বাবা আনিসুজ্জামান

'বাংলাদেশের মাটিতে আমি জন্মগ্রহণ করিনি। তবে এই মাটিই যেন আমার শেষ আশ্রয় হয়, এই আমার অন্তিম প্রার্থনা।'—বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন আনিসুজ্জামান। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলায় সংবিধান প্রণয়ন, শিক্ষা, ভাষা, সাহিত্য—সর্বত্রই তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। উত্তাল ইতিহাসের নানা সন্ধিক্ষণে যথোচিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ক্রমিক উত্থানের মধ্য দিয়ে নিঃসন্দেহে তিনি পরিণত হয়েছেন জাতির বিবেকে।
বরেণ্য মনীষীর সঙ্গে আমার পরিচয় কাজের সূত্রে। যেকোনো উপলক্ষে যখন-তখন ছুটে গিয়েছি—সহজাত বৈশিষ্ট্যের কারণেই তাঁর কাছে পেয়েছি অবারিত দ্বার, আশাতীত অনুপ্রেরণা, মমতা, সাহস আর ভরসা।
তারিখটি ছিল ২০১৪ সালের নভেম্বরের ১০ তারিখ। আনিসুজ্জামান স্যার ফোন করে হঠাৎ ২ দিন পর বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে স্যারের ২০১১ নম্বর রুমে আসতে বললেন। 'সরদার ফজলুল করিম: দিনলিপি'র ভূমিকাতে তিনি নতুন করে দুটি লাইন সংযুক্ত করতে চান। আকাশ স্যারও এসেছিলেন সে বিকেলে। এরপর আমার লেখা এবং সম্পাদিত প্রায় সব বইয়ে ভূমিকা লেখেন আনিসুজ্জামান স্যার। সর্বশেষ সরদার 'ফজলুল করিম জীবনীগ্রন্থ' ভূমিকা লিখে দেওয়ার সময় ২০১৫ সালে খুব ভয় ভয় মনে সাহস সঞ্চয় করে স্যারকে আমার ইচ্ছার কথা জানালাম। বললাম, স্যার, আপনাকে নিয়ে আমি একটি কাজ করতে চাই—'আনিসুজ্জামানের জীবন ও সাহিত্য' নামে। স্যার বললেন, 'সরদার ভাইয়ের কাজটি আগে ভালোভাবে শেষ করো, তারপর আমার কাজটি শুরু কোরো।' এরপর থেকে সেই শুরু। গত ৪ বছরে প্রতি সপ্তাহে কখনো বা প্রতি মাসে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। ছুটির দিনে সকালে দর্শনার্থী আসার আগপর্যন্ত তিনি আমার লেখার খসড়া দেখে দিতেন। তাঁর লেখা প্রায় সব বই একে একে পড়তে দিয়েছেন এই কবছরে। জীবনীগ্রন্থ 'মুনীর চৌধুরী' ছিল সুতা দিয়ে বাঁধা স্যারের সংগ্রহে থাকা সর্বশেষ সংখ্যা। হাতে দিয়ে বলেন, 'একটি অনুলিপি করে এ কপিটি আমাকে দিয়ে যেয়ো।' বলেন, '“কাল নিরবধি”, “আমার একাত্তর” আর “বিপুলা পৃথিবী”-তে তুমি আমাকে আর আমার সময়কে খুঁজে পাবে।' মাঝখানে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত স্যারের অসুস্থতার জন্যে কাজটিতে বিরতি ছিল। সে সময় স্যারকে দেখতে যেতাম বাসায় কিংবা বিভিন্ন হাসপাতালে, আগের চেয়েও নিয়মিতভাবে কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই 'আনিসুজ্জামানের জীবন ও সাহিত্য' নিয়ে কোনো কথা হতো না।
চিকিৎসা শেষে স্যার সুস্থ হয়ে যখন সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে আসেন, তখন কাজটি আবার শুরু করি। ২০১৮ সালে তিন মাসব্যাপী বাংলার পাঠশালা ফাউন্ডেশন আয়োজিত বাংলাদেশের সংস্কৃতি: অধ্যাপক আনিসুজ্জামান পাঠে স্যারের 'গ্রন্থপঞ্জি ও জীবনীপঞ্জি' শিরোনামে একটি সেশন নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার।
তিনি ছিলেন আমার জীবন বৃত্তান্তের একাডেমিক রেফারেন্স। অনেকের কাছেই ছিলেন সমুদ্রের দিকনিদর্শনকারী 'ভাসমান বয়া', অনেকের কাছে ছিলেন 'বাতিঘর', কিন্তু তাঁর চলে যাওয়ায় আমি অনুভব করছি আমার হৃৎপিণ্ডের কোনো একটি অংশকে যেন হারিয়েছি। হাসপাতালে ভর্তির আগের দিন ইউএস ফরেস্টের ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিসে আমার সম্পর্কে অসুস্থ অবস্থায় স্যার ১২টি বিষয়ে প্রায় ২ পৃষ্টার একটি লিখিত মন্তব্য ই-মেইলে পাঠিয়েছিলেন।
