জীবনানন্দের রবীন্দ্রনাথ…

সকল লোকের মাঝে বসে, নিজের 'মুদ্রাদোষে' একা হয়ে যাওয়া কিংবা আলাদা থাকতে গিয়ে বরিশাল শহরে যে মানুষটি সহকর্মী-শিক্ষার্থী ও প্রতিবেশীদের কাছে 'নিভৃতচারী' বা কখনো 'অসামাজিক' হিসেবে পরিচিত, সেই মানুষটিকেই এবার দেখা গেল রাজপথে, শোকমিছিলে।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে যে শোকমিছিলটি বের করেছিলেন বরিশাল বিএম কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, সেই মিছিলে শামিল ইংরেজির অধ্যাপক জীবনানন্দ দাশ—পারতপক্ষে যিনি সব ধরনের লোক-সমাগম, ভিড় এমনকি বরিশালের ব্রাহ্মসমাজের অনুষ্ঠানও এড়িয়ে চলতেন। প্রশ্ন হলো, হৃদয়ের কোন টান, কোন অনুভূতি এ রকম একজন নিভৃতচারী মানুষকে অনেক লোকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বরিশাল শহরের টাউন হল পর্যন্ত নিয়ে গেল এবং শুধু তা-ই নয়, পারতপক্ষে যিনি দু-চার লাইনের বেশি কথাও বলতেন না, সেই মানুষটির মুখ থেকে পরবর্তীকালে তাঁর শিক্ষার্থীরা এমন কিছু কথামালা বের করে আনলেন, যা প্রবন্ধ হিসেবে ছাপা হয় ওই কলেজেরই ম্যাগাজিনে!

রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা, সমীহ আর ভালোবাসার এমন আরও অনেক নজির জীবনানন্দ পরবর্তীকালে স্থাপন করেছেন, যা শুধু বিস্ময়করই নয়, বরং অগ্রজ বা একই সময়ে জীবিত কোনো কবির প্রতি আরেকজন কবির এ রকম নির্মোহ অভিব্যক্তি বিশ্বসাহিত্যেই বিরল। প্রসঙ্গত, বড় পরিসরে জীবনানন্দের কবিতার প্রথম স্বীকৃতি আসে মূলত রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই। তিনি জীবনানন্দের প্রথম ও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পড়ে সংক্ষেপে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন; যে চিঠিকে জীবনানন্দ জীবনের 'অমূল্য সম্পদ' বলে মনে করতেন। ১৯৩৮ সালে কবিগুরু বিশ্বভারতী থেকে'বাংলা কাব্য পরিচয়' নামে বাংলা কবিতার যে সংকলন প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে জীবনানন্দের 'মৃত্যুর আগে' কবিতাটি নিয়েছিলেন।
ছয়টি কবিতারই শিরোনাম 'রবীন্দ্রনাথ'
অগ্রজ কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামেই ছয়টি কবিতা লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং সত্যপ্রসন্ন দত্ত তাঁদের সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া 'পূর্বাশা' পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বের করেন, যেখানে দুটি কবিতার মধ্যে একটি ছিল জীবনানন্দ দাশের 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামে। ১৯৪১ সালের নভেম্বরে 'পরিচয়' পত্রিকা রবীন্দ্রনাথের স্মরণে বিশেষ সংখ্যা বের করে, যার জন্য জীবনানন্দ 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামে আরেকটি কবিতা লেখেন। পরের বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশের পাবনা শহর থেকে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সংকলিত একটি অনিয়মিত কবিতা সংকলন বের হয় 'পঁচিশে বৈশাখ' নামে; সেখানেও 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামে একটি কবিতা লেখেন