বাবাকে লেখা চিঠি

বাবা,

অনেক দিন লেখা হয়নি তোমাকে। কলেজজীবনের শেষের দিকে তো আলসেমি করে কোনোরকমে দুকলম লিখে দিতাম। প্রতি সপ্তাহেই যেখানে কথা হয়, সেখানে চিঠি লেখার এই ছোট্ট কাজটুকু করতেও প্রচণ্ড ভার বোধ হতো, অযৌক্তিকও লাগত বটে। তবু আমি জানতাম, চিঠিগুলো তোমরা জমিয়ে রাখো। অবহেলা করে দুই লাইন লেখা কাগজটাকেও আবর্জনার ঝুড়িতে ফেলতে তোমাদের বড় আপত্তি। সরাসরি বলতে গিয়ে বড় অস্বস্তি হয়; ইচ্ছা থাকলেও বলে উঠতে পারি না। বছর ঘুরে যখন ৬ মে আসে, ‘শুভ জন্মদিন, বাবা’ কথাটা বলার পর তুমি যেমন লজ্জাজড়ানো কণ্ঠে বলো, ‘আমার আবার জন্মদিন!’, তুমি হয়তো জানো না, তেমনই এক লজ্জা এসে কণ্ঠনালিকে আঁকড়ে ধরে তোমার এই ছোট্ট মেয়েটারও, যাতে সে পৃথিবীর সব থেকে প্রিয়তর মানুষটাকে তার ভালোবাসার কথা জানাতে না পারে।

পৃথিবী আজকে খুব অশান্ত; প্রতিদিন অজস্র মৃত্যুসংবাদ, হাহাকারের জমাট শব্দ ঘিরে ধরেছে চারদিকে, একটু একটু করে অবসাদগ্রস্ততা জেঁকে বসেছে চারপাশে। কথা বলার চেয়ে চুপ করে থাকাই যেন শ্রেয়তর মনে হয়, পাশে থাকা ফোনটা তারপরও কেঁপে ওঠে। ঠিক জানি, ও পাশের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ আবারও জিজ্ঞাসা করবে, ‘ভালো আছিস তো, মা? রাতে খাওয়া হয়েছে?’

তুমি প্রায়ই অভিমান করে একটা কথা বলো, ‘তুমি তো ফোনই দাও না; কী হবে আমাদের?’ আমি হাসি, এই প্রশ্নের কী উত্তর দেব বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকি। জানো বাবা, কিছুদিন আগেও তোমার এই দিনে এতবার কথা বলা নিয়ে আমি খুব বিরক্ত হতাম। বারবার ফোন দেওয়ার অপরাধে দু-চার কথা শুনিয়েওছি বেশ কয়েকবার; কিন্তু তোমার এই কাজটার হেরফের এক দিনের জন্যও দেখিনি। অথচ এই আমি ভুলেই যাই, ছোটবেলায় বাসে উঠলেই তোমার পাশের জায়গাটা আমি নিতাম আর ঠিক পাঁচ মিনিট পরপর জিজ্ঞেস করতাম, ‘বাবা, আর কত দূর, আর কতক্ষণ লাগবে?’ তুমি কি বিরক্ত হতে, বাবা? কই, আমার তো মনে পড়ে না!

তোমাকে এই দীর্ঘ অদর্শনে আমি একটা জিনিস খুব করে উপলব্ধি করেছি, জানো? জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ আমার আশপাশের প্রত্যেকটা মানুষ। অনেক দেরিতে হলেও বুঝতে শিখেছি, মানুষের পাশে থাকা, তাদের নিজেদের থেকে একটু সময় দেওয়ার থেকে বড় সাহায্য আর হয় না। আগে তোমার এই অতি উৎকণ্ঠা, আমার বিষয়ে এত অস্থিরতা আমার কাছে বড় অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে, তাচ্ছিল্য করেছি। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না, এই অজুহাতে ফোন রেখেছি, বারবার ফোন দেওয়ায় রেগে গিয়েছি কিংবা ঘুমের অজুহাতে ফোন হয়তো ধরিইনি। ক্ষমা করে দিয়ো, বাবা। কথা দিচ্ছি, এরপর থেকে তোমার এই ভুল তোমার মেয়ে নিজে থেকেই করবে।

ঠিক আড়াইটায় যখন প্রতিদিন টেলিভিশনের সামনে পা দুটো টেনে নিয়ে যাই, সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করি যেন কোনো মৃত্যু অন্তত না থাকে। প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি, মৃত্যু খুব সহজ হয়ে আসছে, যেন এই স্বাভাবিক।

>কবে দেখা হবে, জানি না; আমি জানি সেই পর্যন্ত তুমি অপেক্ষা করবে, কিন্তু এবার তোমার মেয়েও তোমার দেখা পাওয়ার জন্য তীর্থের কাক হয়ে বসে আছে যে।

আগে প্রার্থনা করতাম, আমার পরিবার যেন ভালো থাকে; এখন প্রার্থনা করি, পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক শারীরিক ও মানসিকভাবে; সবাই কাছে থাকুক। প্রতি মুহূর্তে অপরাধবোধ হয়, তোমাদের দেখার থেকে ক্ষুদ্র স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রতিশোধ যেন প্রকৃতি কড়ায়-গন্ডায় নিচ্ছে আমার থেকে। তাই আগের থেকে একটু বেশি কথা বলার চেষ্টা করি তোমার সঙ্গে, তোমাদের সঙ্গে।

কবে দেখা হবে, জানি না; আমি জানি সেই পর্যন্ত তুমি অপেক্ষা করবে, কিন্তু এবার তোমার মেয়েও তোমার দেখা পাওয়ার জন্য তীর্থের কাক হয়ে বসে আছে যে।

পৃথিবী সুস্থ হলে টানা বারান্দার সিঁড়িতে বসে একসঙ্গে চা খাব কিন্তু, বাবা! মাকে বলো, হারমোনিয়ামে এই গানটা যেন তুলে রাখে—
‘আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুল ফুটবে, আমার সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে।’

শিক্ষার্থী
আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: info@onnoalo.com