একমাত্র অক্সিজেন ছাড়া পৃথিবী তাঁদের কিছুই দিত না!

আজ আন্তর্জাতিক দাস–বাণিজ্য স্মরণ ও রদ দিবস। এই দিনে জানা যাক একসময় কেমন ছিল ক্রীতদাসদের জীবনসংগ্রাম।

শিল্পীর তুলিতে দাসদের মানবেতর জীবন

নারী, শিশুসহ কিছু মানবসন্তান কিনে নিয়ে যাচ্ছে অন্য আরেক মানবসন্তান—ভাবতেই এখন কেমন লাগছে না? কিন্তু এ পৃথিবীতে একসময় ছিল মানুষ কেনাবেচার রমরমা ব্যবসা। এখন বিশ্ব যখন দাস–বাণিজ্য ও এর বিলুপ্তির স্মরণে দিবস পালন করতে একত্র হয়, তখন বারবারই জানতে ইচ্ছা করে, কেমন ছিল ক্রীতদাস হিসেবে কিনে নিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জীবনসংগ্রাম? পৃথিবী থেকে তাঁরা অক্সিজেন ছাড়া বিশেষ কিছু পেয়েছিলেন কি?

ট্রান্স–আটলান্টিক ক্রীতদাস বাণিজ্য—মানব নিষ্ঠুরতার এ অধ্যায় শুরু হয়েছিল ষষ্ঠদশ শতাব্দীর সময়কালে। এ সময় কিছু অঞ্চলে ভূমির তুলনায় মানুষের সংখ্যা ছিল বেশি; তাঁরা না খেতে পেরে মারা যাচ্ছিলেন। এরপর কাজ দেওয়ার নাম করে শুরু হলো তাঁদের কিনে নেওয়া এবং অত্যাচার। অভাবগ্রস্ত, নিঃস্ব ও বিধবারা অনেক ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় শেষ গন্তব্য হিসেবে চলে যেতেন ওই সব ক্রীতদাস বিক্রির বাজারে। আইনগত ও পেশাগতভাবে দাস-দাসী এবং তাঁদের সন্তানেরা মালিকদের সম্পত্তিরূপে পৃথিবীতে বন্দী হিসেবে বেঁচে থাকতেন।

দাসদের মুক্তির ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছিলেন আব্রাহাম লিংকন
শিল্পীর আঁকা চিত্র

প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বন্দী রাখা হতো, নিজের ভূমি ফেলে নিয়ে যাওয়া হতো অন্যত্র। ট্রান্স–আটলান্টিক ক্রীতদাস বাণিজ্য প্রাথমিকভাবে প্রভাবিত করেছিল আফ্রিকান দেশগুলোকে, যেখানে লাখ লাখ ব্যক্তিকে জোরপূর্বক বন্দী করা হয়েছিল, দাস বানানো হয়েছিল এবং আমেরিকা ও বিশ্বের অন্যান্য অংশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যদিও আফ্রিকান দেশ প্রধানত দাস–বাণিজ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এমনকি অন্য কিছু অঞ্চলও ইউরোপীয় দাস ব্যবসায়ীদের হাতে আটকে পড়েছিল।

ইউরোপে উৎপাদিত পণ্য আফ্রিকায় বিক্রি করা হতো দাসদের বিনিময়ে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় দাসদের শ্রমে উৎপন্ন চিনি, তুলা, তামাকসহ অন্যান্য অর্থকরী ফসল জাহাজে করে ইউরোপে যেত। ষষ্ঠদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে সাড়ে ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে ইউরোপীয় দাস ব্যবসায়ীরা প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ আফ্রিকানকে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় নিয়ে যান। ওই সময়ে কমপক্ষে ১৫ লাখ আফ্রিকান শুধু যাত্রাপথেই প্রাণ হারান। পরে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছানোর পর সেখানকার অমানবিক পরিবেশে ও পরিশ্রমে মারা যান আরও বহু আফ্রিকান।

আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল বরাবর দেশগুলোকে প্রায়ই ‘স্লেভ কোস্ট’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সেনেগাল, গাম্বিয়া, গিনি, সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, আইভরি কোস্ট, ঘানা, টোগো, বেনিন ও নাইজেরিয়া এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখান থেকে ক্রীতদাসদের বন্দী অবস্থায় আমেরিকায় পরিবহন করা হয়েছিল। এই দাস–বাণিজ্য আফ্রিকাজুড়ে তাঁদের সামাজিক বিকাশ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে ব্যাহত করেছিল।