এ বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি স্যারের জন্মদিনে বলছিলাম, 'স্যার আমাকে একটু ভালো করে দোয়া করে দেন, যেন আপনাকে নিয়ে কাজটি আমি ভালোভাবে শেষ করতে পারি।' স্যার আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেন, 'আমি দোয়া করছি।' স্যারের হাতের স্পর্শ যেন এখনো আমি চোখ বন্ধ করলেই পাই। আমি স্যারকে লেখা একটি চিঠিতে লিখেছিলাম, 'আপনার কোনো এক জন্মদিনে আপনার হাতে তুলে দিতে চাই শ্রদ্ধাঞ্জলি, আমার অর্ঘ্য 'আনিসুজ্জামানের জীবন ও সাহিত্য'।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে আমার কাজের একটি অধ্যায়—'সন্তানদের (রুচিতা হক, শুচিতা জামান ও আনন্দ জামান) দৃষ্টিতে আনিসুজ্জামান'—সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ:
প্রশ্নমালার প্রশ্ন ছিল:
বাবা সময় দিতেন কি না, বাবাকে নিয়ে আনন্দের স্মৃতি, সবচেয়ে কঠিন সময়ের স্মৃতি, আনিসুজ্জামান হয়ে ওঠায় সন্তান হিসেবে তাঁদের অনুভূতি কিংবা কোনো বিব্রতকর মুহূর্ত, ব্যক্তিজীবনে শোকের সময় বাবাকে কীভাবে পেয়েছেন, বাবাকে নিয়ে আরও কোনো প্রত্যাশা, বাবার লেখালেখি পড়েছেন কি না? আকাশচুম্বী খ্যাতির কারণে পারিবারিক জীবনে কোনো বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন কি না, অথবা বাবার কোনো বিষয়ে গর্ব হয়?
রুচিতা হক
তারিখ: ১৩ জুলাই ২০১৮, (স্থান: ন্যাম ভবন, রোড নং-২৫, বাড়ি নং-২৭, গুলশান-১, ঢাকা)
আপনাকে নিয়ে বাবার কোনো আনন্দের স্মৃতি বা ঘটনা:
কুমিল্লা বোর্ড থেকে এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক শাখায় ৮ম স্থান অধিকারের পর আব্বা অনেক আবেগাপ্লুত ছিলেন। কোনো একটি বক্তৃতায় আবেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, 'আমার মেয়ের ফলাফলে আমি খুবই আনন্দিত।'
বাবাকে নিয়ে সংকটের স্মৃতি:
রুচিতা হক: ২০১৮ সালে ৮০তম জন্মবার্ষিকীর আগে আগে আব্বা অসুস্থ হয়ে দীর্ঘ সময় বিছানায় ছিলেন। সবার আশঙ্কা ছিল স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা নিয়ে। আব্বাকে নিয়ে সে সময়টা ছিল আমাদের অনিশ্চয়তার। তবে আব্বার অসুস্থতায় আমাদের সুযোগ হয়েছিল তাঁর কাছাকাছি আসার।
বাবা আপনাদের কীভাবে সময় দিতেন:
রুচিতা হক: ছুটির দিন ছাড়া আব্বার সঙ্গে দেখা হতো কিন্তু ওইভাবে বিশেষ কোনো কথা হতো না। কোনো আনন্দের মুহূর্তে দেখা হতো। আব্বা বেড়াতেও নিয়ে যেতেন, কিন্তু ওই রকম আন্তরিক প্রকাশ দেখাতেন না। কর্তব্যবোধটাই বেশি ছিল, আন্তরিক প্রকাশটা অনেক পরিমিত।
আনিসুজ্জামান স্যারের সন্তান হিসেবে আপনার অনুভূতি:
রুচিতা হক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় বুঝতে পারতাম, আব্বা অন্যদের চেয়েও আলাদা। আব্বাকে সবাই অন্য রকম সম্মান করতেন, যা দেখে আমার মনেও একধরনের ভালো লাগা কাজ করত। আব্বার কাছে আবেগের চেয়ে কর্তব্যবোধ অনেক বড়। আব্বা কখনো ফোন বন্ধ রাখেন না। বলেন, 'কেউ তো গল্প-গুজবের জন্য ফোন করেন না, প্রয়োজনেই করেন।'
আনিসুজ্জামান স্যারের আকাশচুম্বি খ্যাতি পরিবারের জন্য কোনো বিড়ম্বনা ছিল কি:
রুচিতা হক: পারিবারিক অনুষ্ঠানে প্রায়ই উপস্থিত থাকতে পারতেন না। আব্বার জন্মদিন অথবা আমাদের জন্মদিন আব্বাকে ছাড়াই পালন করতে হতো। ছোটসময় অভিমান হতো, কিন্তু একটা সময়ে এটি স্বাভাবিক একটি নিয়মে পরিণত হয়।
আনিসুজ্জামান স্যারের লেখা পড়েন?
