ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ইতিহাস

ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বর্তমানে বাংলাদেশে স্বমহিমায় উজ্জ্বল, দ্যুতি ছড়াচ্ছে দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও চলচ্চিত্র উৎসব, নির্মাতা, প্রযোজক, কলাকুশলী, সমালোচকদের কাছে রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজিত চলচ্চিত্রের এ উৎসব আজ সুপরিচিত। কেমন করে এ উৎসবের শুরুটা হলো, সেটাই জানাব সংক্ষেপে।

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

বাংলাদেশ তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে। একাত্তরের প্রত্যয় নিয়ে তরুণেরা নতুন কিছু করার চেষ্টা করছেন। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সুসংহত করার চেষ্টা যেমন চলছে, তেমনি সেলুলয়েডে বাংলার সংস্কৃতি ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরার প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে। শুধু সত্তরের দশকেই ৮০টির মতো চলচ্চিত্র ক্লাব গড়ে ওঠে। এ থেকে বোঝা যায়, স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরই চলচ্চিত্রের সঙ্গে বোঝাপড়ার একটা তাগিদ অনুভূত হয়েছিল এই ভূখণ্ডে। নিশ্চয় আমাদের জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১) প্রামাণ্যচিত্রটি সম্পর্কে জানা রয়েছে। যুদ্ধকালে গেরিলা কায়দায় চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন রায়হান। শুধু তা–ই নয়, সে সময় আরও তিনটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। জহির রায়হান নিজেই নির্মাণ করেন আরও একটি প্রামাণ্যচিত্র: ‘আ স্টেট ইজ বর্ন’ (১৯৭১)। রায়হানের তত্ত্বাবধানে আলমগীর কবির নির্মাণ করেন ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ (১৯৭১) এবং বাবুল চৌধুরী তৈরি করেন ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’ (১৯৭১)। বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী অর্জনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল চলচ্চিত্র। তো দেশ স্বাধীনের পর এতগুলো চলচ্চিত্র সংসদ ও ক্লাব যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

সত্তরের দশকের শেষভাগে, ১৯৭৭ সালের ২৫ জুলাই, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেতনাকে ধারণ করে ঢাকার গ্রিন রোড কলোনির কমিউনিটি সেন্টারে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সভাপতিত্বে সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রকর্মীরা একটি সভা করেন। নতুন চলচ্চিত্র সংসদ তৈরির জন্য এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নাম চূড়ান্ত হয় ‘রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ’। পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পাই, এই চলচ্চিত্র সংসদ শুধু চলচ্চিত্র প্রদর্শন নয়, সংগীত, নৃত্য ও চিত্রকলা প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছে।

১৯৭৭ সালের ৯ আগস্ট রেইনবো নিজেদের কার্যক্রম প্রসারিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিতে তৎকালীন সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারি খালেদ হায়দারের কাছে সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করে। ফেডারেশনের সদস্য হতে কয়েক মাস লেগে যায় রেইনবোর। শুরুর সেই যাত্রার সারথি ছিলেন মোস্তফা কামাল, এম লতিফুর রহমান, রেস্তাদুল ইসলাম, খন্দকার কামরুজ্জামান, খন্দকার মশিউর রহমান, বেলায়েত হোসেন, পিনু মোস্তফা, জাফরিন আলম, আহমেদ মুজতবা জামাল, মোকাম্মেল হোসেন প্রমুখ। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, সংসদ প্রতিষ্ঠার এই প্রস্তুতিকাল থেকেই আহমেদ মুজতবা জামাল জড়িত ছিলেন। কিন্তু তিনি সে সময় কমিটিতে ছিলেন না। আহমেদ মুজতবা জামাল, অগ্রজ মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে গঠিত হতে যাওয়া চলচ্চিত্র সংসদের সব কাজেই সক্রিয় ছিলেন।