আমাদের উপমহাদেশের অবস্থাও ছিল প্রায় একই রকম। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দাসই হয় দুর্ভিক্ষের কারণে নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছিলেন অথবা ছিলেন নিচু শ্রেণির কিংবা হারিয়ে যাওয়া মানুষ। হিন্দু সমাজে টাকা দিয়ে কেনা দাসদের দাস/দাসী বলা হতো। মুসলিম সমাজে পুরুষ ক্রীতদাসদের নাম ছিল ‘গোলাম’ আর মেয়ে ক্রীতদাসের পরিচয় ছিল ‘বাঁদি’। আমাদের দেশের সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম আর ঢাকা অঞ্চলে ১৮৩৯ সালের আইন কমিশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ওখানকার এক-পঞ্চমাংশ মানুষই ছিলেন ক্রীতদাস।
আফ্রিকায় ক্রীতদাসেরা
ছবি: সংগৃহীত

এমনকি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো স্থানীয় গতিশীলতা ও শক্তিকাঠামোকে প্রভাবিত করে ক্রীতদাসদের বন্দী ও পরিবহনের সুবিধার্থে আফ্রিকান উপকূলে দুর্গ ও বাণিজ্য পোস্ট স্থাপন করেছিল। ট্রান্স–আটলান্টিক ক্রীতদাস বাণিজ্যের প্রভাব আজও অনুভূত হয় এই দেশগুলোর বংশধরদের কিংবা সাধারণ মানুষের মধ্যে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই মানুষেরা এখনো সামাজিক, আর্থিক ও নাগরিক অন্যান্য সুবিধা থেকে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে রয়েছে এত বছর পরও।

আমাদের উপমহাদেশের অবস্থাও ছিল প্রায় একই রকম। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দাসই হয় দুর্ভিক্ষের কারণে নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছিলেন অথবা ছিলেন নিচু শ্রেণির কিংবা হারিয়ে যাওয়া মানুষ। হিন্দু সমাজে টাকা দিয়ে কেনা দাসদের দাস/দাসী বলা হতো। মুসলিম সমাজে পুরুষ ক্রীতদাসদের নাম ছিল ‘গোলাম’ আর মেয়ে ক্রীতদাসের পরিচয় ছিল ‘বাঁদি’। আমাদের দেশের সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম আর ঢাকা অঞ্চলে ১৮৩৯ সালের আইন কমিশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ওখানকার এক-পঞ্চমাংশ মানুষই ছিল ক্রীতদাস।

তবে এসব মন খারাপ করা বিষয়ের পাশাপাশি ইতিহাসে শক্তিশালী বিরোধিতার উত্থানও রয়েছে। একটি বৈপ্লবিক আন্দোলন, যা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত দাসপ্রথার পতন হয়েছিল। ১৭৯১ সালের ২২ ও ২৩ আগস্ট বর্তমান হাইতি ও ডমিনিকান রিপাবলিক অঞ্চলে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনে ১৮০৭ সালে ও যুক্তরাষ্ট্রে ১৮০৮ সালে আফ্রিকান দাসদের মুক্তি দেওয়া হয়।

আচমকা মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, ব্যাপারটা তেমন সহজ ছিল না। দাসপ্রথা বিলুপ্তির মহানায়ক আব্রাহাম লিংকন এলেন এবং বললেন, ‘গণতন্ত্র হলো মানুষের সরকার, মানুষের দ্বারা সরকার, মানুষের জন্য সরকার।’ ব্যস, দুই মিনিটেই বদলে গেল গণতন্ত্রের সংজ্ঞা। ক্রীতদাসেরা আবেগে আপ্লুত হলো।

আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালের কোন এক শীতের সকালে সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে বিল উত্থাপন করলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৬৫ সালে বিলটি পাস হয় এবং ডিসেম্বরে তা অনুমোদন করা হয়। যদিও আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তাঁকেও হত্যা করা হয়।

দাসদের অত্যাচার করা হতো এভাবেই
শিল্পীর আঁকা চিত্র

উইলিয়াম উইলবারফোর্স, হ্যারিয়েট বিচার স্টো এবং আব্রাহাম লিংকনের মতো ব্যক্তিত্বরা প্রলয়ংকরী সাহসের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে আজ আমরা দাসপ্রথামুক্ত দিবস পালন করি। তাঁদের ক্রিয়াকলাপ, রাজনৈতিক সক্রিয়তা বা শক্তিশালী সাহিত্য ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সে সময় বিশ্ব আলোড়িত হয়েছিল।

দাসত্ববিরোধী আন্দোলনের উত্তরাধিকার ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, এর ঢেউ আধুনিক সময়েও প্রসারিত হয়েছে। নাগরিক অধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার ও লিঙ্গসমতার যেসব আন্দোলন হচ্ছে, এর পেছনে দাসত্ববিরোধী আন্দোলনের যে অনুপ্রেরণা রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। লেখক ফ্রেডরিক ডগলাস বলেছেন, ‘যখনই আমরা অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের আওয়াজ তুলি, তখনই পরিবর্তন সম্ভব হয়।’