জীবনানন্দ দাশ। এর আগে একই শিরোনামে আরেকটি কবিতা লেখেন, যেটি জীবদ্দশায় কোথাও ছাপা হয়েছিল কি না জানা যায় না। তবে জীবনানন্দের মৃত্যুর বহু বছর পরে 'প্রতিক্ষণ' পত্রিকার বৈশাখ ১৩৯১ সংখ্যায় ছাপা হয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি জীবনের শেষ বছরে ১৯৫৪ সালে পঞ্চম কবিতাটি লেখেন। এই কবিতাটি ছাপা হয়েছিল 'ঊষা' পত্রিকায় জ্যৈষ্ঠ ১৩৬১ সংখ্যায়। এই পাঁচটি কবিতার হদিস পাওয়া যায়। তবে ফয়জুল লতিফ চৌধুরী (জীবনানন্দের চোখে রবীন্দ্রনাথ, ভোরের কাগজ, ১৪ জুন ২০১৮) এই শিরোনামে আরও একটি কবিতার সন্ধান দিচ্ছেন, যেটিও জীবনানন্দ লিখেছিলেন তাঁর মৃত্যুর বছর, ১৯৫৪ সালে। মি. চৌধুরী বলছেন, এই কবিতাটি খসড়া পর্যায়ে ছিল এবং কোথাও ছাপা হয়নি। কবিতার শুরুটা ছিল এ রকম: 'পৃথিবীর কোলাহল সব ফুরিয়ে গেছে।'
প্রসঙ্গত, 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামের পাঁচটি কবিতা জীবনানন্দের জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরে প্রকাশিত কোনো কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়নি। এগুলো পরবর্তীকালে তাঁর রচনাবলি ও রচনাসমগ্রতে 'অন্যান্য কবিতা' হিসেবে গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। ২০০৬ সালে ঐতিহ্য প্রকাশিত ৬ খণ্ডের রচনাবলির দ্বিতীয় খণ্ডে তিনটি, তৃতীয় খণ্ডে একটি এবং পঞ্চম খণ্ডে একটি কবিতা গ্রন্থভুক্ত হয়েছে।
'ঊষা' পত্রিকায় প্রকাশিত 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামে কবিতাটি এ রকম:
'মানুষের মনে দীপ্তি আছে
তাই রোজ নক্ষত্র ও সূর্য মধুর—
এ রকম কথা যেন শোনা যেতো কোনো একদিন,
আজ সেই বক্তা ঢের দূর
চলে গেছে মনে হয় তবু;
আমাদের আজকের ইতিহাস হিমে
নিমজ্জিত হয়ে আছে বলে
ওরা ভাবে নীল হয়ে গিয়েছে অন্তিমে
সৃষ্টির প্রথম নাদ—শিব ও সৌন্দর্য;
তবুও মূল্য ফিরে আসে
নতুন সময়তীরে সার্বভৌম সত্যের মতন
মানুষের চেতনায় আশায় প্রয়াসে।'
'পূর্বাশা'র রবীন্দ্রসংখ্যায় (১৯৪১) 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামে একটি বড় কবিতা লেখেন জীবনানন্দ দাশ, যেখানে রবীন্দ্রনাথকে 'মানুষের হৃদয়ের প্রীতির মতন বিভা' বলে উল্লেখ করেন:
'অনেক সময় পাড়ি দিয়ে আমি অবশেষে
কোনো এক বলয়িত পথে
মানুষের হৃদয়ের প্রীতির মতন এক বিভা
দেখেছি রাত্রির রঙে বিভাসিত হয়ে আপনার প্রতিভা
বিচ্ছুরিত করে দেয় সংগীতের মতো কণ্ঠস্বরে।'
ওই বছরই 'পরিচয়' পত্রিকায় 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামে কবিতায় তিনি কবিগুরুকে তুমি বলে সম্বোধন করে লেখেন:
'তোমার বিভূতি, বাক-বেদনার থেকে উঠে নীলিমাসংগীতি
আমাদের গরিমার বিকীরণে ডুবে, গড়ে গেছে সব মানুষের প্রাণ।'
এর পরের বছর ১৯৪২ সালে পাবনা থেকে প্রকাশিত 'পঁচিশে বৈশাখ' (শ্রাবণ ১৩৪৯ সংখ্যা) নামে সংকলনে 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামের কবিতাটি তিন স্তবকের। শুরুটা এ রকম:
'আজ এই পৃথিবীতে অনেকেই কথা ভাবে।
তবুও অনেক বেশি লোক আজ শতাব্দী-সন্ধির অসময়ে
পাপী ও তাপীর শববহনের কাজে উচাটন
হয়ে অমৃত হবে সাগরের বালি, পাতালের কালি ক্ষয়ে?'
