এলভিস প্রিসলির গান কেন শুনছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম

১৭ আগস্ট ছিল কিংবদন্তি সংগীত তারকা এলভিস প্রিসলির মৃত্যুদিন। মার্কিন এই সংগীতশিল্পী কেন এত জনপ্রিয়, সে কি কেবল গানের জন্য নাকি তাঁর ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন—সবকিছুতে অভিনবত্বের ছোঁয়া থাকায়?

এলভিস প্রিসলি
ছবি: সংগৃহীত

‘বয়স তখন ছিল পনেরো/ তাই ছিল স্বপ্ন দেখার ব্যারাম/ মাথার ভেতর ছিল এলভিস প্রিসলি/ খাতার ভেতর তোমার নাম’—অঞ্জন দত্তের ‘ম্যারি অ্যান’ গানটি শুনেছেন আর মাথার ভেতরে এই লাইন কয়েকটা গেঁথে যায়নি এমন শ্রোতা পাওয়া যাবে না বললেই চলে। কে এই এলভিস প্রিসলি? কিশোর বয়সের প্রেমে মশগুল অঞ্জনের চেতনায় ধাক্কা দিয়েছিলেন?

পৃথিবীব্যাপী ১৯৫০-৭০ দশকের তরুণ-তরুণীদের চিত্তদোলানো ‘স্বপ্নপুরুষ’ ছিলেন প্রিসলি। ‘কিং অব রক অ্যান্ড রোল’—অবধারিতভাবে যাঁর নামের আগে বসে এই অভিধা। কবীর সুমন, অঞ্জন দত্তদের প্রজন্ম রকের স্বাদ পেয়েছিল প্রিসলির কণ্ঠে। গিটার হাতে মঞ্চে সুদর্শন এক যুবক যখন চমৎকার ব্যারিটোনে গাইছেন, ‘ওয়াইজ মেন সে/ওনলি ফুলস রাস ইন/ বাট আই ক্যান্ট হেল্প ফলিং ইন লাভ উইথ ইউ।’ তাঁর এমন কাঁপানো স্বরের প্রেমে না পড়ে থাকতেই পারবেন না। এভাবে প্রেম নিবেদনই-বা আর কজন করতে পারে! আবার যখন শুনবেন, ‘অ্যাজ দ্য স্নো ফ্লাইস/ অন আ কোল্ড অ্যান্ড গ্রে শিকাগো মর্নিং/ আ পুওর লিটল বেবি চাইল্ড ইজ বর্ন/ ইন দ্য ঘেটো’—শিকাগো শহরে এক সকালে বস্তিতে সদ্যোজাত শিশুটির কান্না আপনার পাথরহৃদয়কেও গলিয়ে দেবে। ‘ঈশ্বর প্রদত্ত’ বলে যে প্রশংসা, প্রিসলি ছিলেন তেমনই, একসঙ্গে আনন্দ ও বেদনায় নীল করে দেওয়ার মতো কণ্ঠই ছিল প্রিসলির।

কণ্ঠে অন্য রকম সুর আর গিটারের উন্মাদনা দিয়েই মাত করেছিলেন এলভিস প্রিসলি
ছবি: সংগৃহীত

কেবল গানে নয়, পারফরম্যান্সের পাশাপাশি বেশ ফ্যাশনসচেতন ছিলেন প্রিসলি। সাধারণ চেকড-ব্ল্যাজার্স, স্লিভ কলার শার্ট, স্ল্যাকস হিসেবে পরিচিত গোড়ালির ওপর থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢোলা প্যান্ট আর পায়ে লোফার্স—এমন পোশাকে কত আইকনিক ছবি যে আছে তাঁর! গানে, পারফরম্যান্সে, ফ্যাশনে পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক মাতিয়ে রেখেছিলেন প্রিসলি। তাঁর সেই প্রভাব কী এখন নেই! প্রিসলি এমন এক ব্যক্তিত্ব, একবিংশ শতকেও সারা বিশ্বে যাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর গান শুনেছে, চুলের মধ্যে চালাতে চেয়েছে প্রিসলির ব্যাকব্রাশ।

শুরুতে যে অঞ্জনের ‘ম্যারি অ্যান’ গানের কথা বললাম, সেই গানেও রয়েছে প্রিসলির ‘রক অ্যান্ড রোলের’ ছাপ। একসময় স্টেজে প্রিসলির কাভার ছিল এখানকার শিল্পীদের নৈমিত্তিক ঘটনা। আমাদেরও একজন এলভিস প্রিসলি ছিলেন—জাফর ইকবাল। মূলত নায়ক হিসেবে পরিচিত হলেও অনেক বিখ্যাত গান উপহার দিয়েছেন তিনি। ষাটের দশকে ‘র‌্যাম্বলিং স্টোন’ ব্যান্ড দলেও গেয়েছেন। ছিলেন ফ্যাশনসচেতন।