রুচিতা হক: আত্মজীবনীমূলক লেখাগুলো—'কাল নিরবধি', 'আমার একাত্তর' এবং 'বিপুলা পৃথিবী' পড়েছি। বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িকীতে প্রকাশিত লেখা পড়ি। লেখা পড়ে মনে হয়েছে, আব্বা খুব ভাগ্যবান। যেখানে যখন গেছেন, তখনই অনেক বড় মানুষের দেখা পেয়েছেন।
বাবাকে নিয়ে কোনো আনন্দের স্মৃতি:
রুচিতা হক: ২০১৮ সালে ৮০তম জন্মবার্ষিকীর পূর্বে আব্বা অসুস্থ হয়ে দীর্ঘ সময় বিছানায় ছিলেন। দীর্ঘ অসুস্থতার পর আব্বার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা আমাদের সবার জন্যে একটি আনন্দের স্মৃতি। আরেকটি আনন্দের স্মৃতি আব্বার ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পুরস্কার অর্জন। যদিও পরে অনেক স্বীকৃতি পেয়েছেন।
বাবাকে নিয়ে কোনো প্রত্যাশার কথা:
রুচিতা হক: আব্বার ব্যস্ততায় আমরা পারিবারিক জীবনকে সেভাবে উপভোগ করতে পারিনি। আব্বা সব সময় নিজের সন্তান ও পরিবার থেকে বাইরের প্রয়োজনকে এবং কর্তব্যকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। সে কারণে আমরা ভাইবোনরা একটু অন্তর্মুখী। মাঝেমধ্যে সে জন্য কিছুটা অভিমান হয়েছে, যদিও এখন আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
বাবাকে নিয়ে কোনো কষ্টের কথা:

রুচিতা হক: আব্বার সন্তান হয়ে আলাদা কোনো পরিচয় না হওয়া—আব্বার পরিচয়ে পরিচিত হওয়া। এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক শাখায় ৮ম স্থান অধিকারের পর সেভাবে কোনো পেশায় না আসায় মনে হতো সন্তান-পরিবার বিব্রত হবে। আব্বা বাইরের জগৎকে অনেক বেশি সময় দিতেন। সন্তান হিসেবে আমাদের ইচ্ছা করত আব্বাকে কাছে পেতে। আম্মার চাকরির কারণে আমরা আম্মাকেও খুব বেশি পেতাম না। অনেক সময় বিশেষত পরীক্ষার সময় আমাদের একা একা স্কুলে যেতে হতো পরীক্ষা দিতে। অন্যদের সঙ্গে অভিভাবকদের দেখে তখন কষ্ট হতো। মনে একধরনের সান্ত্বনা খুঁজে নিতাম। মনে হতো, 'বাবা যতটা না পরিবারের, তার চেয়ে বেশি বাইরের, সমষ্টির।'
বাবার জন্য বিব্রত হয়েছেন এমন কোনো মুহূর্তের স্মৃতি:
রুচিতা হক: আব্বা-আম্মা আমাদের ওপর অনেক নির্ভর করতেন। বিশ্বাস করতেন। বড় হওয়ার পরও আমাদের নিয়ে তেমন কোনো সচেতনতা দেখাননি। সময়-অসময়ে অনেক ছাত্র বাসার ভেতরে চলে আসত। আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে তিনি খুব বেশি একটা সচেতন ছিলেন না। নানি বলতেন, 'তোমরা বড় হয়েছ, তোমার মা-বাবার কি কোনো খেয়াল আছে?' দাদা বলতেন, 'যে মা-বাবার পাল্লায় পড়েছ, আল্লাহই তোমাদের দেখে রাখবেন।'
বাবাকে নিয়ে আপনার কোনো গর্ব:
রুচিতা হক: অন্যরা যখন বলে, আনিসুজ্জামানের মেয়ে তখন সন্তান হিসেবে আব্বাকে নিয়ে গর্ব হয়।
আনন্দ জামান
তারিখ: ১১ আগস্ট ২০১৮ (স্থান: ন্যাম ভবন, ঢাকা)
বাবার সম্পর্কে কোনো শৈশবের স্মৃতি বা অনুভব:
আনন্দ জামান: আমাদের ছোটবেলা কেটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশই বলে দিত, 'অন্যরা যা পারে, তুমি কিন্ত তা পারো না। বন্ধুরা প্রাচীর টপকালেও আমি প্রাচীরের সামনে গিয়ে থেমে যেতাম, বাবার সুনামের ভয়ে।'
