একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ

আজ বাবা দিবস। এদিনে সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের ছেলে লিখেছেন তাঁর বাবাকে নিয়ে।

সৈয়দ নাসিফ মকসুদ ও সৈয়দ আবুল মকসুদ।গ্রাফিকস: মনিরুল ইসলাম

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১। সন্ধ্যা। বেশ কিছুক্ষণ হলো সূর্য অন্তর্হিত। তার শেষ রশ্মি, যা আকাশকে উজ্জ্বল করে রাখে, তা–ও অপসৃয়মাণ। ঠিক এমনই সময় মৃত্যুর দরজা ঠেলে আব্বা ও পাশে হারিয়ে গেলেন। আমরা বুঝিনি; ভেবেছি, সংজ্ঞা হারিয়েছেন। গাড়িতে তাঁর নিথর দেহ কোলে নিয়ে যখন হাসপাতালে যাচ্ছিলাম, তখনো না। জানলাম হাসপাতালে, ডাক্তার যখন বললেন, তিনি আর নেই।
এক অপরিচিত অবিশ্বাস আর সত্যকে অস্বীকার করার মানসিকতা আমাকে পেয়ে বসল। মনে হলো, আমি টুকরো টুকরো হয়ে গেলাম। আবার টুকরোগুলো নিজেই কুড়িয়ে আরেক দুর্বহ দায়িত্বের জন্য প্রস্তুত হলাম। আম্মাকে বলতে হবে, জিহানকে বলতে হবে। জিহান, আমার বোন, তখন দেশে ছিল না।

দেশের মানুষ যখন টিভির পর্দায় ব্রেকিং নিউজ দেখছে, ‘বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ আর নেই’, আমি তখন শোকের ঘূর্ণাবর্তে এলোমেলো হয়ে গিয়েও আপাত স্থৈর্য আঁকড়ে ধরে আব্বার শেষকৃত্যের আয়োজনে মনোযোগ দিয়েছি।
দেশের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন বিবেকবান বুদ্ধিজীবী, পরিশ্রমী গবেষক, সত্যনিষ্ঠ চিন্তাবিদ, জনপ্রিয় কলামিস্ট অথবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার নাগরিক সমাজের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। বাইরের মানুষের কাছে তিনি যেমন ছিলেন বিবেকবান, নীতিনিষ্ঠ, সংবেদনশীল মানুষ, ঠিক তেমনি ঘরের মানুষের কাছেও তিনি ছিলেন একই রকম হৃদয়বান এবং অসামান্য স্নেহশীল। বাইরের সৈয়দ আবুল মকসুদ আর ঘরের সৈয়দ আবুল মকসুদের মধ্যে কোনো তফাত কোনোদিন দেখিনি।

অতি আপনজনের মৃত্যু আমাদের অস্তিত্বে এক শূন্যতার সৃষ্টি করে। তাঁকে না বলা কথা, না দেওয়া আলিঙ্গন চিরকালের জন্য অসম্ভব হয়ে যায়। মানুষটার সঙ্গে জড়িত স্মৃতি তখন আমাদের বিষণ্ন করে, আবার উজ্জীবিতও করে। বাইরের জগৎ নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ততা সত্ত্বেও আব্বা কখনো পরিবারের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন না। বরং বলা যায়, তিনি ছিলেন পরিবারের প্রয়োজনের প্রতি পুরোদস্তুর সংবেদনশীল।

দুই.

আমরা দুই ভাই–বোন যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারি, তবে আমাদের বিদেশে বেড়াতে নিয়ে যাবেন—এমন ঘোষণা আব্বা দিয়েছিলেন। পুরস্কারের লোভেই হোক বা অন্য কোনো কারণে, দুই ভাই–বোনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাই। আমার বোন অর্থনীতিতে আর আমি ইংরেজি সাহিত্যে। আব্বা তাঁর কথা রেখেছিলেন। ২০০১ সালে আমরা পুরো পরিবার ঢাকা থেকে গেলাম নেপালের কাঠমান্ডু, তারপর পোখারা। নেপাল থেকে ভারতের দিল্লি, আগ্রা, জয়পুর হয়ে শেষে কলকাতায় আরও কয়েক দিন ছিলাম। সেবার ২২ দিন ঘুরেছিলাম এবং পুরো ভ্রমণ হয়েছিল প্লেনে। মনে আছে, পোখারায় এক জায়গা থেকে পাঁচটা পর্বতশৃঙ্গ দেখে আব্বা খুবই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। আগ্রায় তাজমহল দেখে আব্বা রবীন্দ্রনাথের ‘তাজমহল’ কবিতাটা আবৃত্তি করেছিলেন।