১৯৭৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর, ধানমন্ডিতে অবস্থিত তৎকালীন সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে রেইনবো শুরু করে তাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। প্রথম আয়োজনটি ছিল তিন দিনব্যাপী—২৬, ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর। প্রধান অতিথি হিসেবে সেই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন তৎকালীন সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন খান। তায়েব উদ্দিন আহমেদ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। রেইনবোর মহাসচিব মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল আর সভাপতি লতিফুর রহমান অনুষ্ঠানটিতে বক্তব্য দিয়েছিলেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের তৎকালীন প্রধান ভি আই তিতায়েভ। উদ্বোধন শেষে, সোভিয়েত দূতাবাসের সৌজন্যে ‘হোয়াইট বার্ড উইথ ব্ল্যাক মার্ক’ চলচ্চিত্রটি দেখানো হয়েছিল। ইউরি ইলিয়েনকো পরিচালিত ছবিটি মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে স্বর্ণপদক পায়। পরের দিন ২৭ ডিসেম্বর হয় সেমিনার, বিষয়: চলচ্চিত্র ও সমাজ। সেমিনার শেষে আনিস ফিল্মসের (ঢাকা) সৌজন্যে রাজেন তরফদার পরিচালিত সিনেমা ‘পালঙ্ক’ (The Bed) প্রদর্শিত হয়। রেইনবোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শেষ দিন, অর্থাৎ ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সর্বশেষে দেখানো হয় কামিল ইয়রমাতভ পরিচালিত উজবেক চলচ্চিত্র ‘দ্য পোয়েম অব টু হার্টস’। যেহেতু রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদের নিয়মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর চর্চা থেকে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পথচলা শুরু, তাই এ সংসদ সম্পর্কে আরেকটু বলা প্রয়োজন।

যাত্রার শুরু থেকেই রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, সেমিনার, কর্মশালা, সভা, চলচ্চিত্র অধিবেশন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র–সংস্কৃতি গড়ে তোলার পেছনে শক্ত ভূমিকা রেখে চলেছে। রেইনবো প্রথম বছরেই ৬১টি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বলা বাহুল্য নয়, আজকালকার সংগঠনের মতো শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক ছিল না রেইনবো। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত রেইনবোর চারটি শাখা বিভিন্ন জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, যেমন চট্টগ্রাম, রাজশাহী, গাইবান্ধা ও টাঙ্গাইল জেলায় রেইনবো ছিল সক্রিয়, বিশেষ করে চট্টগ্রামে তারা অনেক অনুষ্ঠান করেছে। এরই ভেতর ১৯৮০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড কর্তৃক নিবন্ধিত হয় রেইনবো। এই সময়টাতে রেইনবোর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত পরিচালক আলমগীর কবির। তাঁর তত্ত্বাবধানে ওই সময়ে অনেকগুলো কর্মশালার আয়োজন করে রেইনবো। চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভেতর এসব কর্মশালা তখন বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। এসব কার্যক্রমের পাশাপাশি সংগঠনটি নিয়মিত একটি বার্ষিক পত্রিকাও প্রকাশ করে। শুরুতে এর নাম ছিল ‘নিক্কন’, কিন্তু ১৯৮২ সালের পর পত্রিকাটির নাম পাল্টে রাখা হয় ‘সেলুলয়েড’। অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে এই প্রকাশনা এখনো অব্যাহত আছে।

রেইনবোর নানামুখী কার্যক্রম ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। এর কারণ সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংসদকর্মী পরিবর্তিত হয়েছে, সব সময় তাদের কর্মনিষ্ঠা ও অভিপ্রায় এক ছিল না। তা ছাড়া অর্থাভাবও ছিল একটা বড় কারণ। তবে কাজের কাজ যেটি হয়েছে, ছড়িয়ে–ছিটিয়ে কাজ করার বদলে রেইনবো ১৯৯২ সাল থেকে একটি কাজ বেশ গুরুত্বের সঙ্গে কাঁধে তুলে নেয়, সেটি হলো ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা। রেইনবোর পঞ্চদশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন উপলক্ষে চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বা ডিফ হয়ে ওঠে।

