বার্মায় শিকারে গিয়ে যেসব মজার কাণ্ড করেছিলেন শরৎচন্দ্র

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ছবি: সংগৃহীত
আজ ১৫ সেপ্টেম্বর অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণবার্ষিকী

অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্রহ্মদেশে (বার্মা, পরে মিয়ানমার) গিয়েছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। ১৯০৩ সালে যখন জাহাজে চড়ে রেঙ্গুনে যান, তখন তিনি ২৭ বছরের যুবক। আর ১৯১৬ সালে যখন কলকাতায় ফিরে আসেন, তখন তাঁর বয়স ৪০। ব্রহ্মদেশে তাঁর এই ১৩টি বছর ছিল ‘গভীর রহস্যে পূর্ণ’।

১৯৩৮ সালে ৬২ বছর বয়সে শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর অনেকের কাছেই তাঁর বর্মি জীবন অজানাই ছিল। পুরো ঘটনার নাড়িনক্ষত্র জানতেন কেবল একজন। তিনি গিরীন্দ্রনাথ সরকার, শরৎচন্দ্রের বিশেষ বন্ধু। তিনটি দশক ব্রহ্মদেশে কাটিয়েছিলেন এই ভূপর্যটক। শরৎচন্দ্রের বন্ধু ও কাছের লোকেরা গিরীন্দ্রনাথকে অনবরত চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন পুরো কাহিনি লেখার জন্য। অবশেষে শরৎচন্দ্রের এক শোকসভায় প্রবীণ সাহিত্যিক সরোজনাথ ঘোষ ঘোষণা করলেন, ‘যত দিন না শরৎচন্দ্রের ব্রহ্মপ্রবাসের কাহিনি বাহির হইবে, তত দিন শরৎচন্দ্রের জীবনচরিত অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে।’ মূলত এরপরই লেখা শুরু করলেন গিরীন্দ্রনাথ সরকার। আর ‘ব্রহ্মদেশে শরৎচন্দ্র’ নামের এই বই বেরোল চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে। ৪০৮ পৃষ্ঠার এ বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে শরৎচন্দ্রের শিকার সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে।

গিরীন্দ্রনাথ গেলেন পেগুতে, এক স্বজনের বাড়িতে। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন শরৎচন্দ্রকে। শরৎ তখন পুরোপুরি বেকার। জায়গাটি রেঙ্গুন থেকে ৪৫ মাইল দূরত্বে, ট্রেনে তিন ঘণ্টার পথ।

মানুষের হাতে যখন কাজ থাকে না, তখন মাছ ধরার চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই। তবে একা এ কাজে আনন্দ নেই। লাগে একজন সঙ্গী। গিরীন্দ্রনাথও শরৎচন্দ্রকে নিয়ে পেগুর রসুল বক্স নামের একজনের পুষ্করিণীতে মাছ ধরতে গেলেন। কিন্তু এ কাজে শরৎচন্দ্রের ‘ঝোঁক যতটা ছিল, দক্ষতা ততটা ছিল না’। বড় মাছ ধরতে হলে ফাতনার দিকে নিবিড় দৃষ্টি রাখার জন্য ধৈর্যের প্রয়োজন। কিন্তু শরৎচন্দ্রের তা ছিল না। গিরীন্দ্রনাথ অগত্যা তাঁর হাতে একটি ছোট ছিপ ধরিয়ে দিলেন, যাতে পুঁটিজাতীয় মাছ ধরা যায়। শরৎচন্দ্র অল্প সময়ের বেশ কিছু পুঁটি মাছ ধরে টিনের মধ্যে জমা করলেন।

এমন সময় দুই সুন্দরী বর্মিনী এলেন। তাঁরা জানতে চাইলেন, ‘আপনি কি মাছ বিক্রি করবেন?’ শরৎ তো তাঁদের ভাষা বোঝেন না। অবশেষে ২০টি পুঁটি মাছ বিক্রি করে ১০ পয়সা পেলেন তিনি। পয়সাগুলো হাতে নিয়ে বললেন, একপ্যাকেট সিগারেট হবে এখন।

