পাগলি মেয়েটা তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসে
আচ্ছা বাবা, তুমি এত অদ্ভুত কেন, বলো তো, এই যে এত কিছু করো, একটুও কি নিজের কথা ভাবো?
বাবা, তোমার মনে আছে ওই বৃষ্টিভেজা দিনের কথা? তোমার পাঁচ বছরের মেয়েটি ছোট্ট ছোট্ট পা দুটি দিয়ে রাস্তায় বৃষ্টির জমে থাকা পানির মধ্যে হাঁটতে পারবে না বলে তুমি সকালবেলা কাঁধের ওপর বসিয়ে নিজে হেঁটে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলে। তুমি তোমার নিজের চিন্তা না করে বলেছিলে আমি যেন ছাতাটা আমার মাথার ওপরই রাখি, যেন আমি না ভিজি। একটু বৃষ্টিতে ভিজলে তুমি কত কথা বলতে, মাথায় পানিটুকু জমতে দিতে চাইতে না। এতটা আগলে রেখেছ আমাকে। সেদিন তোমার কাঁধে চড়ে স্কুলে গিয়েছিলাম, তাও ঝড়বৃষ্টির মধ্যে, তা দেখে স্কুলের টিচাররা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। তোমার কত স্বপ্ন ছিল আমাকে নিয়ে। আমাকে ভালো স্কুলে পড়াবে, অনেক বড় করবে।
অনেক আশা নিয়ে তোমার স্বপ্নের স্কুলটিতে আমাকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে গিয়েছিলে। যেদিন আমি চান্স পেলাম, মেধাতালিকায় আমার নাম এল, বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিয়েছিলে। আমি সেদিনের তোমার ওই কান্নার কারণটি বুঝতে পারিনি। তুমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে নোটিশ বোর্ডে আমার নামটা দেখাতে চাইলে। আমি এতটাই পিচ্চি ছিলাম যে এতগুলা মানুষের ভিড়ে নোটিশ বোর্ড পর্যন্ত আমার মাথা যাচ্ছিল না। তোমার আনন্দ দেখে ওসব নাম-দেখাদেখিকে আমি আর পাত্তা দিলাম না।
জানো বাবা, সেদিন তোমার আনন্দটা আমার কাছে অনেক বড় কিছু ছিল। জেএসসির রেজাল্টের দিন হঠাৎ করে তুমি এসে জড়িয়ে ধরে বলেছিলে, আমি গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি। আমি প্রথম তোমার হাসিমাখা মুখে রেজাল্টের কথা জানতে পারি। আমার সফলতাগুলো কেন তোমাকে এতটা আনন্দ দিত, বুঝতাম না তখন। অনেক মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা। তোমার মোটরবাইকে চড়ে স্কুলে যাওয়া, পার্কে ঘোরা। একসময় তো রাস্তায় যেতে যেতে চলন্ত মোটরবাইকে তোমার পিঠে মাথা রেখে ঘুমিয়েই পড়তাম। তুমি কী ভয়টাই না পেতে! ছোট্টবেলায় তুমি বাসায় আসতে দেরি করলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। তোমার ভিতু মেয়েটা তেলাপোকা দেখে চিৎকার দিত বলে তুমি কী মজাটাই না করতে! তুমি সব সময় বলতে, তোমার চোখে ওই ছোট্টটিই থাকব।
রাস্তাঘাটে পাজি ছেলেরা যখন বিরক্ত করত, ভয় দেখাত, বাসায় এসে একা একা বসে কাঁদতাম। তুমি অন্যদের মতো ভয় না দেখিয়ে, ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে না বলে উল্টো বলতে সাহস করে চলতে, মাথা উঁচু করে বাঁচতে। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না তোমার মেয়ের। বাবা, তুমি সব সময় আমার পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছ। যে যা-ই বলুক না কেন, তুমি তোমার মেয়ের কথা ছাড়া কিচ্ছু ভাবতে না।
>রাস্তাঘাটে পাজি ছেলেরা যখন বিরক্ত করত, ভয় দেখাত, বাসায় এসে একা একা বসে কাঁদতাম। তুমি অন্যদের মতো ভয় না দেখিয়ে, ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে না বলে উল্টো বলতে সাহস করে চলতে, মাথা উঁচু করে বাঁচতে।
বাবা, মনে আছে ওই দিনটার কথা?
সারা রাত অফিসের কাজের চাপ শেষে ঘুম ঘুম চোখে বাসায় এসে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে মঞ্চে। ওই দিন তোমার মেয়ে প্রথম তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করবে বলে তুমি তোমার ক্লান্ত, ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে অপেক্ষা করছিলে। ওই দিন তোমার ওই ক্লান্ত চোখে আমি স্বপ্নপূরণের আনন্দ দেখতে পেয়েছিলাম।
বাবা হয়ে তোমার আমার প্রতি বিশ্বাস, ভরসা, স্নেহ, ভালোবাসা আমাকে কখনো নষ্ট পথে পা বাড়াতে দেয়নি।
বাবা, অনেক দিন তোমার মুখে সেই প্রিয় গান ‘আয়, খুকু আয়’ গানটি শোনা হয় না। একবার কি আমার জন্য গেয়ে শোনাবে?
বাবা, তুমি তো জানো তোমার এই মেয়েটি বড্ড বেশি অভিমানী, রাগী, লাজুক। আমার সব রাগ, অভিমানের জন্য ক্ষমা করে দিয়ো।
বাবা, তোমাকে বলা হয়নি কখনো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তোমার এই পাগলি মেয়েটা তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসে। তুমি ছাড়া পৃথিবীর একটি দিনও ভাবতে পারে না সে।
পরিসংখ্যান বিভাগ (১ম বর্ষ)
এমসি কলেজ, সিলেট।
অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]