১৩৯১ সালে 'প্রতিক্ষণ' পত্রিকায় প্রকাশিত 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামে কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছেন, তার (রবীন্দ্রনাথ) জন্য পৃথিবী অপেক্ষা করছিল:
'তারপর তুমি এলে
এ পৃথিবী সলের মতন
তোমার প্রতীক্ষা করে বসেছিল।'

রবীন্দ্রনাথকে কেন গুরুত্বপূর্ণ ভাবতেন?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বছর (১৯৪১) মৃত্যুবরণ করেন, জীবনানন্দ দাশ তখন তাঁর জন্মশহর বরিশালে ব্রজমোহন কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। বিশ্বকবির মৃত্যুতে কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের শোকমিছিলে অংশ নেন জীবনানন্দ দাশ। মিছিলটি কলেজ থেকে টাউন হলে গিয়ে শেষ হয়। এর কিছুদিন পর ছাত্রাবাসের উঁচু ক্লাসের কয়েকজন ছাত্রের উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের স্মরণসভার আয়োজন করা হয়, যেখানে ছাত্রদের অনুরোধে জীবনানন্দ একটি বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতাটিই পরবর্তীকালে ব্রজমোহন কলেজ পত্রিকায় 'রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা' শিরোনামে ছাপা হয়। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সমসাময়িক ও অনুজ কবিদের সম্বন্ধের আলো-ছায়া নির্ণীত হয়েছে। এই প্রবন্ধে জীবনানন্দ অকপটে স্বীকার করেন, 'আজ যে আধুনিক কাব্যের ঈষৎ সূত্রপাত হয়েছে তার পরিণাম—বাংলা সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথের ভিত্তি ভেঙে ফেলে কোনো সম্পূর্ণ অভিনব জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে, সাহিত্যের ইতিহাস এ রকম অজ্ঞাতকুলশীল জিনিস নয়।'
রবীন্দ্রসত্তার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও বাঙালি জাতি, কোনো চিরায়ুষ্মান শরীরে তাঁর মন আত্মার মতো যে রকমভাবে মিশে রয়েছে, অন্য কোনো একজন ব্যক্তি বিশেষের সঙ্গে তাদের সে রকম মিলন কোনোদিনও হয়নি বলেও মন্তব্য করেন জীবনানন্দ। আধুনিকতার নামে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকারের সমালোচনা করে তিনি লিখছেন, 'অর্থহীন অসন্তোষে বা দুর্বল বিদ্রোহের অভিমানে আমি আমার পূর্ববর্তী বড় কবিকে ডিঙিয়ে গেলাম অকাব্যের জঞ্জালের ভিতর—সাহিত্যের ইতিহাসে এ রকম আন্দোলনের কোনো স্থান নেই।'
রবীন্দ্রসাহিত্য ও কবিজীবন দেশ ও জাতির মেরুদণ্ড গঠনে পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে যেভাবে নিজেকে ক্ষয়িত করেছে, বাংলা ছাড়া অন্য কোনো দেশে হলে তার অপেক্ষাকৃত সুব্যবহার হতো বলেও উল্লেখ করেন জীবনানন্দ দাশ। তবে এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের সর্বব্যাপী মহত্ত্ব স্বীকার করলেও জীবনানন্দ এ-ও লিখেছেন যে, 'তার প্রকৃত কাব্যলোকে সমাজ ও ইতিহাসচেতনা একটা নির্ধারিত সীমায় এসে তারপর মন্থর হয়ে গেছে।'
এখানেই জীবনানন্দের সাহস অথবা দুঃসাহস। নিজের যোগ্যতায় কতটা আস্থা এবং মেরুদণ্ড কতটা শক্ত হলে রবীন্দ্রনাথের মতো একজন বিশ্বমানবেরও সমালোচনা করা যায়, সেটি জীবনানন্দ দেখিয়েছেন। যে রবীন্দ্রনাথকে তিনি মাথার তাজ মনে করতেন, তাঁর কাব্যলোকে সমাজ ও ইতিহাসচেতনা একটা নির্ধারিত সীমায় এসে মন্থর হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করতেও দ্বিধা করছেন না। স্মরণ করা যেতে পারে, জীবনানন্দের সমসাময়িক (একই বছরে জন্ম) কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতারও তিনি এমন সময়ে সমালোচনা করেছিলেন, যখন নজরুলের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। নজরুলের কবিতা সম্পর্কে জীবনানন্দ একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন এবং সেখানে যে কথাগুলো তিনি বলতে চেয়েছেন তা হলো, 'নজরুল ইসলামের কবিতায় মহাকাব্যিক গভীর প্রসাদ নেই, তার প্রতিশ্রুতিও কম। কিন্তু কোনো এক যুগে কজনের কবিতায়ই বা তা থাকে?' জীবনানন্দ মনে