
বেগম সুফিয়া (১৯১১-১৯৯৯) কামাল জন্মেছিলেন এক বর্ষণমুখর দিনে, পুণ্যাহ নামে এক উৎসবের দিন ছিল সেটা। বরিশালের এক পর্দানশিন, খানদানি, মুসলিম পরিবারে জন্মানো এই জমিদার কন্যার শৈশব কেটেছিল বঙ্গীয় মুসলিম পিতৃতান্ত্রিক পরিবারপ্রথার অমোঘ ঘেরাটোপে। মাত্র সাত বছর বয়সেই তাঁর পিতা আব্দুল বারি নিরুদ্দেশ হন, পলাতক পিতার গৃহে মা সয়দা সাবেরা খাতুনের সাহসের ছায়ায় বড় হতে থাকেন বিদ্যাপ্রেমী কন্যা সুফিয়া। মেয়েসন্তান হওয়ার কারণে তিনি ছিলেন অবরুদ্ধ, মুক্তাঙ্গনের কোনো বিদ্যাপীঠ নয় গৃহেই আরবির পাশাপাশি শিখতে শুরু করেন বাংলা ভাষা, মায়ের কাছে। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল কবিতা লেখা ও পড়ার ঝোঁক। এ সম্পর্কে তিনি তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘এমনি কোন বর্ষণমুখর দিনে মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের লেখা “হেনা” পড়ছিলাম বানান করে। প্রেম, বিরহ, মিলন এসবের মানে কি তখন বুঝি? তবু যে কী ভালো, কী ব্যথা লেগেছিল তা প্রকাশের ভাষা কি আর আজ আছে? গদ্য লেখার সেই নেশা। এরপর “প্রবাসী” পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়তে পড়তে অদ্ভুত এক মোহগ্রস্ত ভাব এসে মনকে যে কোন অজানা রাজ্যে নিয়ে যেত। এরপর দেখতাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন লিখছেন, লিখছেন বেগম সারা তাইফুর। কবিতা লিখছেন বেগম মোতাহেরা বানু। মনে হলো, ওরা লিখছেন, আমিও কি লিখতে পারি না? শুরু হলো লেখা লেখা খেলা, কী গোপনে, কত কুণ্ঠায়, ভীষণ লজ্জার সেই হিজিবিজি লেখা ছড়া গল্প। কিন্তু কোনোটাই কি মনের মতো হয়? কেউ জানবে, কেউ দেখে ফেলবে বলে ভয়ে ভাবনায় সে লেখা কত লুকিয়ে রেখে আবার দেখে দেখে নিজেই শরমে সংকুচিত হয়ে উঠি।’
ভেবে আশ্চর্য হই, বিশ শতকেও নারী তাঁর লেখা নিয়ে লজ্জিত, কুণ্ঠিত, যেন তার লেখাও লজ্জাশীলা রমণী। পিতৃতন্ত্রের পর্দার আড়ালে বেড়ে ওঠা এই কন্যাশিশু ভিন্নরূপে দেখতে পেলেন ‘আজিকার শিশু’কে, তারা পুতুল খেলা নয়, করছে লেখাপড়া, চালাচ্ছে কলের জাহাজ।
‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা
তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা
আমরা যখন আকাশের তলে উড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি
তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগনজুড়ি।’
(‘আজিকার শিশু’—সুফিয়া কামাল)
বেগম রোকেয়ার (১৮৮০) জন্মের ৩১ বছর পর জন্মেও তিনি ছিলেন যেন অবরোধবাসিনীই, পেয়েছিলেন অবরুদ্ধ এক শৈশব, যা নির্ধারিত ছিল সেকালের সব কন্যাশিশুর জন্যই। অন্দরমহলে বন্দী হয়ে গৃহ পরিপাটি করে রাখাই ছিল মেয়েদের কাজ, অন্যদিকে ছেলেদের জন্য ছিল অবারিত শৈশব, মুক্ত প্রান্তর, বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ। ছোট্ট সুফিয়া ভাঙতে চাইলেন এ নিয়ম, পড়াশোনার প্রতি তার অদম্য উৎসাহের সঙ্গে পেরে উঠলেন না তার মা, অগত্যা আমাদের এই কবি ছেলের পোশাকে সজ্জিত হয়ে মাথায় টুপি পরে ভাই এর সঙ্গে যেতে থাকলেন স্কুলে। এ নিয়ম বেশি দিন চলল না। কারণ, ভাই পড়তে গেল অন্য শহরে আর তাঁরও বন্ধ হলো স্কুলে যাওয়া৷ তাতে কিছুতেই হার মানতে চাইলেন না সুফিয়া। অতঃপর বাড়িই হয়ে উঠল তাঁর স্কুল, টেবিল, ব্ল্যাকবোর্ড সজ্জিত ঘরের কোণই তাঁর বিদ্যাপীঠ, তাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকল লেখাপড়া, ভাই আর মামাতো ভাইরা ছুটিতে বাড়িতে এলে শুরু হতো স্কুল স্কুল খেলা।
পরিবার–কাঠামোয়, পিতৃতন্ত্রের পরাক্রমশালী নিয়মের সহস্র শিকলে বন্দী যে সমাজব্যবস্থা, তা চিরকালই নারীর জন্য, কন্যাশিশুর জন্য পীড়নমূলক, অবদমনমূলক, বালিকা সুফিয়া পেয়েছিলেন তাঁর ভাইয়ের আনুকূল্য আর সহযোগিতা। ফলে খেলাচ্ছলে বাড়িতে বসেই তিনি শিখলেন ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক। ভাইয়েরা তাঁর প্রতিভার স্ফুরণে বিস্মিত, আনন্দিত। পুরস্কারস্বরূপ নিজের বৃত্তির টাকায় তাঁকে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার গ্রাহক করে দিলেন তাঁর ভাই। ভাবলে অবাক লাগে সে এমন এক অন্ধকার যুগ যে কোনো মেয়ের নামে পত্রিকা এলে পাছে লোকে কিছু বলে সেই ভয়ে সরাসরি তাঁর নামে ডাক আসত না। পোস্ট অফিস থেকে কৌশলে এবং গোপনে তাঁর কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা হতো। ভাইয়ের পাঠানো বইগুলো আর মামার লাইব্রেরি ছিল তাঁর কাছে অমূল্য সম্পদ, এক অনন্য বিদ্যানন্দের খনি। নিজের মনোজগতের ডানার পালকগুলো তিনি সেখান থেকেই পেয়েছিলেন।