বাংলাদেশের দ্রষ্টব্য অধিকাংশ ঐতিহাসিক স্থানে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আব্বার সঙ্গে। আব্বা ধনী ছিলেন না, কিন্তু সন্তানদের অভিজ্ঞতা ও জানাশোনার পরিধি বাড়াতে তিনি কখনো কার্পণ্য করেননি। মাত্র আট বছর বয়সে আমি প্রথমবার দেশের বাইরে যাই। কলকাতায়, ১৯৮৮ সালে। সেবার কলকাতা মহানগরের যে রূপ দেখেছিলাম, তা চিরকাল মনে দাগ কেটে আছে। লোডশেডিং শব্দটার সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়। মাদার ডেইরির মাধ্যমে কীভাবে তারা সারা ভারতে দুধ সরবরাহ করে, আর যেদিন ‘মহাভারত’ দেখাত দূরদর্শনে, সব রাস্তা হয়ে যেত ফাঁকা। কালীঘাটে মাদার তেরেসার প্রতিষ্ঠা করা ‘নির্মল হৃদয় আশ্রমে’ মৃত্যুপথযাত্রী মানুষদের সেবা দেওয়ার যে চিত্র দেখেছিলাম, তা আজও স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে। মনে আছে, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় আব্বার আক্ষেপ। কোনো ফিল্মের শুটিংয়ের জন্য সত্যজিৎ ছিলেন কলকাতার বাইরে। পরবর্তীকালে আরও বহুবার ভারতে গেছি আর কলকাতার অলিগলির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর গ্রন্থ রচনা করতে আব্বা পুরান ঢাকা চষে বেড়িয়েছেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দশকের বহু ছাত্রের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। আমি তখন ছিলাম স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্র। সে সময় আব্বার সঙ্গে পায়ে হেঁটে পুরান ঢাকায় ঘোরার সুযোগ হয়েছে। পুরান ঢাকার গলিঘিজিই শুধু দেখিনি; দিন শেষে কাবাব, বিরিয়ানি আর তেহারি খাওয়াতে আব্বার কখনো ভুল হতো না। যদিও নিজে ছিলেন নিরামিষভোজী, তাই ওই রস থেকে বঞ্চিত। ঢাকার ইতিহাস নিয়ে পরবর্তীকালে যখন পড়েছি, অনেক কিছুই চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তার কারণ, সে সময় শহরের সেসব অংশ আমার দেখা হয়েছিল। আব্বার বিশ্বাস ছিল, বই বা পত্রিকা পড়ে যা জানা যায়, তা আংশিক। প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে ও উপলব্ধি ধারণ করতে হলে, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই।ৎ

শুধু বিখ্যাত পর্যটন স্থান নয়; মনে আছে, একবার একটা আমলকীগাছ দেখতে আব্বা আর আমি গিয়েছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন, আমলকীর এই ডালে ডালে/ পাতাগুলো শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে’, রবীন্দ্রনাথের এই গানে যে সৌন্দর্যের বর্ণনা আছে, তা নিজ চোখে দেখাতে আব্বা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমলকীগাছ সাধারণত অনেক বড় হয়ে থাকে আর পাতাগুলো ছোট; শীতের বাতাসে হলুদ পাতাগুলো যখন ঝরে পড়ে, সেটা এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য।

এখনো স্মৃতিতে খুব জীবন্ত হয়ে আছে ভারতের বারাকপুরে গান্ধী স্মারক সংগ্রহালয়ে কাটানো সময়টা। হুগলি নদীর তীরে গান্ধী সংগ্রহালয় অবস্থিত। মনে আছে, তাদের গেস্ট হাউসের বিছানায় শুয়ে হুগলি নদীর দৃশ্য দেখেছিলাম। এক অদ্ভুত শান্তি ও স্নিগ্ধতা, যা তখন অনুভব করেছিলাম, আজও মনকে অচঞ্চল করে।