করেন, কাব্যের সুর কী এক আশ্চর্য বৈদেহী পবিত্রতায় নিজের ধ্রুবলোকে পৌঁছেছে; এ রকম দাবি নজরুল ইসলামের কবিতা সম্পর্কে করা যায় না। জীবনানন্দ উল্লেখ করেন, 'কাজীর কবিতা বিশেষ একটা মাত্রার দেশে তার অতীতের ভিতরে পরিসমাপ্ত। আজও তা পড়বার জিনিস হয়তো—আবৃত্তির জিনিস; পড়া শেষ করে সময় কেটে গেলে মানস কর্ণ তৃপ্ত হতে চায় না—মন বিষয়ান্তর খোঁজে দিকনির্ণনীয় মহৎ কবিদের।' নজরুলের কবিতা সম্পর্কে এ রকম 'উদ্ধত' মন্তব্যের কারণে 'স্বরাজ' পত্রিকার (তখন জীবনানন্দ 'স্বরাজ' পত্রিকার রবিবাসরীয় সম্পাদক) কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয় এবং একপর্যায়ে তাঁর চাকরিটাই চলেই যায়।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নিয়ে ১৯৪১ সালের ওই প্রবন্ধের পাঁচ বছর পর ১৯৪৬ সালে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে জীবনানন্দ আরেকটি প্রবন্ধ লেখেন 'উত্তররৈবিক বাংলা কাব্য' শিরোনামে, যেটিও ছাপা হয় ব্রজমোহন কলেজ পত্রিকায়। এই প্রবন্ধে জীবনানন্দ সরাসরি মন্তব্য করেন, 'কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার। আর কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।'
যে বছর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি এই প্রবন্ধটি লেখেন, সে বছরই পাকাপাকিভাবে জন্মস্থান বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় চলে যান এবং মাস কয়েক পরে (জানুয়ারি ১৯৪৭) 'স্বরাজ' পত্রিকায় যোগ দেন। এই পত্রিকাতেই ১৯৪৭ সালের ১০ আগস্ট 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতির তীব্রতা অনুভব করে লেখেন, 'গত অর্ধশতাব্দীর কিছু বেশি সময় ধরে আমাদের দেশ ও জাতির ও পৃথিবীর যেকোনো ঘনঘটাঘোর কঠিন সংকটের মুহূর্তে তাকে (রবীন্দ্রনাথ) অন্যায়ের—অন্ধকারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘোষণা নিয়ে দাঁড়াতে দেখেছি; মানবজীবনে মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে মনুষ্যজীবের সদর্থের প্রতি একজন মহাব্যক্তির মৃতসঞ্জীবনী বিশ্বাসের জোরে। রবীন্দ্রনাথ যতদিন বর্তমান ছিলেন মানুষের প্রতি মানুষের অবিশ্বাসের নরককুণ্ড ক্লেদে দেশকাল এমন দুস্তর নৈরাজ্যে তলিয়ে যায়নি।'
জীবনানন্দ বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, 'আগস্ট আন্দোলনের অবদমন, মন্বন্তর, কালোবাজার, দাঙ্গা, ভারত ও প্রদেশগুলোর বিচ্ছেদ রবীন্দ্রনাথের চলে যাওয়ার পরেই কি এই শতাব্দীর সবচেয়ে দুর্মর বারবেলা আমাদের আক্রান্ত করেছে!'
এই বছরই 'স্বরাজ' পত্রিকায় 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামে দ্বিতীয় প্রবন্ধে জীবনানন্দ তাঁকে 'লোকোত্তর পুরুষ' বলে অভিহিত করেন। রবীন্দ্রপ্রতিভার ভেতরে তিনি দুটি বিশিষ্ট দিকের কথা উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন, এই দুটি ধারার অপূর্ব সমন্বয়ই রবীন্দ্রনাথকে মানবসহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কবিদের সঙ্গে পঙ্ক্তিতে আসন দিয়েছে। কী সেই দুটি বিশিষ্ট দিক? জীবনানন্দ লিখছেন, 'যদি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে লিরিক-প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ দেখা যেত তাহলে চণ্ডীদাস বা বিদ্যাপতির চেয়ে তাকে কোনো শ্রেষ্ঠতর অভিধা দিতে শেষ পর্যন্ত গীতিকবিতার রাজ্যে তার অশেষ বৈচিত্র্য সত্ত্বেও আমরা দ্বিধা বোধ করতাম। কিন্তু রবীন্দ্রপ্রতিভা শুধু স্বভাবজাত কল্পনামনীষায়ই গরিমাময় নয়। তার প্রতিভার ভিতর এমন অলৌকিক ধীশক্তি ও তার নিপুণ প্রয়োগবৈচিত্র্যের বিশিষ্টতা রয়েছে যে, এ দুটি ধারার নিবিড় সামঞ্জস্য তাকে একজন অসাধারণ গীতিকবির শ্রেণি থেকে অলোকসামান্য বিশ্বকবির পর্যায়ে উন্নীত করেছে।'