১৯১৮ সালে সাত বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে দেখা পেলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসাইনের। তাঁর প্রভাব পড়েছিল তাঁর পরবর্তী লেখকজীবনে। মায়ের ইচ্ছা ছিল সুফিয়া বেগম রোকেয়ার স্কুলে পড়ুক। কিন্তু কলকাতায় থাকতেন না বলে পড়া হয়নি সেই স্কুলে।
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সুযোগের অভাব তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, তাঁর ভেতরে যে সাহিত্যের বীজ ছিল, তা ধীরে ধীরে ডালপালা ছড়িয়ে মহিরুহ হয়ে ওঠে।
যে যুগে কন্যার পড়ালেখার বিষয়টি গৌণ ছিল, সে যুগে মাত্র ১৩ বছরেই তিনি বিয়ের পিঁড়িতে বসবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। তবে যা অস্বাভাবিক তা হলো, নারীশিক্ষার জন্য বৈরী সময়টাতে তাঁকে যিনি সমর্থন করেছেন বিদ্যার্জন ও সাহিত্যপাঠে তিনি স্বামী এবং মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেন; তিনি ছিলেন সাহিত্যমনস্ক এবং আধুনিক, তিনি তাঁকে সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত জুগিয়েছেন, যোগাযোগও ঘটিয়ে দেন সমসাময়িক লেখকদের সঙ্গে। সুফিয়ার প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ ছাপা হয় ১৯২৬ সালে সে সময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী ‘সওগাত’-এ।
>শৈশবে পাইলট হতে চেয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। তা তিনি হতে না পারলেও উড়তে পেরেছিলেন পুরুষতন্ত্রের ডালা ভেঙে, হাঁটতে পেরেছিলেন ছকের বাইরে।
ত্রিশের দশকে কলকাতায় অবস্থানকালে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র প্রমুখের দেখা পান সুফিয়া কামাল। দেশবিভাগের আগে কিছুকাল তিনি নারীদের জন্য প্রকাশিত সাময়িকী ‘বেগম’-এর সম্পাদক ছিলেন।
সুফিয়া কামালের কবিতায় রয়েছে অনিশ্চিত রোমান্টিক স্বর, যা মৌলিক, স্থায়ী ও অবিচ্ছেদ্য চিত্তবৃত্তির প্রকাশ। আছে প্রকৃতির আহ্বান আর গোপন, ঐশ্বরিক, অনির্বচনীয় দীর্ঘশ্বাস:
‘তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান
ডেকেছে কি সে আমারে? শুনি নাই রাখিনি সন্ধান
কুহেলী উত্তরি তলে মাঘের সন্ন্যাসী
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে তাহারেও পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোনোমতে।’
(‘তাহারেই পড়ে মনে’—সুফিয়া কামাল)
তাঁর কবিতায় রয়েছে প্রকৃতির স্বাদ, রূপ, রস; যা পরিবেশিত হয়েছে চমৎকার ছন্দে, অন্ত্যমিলে। বিশ শতকের বাঙালির প্রতিভার মহত্তম সৃষ্টি আধুনিক বাংলা কবিতা। আাধুনিক বাংলা কবিতা মহাকাব্যিক ও রোমান্টিক কবিতা থেকে উন্নত, সুফিয়া কামালের কবিতায় রয়েছে আধুনিকতার সঙ্গে রোমান্টিকতার মেলবন্ধন।
লেখকসত্তার পাশাপাশি সুফিয়া কামাল নিজের মধ্যে ধারণ করতেন এক প্রতিবাদী সত্তা। ছিল তাঁর রাজনীতিসচেতনতা, স্বদেশ চেতনা আর মাতৃভাষার প্রতি শর্তহীন প্রেম। ফলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে মেয়েদের সংগঠিত করেছিলেন তিনি। মিছিল করেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে জাতীয় সব সংকটে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক বিবেকের মতো দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সামরিক শাসনের গণবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে, রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে, রবীন্দ্রশতবর্ষ উদ্যাপনের দাবিতে ও দাঙ্গা প্রতিরোধে সুফিয়া কামাল সামাজিক গণমানুষের সর্বাধিনায়কের ভূমিকায় একাধারে ছায়ানট, কচিকাঁচার মেলা, পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংসদ প্রতিষ্ঠা ও নারী আন্দোলনের মহিলা সংগ্রাম পরিষদ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।
শৈশবে পাইলট হতে চেয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। তা তিনি হতে না পারলেও উড়তে পেরেছিলেন পুরুষতন্ত্রের ডালা ভেঙে, হাঁটতে পেরেছিলেন ছকের বাইরে। সাহিত্যে, নারী জাগরণে, আন্দোলনে নিজেকে বিকশিত করেছিলেন। তাঁর মেধা, প্রতিভা আর দ্রোহের পাপড়িগুলো ফুটেছিল নিজের রঙে। তিনি আমাদের জননীসাহসিকা। জন্মদিনে আজ তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com