আব্বার খাওয়াদাওয়া নিয়ে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। যেহেতু তিনি নিরামিষভোজী ছিলেন, তাই বিভিন্ন ফল ও সবজি ছিল তাঁর প্রধান আহার্য্য। ফলের মধ্যে আম ও আপেল ছিল খুবই প্রিয়। কিন্তু ১৯৮৮ সালের পর আব্বা আর কোনোদিন আপেল খাননি। আটাশির আগস্টে আমার দাদা সৈয়দ আবুল মাহমুদ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন। এর দুই মাস আগে ডাক্তার যখন শেষ কথা বলে দিয়েছিলেন, আব্বা দাদার কাছে জানতে চান, কী খেতে তাঁর ইচ্ছা করছে। আমার দাদা আপেল খেতে চেয়েছিলেন। আশির দশকে এখনকার মতো সারা বছর ফরমালিন দেওয়া আপেল পাওয়া যেত না। শুধু শীতকালে কিছুদিন আপেল বাজারে থাকত। তাই সেই গ্রীষ্মে অনেক খুঁজেও আব্বা আপেল পেতে সমর্থ হলেন না। দাদার মৃত্যুর আগে যেহেতু আব্বা তাঁকে আপেল খাওয়াতে পারেননি, নিজের এই অসামর্থ্যে তিনি নিজেকে ক্ষমা করেননি। তাই আমৃত্যু নিজেকে বঞ্চিত করেছেন প্রিয় ফলটি খাওয়া থেকে। কারও কাছে বিষয়টা খুব সামান্য মনে হতে পারে। কিন্তু একজন মানুষের মানসিক গঠন সম্পর্কে ধারণা পেতে বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ।

তিন.

আব্বা যে নিরামিষভোজী ছিলেন, সে কথা যখন বললাম, তাহলে কখন তিনি এই ব্রত গ্রহণ করেন, তা বলাও অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আব্বার কাছ থেকেই শোনা; ১৯৭৪ সালে দেশে যখন দুর্ভিক্ষ চলছিল, তখন মানুষকে ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁটে খেতে দেখে, খাদ্যের অভাবে মানুষকে মরে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে ভোগবিলাসের জীবনের প্রতি আব্বার শুধু বিতৃষ্ণা নয় বরং বিবমিষা সৃষ্টি হয়। সে সময় থেকেই আব্বা ভালো খাওয়া ছেড়ে দেন এবং আজীবন তা রক্ষা করেছিলেন।

আব্বার খাওয়াদাওয়া নিয়ে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। যেহেতু তিনি নিরামিষভোজী ছিলেন, তাই বিভিন্ন ফল ও সবজি ছিল তাঁর প্রধান আহার্য্য। ফলের মধ্যে আম ও আপেল ছিল খুবই প্রিয়। কিন্তু ১৯৮৮ সালের পর আব্বা আর কোনোদিন আপেল খাননি। আটাশির আগস্টে আমার দাদা সৈয়দ আবুল মাহমুদ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন। এর দুই মাস আগে ডাক্তার যখন শেষ কথা বলে দিয়েছিলেন, আব্বা দাদার কাছে জানতে চান, কী খেতে তাঁর ইচ্ছা করছে। আমার দাদা আপেল খেতে চেয়েছিলেন। আশির দশকে এখনকার মতো সারা বছর ফরমালিন দেওয়া আপেল পাওয়া যেত না। শুধু শীতকালে কিছুদিন আপেল বাজারে থাকত। তাই সেই গ্রীষ্মে অনেক খুঁজেও আব্বা আপেল পেতে সমর্থ হলেন না। দাদার মৃত্যুর আগে যেহেতু আব্বা তাঁকে আপেল খাওয়াতে পারেননি, নিজের এই অসামর্থ্যে তিনি নিজেকে ক্ষমা করেননি। তাই আমৃত্যু নিজেকে বঞ্চিত করেছেন প্রিয় ফলটি খাওয়া থেকে। কারও কাছে বিষয়টা খুব সামান্য মনে হতে পারে। কিন্তু একজন মানুষের মানসিক গঠন সম্পর্কে ধারণা পেতে বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ।