রামমোহনের পর রবীন্দ্রনাথের মতো দেশ ও সমাজ ও বিশ্বচেতনার এমন জাগ্রত পুরোহিত বাঙালি পায়নি উল্লেখ করে জীবনানন্দ সংশয় প্রকাশ করছেন, 'ভবিষ্যতে অনেক দিন পর্যন্ত আর পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।' বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রবীন্দ্রনাথের সামাজিক ও জাতীয় চৈতন্যের বিশিষ্ট নির্দেশগুলো কায়মনোবাক্যে গ্রহণ করলে রাষ্ট্র সেই সমস্ত পরিকল্পনা ও বিধান সম্পর্কে সজাগ অনুভূতি ও কর্মপ্রবর্তনার পরিচয় দিলে দেশে অনেক কিছুই হতে পারত বলেও বিশ্বাস করেন জীবনানন্দ। বলেন, 'রবীন্দ্রপ্রতিভা বহু বর্ণে রঞ্জিত হলেও আমার মনে হয় কবিতায়ই তিনি নিজেকে বিশিষ্টভাবে অর্পণ করবার সুযোগ পেয়েছেন বলে সেই প্রেরণার সমগ্রতার ভিতরেই তার শ্রেষ্ঠ উৎকর্ষ সম্ভব হয়েছে। বস্তুত চিত্রাঙ্কনে নিজেকে ঢেলে দিলে—কিংবা সমাজতত্ত্বের চর্চার জীবন দান করলে তিনি আধুনিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রী বা সমাজতাত্ত্বিক হতেন কি না এ নিয়ে অ্যাকাডেমিক তর্ক সম্ভব হলেও আমার মনে হয় কবিতাতেই তার শ্রেষ্ঠ বিকাশের পিছনে একটি সত্য নিহিত রয়েছে এই যে কবিতাই সমস্ত শিল্প ও জীবনদর্শনের জননী এবং রবীন্দ্র-প্রতিভা স্বভাবতই গিয়েছে সেই মূল উৎসের দিকে।'
এর দুই বছর পর ১৯৪৯ সালের ৬ নভেম্বর কলকাতার ইংরেজি পত্রিকা 'স্টেটসম্যান'-এ 'বেঙ্গলি পোয়েট্রি টুডে' নামে আরেকটি প্রবন্ধে তিনি লেখেন, 'আমাদের সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের মতো বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কেউ নেই এবং অদূর ভবিষ্যতেও কেউ থাকবেন কি না, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।' বাংলা ১৩৫৫ সালে লিখিত 'কী হিসেবে শাশ্বত' শিরোনামের একটি প্রবন্ধের শুরুতেও রবীন্দ্রস্তুতি: 'আমাদের ধারণা যে সাহিত্যে কোনো কোনো লেখা অমর ও অবিস্মরণীয়। যেমন মহাভারত হোমর শেকসপিয়র রবীন্দ্রনাথ।'

রবীন্দ্রনাথের চিঠি: 'মূল্যবান সম্পদ'
এ যাবৎ আবিষ্কৃত জীবনানন্দের লেখা এবং তাঁকে লেখা যে ১৩১টি চিঠির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেখানে রবীন্দ্রনাথকে জীবনানন্দের লেখা দুটি এবং জীবনানন্দকে লেখা রবীন্দ্রনাথের দুটি চিঠি রয়েছে।
জীবনানন্দ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরাপালক'-এর একটি কপি পাঠিয়েছিলেন কবিগুরুকে। তিনি সেটি পড়ে একটি ছোট্ট প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন। ১৩৩৫ সালের ২২ অগ্রহায়ণ শান্তিনিকেতনে বসে লেখা ওই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: 'কল্যাণীয়েষু, তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদিকে পরিহাসিত করে। বড়ো জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উলটো। ইতি।'
বাংলা ১৩৩৫ সালের ৩ পৌষ কলকাতার ৬৬ হ্যারিসন রোডে বসে রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠি জীবনানন্দের মৃত্যুর পর বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। কেননা, চিঠিটি আবিষ্কৃত হলেও এটি রবীন্দ্রভবন সংগ্রহশালায় নেই। ফলে প্রভাতকুমার দাস (পত্রালাপ জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ১০০) ধারণা করছেন, ভুলে হয়তো চিঠিটি তিনি (জীবনানন্দ) ডাকে দেননি। তা ছাড়া চিঠির পরিপাটি চেহারা দেখলে এই মন্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। চিঠির ভাষা বলছে, এটি রবীন্দ্রনাথের চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার হিসেবে তিনি লিখেছিলেন। শুরুটা এ রকম: 'আপনার স্নেহাশীষ লাভ করে অন্তর আমার পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।' এই চিঠিতে জীবনানন্দ লেখেন, 'আজকালকার বাংলাদেশের নবীন লেখকদের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য এই যে, তাদের মাথার ওপরে স্পষ্ট সূর্যালোকের মতো আধুনিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীকে তারা পেয়েছে।' অর্থাৎ পরবর্তীকালে জীবনানন্দ তাঁর প্রবন্ধ ও কবিতায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যে শ্রদ্ধা ও সমীহ প্রকাশ করেছেন, তারুণ্যেই সে ভক্তির ভিত রচিত হয়। তিনি ২৯ বছর বয়সেই রবীন্দ্রনাথকে 'আধুনিক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষী' বলে উল্লেখ করেন।
