেকজন মস্ত মাপের, তিনি মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান, '৪৭-এর মে মাসেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা।” তারপর জুলাইতে আলীগড় ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদের আগাম নির্দেশিত করেই দেওয়া— “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।” এসব উচ্চারণই হয়তো সাহস দিয়েছিল তাদের, যারা বাঙালির উপর উর্দু চাপিয়ে দেয়ার পাঁয়তারা করছিল।'

পথে ঘাটেও আলামত দেখা যাচ্ছিল। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম জানাচ্ছেন, 'আমরা অবশ্য তেমন করে টেরই পাইনি, গোড়ার থেকেই যে পাকিস্তান ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের আর 'দৈনিক আজাদ'-এর বদৌলতে পাকিস্তানী জবানে আমাদেরকে তৈরী করা শুরু হয়ে যাচ্ছিলো। “উর্দু কী পহেলী ছবক”-এ আমরা খানিক খানিক যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। ছবক বলতে শব্দমালা; শুরুতেই যেমন “মোহাজির” বিহারি রিফিউজি ওরা, আর এদেশী বাঙালি আমরা নাকি “আনসার”। তার পরের থেকে তো সার ধরে “আজাদী”, “উম্মাহ”, “ইনসান”,“ইনসাফ”, “ইত্তেফাক”, “ওয়াতান”, “কওম”, “পয়গাম”, “মাগরেবী”, “মাশরেকী”, “মিল্লাত”, “তমদ্দুন”, “তাহজীব”, “সদরে আলা” ইত্যাকার এই রকম সব।'

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ১৯৫০
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ১৯৫০

তবে দ্রুতই শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। একদিকে বয়োজ্যেষ্ঠরা—ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক প্রমুখ। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম লিখছেন: 'কী প্রচন্ড দুঃসাহসিক ভবিষদ্বাণী অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের, “বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশি দিন চাপা থাকতে পারে না। শিগ্রহি তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হওয়ার আশংকা আছে।”'
আরেক দিকে তরুণরা। পাকিস্তানের জন্মের মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই দিনাজপুরে বসে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বার্তা পেলেন 'ঢাকায় যেতে হবে, নতুন এক রাজনৈতিক সংগঠন গড়া হচ্ছে।' সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে দুই দিন ধরে সভা হলো। কলকাতা ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মূলত তরুণদের জমায়েত। কলকাতা থেকে এসেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, ঢাকা থেকে তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, কামরুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। গঠিত হলো 'ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ লিগ অব পাকিস্তান'—'পাকিস্তানিত্বের উত্তেজনার, গোঁড়ামির থেকে বাইরে—ষোলো আনা পুরোপুরি সেটি অসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক।' চার মাস পর গঠিত হলো পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ। তার এক মাস পরই কাকতালীয়ভাবে আরেক ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে পরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবিতে প্রস্তাব রাখলেন। একটু একটু করে জমাট বাঁধছে প্রতিরোধ। সব বাঁধ ভেঙে গেল মার্চ মাসেই। ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের ডাকা আন্দোলনে ফেটে পড়ল ঢাকা। উনিশে মার্চ ঢাকায় এলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। আশা করা হয়েছিল বাঙালিদের দাবি নিয়ে অন্তত সহানুভূতিশীল কিছু কথা তিনি বলবেন। উল্টো তার মুখে উচ্চারিত হলো বাঙালির দাবিকে নাকচ করে দেওয়া সেই দাম্ভিক উক্তি—'উর্দু, এবং কেবল উর্দুই, হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা।' বাকিটা ইতিহাস।