আব্বার খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অতটা অবহিত না থাকতে পারেন, কিন্তু তাঁর ব্যতিক্রমী পোশাক সম্পর্কে যে কেউ উৎসাহী না হয়ে পারেন না। আমাদের সমাজের আর দশজন যে সমস্ত পোশাক পরে থাকেন, আব্বার পোশাক ছিল নিশ্চিতভাবেই তার থেকে ব্যতিক্রম। ২০০৩ সালে ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন হামলার প্রতিবাদে আব্বা সত্যাগ্রহ শুরু করেন। এর একটি অংশ ছিল শার্ট-প্যান্টের বদলে সাদা লুঙ্গি ও চাদর পরা। অনেকের কাছে অদ্ভুত ঠেকতে পারে, কেন বাংলাদেশের একজন মানুষ হাজার মাইল দূরের এক দেশে অন্য দেশের আক্রমণের প্রতিবাদে সমাজের আর দশজনের প্রচলিত পোশাক পরিবর্তন করবে? আব্বার পোশাক পরিবর্তন নিতে হবে পুরোপুরি প্রতীকী অর্থে। আর ‘ইরাকে হামলার প্রতিবাদে’ এই সত্যাগ্রহ যতটা ঠিক, ততটাই সেটা ছিল ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পশ্চিমী সংস্কৃতি, ভোগবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা—এই চার অপশক্তির বিরুদ্ধে। ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসে ইরাক হামলা একটি মুহূর্তমাত্র। মনে আছে, সে সময় থেকে আব্বা বাংলাদেশের সব জেলায় গেছেন। অধিকাংশ ইউনিয়ন ও অসংখ্য গ্রামে গিয়ে মানুষকে এই চার অপশক্তি সম্পর্কে সচেতন করতেন। আব্বার এই প্রচারাভিযান কেউ স্পন্সর করেনি। সম্পূর্ণ নিজের পকেটের টাকা খরচ করেই আব্বা এই কাজ করে গেছেন নিজস্ব প্রত্যয়ে। এই সত্যাগ্রহ (যা একটি অহিংস প্রতিবাদ) যেসব অপশক্তির বিরুদ্ধে, তার কোনোটিই এখনো স্তিমিত হয়নি। তাই আব্বাও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই পোশাক পরে থাকেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ
ছবি: প্রথম আলো

চার.

আব্বা মনে করতেন, একজন শিল্পী বা বুদ্ধিজীবীর সবচেয়ে বড় সম্পদ তাঁর অবিনিময়যোগ্য নৈতিক সততা (non-negotiable moral integrity)। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশের বিপুলসংখ্যক শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীর মধ্যে এই গুণ হতাশাজনকভাবে অনুপস্থিত, আর এই বাস্তবতা আব্বাকে সব সময় পীড়া দিত।

আব্বা সারা জীবন সাহিত্যচর্চা করে, বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী মূল্য আছে এমন সৃষ্টির পরও কোনো রাষ্ট্রীয় পদক পাননি। তাঁর সর্বোচ্চ সম্মাননাটি হলো, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, যা তিনি পেয়েছিলেন ১৯৯৫ সালে। পুরস্কার গ্রহণ উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত ভাষণে আব্বা বলেছিলেন:
‘আমি কোনো বিত্তশালী মানুষ নই। মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। অসচ্ছলতার সঙ্গে পরিচয় আমার শৈশব থেকেই। এই পুরস্কারের সঙ্গে যে অর্থ প্রদত্ত হয়েছে, এই দুর্মূল্যের দিনে তার পরিমাণ প্রচুর না হলেও আমার কাছে কম নয়। আমার পিতাও আজীবন নীরবে কাব্যচর্চা করে বৈষয়িক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। তবু আমৃত্যু তিনি চাইতেন, তাঁর একমাত্র সন্তান সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত থাকুক। সমাজ ও রাষ্ট্রের থেকে কোনো কিছু প্রাপ্তির আশা তিনি আমাকে পরিত্যাগ করতে পরামর্শ দিতেন। এই পুরস্কারের অর্থের ৫২ শতাংশ থেকে আট হাজার টাকা দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে আমি সৈয়দ আবুল মাহমুদ তহবিল নামে একটি কল্যাণ তহবিল গঠন করতে চাই বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে, যে টাকার লভ্যাংশ সহায়–সম্বলহীন কবি-সাহিত্যিকদের চিকিৎসার জন্য ব্যয় করা হবে।

