আমার প্রবাসী বাবা
আমার যখন জন্ম হয়, তখন তিনি বাংলাদেশ সীমান্তের বাইরে অনেক অনেক দূরে৷ তবু সেখান থেকেই একটি খামের ভেতরে ছোট্ট সোনার লকেটের সঙ্গে চিরকুটে লিখে পাঠিয়েছে, ‘আমার ছোট মায়ের জন্য উপহার!’ সেখান থেকেই গল্পটা শুরু৷
জীবনের এতগুলো বসন্ত পার হয়ে গেলেও খুবই অল্প কিছু সুন্দর সময়ে তাকে কাছে পেয়েছি৷ ব্যাপারটা একই সঙ্গে আনন্দের ও হতাশার৷ বিভিন্ন পরীক্ষার দিনে, রেজাল্টের দিনে, স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিনে এবং এমন অনেক বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে সবাই মা-বাবা দুজনকে একসঙ্গে পেলেও আমি সশরীরে মা-বাবা দুজনকে একসঙ্গে পাইনি কখনো৷ দেড়-দুই বছরে একবার যেখানে বাবার সঙ্গে দেখা হয় আমাদের, সেখানে কোনো একজন বান্ধবীকে দেখেছিলাম একবার সাপ্তাহিক ছুটিতে বাবাকে কাছে না পেয়ে রোনাজারি করতে! মনটা তখন খুব হাহাকার করত, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দূরত্বের সম্পর্কে অভ্যস্ত হয়ে গেছি৷ সম্পর্ক মানেই কেবল চোখের সামনে থাকা নয়, বরং সর্বক্ষণ হৃদয়ে থাকা। সম্পর্ক তো হবে আত্মার সঙ্গে আত্মার, আর এই সম্পর্ক চিরন্তন৷
যখন ছোট ছিলাম, মাথার ওপর দিয়ে কোনো প্লেন উড়ে যাওয়ার শব্দ পেলেই ভাইবোন মিলে আনন্দে চিৎকার করে উঠতাম বাবা আসছে বলে! কিন্তু আসত না, অল্প কিছুক্ষণ পর হতাশ হয়ে ফিরে আসতাম সবাই৷ জীবনের একটা লম্বা সময় বাবার শূন্যতাকে মেনে নিয়ে পথ চলতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তারপরও আমি ব্যথিত নই৷ এত দূরে থেকেও আমাকে যে মানুষটা সবচেয়ে ভালো পড়তে জানে, সেটা তিনিই! মাকে প্রায়ই বলেন, ‘ও একটু নিজের ইচ্ছায় চলতে পছন্দ করে, ওকে কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দিয়ো না, ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়ো!’ আর আমাকেও বলে, ‘নিজেকে কখনো বোঝা মনে করবে না, যেকোনো সদিচ্ছার কথা মুখ ফুটে জানাবে, সর্বদা মানুষের ভালো হয়, এমন কাজকর্ম করবে৷’
>যখন ছোট ছিলাম, মাথার ওপর দিয়ে কোনো প্লেন উড়ে যাওয়ার শব্দ পেলেই ভাইবোন মিলে আনন্দে চিৎকার করে উঠতাম বাবা আসছে বলে! কিন্তু আসত না, অল্প কিছুক্ষণ পর হতাশ হয়ে ফিরে আসতাম সবাই৷
বাবার উপদেশ মনে রেখে পথ চলছি, কিন্তু ভীষণ রকমের এক শূন্যতা নিয়ে এই পথ চলছি৷ স্বপ্ন দেখি খুব, কোনো একদিন আমার প্রবাসী বাবার প্রবাসজীবনের অবসান হবে, একসঙ্গে কোনো এক বিকেলবেলায় মৃদু বাতাসে বসে অনেক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হবে আমাদের, সারা জীবনের শূন্যতা বাতাসে মিলিয়ে যাবে একনিমেষে৷ কত মানুষের তো বাবা থাকে না, বরং আমি তাদের চেয়ে ভালো আছি তো, দূরে থেকেও বাবা আছে মনে হলে বুকের ভেতর যে শক্তির সঞ্চার হয়, সেটা বাবা না থাকলে কখনো হতো কি না, জানি না৷
বাবার জন্য অর্ধেক হৃদয়ের উজাড় করা ভালোবাসা জমা রেখেছি, বাকি অর্ধেক বাবার বউয়ের জন্য, নইলে বাবার বউ আবার অভিমান করে বসবে৷ আমাদের সবার বাবা সুস্থ আর দীর্ঘায়ু নিয়ে অনেক ভালো থাকুক, এটাই কামনা করি৷
আবিদা হোসাইন মদীনা
এমবিবিএস ৪র্থ বর্ষ।