বাবাকে নিয়ে কোনো আনন্দের স্মৃতি:
আনন্দ জামান: আব্বাকে নিয়ে আমাদের আলাদা করে আনন্দিত হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আব্বাকে সব সময় আমরা পেয়েছি ড. আনিসুজ্জামান হিসেবে, তাই অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের আনন্দই আমাদের আনন্দ। আব্বা জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন, যেমন স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পুরস্কার, পদ্মভূষণ পুরস্কার ইত্যাদি। আব্বার যেকোনও সস্মান আমাদের জন্যে আনন্দের স্মৃতি।
বাবা আপনাদের কীভাবে সময় দিতেন:
আনন্দ জামান: পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে আব্বাকে আমরা পেতাম না। বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে যেমন জন্মদিনে কখনো রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতেন। আব্বার কর্তব্যবোধটাই বেশি ছিল, প্রকাশ অনেক পরিমিত।
বাবাকে নিয়ে আপনার কোনো বিশেষ ঘটনা:
আনন্দ জামান: বেঙ্গল ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতানুষ্ঠানের বরাবরই সভাপতি থাকেন আব্বা, কিন্তু অনুষ্ঠানের টিকিট সংগ্রহ করতে হতো অফিসের কোনো সহকর্মী অথবা পরিচিত কারও মাধ্যমে। আমার স্ত্রী ইলোরাকে কখনো তাঁর নিজের টিকিট দিতেন কিন্তু আমাকে নয়। আব্বার কথা, 'তোমাদের কেন পরিচয় করিয়ে দিতে হবে? দেশের কাজে, দশের কাজে, সমাজের কাজে অন্যকে বলতে পারি, কিন্তু নিজের জন্য কি বলা যায়?' আব্বা সব সময় বলতেন, 'আমার সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিলেন কে?'
আনিসুজ্জামান স্যারের সন্তান হিসেবে আপনার অনুভূতি:
আনন্দ জামান: আব্বার জীবনের উত্থান-পতন তেমন নেই। জীবন আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনি আছে। মেহমান, আপ্যায়ন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ম মেনে সময়মতো অংশগ্রহণ ইত্যাদি। আব্বার বৈষয়িক কোনো স্বপ্ন নেই, তাই সময়ও নেই। একবার বিদেশে একটি ট্রানজিস্টার কিনতে গিয়ে ট্রানজিস্টারের দামের চেয়ে ট্যাক্সি ভাড়া বেশি দিয়েছিলেন। এমনকি আব্বার ধারণা একটি লাক্স সাবানের দাম পাঁচ টাকা। আব্বার ঘরের এবং আত্মীয়স্বজনের দায়িত্ব সব সময় আম্মা পালন করেন, যাতে আব্বা নির্বিঘ্নে দেশের এবং সমাজের কাজ করতে পারেন।
বাবার কোনো ঘটনা, যা স্মৃতিতে গেঁথে আছে:
আনন্দ জামান: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আব্বা এক টাইপিস্টকে একটি লেখা কম্পোজ করতে দিয়েছিলেন। টাইপিস্ট আব্বাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন একটি বানান সম্পর্কে—ঠিক আছে কি না? আব্বা অনেক সময় ধরে খুঁজে বের করে দুটি ডিকশনারি আর একটি বই দুপুরের রোদে আমাকে দিয়ে বলেন, 'তাকে বানানটি দেখিয়ে দিয়ে এসো।' আব্বার জানার এবং শেখার আগ্রহ প্রবাদতুল্য।
বাবার লেখা পড়েন?