কিন্তু শরতের মনে আক্ষেপ রয়ে গেল। তিনি চেয়েছিলেন বর্মি তরুণীদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে। তখন গিরীন্দ্রনাথ বললেন, ঠাট্টা-তামাশা করলে ওরা ফনানে-ছা করে দেবে। ফনানে-ছা মানে কী? শরৎ জানতে চাইলেন। গিরীন্দ্রনাথ বললেন, এর মানে হলো জুতাপেটা!

ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ১৯১৪
ছবি: সংগৃহীত

পরদিন বিকেলে আবার রসুল বক্সের পুকুরে মাছ ধরতে গেলেন শরৎচন্দ্র ও গিরীন্দ্রনাথ। দেখলেন এক ইংরেজ ভদ্রলোক মাছ ধরতে এসেছেন। তাঁর আয়োজন ভালো। বিলেতি ছিপ, বন্দুক, একজন বয়, স্যুটকেস, ওয়াটারপ্রুফ কোট, টিফিন বক্স, হুইস্কির বোতলসহ বহু সরঞ্জাম। গিরীন্দ্র ও শরৎ পুকুরের অপর পাশে বসলেন। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন একটি বড় মাছ ধরলেন শরৎ, ওজন প্রায় কুড়ি পাউন্ড। আর ইংরেজ ভদ্রলোক কিছুই পেলেন না। ইংরেজ ভদ্রলোক সকালের ট্রেনে রেঙ্গুন থেকে মাছ ধরতে এই পেগুতে এসেছিলেন। বললেন, ‘আজ যদি মাছ না নিয়ে ফিরি, মেমসাহেব আমাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না। কারণ, এত দূরে টাকা খরচ করে আসতে মানা করেছিল।’

বেচারার অবস্থা দেখে শরৎচন্দ্র বললেন, ‘আপনি আমার মাছটি নিয়ে যান।’ তিনি প্রথমে নিতে চাইলেন না। বললেন, ‘আপনারা আমার সঙ্গে রেঙ্গুনে চলুন। এত বড় মাছটি আমি ধরেছি, মেমসাহেবকে দেখিয়ে আবার আপনাদের ফেরত দিয়ে দেব।’ তখন শরৎ ও গিরীন্দ্র বললেন, তিন দিনের আগে তাঁদের রেঙ্গুনে ফেরার ইচ্ছা নেই। তখন ইংরেজ সাহেব শরৎকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মাছটি নিয়ে গেলেন। আর তাঁর কার্ড দিয়ে গেলেন। সেখানে নাম লেখা—চার্লস এ কোনস, সচিব, বার্মা চেম্বার অব কমার্স, রেঙ্গুন।

মাছ ধরার শখ মিটলে একদিন শরৎচন্দ্র নিকটবর্তী জঙ্গলে গেলেন বন্দুক হাতে নিয়ে হরিণ শিকার করতে—‘পথ প্রায় জনশূন্য। দিনের বেলাতে উদাসভাব মনে আসে। দুই দিকে সারি সারি ঘন সেগুনবন ছাড়াইয়া একেবারে খুব ঘন কাটা ঝোপের মধ্যে প্রবেশ করিলাম।’ হামাগুড়ি দিয়ে ঝোপের মধ্যে প্রবেশ করতে গিয়ে দুজনের শরীরই কাঁটায় রক্তাক্ত হলো। হঠাৎ পায়ের কাছে ফোঁস শব্দ শুনে দেখলেন, প্রকাণ্ড এক গোখরা সাপ দুটি পাথরের ফাঁক দিয়ে ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে। তাড়াতাড়ি বন্দুকের বাঁট দিয়ে সাপের মাথায় আঘাত করে ‘শরৎদা, পালাও’ বলে দৌড় দিলেন গিরীন্দ্র। শরৎচন্দ্রও ‘কই, কী সাপ’ বলে চিৎকার করতে করতে দৌড় দিলেন। বাইরে নিরাপদ স্থানে এসে শরৎচন্দ্র বললেন, ‘সাপটি কী জাতের, ভালো করে দেখলে হতো।’ গিরীন্দ্র বললেন, ‘না দেখেই তোমার ধাত ছেড়ে গিয়েছে। দেখলে কি আর তোমায় খুঁজে পাওয়া যেত?’