প্রথম চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ভাষা নিয়ে জবরদস্তির যে অভিযোগ করেন, সে বিষয়ে জীবনানন্দ নিজের একটি ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেন। তিনি লেখেন, 'কবি কখনো আকাশের সপ্তর্ষিকে আলিঙ্গন করবার জন্য উৎসাহে উন্মুখ হয়ে ওঠেন, পাতালের অন্ধকারে বিষজর্জর হয়ে কখনো তিনি ঘুরতে থাকেন। বীঠোফেনের কোনো কোনো সিম্ফনি বা সোনাটার ভেতর অশান্তি রয়েছে, আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু আজও তা টিকে আছে। চিরকালই থাকবে তাতে সত্যিকার সৃষ্টির প্রেরণা ও মর্যাদা ছিল বলে।'
১৯৩৭ সালে জীবনানন্দের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' প্রকাশিত হলে জীবনানন্দ এবারও এর একটি কপি রবীন্দ্রনাথকে পাঠান। সঙ্গে একটি চিঠি। বরিশালের সর্বানন্দ ভবন থেকে ১৯৩৭ সালের ৫ মার্চ লেখা ওই চিঠিতে জীবনানন্দ ৯ বছর আগে তাঁকে লেখা একটি চিঠির জন্য রবীন্দ্রনাথকে ধন্যবাদ জানান এবং স্বীকার করেন যে চিঠিটি তাঁর কাছে একটি মূল্যবান সম্পদ।
'ধূসর পাণ্ডুলিপি' পড়ে রবীন্দ্রনাথ আরেকটি চিঠি দেন মাত্র দুই লাইনে। ১৯৩৭ সালের ১২ মার্চ শান্তিনিকেতন থেকে লেখা ওই চিঠিতে কবিগুরু লেখেন—'তোমার কবিতা পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।' দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের এই চিঠির সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জীবনানন্দের কবিতার বাঁক বদলের ইঙ্গিত বেশ স্পষ্ট। কেননা, প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরাপালক'-এ তাঁর যে ভাষা ও ঢং, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ধূসর পাণ্ডুলিপি'তে তা থেকে বেরিয়ে একেবারে নিজস্ব ভাষা ও ঢংয়ে আবির্ভূত হন তিনি। রবীন্দ্রনাথ মাত্র তিনটি শব্দে বলছেন, 'তাকিয়ে দেখার আনন্দ'; অর্থাৎ জীবনানন্দের কবিতার যে চিত্ররূপময়তা, রবীন্দ্রনাথ সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
জীবনের তুচ্ছতা ও প্রদীপ্তি
যে শহরে রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও বেড়ে ওঠা—সেই কলকাতা শহরের প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের পর এই শহরেরই সিটি কলেজে কর্মজীবন শুরু করেন জীবনানন্দ দাশ। প্রথম চাকরির মেয়াদে ছয় বছর (১৯২২-২৮) এবং এরপর বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে তো বটেই, জীবনের শেষ আট বছরও (১৯৪৬-৫৪) কাটিয়েছেন এই কলকাতায়। অথচ একই শহরে বসবাসের পরও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জীবনানন্দের দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। তবে তাঁর সমসাময়িক কবি এবং তখন তুমুল জনপ্রিয় কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে জীবনানন্দের সাক্ষাৎ হয়েছিল। 'আমার কথা' শিরোনামে একটি প্রবন্ধে (জীবনানন্দ রচনাবলি, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৩০) তিনি নিজেই লিখেছেন, 'কল্লোলের যুগে আমি কলকাতায় থাকতাম। কল্লোলের শ্রেষ্ঠ লেখকদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা কথাবার্তা হতো। কালি-কলম অফিসেই নজরুল ইসলামকে প্রথম দেখেছি।'
তবে একই শহরে থাকলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেননি জীবনানন্দ। বরিশালের সর্বানন্দ ভবন থেকে ১৯৩৭ সালের ৫ মার্চ রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠিতে জীবনানন্দ উল্লেখ করেন: 'অনেকবার দেখেছি আপনাকে। তারপর ভিড়ের ভিতরে হারিয়ে গেছি। আমার নিজের জীবনের তুচ্ছতা ও আপনার বিরাট প্রদীপ্তি সব সময়ই মাঝখানে কেমন একটা ব্যবধান রেখে গেছে—আমি তা লঙ্ঘন করতে পারিনি।'