এ উৎসবের প্রারম্ভিক কাল থেকে যুক্ত ছিলেন বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ড. সুফিয়া আহমেদ, ড. সেলিম জাহান, আবদুস সেলিম, কিশওয়ার কামাল, মফিদুল হক, রবিউল হুসাইন, লুৎফে নাজিব খান, কে এম আর মঞ্জুর, এম শফিকুর রহমান প্রমুখ। পরবর্তীকালে আরও যোগ দেন এ এইচ মোফাজ্জল করিম, সৈয়দ মারগুব মোরশেদ, মিজারুল কায়েস, ম. হামিদ, আসাদুজ্জামান নূর, শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল, হায়দার রিজভী, শাহরিয়ার আলম, জাহিদ হোসেন, জালাল আহমেদ, আবদুল হান্নান, কবীর আনোয়ার, মসিহ্‌উদ্দিন শাকের, আলী আহমদ, ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ, চাষী নজরুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম খোকন, সোহানুর রহমান সোহান, মোহাম্মদ আলমগীর, মনজুরুল আহসান বুলবুল, শ্যামল দত্ত, আবু সাইয়ীদ, মিজানুর রহমান, সামিয়া জামান, বিধান রিবেরু, বৈশাখী সমাদ্দার প্রমুখ। তাঁদের ভেতর অনেকে আর বেঁচে নেই, অনেকে আবার উৎসবের সঙ্গে যুক্ত আছেন এখনো। ’৯২ সাল থেকেই উৎসবটির পরিচালক হিসেবে রয়েছেন রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদের বর্তমান সভাপতি আহমেদ মুজতবা জামাল। তিনি ১৯৭৭ সালে সংসদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকলেও কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন ১৯৭৮ সালে। সে সময় মোকাম্মেল হোসেনও যুক্ত হন। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি জেনারেল মোস্তফা কামাল উচ্চতর ডিগ্রির জন্য তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কিয়েভ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। তখন রেইনবোর মহাসচিবের দায়িত্ব নেন পর্যায়ক্রমে খন্দকার মছিউর রহমান (১৯৮১–১৯৮৪) ও এম বেলায়েত হোসেন (১৯৮৪–১৯৮৫)। এরপর ১৯৮৫ সালে সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে সংসদের কার্যক্রমকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন আহমেদ মুজতবা জামাল।

ঢাকার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার সুবাদে আশির দশক থেকেই পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন আহমেদ মুজতবা জামাল। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি নজর কাড়েন ঢাকার জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গ্যেটে ইনস্টিটিউটের পরিচালক মিসেস এইচ লেশনারের। তিনি আহমেদ মুজতবা জামালকে মিউনিখে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের নবম আসরে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেন। ১৯৯১ সালের ২০ জুন আহমেদ মুজতবা জামাল তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির মিউনিখে নবম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (২২-২৯ জুন ১৯৯১) যোগ দেন। উৎসবে গিয়ে ভারতের বিখ্যাত পরিচালক আদুর গোপালাকৃষ্ণান, ব্রিটিশ চলচ্চিত্র সমালোচক ডেরেক ম্যালকম, প্রখ্যাত ডেনিশ নির্মাতা লার্স ভন ত্রিয়ের এবং ফিপ্রেসির জেনারেল সেক্রেটারি ক্লাউস এডারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয় মুজতবা জামালের। বলা বাহুল্য নয়, এ উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য যাবতীয় সহযোগিতা করেছিল ঢাকার গ্যেটে ইনস্টিটিউটের পরিচালক এইচ লেশনার, ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের সচিব অধ্যাপক আবদুস সেলিম ও জনতা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি। মিউনিখের উৎসবটিই মূলত ঢাকায় চলচ্চিত্র উৎসব শুরুর প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

মিউনিখ থেকে ফেরার পরের বছরই, ১৯৯২ সালে দেশের বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিজনদের নিয়ে ‘ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবের’ যাত্রা শুরু করেন আহমেদ মুজতবা জামাল। প্রথম সেই উৎসবের পোস্টার নকশা করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা আবু সাইয়ীদ। উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯২ সালের ২৬ থেকে ৩১ ডিস্বেম্বর। বলে রাখা ভালো, তখনো কিন্তু উৎসবটি ‘আন্তর্জাতিক’ নামটি গ্রহণ করেনি। প্রথম উৎসবের উদ্বোধন করেছিলেন সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। এর পরের বছর ১৯৯৩ সালে ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসব হয়ে ওঠে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। সেবার প্রখ্যাত পরিচালক আদুর গোপালাকৃষ্ণানই ছিলেন একমাত্র বিদেশি অতিথি। তাঁর উপস্থিতির মাধ্যমেই উৎসবটি আন্তর্জাতিকতা পায়। দ্বিতীয় এ আসর থেকে উৎসবটি ৯ দিনের ব্যাপ্তি পায়। সেবার উৎসবের উদ্বোধন করেন ইংরেজি দৈনিক অবজারভারের সম্পাদক ওবায়দুল হক। তিনি চলচ্চিত্র পরিচালকও ছিলেন। ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া’ ছবির নির্মাতা তিনি।