প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রভাবিত করে যাওয়া এলভিস প্রিসলি কেন এত জনপ্রিয়? সে কি কেবল গানের জন্য নাকি তাঁর ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন—সবকিছুতে অভিনবত্বের ছোঁয়া থাকায়? সেই আলোচনায় প্রবেশের আগে দেখা যাক তাঁর সময়ের ‘রকজগৎ’ কেমন ছিল।

জাফর ইকবাল ছিলেন ‘আমাদের এলভিস প্রিসলি’
ছবি: সংগৃহীত

এলভিস প্রিসলির জন্ম ১৯৩৫ সালের ৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপিতে। মৃত্যু ১৬ আগস্ট ১৯৭৫। মাঝখানে ৪১ বছরের এক আলো জ্বলমলে জীবন। কিন্তু ছেলেবেলাটা খুব বেশি জ্বলমলে ছিল না তাঁর।

শ্রমিক পরিবারে জন্ম। খুব বেশি সুবিধা পাননি। অভাবের সংসারে চেয়ারকে মাইক্রোফোন বানিয়ে প্রতিভার জানান দেওয়া। সেই প্রতিভা দিয়েই পৃথিবীকে মুগ্ধ করে রেখেছেন এখনো। বৃহত্তম মিসিসিপি নদীর তীরের সন্তান হওয়ায় হয়তো অবাধ বয়ে যাওয়ার মতো গানের গলা পেয়েছিলেন তিনি। বিখ্যাত মার্কিন সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন লিখেছিলেন, ‘মিসিসিপি নদী সব সময় নিজের পথে বয়ে চলে।’ প্রিসলিও ছিলেন তেমন। নিজের পথে চলতে গিয়ে ড্রাগ নেওয়া। তারপর একদিন হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে পরপারে চলে গেলেন।

মিসিসিপিতে নারকীয় দাসপ্রথা শেষ হতে সময় লেগেছিল শত বছরের বেশি। সেই সব কালো দিন দেখেছিলেন প্রিসলি। নিজের সুবিধাবঞ্চিত শৈশবে দেখা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের ওপর নির্যাতনের দৃশ্য নিশ্চয় ছাপ ফেলেছিল তাঁর মনে। এ কারণে প্রিসলির গানে প্রেমের পাশাপাশি ওঠে এসেছে ক্ষুধা, দারিদ্র্যের মতো শব্দগুলো। গানের মাধ্যমে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন সে সময়ের শ্বেতাঙ্গশাসিত সামাজিক রীতিনীতিকে। আর এর হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন একটি গিটার আর কৃষ্ণাঙ্গদের রক্তবাহিত সংগীত ব্লুজ-জ্যাজ থেকে ওঠে আসা ‘রক অ্যন্ড রোল’কে।

বব মার্লেরা যখন পৃথিবীজুড়ে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার নিয়ে কথা বলছিলেন, তার আগেই প্রিসলি স্বপ্ন দেখেছিলেন এক মানবতাবাদী আমেরিকার। জন্মভূমি আমেরিকার ওপর ঈশ্বরের অনুগ্রহ চাইতে গিয়ে ভাতৃত্ববোধের কথাও বলেছেন। ‘আ বয় লাইক মি, আ গার্ল লাইক ইউ’, ‘সাসপিশাস মাইন্ড’—এর মতো গান দিয়ে সে সময়ের টিনএজারদের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন প্রিসলি।

রক অ্যান্ড রোল আসলে অনেক জনরার সংমিশ্রণে তৈরি আরেকটি মিউজিক জনরা। মূলত আফ্রো-আফ্রিকান সংগীত জ্যাজ, ব্লুজ, রিদম, বুগি-উগি, গস্পেল, কান্ট্রি মিউজিকের সমন্বয়ে যাঁর সূচনা।

১৯২০-৩০ দশকের দিকে ব্লুজ-কান্ট্রি মিউজিক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। আর রক অ্যান্ড রোল নামকরণই হয় পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝিতে। অবশ্য এর পেছনে বড় কৃতিত্ব দিতে হবে বিলি হ্যালিকে। তাঁর গানের দলই প্রথম বিশ্বকে চেনায় এই গানের জনরাকে। এর চূড়ান্ত জনপ্রিয়তা আসে প্রিসলির কণ্ঠে।

