কীভাবে এল ঈদসালামি

ঈদসালামি আর ঈদ–উৎসব একই সূত্রে গাঁথা। মডেল: কাউসার আহমেদ ও ভুবন গগন
ছবি: কবির হোসেন

হিন্দি ভাষার জনপ্রিয় লেখক মুনশি প্রেমচাঁদ ‘ঈদগাহ’ নামে একটি গল্প লিখেছেন। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র এতিম বালক হামিদ ও তার দাদি আমেনা। আমেনা ঈদের দিন খাবার কেনার জন্য হামিদকে ৩ পয়সা উপহার দেয়। কিন্তু হামিদ ওই ৩ পয়সা দিয়ে খাবারের পরিবর্তে একটি চিমটা সংগ্রহ করে। বাড়ি ফিরে আমেনার হাতে চিমটাটি তুলে দিতেই সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘ওরে ও হতভাগা, খাবারের জন্য এই কটা পয়সা দিয়েছি, কে তোকে চিমটা কিনতে বলল!’ হামিদ নমিত কণ্ঠে বলে, ‘রুটি সেঁকতে গিয়ে রোজ তোমার হাত পুড়ে যায়, চিমটা দিয়ে রুটি সেঁকলে আর হাত পুড়বে না, এ জন্যই তো এটা কিনে আনলাম।’

ঈদি বা ঈদসালামির প্রসঙ্গ উঠলে এই মর্মস্পর্শী গল্পটির কথা উল্লেখ না করে পারা যায় না। যাঁদের জীবনের সঙ্গে এই হৃদ্যতাপূর্ণ উপহারের স্পর্শ লেগে আছে, তাঁরা স্বভাবতই স্মৃতিকথনের কালে নস্টালজিক হয়ে পড়েন।

শুরুর কথা

ঈদসালামির সূচনাকাল সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে কতিপয় ইতিহাসবিদের মতে, দশম শতাব্দীতে ফাতিমীয় খিলাফতের যুগে মিসরে সালামি প্রথার সূচনা ঘটে। এ সময় ঈদের দিন বড়রা ছোটদের হাতে কিছু পরিমাণ পয়সা তুলে দিতেন। এই প্রথা তখন ‘ঈদি’, ‘হাদিয়া’ প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। ক্রমে অটোমান সাম্রাজ্য ও আরবেও ঈদি বিনিময়ের রীতি সম্প্রসারিত হয়। কেবল নগদ অর্থ নয়, রুচিভেদে কেউ কেউ নতুন কাপড়, মিষ্টিও ঈদির তালিকায় যুক্ত করেন।

নবাব-বাদশাহরা ঈদ করতেন, তবে তা সীমিত ছিল অভিজাত উচ্চবিত্তের মধ্যে, উৎসব হিসেবে ঈদের তাৎপর্য জনসাধারণের নাগালের বাইরে ছিল।

বাংলায় ঈদসালামি

এই ভূখণ্ডে ঈদ–উৎসবের পরিসর খুবই সমাকীর্ণ। এর পেছনে রয়েছে দুটি কারণ: এক. গ্রামবাংলার মুসলমানরা ছিলেন দরিদ্র; দুই. মুসলমানের মধ্যে স্বতন্ত্র কমিউনিটির বোধ তখনো প্রবল হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে একটি সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সহজ ছিল না। নবাব-বাদশাহরা ঈদ করতেন, তবে তা সীমিত ছিল অভিজাত উচ্চবিত্তের মধ্যে, উৎসব হিসেবে ঈদের তাৎপর্য জনসাধারণের নাগালের বাইরে ছিল। তবে উনিশ শতক ধরে চলা ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে গ্রামীণ ও নগরজীবনের উৎসবে নতুনত্বের ছোঁয়া লাগে। আর বিশ শতকের চতুর্থ দশক থেকেই ঈদ–উৎসব সর্বব্যাপী ছড়িয়ে যেতে শুরু করে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর বাংলাদেশের উৎসব (১৯৯৪) বইয়ে লিখেছেন, বাংলাদেশের ঈদ–উৎসবের বয়স বড়জোর ৪০ থেকে ৫০ বছর। তিনি এটাও বলেছেন, ঢাকা, কলকাতা প্রভৃতি শহরে নাচ, গান ও মিছিলের সমন্বয়ে ঈদ উদ্‌যাপনের চিত্র পাওয়া গেলেও গ্রামবাংলার তেমন উল্লেখযোগ্য খবর পাওয়া যায় না।