১৯৯২ সালে প্রথম ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে (২৬ ডিসেম্বর) প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছেন সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। মঞ্চে বিশিষ্ট অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, ড. মোহম্মদ মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও ওবায়দুল হক।
ছবি: উৎসব কর্তৃপক্ষ

ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শুরু থেকেই রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির স্লোগানটি সামনে রেখে তাদের পথচলা শুরু করে, স্লোগানটি হলো, ‘বেটার ফিল্মস, বেটার অডিয়েন্সেস, বেটার সোসাইটি’। পরে এই স্লোগানের ভাবানুবাদ করা হয়: নান্দনিক চলচ্চিত্র, মননশীল দর্শক, আলোকিত সমাজ। উৎসবের স্লোগান থেকেই বোঝা যায়, প্রচলিত সস্তা ধারার চলচ্চিত্রের বাইরে যে ধরনের চিন্তাশীল ও নান্দনিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, সেগুলোকে উৎসবে দেখানো এবং এর মাধ্যমে দর্শকের উন্নত রুচি তৈরি তথা একটি প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয় এ উৎসবের রয়েছে।

ঢাকায় উৎসব শুরুর কয়েক বছর পর, ১৯৯৪ সালে আহমেদ কলকাতায় অনুষ্ঠিত ২৫তম ভারতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (১০–২০ জানুয়ারি) যোগ দেন, এ ঘটনাও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, কলকাতায় আদুর গোপালাকৃষ্ণানের সঙ্গে তাঁর তৃতীয়বারের মতো দেখা হয়। তিনি তাঁকে রাতের খাবারের দাওয়াত দেন। নৈশভোজে ডেরেক ম্যালকমও উপস্থিত ছিলেন। এই নৈশভোজ আহমেদের জীবনে আরেকটি অধ্যায়ের সূচনা করে।

সেদিন রাতে খেতে খেতে ডেরেক মাইকেল ম্যালকম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচক সংগঠন ফিপ্রেসির বাংলাদেশ অধ্যায় আরম্ভ করার উপদেশ দেন আহমেদকে। তিনি আহমেদকে সংগঠনটিকে পাঁচ-সাতজন সদস্যের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেন। নৈশভোজে দেওয়া মেলকমের পরামর্শটি মাথায় রেখে আহমেদ ঢাকায় ফিরে আসেন, আর এ বিষয় নিয়ে ১৯৯৪ সালের ২৪ জানুয়ারি অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ওবায়দুল হক, আবদুস সেলিম, সন্তোষ গুপ্তসহ আরও অনেকের সঙ্গে আলোচনা করেন। এখান থেকেই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচক সংগঠন ইফক্যাবের (IFCAB) আবির্ভাব। ১৯৯৫ সালে ফিপ্রেসির পক্ষ থেকে ইফক্যাবের সদস্যপদ আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এই ইফক্যাবও বেশ ঘনিষ্ঠভাবে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে এই সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে আছেন আহমেদ মুজতবা জামাল। আর আমি রয়েছি অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে।

১৯৯১ সালে মিউনিখ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আহমেদ মুজতবা জামাল, জার্মান চলচ্চিত্র সমালোচক ক্লাউস এডার ও ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক আদুর গোপালাকৃষ্ণান।
ছবি: আইএনপি/ম্যাথিউ

ডিফের তৃতীয় আসরের উদ্বোধন করেছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান, চতুর্থ ডিফ উদ্বোধন করেন জাতীয় অধ্যাপক ড. এম ইন্নাস আলী এবং ১৯৯৭ সালে ডিফের পঞ্চম আসরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব উদ্বোধন করলে সবাই উৎসবকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। সে বছর ঢাকায় ‘লাল দরজা’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে এসেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। ছবিটি উদ্বোধনী দিনে দেখানো হয়। সে বছর আদুর গোপালাকৃষ্ণানও এসেছিলেন ঢাকায়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০১০ সালেও ডিফ উদ্বোধন করেন। ২০১৭ সালে, ডিফের পঞ্চদশ আসরে প্রধান অতিথি হয়ে উৎসব উদ্বোধন করেন তখনকার রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। সে সময় রাষ্ট্রের কিছুটা সমর্থন পেয়ে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব তার পাখা মেলে দিতে পেরেছিল।