অগত্যা কী করা? আন্দোলন তো চলছিলই। লেখালেখি, মিছিল-মিটিং সংগঠিত করা, বিভিন্ন ধরনের সংকলন বের করা, নানাবিধ কাজে জড়িয়ে পড়তে লাগলেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। এরই মধ্যে আরও কয়েকজনকে নিয়ে বিশেষ একটি উদ্যোগ নিলেন, বাংলাদেশের পত্রিকা প্রকাশনার ইতিহাসে যা একটি উজ্জ্বল মাইলফলক হিসেবে রয়ে গেছে। পত্রিকার অভিনব নামটি যেন এই অস্থির সময়েরই প্রতিফলন। তাঁর কথাটিই শোনা যাক:
আমাদের ওই কম্মের জুড়ি আগেও নেই, পরেও আর হয়নি। সমকালে বিশেষ করেই তরুণ প্রজন্মের মাঝে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল এই 'অগত্যা'। আমরা যারা জুটেছিলাম, মাসভর পত্রিকার খোরাক জোগাতাম, কত যে নানান সব কথা হত। 'শিশু রাষ্ট্র' পাকিস্তানের অছিলায় যারা হয়ে উঠেছিল 'যেমন তেমন নয়' 'মস্ত কেউকেটা' তাদেরকে নিয়ে; যারা রবীন্দ্র-বর্জনে, নজরুল-খণ্ডিতকরণে প্রচণ্ড আওয়াজ তুলে মাতামাতি করত তাদেরকে নিয়ে; আর মাতৃভাষা-নিধনে, আরবি হরফ চালুর অপকাণ্ডে পাপ দুশমনের শয়তানি ভূমিকা নিয়েছিল—'অগত্যা' তাদের কারুকেই ছেড়ে কথা কয়নি। পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যার জন্য আগের থেকেই গোটা কতক টার্গেট ঠিক করে নেওয়া হত। তাদের নামের বানানো বিকৃত করে লেখা হত।

গুরুগম্ভীর লেখা তো ছিলই, কিন্তু ঠাট্টা-মশকরার মধ্য দিয়ে কীভাবে রাজনীতি, রাষ্ট্র ও অর্থনীতির জটিল বিষয়গুলো সহজভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যায় 'অগত্যা' তা-ই করেছিল। পত্রিকা টিকে ছিল মাত্র চার বছর। কিন্তু এরই মধ্যে এক অভিনব প্রতিবাদের ভাষা প্রচলন করে অনন্য হয়ে গিয়েছিল 'অগত্যা'। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম যথার্থই লিখেছেন, 'এলাম, দেখলাম, জয় করলাম।'

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ১৯৬০
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ১৯৬০

মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জন্মতারিখ পয়লা মে—বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষদের সম্মানে নিবেদিত একটি ঐতিহাসিক দিন। তাঁর আদি ভিটার সঙ্গেও জুড়ে আছে ইতিহাস। তাঁর দেশের বাড়ি বগুড়া জেলার চিঙ্গাসপুর গ্রামে, 'ইতিহাসের রাজধানী মহাস্থান গড়-লাগোয়া এলাকার মানুষ' তিনি। ইতিহাসের সঙ্গে এই স্পর্শকতুল্য সম্পর্কের ব্যাপারে কিছুটা 'আত্মশ্লাঘাও' ছিল তাঁর, রসিকতা করে হলেও মাঝেমধ্যে তা-ই বলতেন। কিন্তু আরেকটি ইতিহাসের সঙ্গে ছিল তাঁর সত্যিকারের নিবিড় সম্পর্ক। এক শ বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার এক কোণে বসবাসরত, একসময় পশ্চাৎপদ, বিশেষ এক জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের সাক্ষী তিনি। কেবল সাক্ষীই নন, এই বিকাশের বিভিন্ন ধারার সঙ্গে, নানাবিধ ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতও। তার আত্মজীবনী 'নিবেদন ইতি'তে তাই 'ফিরে ফিরে সময় কালের উল্লেখ' এসেছে। তিনি যথার্থই বলেছেন 'সময়ের ওই পটভূমি-মঞ্চে একদা আমরাই ছিলাম কুশীলবের ভূমিকায়।'