লেখক–সাহিত্যিকদের স্মৃতিকথায়

তবে আবুল মনসুর আহমদ, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, আবু রুশদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সাঈদ আহমদ, কাইয়ুম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, শামসুর রাহমান, সৈয়দ মোস্তফা আলী, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম প্রমুখের আত্মজৈবনিক রচনায় ঈদ উদ্‌যাপনের বিন্দুবিসর্গ উঠে এসেছে। অতিসম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত কারাগারের রোজনামচা বইয়েও ঈদের স্মৃতিকণা স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া কাজী নজরুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, সুফিয়া কামাল, মুর্তজা বশীর, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক তাঁদের গান, কবিতা ও গল্পে ঈদের নানা দিক তুলে এনেছেন। কিন্তু এসবের কোথাও ঈদসালামির প্রসঙ্গ সেভাবে আসেনি। ফলত বাংলায় ঈদসালামির সুনির্দিষ্ট উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। ঢাকাবিষয়ক গবেষক দেলওয়ার হাসান নওয়াবাহার–ই মুর্শিদ কুলি খান বইয়ের লেখক আজাদ হোসেনী বিলগ্রামীর লেখার বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, ‘নওয়াব সুজাউদ্দিনের অধীন মুর্শিদ কুলি খান (১৭০৪-২৫) ঈদের দিনে ঢাকার দুর্গ থেকে ঈদগাহর ময়দান পর্যন্ত এক ক্রোশ পথে প্রচুর পরিমাণ টাকাকড়ি ছড়িয়ে দিতেন।’ শামসুজ্জামান খানের মতে, এই বর্ণাঢ্য আয়োজনে সনাতনদের উৎসবের একটি প্রভাব পড়েছে বলে মনে করা যেতে পারে।

সুফিয়া কামাল তাঁর একালে আমাদের কাল স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘আমলা-কর্মচারী, ডাক্তার-কবিরাজ এঁরা ছিলেন হিন্দু। তাঁদের পালাপার্বণ-পূজায় জমিদারের খরচায়ই উৎসব হতো। ভোজও তাঁরা জমিদারকে দিতেন ‘সম্মানী’ নজরসহ। তাঁদের দেওয়া উপহার পায়েস ‘পরমান্ন’-নাড়ু-মণ্ডা মিষ্টি যে কত খেয়েছি। আবার তাঁদেরও দিতে হতো সম্মানী টাকা। সাহেব, বেগম সাহেবা, ফুফুজান, খালাআম্মা, আপাজান, দুলাভাই সাহেবদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ পেতেন সেলামি বাবদ।’ সুফিয়া কামালের বর্ণিত সালামির বিবরণ বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের। এর কাছাকাছি সময়ের কথা উল্লেখ করে শামসুজ্জামান খান তাঁর বাংলাদেশের উৎসব (২০১৩) বইয়ে লিখেছেন, ‘তখনো ঈদে সেলামির চল হয়নি, তবে বাড়ির কাজের লোক, পাটনি, নাপিত এরা বকশিশ পেত।’