বায়ুরুদ্ধ-অন্ধকার কয়লা খনিতে বা সারা দিনের ফসল তোলার ক্লান্তি ঝাড়তে অসহায় দাস কৃষ্ণাঙ্গ মানুষগুলো একটু সুযোগ পেলেই নিজেদের সুখ–দুঃখের গান রচনা করে বসে যেতেন গিটার হাতে। সেসব গানগুলোর কথা ছিল সহজ-সরল, প্রতিদিনকার জীবনের। তাঁদের ঘাম ও রক্তমাখা ব্লুজ ও কষ্টের জীবনগাথা ছয় তারের জাদুতে পৃথিবীব্যাপী জানিয়ে দিয়েছিলেন বি বি কিং। গানের জগতের প্রবেশের সময় প্রিসলিকে যা খুব প্রভাবিত করেছিল। ‘দ্য গডমাদার অব রক অ্যান্ড রোল’ হিসেবে পরিচিত সিস্টার রোসেত্তা থার্পে, লিটল রিচার্ড, জিমি রজার্স, ফ্যাটস ডোমিনো, ডিন মার্টিনদের মতো কিংবদন্তি সংগীতশিল্পীরা বেশ প্রভাব ফেলেছিলেন প্রিসলির জীবনে, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ সংগীতশিল্পী।
ছবি: প্রথম আলো

‘ম্যারি অ্যান’ গানে কলকাতার অঞ্জন দত্ত বলেছিলেন এলভিস প্রিসলির কথা
ছবি: সংগৃহীত

বব মার্লেরা যখন পৃথিবীজুড়ে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার নিয়ে কথা বলছিলেন, তার আগেই প্রিসলি স্বপ্ন দেখেছিলেন এক মানবতাবাদী আমেরিকার। জন্মভূমি আমেরিকার ওপর ঈশ্বরের অনুগ্রহ চাইতে গিয়ে ভাতৃত্ববোধের কথাও বলেছেন। ‘আ বয় লাইক মি, আ গার্ল লাইক ইউ’, ‘সাসপিশাস মাইন্ড’—এর মতো গান দিয়ে সে সময়ের টিনএজারদের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন প্রিসলি। মূলত হারিয়ে ফেলা, বিচ্ছেদ, কামনা, আকাঙ্ক্ষা, অনুপ্রেরণা, নস্টালজিয়া, বিদ্রোহ, হতাশা, পলায়নবাদ—সবকিছুর সংশ্লেষ ঘটেছে তাঁর গানে। শেষ পর্যন্ত এসবের ভেতরেও একজন একাকী ব্যক্তি ছিলেন এলভিস প্রিসলি, যিনি একা একা ঘুরে বেড়িয়েছেন শহর থেকে শহরে, ‘ইট’স আ লোনলি ম্যান/ হু ওয়ান্ডারস অল অ্যারাউন্ড/ ইট’স আ লোনলি ম্যান/ হু রোমস ফ্রম টাউন টু টাউন’ গেয়েছেন বারবার। আসলে নিজের জগতের একাকী পরিব্রাজক ছিলেন তিনি।

এলভিস প্রিসলির লেখাটি শেষ করতে চাই এই বলে, রক অ্যান্ড রোল থেকেই পরে অনেক রকের উৎপত্তি। তবে এখন অনেকে বলেন, নতুন শতাব্দীতে এসে রক অ্যান্ড রোল হারিয়ে গেছে। আসলে কিছুই হারায় না। সবকিছু নতুন নতুন রূপে পরিবর্তিত-আবর্তিত হয়। ব্লুজ-জ্যাজ যেমন হারায়নি, তেমনি রক অ্যান্ড রোলও। বলা হয়ে থাকে, প্রিসলি মিউজিক ইন্ড্রাস্ট্রির সবচেয়ে প্রভাববিস্তারি চরিত্র। পপ কালচারে রক অ্যান্ড রোলকে দিয়েছিলেন নতুন ভাষা। জিমি হ্যান্ডরিক্স-জন লেননদের মতো সংগীত তারকাদের প্রভাবিত করেছিলেন প্রিসলি। তাঁদের কাজ এখনো মানুষকে ভাবায়। যাঁরা বলেন, প্রিসলির মৃত্যুর পর রক অ্যান্ড রোলও মরে গেছে, তাঁদের কানাডীয় সংগীতশিল্পী নেইল ইয়ংয়ের মতো একটু জোর দিয়েই বলতে চাই, ‘রক অ্যান্ড রোল ক্যান নেভার ডাই।’