অবশিষ্ট অর্থ দিয়ে আরেকটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যার কাজ হবে কুষ্ঠ রোগীদের পুনর্বাসনে সাহায্য করা। গত দুই বছরে নানা কুষ্ঠকেন্দ্র ও হাসপাতাল আমি ঘুরে দেখেছি। সে এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। বহু রোগী চিকিৎসা শেষে সমাজে ফিরে গিয়ে অবহেলায় সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, অনেকে ভিক্ষুকে পরিণত হয়। আরোগ্যের পর চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো থেকে চলে যাওয়ার সময় যদি দরিদ্র রোগীদের কিছু টাকা হাতে দেওয়া হয়, ছোটখাটো ব্যবসা করে স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের জন্য, তাহলে অনেকে উপকৃত হবে।’ প্রসঙ্গত বলে রাখি, সে সময় বাংলা একাডেমি পুরস্কারের অর্থমূল্য ছিল পঁচিশ হাজার টাকা।’

মা সুলতানা মকসুদ ও বাবা সৈয়দ আবুল মকসুদের সঙ্গে ছেলে সৈয়দ নাসিফ মকসুদ।
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

গুরুতর অসুস্থ হলে আমাদের লেখক-শিল্পীরা প্রায়ই রাষ্ট্রের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেন আর রাষ্ট্রীয় কৃপার আশায় নৈতিক ঋজুতা রক্ষা করতে পারেন না। আব্বা বিষয়টা পছন্দ করতেন না। তাই তিনি চেয়েছিলেন, দেশের লেখক-শিল্পীরাই একটা ফান্ড গঠন করবেন, যেখান থেকে প্রয়োজনের সময় তাঁরা সাহায্য পাবেন। সেই ফান্ড গঠনের প্রথম অনুদানটি আব্বা দেন। তাঁর প্রত্যাশা ছিল, সমাজের সামর্থ্যবান আরও অনেকে এগিয়ে আসবেন। বাংলাদেশে সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার জন্য লেখকেরা কী করেন, তা এ জগতের ঘনিষ্ঠজনেরা অবগত আছেন। এ বাস্তবতায় যখন চিন্তা করি যে আব্বা তাঁর পুরস্কারের অর্থের অর্ধেক টাকাই দান করেছিলেন, অবাক না হয়ে পারা যায় না। উল্লেখ্য যে ১৯৯৫ সালে আব্বা কোনো অবস্থাপন্ন ব্যক্তি ছিলেন না।

পাঁচ.

সমাজের গড়পড়তা মানুষের সন্তানেরাও তাঁদের মা–বাবার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর অসীম কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন। খ্যাতিমান ও সামাজিকভাবে সফল মানুষের সন্তানেরা কি বেশি কৃতজ্ঞতা আর অধিক ভালোবাসা অনুভব করেন? জানি না। আব্বা তাঁর চুয়াত্তর বছরের জীবনে কাজের জন্য মানুষের যে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা পেয়েছেন, তা বিবেচনা করলে এ কথা বলাই যায় যে তিনি অর্জন করেছিলেন ঈর্ষণীয় খ্যাতি ও সফলতা। কিন্তু আব্বার খ্যাতি ও সফলতা ছাপিয়ে সব সময় আমার মনে হয়েছে, তিনি ছিলেন মানবিক গুণসম্পন্ন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ, যাঁর মধ্যে সমাবেশ ঘটেছে সততা, দৃঢ় চরিত্র, প্রজ্ঞা, সৃষ্টিশীলতা আর অসম্ভব সংবেদনশীলতার। আমাদের সমাজে এমন মানুষ শুধু দুর্লভ নয়, বরং এক বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি। এমন মানুষের বিলুপ্তি কি আমাদের একটুও দুঃখিত করে না?


অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]