শহর ছাড়িয়ে লোকালয়ে

ঈদসালামি আর ঈদ–উৎসব একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যদিও একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল, কিন্তু জাঁকজমকপূর্ণ ঈদ–উৎসবের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। আশির দশক থেকে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের বিপুল বিস্তার ঘটে। বিদেশের শ্রমবাজারগুলোতে বাংলাদেশের মানুষজন কাজ করতে শুরু করেন। এসব কারণে গ্রাম ও শহরের মধ্যকার আর্থিক ব্যবধান ঘুচতে থাকে। এই আর্থিক সচ্ছলতার ভিত্তিতেই গত চার দশকে বাংলাদেশের ঈদ–উৎসব যেমন ব্যাপকতা পেয়েছে, তেমনি সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। গ্রামের যে মেয়েটি পোশাকশিল্পে কাজ করে, সে ঈদের ছুটিতে বাড়ি যায় আপনজনদের জন্য হরেক রকমের উপহার নিয়ে। প্রবাসী ছেলেটিও বিপুল পরিমাণ অর্থ জমিয়ে দেশে ফেরে প্রিয়জনদের সঙ্গে সাড়ম্বরে ঈদ করার জন্য। এরাই খুশির আমেজে ঈদের দিন ছোটদের হাতে তুলে দেয় কড়কড়ে নতুন টাকা। আর এভাবেই সালামি শহর থেকে পৌঁছে গেছে লোকালয়ে, উচ্চশ্রেণি থেকে সাধারণ্যে।

ঈদ–উৎসব এখন বিচিত্র ও বহুমুখী উপাদানে সমৃদ্ধ হয়েছে। এতে যুক্ত হয়েছে বলিহারি বাণিজ্যিক ও পণ্যগত বিষয়। আর তাই ঈদসালামিতেও লেগেছে নবায়নের ছটা। পোশাক, খাবার, অর্থের সীমানা পেরিয়ে ঈদ উপহারে যুক্ত হয়েছে গাড়ি, ফ্রিজ, স্মার্টফোন, আইফোন, ল্যাপটপ ও বই। ফেসবুকের পর্দায় ভেসে ওঠা ‘ঈদের চাঁদ আকাশে, সালামি দিন বিকাশে’, ‘ঈদের খুশি ঘরে ঘরে, সালামি দিন বিকাশ করে’ এসব বিজ্ঞাপনী স্লোগান জানান দেয়, ঈদসালামি এখন ডিজিটাল ঈদসালামিতে রূপান্তরিত হয়েছে। অনলাইন বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোও পাঠকদের টানতে ঈদের মৌসুমে বিশেষ ছাড়ে বই বিক্রির চেষ্টা করে। তাদের বিজ্ঞাপনেও শোভিত থাকে ‘সালামি হিসেবে বইয়ের তুলনা নেই’, ‘প্রিয়জনকে সালামি হিসেবে বই দিন’ প্রভৃতি। এদিকে নিত্যপণ্যের বাজার চাঙা করতে ঈদ উপলক্ষে সালামিবিষয়ক স্মৃতি ও ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার খবরও পাওয়া যায়। এসব আয়োজনে বিজয়ীদের সালামি হিসেবে দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের অর্থ, ভ্রমণের বিমান টিকিট, ফ্ল্যাট বাড়িসহ নানা রকম ঘরোয়া জিনিস। বলা বাহুল্য, বাণিজ্যিক স্বার্থ থাকলেও সালামি বিষয়টিকে জনপ্রিয়করণের পেছনে এসব বাণিজ্যিক প্রকল্পের জোরালো ভূমিকা রয়েছে।

শেষ কথা

ঈদ–উৎসবের আনন্দ সব সময় সবার কাছে সমান হয়ে আসে না। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় যেমনটা পাওয়া যায়, ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/ মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’ অনেকের কাছে ঈদ ভালো খাওয়া, কাপড় পরা নয়, সালামি তো নয়ই। ফলত ঈদ–উৎসবের মতো সালামিও সর্বাঙ্গীণ হয়ে উঠতে পারেনি। যেদিন বিত্তবণ্টনে সাম্যাবস্থা আসবে, সেদিনই ঈদ–উৎসব যেমন সর্বাঙ্গীণ রূপ লাভ করবে, তেমন ঈদসালামিতেও আসবে নতুন সমারোহ।