এখানে এটি স্পষ্ট যে মূলত সমীহ ও শ্রদ্ধার কারণেই রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি হননি তিনি। এর একটি বড় কারণ, জীবনানন্দের লাজুক ও আত্মমুখীন স্বভাব। তিনি যেমন ভিড় এড়িয়ে চলতেন, তেমনি যেচে কারও সঙ্গে আলাপেও যেতেন না। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর যে সমীহসূচক শ্রদ্ধা ভালোবাসা ছিল, তাতে তিনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তও ছিলেন। কিংবা মনে মনে হয়তো চেয়েছিলেন দেখা করবেন, কিন্তু নানা কারণেই হয়তো সেটি আর হয়ে ওঠেনি। তিনি নিজেই ভিড়ের ভেতরে হারিয়ে গেছেন। যদি এই দুই কিংবদন্তির সাক্ষাৎ হতো, তাহলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সেটি নিশ্চয়ই একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকত এবং তাঁদের মধ্যে কী ধরনের কথাবার্তা হতো, তা আন্দাজ করা কঠিন।
জীবনবোধ
জীবনানন্দের সুহৃদ এবং 'ময়ূখ' পত্রিকার সম্পাদক জগদিন্দ্র মণ্ডল (কবিতা নিয়ে ভাবনা ও কয়েজকজন কবি, পৃষ্ঠা ৯৭) মনে করেন, 'রবীন্দ্রপরবর্তী কোনো কবিকে যথার্থ বুঝতে হলে রবীন্দ্রনাথকে সামনে রাখলে বুঝতে সুবিধা হয়; রবীন্দ্রানুগ না হয়ে অন্য কালধর্মী ও অনন্যতায় ভাস্বর হলেও।' সম্ভবত এ কারণে অনেক সময় অ্যাকাডেমিশিয়ানরা জীবনানন্দকে 'রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত প্রথম সফল কবি' বলে চিহ্নিত করেন। কিন্তু কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব নিয়ে জীবনানন্দ নিজে খুব একটা বিচলিত ছিলেন না। এ বিষয়ে তাঁর ভাবনা ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার। 'কবিতা ও কঙ্কাবতি' প্রবন্ধে লিখছেন: 'রবীন্দ্রকাব্য দুস্তর এবং কার্তিক আকাশের চাঁদ যেমন মেঘ খেয়ে ফেলে, অনেকদিন ধরে বাংলা কবিতাকে গ্রাস করে আসছে তেমনি। কিন্তু আমাদের মনে হয় না রবীন্দ্রনাথ বা আমাদের দেশজ কোনো কবির কাব্যের ছিঁটেফোটা প্রভাব যদি আমাদের কাব্যের ভিতর এসে পড়ে তাহলে আমাদের এত ব্যস্ত হয়ে পড়বার প্রয়োজন আছে।'
আবদুল মান্নান সৈয়দের (রচনাবলি, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৩৯) মতে, তিনি (জীবনানন্দ) রবীন্দ্রনাথের মহিমা যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন, কিন্তু নিজের স্বতন্ত্র পথ সম্পর্কেও সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে তিনি পাঠ গ্রহণ করেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হননি। হয়তো সে জন্যই রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিপুল শ্রদ্ধা সত্ত্বেও জীবনানন্দ বাঙালি জাতিকে এক আশ্চর্য নতুন কবিতা উপঢৌকন দিতে পেরেছেন।'
রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা ও সমীহ করলেও তাঁর চিন্তার দ্বারা জীবনানন্দ যে খুব একটা প্রভাবিত ছিলেন না, তা তাঁর সৃষ্টিতে স্পষ্ট। বিশেষ করে আস্তিক রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে জীবনানন্দের চিন্তার তফাৎ ছিল অনেকটা বিপরীতমুখী। রবীন্দ্রনাথ যখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে অকপটে বলেন, 'আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে'…তখন 'ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কি না', এমন প্রশ্নের জবাবে জীবনানন্দ বলেন, 'মানুষের নীতিবোধ মানি।' অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে (অন্তরঙ্গ জীবনানন্দ, ময়ূখ, ১৩৬১-৬২) বলেছিলেন, 'মানুষের নীতিবোধ যা ঈশ্বরও তা-ই।' যদিও জীবনানন্দ নাস্তিক ছিলেন বা তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, এ কথা সরাসরি কখনো বলেননি। বস্তুত জীবনানন্দ মানুষের মানবিক হয়ে ওঠার জন্য ইতিহাস ও বিবর্তনধারায় বিশ্বাসী। অনন্ত বিশ্বেশ্বরের নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসী নন। এই মূল দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই জীবনানন্দ জীবনানন্দ আর রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ।