আনন্দ জামান: স্মৃতিমূলক লেখাগুলো পড়েছি। 'কাল নিরবধি' পড়ে আব্বার শৈশবের কথা জেনেছি। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত লেখা পড়ি।
বাবার কোন দিকটি আপনার দৃষ্টিতে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের:
আনন্দ জামান: আব্বাকে আমরা ছোট থেকে এখন যেমন দেখছি, সেভাবেই দেখে এসেছি। নিজের পরিবার থেকে সমাজের এবং দেশের প্রয়োজনকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। বরাবরই আবেগের চেয়ে কর্তব্যবোধকে প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি।
বাবার কোন বৈশিষ্ট্যটির জন্যে আপনি গর্ব করেন:
আনন্দ জামান: আব্বার এ বৈশিষ্ট্যটি প্রকৃত মানুষের সংজ্ঞায় পড়বে—'মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য না করা। সবাইকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া। সবার জন্যে সমান আপ্যায়ন, সমান সৌজন্যতা।' আব্বা বিভিন্ন আন্দোলনে ছিলেন, নেতৃত্বে ছিলেন, সবার শ্রদ্ধার পাত্র। তেমনি আব্বার কাছেও ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ—সবার জন্য সমান অবারিত দ্বার, সব মানুষ সমান।
শুচিতা জামান
তারিখ: ১৩ জুলাই ২০১৮, (স্থান: ন্যাম ভবন, ঢাকা)
বাবাকে নিয়ে বিশেষ কোনো স্মৃতি বা ঘটনা, যা সব সময় মনে হয়:
শুচিতা জামান: আমার স্বামী সুমন ব্যাংককে মারা যাওয়ার পর প্রথম যখন আব্বার সঙ্গে ঢাকা বিমানবন্দরে দেখা হলো, তখন আব্বা দুহাত বাড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আব্বার আমাকে বুকে জড়িয়ে নেওয়ার কথাটি আমার সব সময় মনে হয়। তখন আমার মনে হয়েছিল, 'আমার সব কষ্টের ভার আব্বা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন।'
বাবার কোন বিষয়টি আপনার বেশি ভালো লাগে:
শুচিতা জামান: আব্বার মানবিক দিকটিকে বেশি শ্রদ্ধা করি। আব্বা আত্মনির্ভরশীল; অন্যের ওপর নির্ভর করতে পছন্দ করেন না। তিনি হার্ট অ্যাটাকের সময় ডাক্তারকে নিজেই ফোন করেছিলেন। রুচি আপার স্বামী রায়হান ভাই আব্বার সঙ্গে যেতে চাইলে বলেন, 'প্রয়োজন হলে নিজেই ফোন করব।'

আনিসুজ্জামান স্যারের সন্তান হিসেবে আপনার অনুভূতি:
শুচিতা জামান: আমরা ভাইবোনেরা যখন ছোট ছিলাম, তখন কোনো মেহমান এলে আমাদের ডেকে পরিচয় করিয়ে দিতেন। অনেক সময় বারবার যেতে হলে আমরা মনে মনে বিরক্ত হয়ে আম্মাকে বলতাম, 'আব্বা ড্রইংরুমে আমাদের ফটো টাঙিয়ে রাখলেই পারে।' কিন্তু পরে যখন বুঝতে শিখেছি, আব্বার জন্য সব সময় গর্ব হয়েছে।
বাবার লেখা পড়েন?
শুচিতা জামান: প্রবন্ধের বই পড়া হয়নি, তবে 'কাল নিরবধি', 'আমার একাত্তর' এবং 'বিপুলা পৃথিবী' পড়েছি। পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে থাকি।
বাবাকে নিয়ে কোনো প্রত্যাশা:
শুচিতা জামান: ২০১৮ সালে আব্বা জন্মদিনের আগে আগে প্রায় এক বছরের বেশি সময় অসুস্থ ছিলেন। সে সময়টা ছিল আমাদের জন্য অনিশ্চয়তার। এখন মোটামুটি সুস্থ হয়েছেন। আব্বাকে নিয়ে কোনো প্রত্যাশা নেই, শুধু সুস্থ, স্বাভাবিক আর আনন্দের সঙ্গে জীবন যাপন করুক, এতটুকুই প্রত্যাশা।
বাবার কোন বিষয় নিয়ে আপনার গর্ব হয়:
শুচিতা জামান: আব্বা সব সময় মানুষের প্রয়োজনে পাশে থাকতে চেয়েছেন। আব্বা যতটা না আমাদের, এর চেয়ে বেশি সমষ্টির। মানুষও আব্বাকে সেভাবে সম্মান করে। এই বিষয়টি আমাদের জন্য অনেক গর্বের।
( সাক্ষাৎকার ও আলোকচিত্রের জন্য কৃতজ্ঞতা: সিদ্দিকা জামান)