১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর নিয়মিত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরের কয়েকটি বছর অনুষ্ঠিত হয়েছে দুই বছর পরপর। মানে ১৯৯৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত উৎসবটি ছিল দ্বিবার্ষিক। এর মাঝখানে ২০০০ সালে উৎসবটি ডিসেম্বর থেকে সরে আসে জানুয়ারিতে। কারণ, ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে রমজান মাস ছিল, তাই উৎসবের তারিখ পিছিয়ে জানুয়ারিতে নেওয়া হয়। ২০০০ সাল থেকেই উৎসবে প্রথম প্রতিযোগিতা বিভাগ সংযুক্ত হয়। সে বছর, ষষ্ঠ আসরের উদ্বোধন করেন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী আবু সাইয়িদ। ২০০০ সালের ওই উৎসবে ঢাকায় এসেছিলেন অপর্ণা সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, নব্যেন্দু চ্যাটার্জি ও রবিন ডব্লিউ হুড। ২০০২ সালের সপ্তম আসরের উদ্বোধন করেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান। ২০০৪ সালের অষ্টম আসর উদ্বোধন করেন তৎকালীন পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী রিয়াজ রহমান। ২০০৬ সালের নবম আসর উদ্বোধন করেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান।

২০০৮ সালের দশম আসর উদ্বোধন করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী। সে বছর থেকে উৎসবে যুক্ত হয় চলচ্চিত্র প্রযোজনাভিত্তিক কর্মশালা। সে বছর প্রথম কর্মশালার প্রশিক্ষক ছিলেন নির্মাতা বাদল রহমান। ২০১০ সালেও তিনি প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন। এর পরের বছরগুলোতে প্রশিক্ষক হিসেবে অস্ট্রেলীয় পরিচালক স্টিভ ওয়ারেন ও হায়দার রিজভীর মতো নির্মাতারাও যুক্ত হন। হায়দার রিজভী প্রশিক্ষক ছিলেন ২০১৬ সালে।

উৎসবের নবম আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথিদের মধ্যে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান।
ছবি: উৎসব কর্তৃপক্ষ

২০১৬ পর্যন্ত দুই বছর অন্তর অন্তর উৎসব হলেও ২০১৭ সাল থেকে আবারও প্রতিবছর আয়োজন করা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের। ২০২৫ সালের উৎসবটি কিছুটা রাজনৈতিক উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে কাটলেও ২০২৪ সালের উৎসবটি ছিল বেশ জমজমাট। সে বছর বিশ্বখ্যাত ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা মাজিদ মাজিদি মাস্টারক্লাস করান। এই মাস্টারক্লাস মাজিদ মাজিদির মুখোমুখি বসে পরিচালনা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ২২তম সেই উৎসবে আরও উপস্থিত ছিলেন উপমহাদেশের খ্যাতিমান তারকা শর্মিলা ঠাকুর। আরও এসেছিলেন মমতা শঙ্কর, অঞ্জন দত্ত, স্বস্তিকা মুখার্জি প্রমুখ। অঞ্জন দত্ত ও মমতা শঙ্করের সঙ্গে অনেক স্মৃতি জমা হয়েছে আমার, ডিফের কল্যাণে।

তো দীর্ঘ সময় ধরে উৎসবটি যে সাফল্য ধরে রেখেছে, তার পেছনের কান্ডারি নিঃসন্দেহে আহমেদ মুজতবা জামাল। বলার অপেক্ষা রাখে না, এমন একটি উৎসব এত বছর ধরে করা যাচ্ছে, তার কারণ অবশ্যই দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও শিল্পপতিরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর বলতে হয় উৎসবের শক্তিশালী কর্মিবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কথা। তারা দিন–রাত পরিশ্রম করে বলেই একটি উৎসব সব সময় সাফল্যের তীরে এসে ভেড়ে। অন্য দেশের মতো সরকারের নির্দিষ্ট কোনো তহবিল বরাদ্দ নেই, নেই কোনো নির্দিষ্ট কোনো ভবন, নেই চলচ্চিত্র কেন্দ্র, অর্থসহায়তা আসবে তেমন কোনো নিশ্চিত উৎস নেই, তারপরও প্রতিবছর উৎসবটি সমান জৌলুশ নিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তার একমাত্র কারণ সংশ্লিষ্ট সবার ভালোবাসা ও আত্মনিয়োগ।

ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের কয়েকটি নিয়মিত বিভাগ রয়েছে: রেট্রোস্পেকটিভ, সিনেমা অব দ্য ওয়ার্ল্ড, এশিয়ান সিনেমা, চিলড্রেন ফিল্ম, বাংলাদেশ প্যানোরামা, স্পিরিচুয়াল সেকশন, উইমেন ফিল্মমেকার সেকশন, শর্ট অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম সেকশন। এসব বিভাগে প্রতিবছর দুই-আড়াই শ ছবি প্রদর্শিত হয়। ছবি দেখানো ছাড়াও ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আরও অনেক সমান্তরাল অনুষ্ঠান দিয়ে গোটা আয়োজনকে করে তোলে জমজমাট। যেমন উৎসবের অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে শুরু হয় ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন উইমেন ইন সিনেমা। সে বছর ১০ ও ১১ জানুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট হলে দুই দিনব্যাপী সম্মেলনে যৌথভাবে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আফগান নির্মাতা সারা কারিমি এবং পর্তুগিজ অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতা ফ্রান্সিসকো ভেরেস মাশাদো। ঘোষণাপত্রে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণের বিপরীতে চলচ্চিত্রে নারীর অবস্থানকে আরও মর্যাদাপূর্ণ করার আহ্বান জানানো হয়। চলচ্চিত্রে নারীবিষয়ক সম্মেলনের প্রথম আসরে অংশ নিয়েছিলেন অস্ট্রেলীয় নির্মাতা রবিন হুগান, ডাচ নির্মাতা ক্লেমেনটাইন এডারভিন, ইন্দোনেশিয়ার নির্মাতা নুরকুরনিয়াতি আইশা দেউয়ি, নরওয়ের ফিল্ম প্রোগ্রামার গিদা ভেলভিন মিকলাবুস্ট, সলিমুল্লাহ খান, মফিদুল হক, খুশী কবির, শামীম আখতার, কাবেরী গায়েন, ফৌজিয়া খান, সামিয়া জামান ও শবনম ফেরদৌসি। চলচ্চিত্রে নারীদের অংশগ্রহণ, চিত্রায়ণ ও ভূমিকা নিয়ে এই সম্মেলন ২০১৪ সাল থেকে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। এযাবৎকালে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে নিজ নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল নারীরা গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ পড়েছেন ও বক্তব্য দিয়েছেন।

২০১৪ সালে চলচ্চিত্রে নারীবিষয়ক প্রথম সেমিনারে সলিমুল্লাহ খান ও দেশের বাইরে থেকে আসা অতিথি বক্তা।
ছবি: উৎসব কর্তৃপক্ষ

উৎসবের আরও একটি আকর্ষণ চিত্রনাট্য নিয়ে কর্মশালা ও প্রতিযোগিতা। দক্ষিণ এশিয়ার নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজকদের জন্য উৎসবে অনুষ্ঠিত হয় স্ক্রিনপ্লে ল্যাব, যার নাম ‘ওয়েস্ট মিটস ইস্ট’। এখানে চিত্রনাট্য জমা পড়ার পর বাছাইকৃত সেরা ১০ চিত্রনাট্য নিয়ে উৎসব চলাকালে কাজ করা হয়। চিত্রনাট্য–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাওয়াত দিয়ে আনা হয় ঢাকায়, এরপর অভিজ্ঞ মেন্টরদের দিয়ে চলে চিত্রনাট্য উন্নয়নের কাজ। এরপর ঘোষণা করা হয় সেরা তিন চিত্রনাট্যের নাম। যে চিত্রনাট্য প্রথম থেকে তৃতীয় হয়, সেটিকে পর্যায়ক্রমে দেওয়া হয় পাঁচ, তিন ও দুই লাখ টাকার অর্থ পুরস্কার। চিত্রনাট্য নিয়ে এ আয়োজন শুরু হয় ২০২২ সালে। উৎসবে নিয়মিত এ আয়োজন থাকলেও ২০২৫ সালে অর্থসংকটের কারণে এটি সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল।

স্ক্রিনপ্লে ল্যাব ছাড়াও উৎসবের আরেকটি নিয়মিত আয়োজন মাস্টারক্লাস শুরু হয় ২০২৩ সালে। স্বনামখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, পরিবেশক, সিনেমাটোগ্রাফার, ফিল্ম ক্রিটিকরা বিভিন্ন সময়ে মাস্টারক্লাসে নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছেন। উৎসবের এ আয়োজন নিয়ে শুরু থেকেই তরুণদের ভেতর আগ্রহ–উদ্দীপনা লক্ষ করা গেছে। তাঁরা সারা দিনব্যাপী এই মাস্টারক্লাস করেন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ পান। নিজেদের মতো প্রশ্ন করে জেনে নেন তাঁদের উত্তর।

নানা ধরনের আয়োজনের ভেতর দিয়ে উৎসব যেমনটা হয়, ঢাকা আন্তর্জাতিক উৎসব তেমনই এক আয়োজন। এটা ঠিক, ইউরোপ বা আমেরিকার মতো ব্যাপকতা এ উৎসবের নেই। কেন নেই, সেটা আগেও বলেছি, যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবই এর মূল কারণ। তারপরও প্রতিবছর মানুষের ভালোবাসা নিয়ে যেভাবে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তাতে শুধু দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গন নয়, আমি মনে করি, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হচ্ছে। কারণ, উৎসবে আসা নানান দেশের মানুষগুলো কিন্তু বাংলাদেশের মুখপাত্র হয়ে ফিরে যান। তাঁদের বলা ও লেখায় বারবার উচ্চারিত হয় বাংলাদেশের এ উৎসবের নাম।

তিন দশকের বেশি সময় ধরে চলা এ উৎসবে অজস্র অতিথি ঢাকায় এসেছেন সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে। তাঁদের ভেতর উল্লেখযোগ্য হলেন ইরানের চলচ্চিত্রকার মাজিদ মাজিদি, জাফর পানাহি, পুরান ডেরাকশান দে, তাহমিনা মিলানি, মানিজে হেকমত, রাসুল সাদরেমিলি, ফাতেমে মির মোতামাদেরিয়া প্রমুখ। শ্রীলঙ্কার প্রসন্ন ভিতানাগে, সোমারত্নে দিশানায়েকে প্রমুখ। চলচ্চিত্র সমালোচকদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের ডেরেক ম্যালকম এবং জার্মানির ক্লাউস এডারের নাম বলতেই হয়। ভারতের নির্মাতা আদুর গোপালাকৃষ্ণান, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অভিনয়শিল্পী শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন, মমতা শঙ্কর, অঞ্জন দত্ত, সব্যসাচী চক্রবর্তী, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, শ্রীলেখা মিত্র, স্বস্তিকা মুখার্জি প্রমুখ। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রোগ্রামারদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সিডনি লেভিন, কানাডার হানাহ ফিশার, দক্ষিণ কোরিয়ার কিম জে সিউক, নরওয়ের গিদা মিকলাভুস্ট, ভারতের মীনাক্ষী শেড্ডি উল্লেখযোগ্য।

দ্বাবিংশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপনী দিনে মঞ্চে ইরানের প্রখ্যাত পরিচালক মাজিদ মাজিদি, সঙ্গে উৎসব পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল।
ছবি: উৎসব কর্তৃপক্ষ

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এক অবিচ্ছেদ্য নাম। দেশের এমন কোনো সংস্কৃতিজন নেই, যাঁরা জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এ উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হননি। দর্শক হিসেবে এলেও এসেছেন উৎসবে। যত দিন যাচ্ছে, ডিফ তত বেশি গুরুত্ব নিয়ে বিস্তৃত হচ্ছে আমাদের চলচ্চিত্রচর্চা ও চলচ্চিত্রবিষয়ক ভাবনায়। এটা সম্ভব হচ্ছে ডিফের সক্রিয়তার কারণেই। এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে, যথাসময়ে আমরা এর শতবর্ষ উদ্‌যাপন করব, সেই প্রত্যাশা করি।