এমন সময় পেছনে ফিরে দেখলেন, তলোয়ারের মতো বড় দা হাতে এক বর্মি রাখাল বালক দাঁড়িয়ে আছে। সে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি যদি সাপটা ধরে আনিয়া দিতে পারি, কত বকশিশ দেবেন?’ রফা হলো, তাকে পাঁচ টাকা দেওয়া হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে ছেলেটি প্রকাণ্ড গোখরা সাপকে ধরে এনে হাজির করল। সাপটি ‘কুণ্ডলী পাকাইয়া তাহার সমস্ত হাতটি জড়িয়ে ছিল।’ শরৎচন্দ্রের ধারণাই ছিল না, ছেলেটা কাজটা করতে পারবে। এ কারণেই তিনি পাঁচ টাকা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। অবশেষে দুই টাকা দণ্ড দিয়ে কোনোমতে রক্ষা পান তাঁরা।

আরেক দিন এই গ্রন্থের লেখক, শরৎচন্দ্র এবং পেগু শহরের বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি দুই দলে বিভক্ত হয়ে শিকারে গেলেন। লেখকের বর্ণনায়, ‘শরৎচন্দ্র একা বন্দুক ঘাড়ে করে নিয়ে অনেক দূর অগ্রসর হয়ে পড়েছিলেন। দূরে চঞ্চলনেত্র হরিণশিশুর নির্ভয় পদচারণা, আর দূরবর্তী সেগুনবনে দলবদ্ধ বিহঙ্গের মধুর কাকলি। এই সমস্ত মধুর দৃশ্য দেখিতে দেখিতে তিনি স্থান-কাল বিস্মৃত হইয়া একটি গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করিলেন।’

হঠাৎ বন্দুকের গুড়ুম শব্দ শুনে সবাই আগ্রহভরে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, শরৎচন্দ্র একটি গোদা চিল শিকার করে বসে আছেন! পরে জানা গেল, জঙ্গলের মধ্যে অনেকক্ষণ বন্দুক হাতে করে একা বসে থেকে বিরক্ত শরৎ দেখলেন, আকাশে একদল বক উড়ে যাচ্ছে। অমনি তিনি ফায়ার করলেন। মিসফায়ার হয়ে একটি টেলিগ্রাফ পোস্টের ওপর বসে থাকা এই চিলের প্রাণবিয়োগ হলো।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ছবি: সংগৃহীত

সবাই যখন শরৎকে লজ্জা দিচ্ছেন, তখন চিলটির ডানা ধরে ওলটপালট করে শরৎ বললেন, ‘দেখো, এর শরীরে কোনো গুলির চিহ্ন নেই। বন্দুকের ভয়ে বেটা হার্টফেল করেছে।’

ফেরার সময় একটি হরিণশিশু দেখে তার পেছনে খানিকটা দৌড়ালেন শরৎ। ততক্ষণে প্রাণীটি গা ঢাকা দিয়েছে। ফিরে এসে বললেন, সেটা শিয়াল ছিল। অমনি সবাই হো হো করে হেসে দিলেন। হাসির কারণ শরৎ জানতেন না যে সারা বর্মা দেশে একটিও শিয়াল নেই। রেঙ্গুন চিড়িয়াখানায় আশ্চর্য দর্শনীয় বস্তুরূপে একটি শৃগাল থাকতে পারে!