জগদিন্দ্র মণ্ডলের ভাষায়, মানবসত্যে বিশ্বাসী হয়েও চিরন্তন কোনো নিয়ন্ত্রক শক্তিতে জীবনানন্দের বিশ্বাস ছিল না। ভয় হতে তব অভয় মাঝে নতুন জনম দাও হে, রবীন্দ্রনাথের নিগূঢ় আস্তিক্য যা অঙ্কুরিত হয়েছে, লালিত হয়েছে আজন্ম গৃহকোণে, গৃহদেবতায়, পিতার আস্তিক্যবোধের প্রবহমানতায়। সে তো জীবনানন্দের গৃহপরিবেশেও ছিল, তবু ব্যক্তিত্বের গড়ন ও কাঠামোতে জীবনানন্দের অস্তিবোধে যে সংশয়, যে প্রশ্ন, যা কেবলমাত্র মানবধর্মাশ্রিত প্রত্যাশার উচ্চারণ ছিল, তা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল না।
রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের মিল-অমিলের প্রসঙ্গে আবদুল মান্নান সৈয়দ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬৫৮) লিখেছেন, 'পরিণত বয়সে মৃত রবীন্দ্রনাথ আর অকালমৃত জীবনানন্দ—দুজনই তাঁদের চৈতন্যজাগৃতির শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লিপ্ত ছিলেন কবিতায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ কবিতাটি মুখে মুখে বলে গিয়েছিলেন, অন্য একজন টুকে নিয়েছিলেন। তিনি আর শোধন করবার সময় পাননি। 'তোমার সৃষ্টির পথ' নামে এই কবিতাটি ১৯৪১ সালের ৩০ জুলাই সকাল সাড়ে নয়টায় রচিত। তারপর যে সপ্তাহখানেক তিনি বেঁচে ছিলেন, তা অস্ত্রোপচারজনিত অচেতনতায় কেটেছিল, জ্ঞান ফিরে পাননি আর। জীবনানন্দ ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার আগের দিন রেডিওতে পড়েছিলেন 'মহাজিজ্ঞাসা' কবিতাটি। এরপর যে সপ্তাহখানেক বেঁচে ছিলেন, সেই চেতন-অচেতনে জড়ানোর মুহূর্তগুলোয় যখনই তিনি চৈতন্যে ফিরে এসেছেন, বলেছেন কবিতার কথা। মৃত্যুর আগে বিজড়িত স্বরে বলেছেন 'ধূসর পাণ্ডুলিপি'র কথা।
জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে
রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য শিল্পকর্মের চেয়ে তাঁর কবিতাকেই এগিয়ে রেখেছেন জীবনানন্দ। তবে রবীন্দ্রনাথের গানও জীবনানন্দ পছন্দ করতেন। বিয়ের প্রথম রাতে নবপরিণীতা লাবণ্যকে রবীন্দ্রনাথের 'জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে' গানটি গাইতে অনুরোধ করেছিলেন। লাবণ্য দাশের জবানিতে (মানুষ জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ২৭) গল্পটা এ রকম: 'ফুলশয্যার রাতে তাঁর সর্বপ্রথম কথা হলো—আমি শুনেছি তুমি গাইতে পারো। একটা গান শোনাবে? আমি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, কোনটা? “জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে” গানটা যদি জান, তবে সেটাই শোনাও। আমার এখনও মনে পড়ে, প্রথমবার গাইবার পর তিনি আরও একবার গাইতে বললেন।' লাবণ্য জানাচ্ছেন, অনেক দিন পরে তিনি হাসতে হাসতে জীবনানন্দকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ফুলশয্যার রাতেই তিনি এই গানটি কেন শুনতে চেয়েছিলেন? তখন জীবনানন্দ হেসে উত্তর দিলেন, এই লাইন দুটির অর্থ বলো তো—'আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া,/ তোমার বীণা হতে আসিল নামিয়া'। লাবণ্য চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। জীবনানন্দ বললেন, জীবনের শুভ আরম্ভেই তো এ গান গাওয়া উচিত এবং শোনাও উচিত।
মেয়ে মঞ্জুশ্রী দাশ এক স্মৃতিচারণে (আমার বাবা, জীবনানন্দ আকাদেমি পত্রিকা, ৩ আগস্ট ১৯৯৫) লিখেছেন, হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় জীবনানন্দ একবার রবীন্দ্রসংগীত শুনতে চেয়েছিলেন। আনিসুল হক ও জাফর আহমদ রাশেদকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে (জীবনানন্দ, অক্টোবর ২০১৮, পৃষ্ঠা ১৭ ) ভূমেন্দ্র গুহ জানান, মৃত্যুর পর ছোটভাই অশোকানন্দের বাসায় জীবনানন্দের মরদেহ ঘিরে নারীরা ব্রাহ্মমতে রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিলেন।