জ্যাক দেরিদার অন্তিম উপলব্ধি

গ্রাফিকস: প্রথম আলোপ্রতিকৃতি: সংগৃহীত

কথাগুলো হচ্ছিল জ্যঁ বেয়ার্নবেঁর প্রশ্নের সূত্র ধরে, সেটা ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে, মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে যখন প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন জ্যাক দেরিদা। বেয়ার্নবেঁর সঙ্গে কথোপকথনের দুমাসের মাথায়, অক্টোবরে দেরিদা লোকান্তরিত হন। তাই স্বাভাবিকভাবেই আলাপচারিতা ও তাঁর বয়ানে নিহিত ছিল আসন্ন বিচ্ছেদ; বিদায়ের মলিন সুর। প্রসঙ্গ-কথা ছিল ‘বাঁচতে শেখা’ নিয়ে, যা দেরিদার ‘স্পেকটারস অব মার্কস’ (১৯৯৩) বইয়ের সূচনাতেই ছিল। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে ‘নয়া আন্তর্জাতিকতাবাদে’র বেশ প্রচলন হলে সেই সূত্রে নয়া আন্তর্জাতিকতার রূপায়ণের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে ‘অবশেষে বাঁচতে শিখছি’ কথাটা দেরিদার মাথায় আসে। প্রাত্যহিক জীবনে কথাটার সাধারণ এক বা একাধিক মানে থাকলেও দেরিদা বাঁচতে শেখাকে দার্শনিক-সূত্রে ভাবতে আগ্রহী ছিলেন। যেমন প্রশ্ন আসে, প্রকৃতপক্ষে বাঁচতে কি শেখা সম্ভব? উত্তরও পেয়েছেন তিনি—কেউ যেমন নিয়মিত অনুশীলন, অধ্যয়ন, অভিজ্ঞতা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জীবনকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে না, তেমনি এসবের মাধ্যমে জীবনকে সদর্থকভাবে দেখতে শিখতেও পারে না। তাই দেরিদার সিদ্ধান্ত, তিনি কখনো বাঁচতে শেখেননি। কারণ, বাঁচতে শেখার প্রকৃত অর্থ তিনি পেয়েছেন মরতে শেখার মধ্যে—মরণশীলতাকে প্রতি পদক্ষেপে উপলব্ধি করে—তাকে গ্রহণ করতে শিখে। দেরিদা আরও স্পষ্ট করে বলেন—মরণশীলতা হচ্ছে সেই জিনিস, যেখানে কোনো প্রকার মুক্তির বিষয় জড়িত নয়; কিংবা পুনরুত্থান বা পুনরুজ্জীবনের মতো ঘটনাও নয়। অন্যদিকে এটা কোনো বানানো কথাও নয়, কেননা আদিকাল থেকে দর্শনও তা-ই বলে আসছে। দার্শনিকেরা কোনো গূঢ় সমস্যাকে কিংবা জীবনের জটিল মুহূর্তগুলোকে যখন দেখতে শেখেন; আসলে তার মধ্য দিয়ে তাঁরা মরতেই শেখেন। প্রসঙ্গক্রমে দেরিদা প্লেটোকে উদ্ধৃত করে বলেন—প্লেটোর কথাও সে-একই। প্লেটো এ-সত্য বিশ্বাস করলেও নিজেকে কখনো মৃত্যুর কাছে সঁপে দেননি। দেরিদার কাছেও তাই মৃত্যুকে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে উঠছে। ‘বেঁচে থাকা’ অর্থে দেরিদা ‘টিকে আছি’ কথাটা ব্যবহার করে বলেছেন, ‘আমাদের কিছুক্ষণের জন্য অর্থাৎ এই বেঁচে থাকার সময়টুকু যেন রেহাই দেওয়া হয়েছে।’

‘স্পেকটারস অব মার্কস’ বইয়ের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে দেরিদা নিজের চিন্তার সত্যতা যাচাই করেছেন। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বায়নের যুগটাকে তিনি চূড়ান্তভাবে ‘অসহিষ্ণু’ আখ্যা দিয়েছেন। কেননা, গত দুই শতক ধরে লাখ লাখ মানুষ ও অপরাপর প্রাণীর অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং এখন তা আরও সংগঠিত রূপ ধারণ করছে। সুতরাং বেঁচে থাকার উপযুক্ত সময় থেকেও সবাইকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাই তাঁর কথা, ‘আমি অশিক্ষিতই রয়ে যাব, যদি আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করা হয় কীভাবে শান্তিসহযোগে মৃত্যুকে গ্রহণ করতে হয়।’ একইভাবে ‘কীভাবে বাঁচতে শিখতে হয়’—এ সম্পর্কেও নিজেকে ‘চির অজ্ঞ’ বলে দাবি দেরিদার। কারণ, বেঁচে থাকার ‘নির্ধারিত’ সময়টুকুও তাঁর ক্রমেই সমাপ্তির পথে। নিজের শারীরিক সমস্যাগুলোর তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘টিকে থাকা’ কিংবা ‘সাময়িক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা’র চিন্তাগুলো তাঁকে বেশ জ্বালাতন করে। এমনকি এসব শব্দবন্ধের মাত্রাও তাঁর কাছে বদলে যেতে শুরু করেছে আজকাল।

চিরটা কাল দেরিদা টিকে থাকা বা বেঁচে থাকার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন, আর এই টিকে থাকা বলতে তিনি জীবন বা মৃত্যুর সঙ্গে শুধু সংযোজনের কথাই বোঝেননি। জীবন বলতে তিনি বুঝেছেন টিকে থাকা, চলতে থাকা, বেঁচে থাকা। আর তা জীবনের শেষ পর্যন্ত নয়, মৃত্যু-পরবর্তীকালেও বেঁচে থাকা। এই চিন্তাকে দেরিদা ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের ‘উবারলেবেন’ (Uberleben) ও ফোর্টলেবেন’ (Fortleben) শব্দদ্বয়ের ভাবানুবাদ করে অর্থ খুঁজেছেন। প্রথমটির মানে হচ্ছে মৃত্যুর পরবর্তীকালে টিকে থাকা—যেভাবে একটি বই তার লেখকের মৃত্যুর পরেও অমর থাকে। আবার দ্বিতীয়টি দ্বারা বেঁচে থাকার আবহমানতাকে বোঝায়। এই বেঁচে থাকা এক ঘটমান বর্তমান। ‘স্পেকটারস অব মার্কস’ বইয়েও এসব চিন্তাসূত্র কাজ করেছে। অন্যদিকে দেরিদার উৎস সন্ধানের চিহ্ন (trace)-সংক্রান্ত ধারণা এবং বারবার ফিরে আসার (spectral) ধারণা দুটিও ‘বেঁচে থাকা’র চিন্তাটিকে গঠনগত ও মূলগত ভিত্তি দিয়েছে বলে মনে করেন। এ ছাড়া তাঁর প্রয়োগকৃত ‘origibary mourning’ অর্থে মৃত্যু-পরবর্তী শোক পালন বোঝাননি—বরং বুঝিয়েছেন যে সন্তাপ মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে অপারগ।

দেরিদা বলেন—মরণশীলতা হচ্ছে সেই জিনিস, যেখানে কোনো প্রকার মুক্তির বিষয় জড়িত নয়; কিংবা পুনরুত্থান বা পুনরুজ্জীবনের মতো ঘটনাও নয়। অন্যদিকে আদিকাল থেকে দর্শনও তা-ই বলে আসছে। দার্শনিকেরা কোনো গূঢ় সমস্যাকে কিংবা জীবনের জটিল মুহূর্তগুলোকে যখন দেখতে শেখেন; আসলে তার মধ্য দিয়ে তাঁরা মরতেই শেখেন। 

দেরিদা তাঁর রচনায় ‘প্রজন্ম’ ও ‘উত্তরাধিকার’ শব্দগুলো বারবার ব্যবহার করেছেন। ‘প্রজন্ম’ কথাটি একাধিক অর্থেও প্রয়োগ করতে দেখা গেছে তাঁকে। দেরিদার কাছে কোনো ব্যক্তি চাইলে অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সমকালীন হয়েও উঠতে পারে—আর তা কালানুক্রম না করেই। তাই নিজের চিন্তাপ্রবাহ পরবর্তী প্রজন্মের দ্বারা কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে, তার বিচারে দেরিদা দুটি বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রথমটি, এই ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা কিন্তু স্থবিরতায় বিশ্বাসী লোকের বিরুদ্ধে ক্রমাগত লড়াই করে যাওয়া। ঐতিহ্যের ধারকেরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটানোর বাসনায় লিপ্ত থাকবে। দেরিদা এই প্রজন্মের অনুসারী হিসেবে দেখেছেন লাঁকা থেকে আলথুসার, লেভিনাস থেকে দ্যলুজ, রোলা বার্ত, ব্লাঁশো, লিওতার, সারা কোফম্যানসহ ফ্রান্সের অনেক কবি, লেখক, চিন্তাবিদ ও মনোবিদকে। এমনকি ফ্রান্স ও ফ্রান্সের বাইরের যেসব চিন্তকের দ্বারা দেরিদা ঋদ্ধ হয়েছেন, তাঁদেরও তিনি সমান প্রজন্মের বলে দাবি করেন। যাঁরা সবাই মিলে একটা চিন্তাশৈলীর বিশিষ্টতা দিয়েছেন। এমন রূপ শৈলীর লক্ষ্য ছিল সমস্ত চিন্তার মূলগত অনির্দিষ্টতা এবং অপ্রতুলতাকে দৃশ্যমান করা। তাই লেখকের এই দুর্লঙ্ঘ্য চরিত্র পুনরুদ্ধার করাকে দেরিদা একটি প্রয়োজন বলে মনে করেন। কারণ অর্জিত জ্ঞান ও প্রচলিত কথার বিরুদ্ধে এটি লড়াইয়ের হাতিয়ার।

নিজের প্রজন্ম সম্পর্কে দেরিদার ভাবনা আর বাইবেলের যুগ থেকে শুরু করে প্লেটো, কান্ট, মার্কস, ফ্রয়েড, হাইডেগার প্রমুখ প্রত্যেকের নিজের মতো সমকালের ভাবনা সমান—এমনটাই ভেবেছেন তিনি। তাই দেরিদা কিছুই পরিত্যাগ করতে চান না, আর চাইলেও তা পরিত্যাগ অসম্ভব বলে মনে করেন। কারণ, বেঁচে থাকতে শেখার আরেকটি অর্থ হচ্ছে নিজের প্রতি ভালোবাসা। সব মানুষ যত দিন সম্ভব বেঁচে থাকতে চায়—আত্মরক্ষা করতে তৎপর থাকে। মানুষ নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য সেসব চর্চা করে থাকে—যা তার সত্তার আধারের কাজ করে। তাই যা কিছু দেরিদা ভালোবাসেন, যা কিছু তাঁকে তৈরি করেছে—তার পরিত্যাগ মানে নিজের সত্তার মৃত্যু। দেরিদার ক্ষেত্রে উপকরণগুলো হচ্ছে বৈপরীত্য, জটিলতা, কূটাভাস, পরিপূরক-দ্বন্দ্বসহ আরও সমস্যাপূর্ণ সূত্র। আর এসবকে লোকে পাঠোদ্ধার করতে না পারলে কিংবা নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করলে তাঁর চিন্তাগুলো পরিত্যাজ্য হয়ে যাবে, এমনটাও ভাবেন না তিনি।

দেরিদার ‘বেঁচে থাকার জন্য লেখা’র মতো বিশেষ ধারার রচনার যে বৈশিষ্ট্য, এ নিয়েও কথা বলেন। সেই সূত্রে নিজের লেখাকে তিনি বিপ্লবের আবহমানতা রক্ষার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেন। তাই লেখার ক্ষেত্রে লেখককে ভেবে নিতে হয় তিনি মূলত কাদের জন্য লিখছেন। এমনকি লেখা এমন হতে হবে, যাতে তার নিজস্ব ঘরানার পাঠকবৃত্ত তৈরি করতে পারে। এমন হতে পারে, এমন লেখা পাঠক আগে পড়েনি, কিন্তু এ লেখায় সে বাঁচতে শিখবে। লেখায় পাঠক পুনর্জন্ম পেতে পারে, এমনকি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিও লাভ করতে পারে। ফলে এ ধরনের লেখায় কবিতাও হয়ে উঠতে পারে দর্শনের অবয়ব। তাই বলে কবিতার ধর্ম বিচ্যুত হবে না। শব্দের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োগ ঘটবে। ভাষায় থাকবে লুকোচুরি। লেখার এই পদ্ধতিগুলোর উপযোগিতা যাঁরা উপলব্ধি করতে পারেন না, তাঁদের ব্যাপারে দেরিদার কথা নেই। যেহেতু প্রতিটা বইয়ের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পাঠককে খোলনলচে পাল্টিয়ে দেওয়া। তাই প্রচলিত যেসব পদ্ধতির ছড়াছড়ি এবং যা জনপ্রিয়, তা কোনো অচলায়তন ভাঙার জন্য অনুপযুক্ত বলে মনে করেন তিনি।

লেখা এমন হতে হবে, যাতে তার নিজস্ব ঘরানার পাঠকবৃত্ত তৈরি করতে পারে। এমন হতে পারে, এমন লেখা পাঠক আগে পড়েনি, কিন্তু এ লেখায় সে বাঁচতে শিখবে। লেখায় পাঠক পুনর্জন্ম পেতে পারে, এমনকি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিও লাভ করতে পারে। ফলে এ ধরনের লেখায় কবিতাও হয়ে উঠতে পারে দর্শনের অবয়ব। তাই বলে কবিতার ধর্ম বিচ্যুত হবে না। শব্দের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োগ ঘটবে। ভাষায় থাকবে লুকোচুরি।

এটাও ঠিক, উদ্দিষ্ট পাঠকবর্গের মন লেখক কখনো পড়তে পারেন না, তা যতই অনুগত থাকার চেষ্টা করুন না কেন? দেরিদা দেখেছেন; লেখার সময় যতই মনে রাখার চেষ্টা করেন না কেন, শেষ পর্যন্ত উদ্দিষ্ট পাঠক অজানাই থেকে যান। কারণ, লেখায় যা কিছু তিনি ইঙ্গিত করেন, দেখা গেল পাঠক হয়তো অন্য কিছু ভেবে নিয়েছেন। সুতরাং নিজের বই সম্পর্কে দেরিদার অভিমত, ‘আমি কেমন একটা আধো-আলো আধো-অন্ধকারের বইগুলোর অস্তিত্বের পেছনে প্রায় ভূতের মতো ভেসে থাকছি। আবার থাকছিও না। যে চিহ্ন আমি ছেড়ে যাই, তা-ই আমার মৃত্যুর দলিল। আমি সেই ভূত যে কোনো দিনও বাঁচতে শেখেনি। এই সমস্ত চিহ্ন হয়তো আমাকে বারে বারে ভাসিয়ে নিয়ে আসবে।’ তার মানে এই নয়, দেরিদা অমরত্ব কামনা করেন। বরং তাঁর কাছে এটা ভবিতব্য যে ‘আমি একটা চিরকুটে কিছু লিখে গেলাম এবং আমি চলে গেলাম। মারা গেলাম। এই গঠনগত সত্য এড়ানো অসম্ভব। একেবারে অপরিবর্তনীয়। এভাবে প্রতিটি লেখন চলাকালীনই আমার মৃত্যু হয়। অন্যভাবে বললে লেখার মধ্য দিয়েই আমি মৃত্যুতে বেঁচে বেঁচে চলি।’ সুতরাং এখানেই সব থেকে কঠিন পরীক্ষা। কেউ জানে না লেখাটি কে পড়বে? কে হবে লেখার ঐতিহ্যবাহক? এবং কীভাবে? অথবা আসলেই কেউ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো থাকবে কি না?—দেরিদাকে এসব প্রশ্ন যেমন আচ্ছন্ন করে রাখে, একইভাবে প্রশ্নগুলোর প্রাসঙ্গিকতাও বেড়ে চলেছে বলে তাঁর ধারণা। এমনকি প্রযুক্তি-সংস্কৃতির ভিড়ে এসব প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতও বর্তমানে পরিবর্তনশীল হিসেবে দেখেন তিনি। দেরিদার বিবেচনায় বর্তমান সভ্যতায় যে গতিতে লেখাপত্তর সংরক্ষিত হয় এবং এর ফলে বহু ব্যবহৃত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় তাতে লেখার গঠন, চরিত্র, উৎকর্ষ বা জীবৎকাল ইত্যাদি ধারণা বদলে গেছে। নিজের লেখার ব্যাপারে দেরিদার ধারণা হচ্ছে—লোকে এখনো তাঁর লেখা পড়তে শুরু করেনি। আর যারা পড়তে শুরু করেছে, তারা হাতে গোনা। সুতরাং তাঁর লেখাগুলো নতুনভাবে উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা সামনে পড়ে আছে। একই সঙ্গে আশঙ্কাও করেন যে মৃত্যুর পর হয়তো অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না তাঁর। নিজের লেখার ব্যাপারে এই আশা ও আশাহীনতাকে দেরিদা ‘দ্বিত্ব অনুভূতি’ বলে অভিহিত করেন।

ভাষা নিয়ে দেরিদার আবেগমিশ্রিত ভালোবাসা সব সময় লক্ষ করা যায়। ‘মনোলিঙ্গুইজম অব দ্য আদার’ (১৯৯৬) বইয়ে তো শ্লেষের সঙ্গে ঘোষণাও করেছেন, ফরাসি ভাষার অন্তিমতম রক্ষাকর্তা এবং দিকদির্দেশক তিনি নিজে। এ প্রসঙ্গে দেরিদার অভিমত যে ফরাসি ভাষাটা তাঁর নিজের—এ কথা তিনি জোর দিয়ে বলতে পারেন না। জন্মগতভাবে ফরাসি-আলজেরীয় লোক হিসেবে ভাষাটা রপ্ত করেছিলেন তিনি, যেখানে প্রপিতামহরা আরবদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। যদিও এর পেছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট জড়িত। তাই পাকে-চক্রে ফরাসি ভাষা দেরিদার অস্তিত্বের অংশ হয়ে শুধু ওঠে না, একমাত্র অবলম্বনও হয়। ফলে তাঁর একমাত্র কাজ হয়ে ওঠে ভাষাটিকে কত স্বাদু ও বৈচিত্র্যময় করে তোলা। দেরিদার মতে, ভাষাকে দায়সারাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কেননা, ভাষার অস্তিত্ব ব্যক্তির পূর্বতন, আর ব্যক্তির অস্তিত্ব বিনাশের পরেও ভাষার অস্তিত্ব থেকে যায়। তাই ভাষাকে স্বকীয়তা দিতে গেলে ভাষার অভ্যন্তরীণ রীতিনীতি মেনেই ‘অন্তর্ঘাত’ চালাতে হয়। দেরিদাও ভাষার মধ্যকার অচলায়তনগুলো সমূলে উৎখাত করতে গিয়ে ভাষায় অভিঘাত সৃষ্টি করেন। আর এটাই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে বলে মনে করেন।

‘দ্য আদার হেডিং’ (১৯৯২) বইয়ে দেরিদা নিজেকে ‘পুরাতন ইউরোপীয়’ বলে আত্মপরিচয় দিয়েছিলেন। এমনকি নিজেকে ‘ইউরোপীয় শঙ্কর’ প্রজাতির মানুষ বলেও আখ্যা দিয়েছেন। অপর দিকে তিনি সব সময় ‘আমাদের’, ‘আমরা’ কথাটা বলতে অস্বস্তিবোধ করতেন। যদিও বিশ্বায়নের পর থেকে ‘আমরা ইউরোপিয়ানরা’তে নেমে এসেছিলেন। দেরিদা স্বীকার করেছেন ‘আমরা’ কথাটাতে আসলেই অস্বস্তিবোধ করে থাকেন তিনি। অবশ্য কখনো কখনো ব্যবহার না করে পারেনও না। কেননা, কিছু ঘটনা তাঁকে বেশ বিব্রত করে। বিশেষ করে ইসরায়েলের আত্মঘাতী রাজনীতি। ইসরায়েলিদের ইহুদিরাষ্ট্র গঠনের গোঁড়া আকাঙ্ক্ষাকে তিনি একটা অনভিপ্রেত বিষয় বলে অভিহিত করেন। যেহেতু ইহুদিবাদের উৎপত্তি নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক ও ধোঁয়াশা বিদ্যমান। দেরিদা দেখেছেন আমেরিকায় এমন গোঁড়া খ্রিষ্টান রয়েছে, যারা নিজেদের খাঁটি ইহুদি বলে দাবি করে। অথচ ইহুদিদের প্রতি ওদের সামান্যতম সহানুভূতিও নেই। রাজনৈতিকভাবে ওরা আবার জর্জ বুশের লোক ছিল। সৌদিরা অন্যদিকে ওদের কাছে অচ্ছ্যুত। দেরিদার মন্তব্য হচ্ছে এসব আমেরিকান-ইসরায়েলি রাজনীতির ফল আর ‘তা সত্ত্বেও আমার “আমরা ইহুদিরা” কথাটা বলতে কখনো বুক কাঁপে না।’ উদাহরণ দিয়ে বলেন, অ্যারিস্টটল ‘প্রার্থনা’ কথাটা বোঝাতে ‘eukhe’ শব্দটি ব্যবহার করতেন, যার মানে ‘যা সত্য বা মিথ্যা কোনোটাই নয়’। সুতরাং দেরিদা ‘আমরা ইহুদিরা’, ‘আমরা ফরাসিরা’ কথাগুলো সত্য-মিথ্যা ডায়ালেক্টিকের ঊর্ধ্বে ব্যবহার করেন বলে জানান।

কেউ জানে না লেখাটি কে পড়বে? কে হবে লেখার ঐতিহ্যবাহক? এবং কীভাবে? অথবা আসলেই কেউ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো থাকবে কি না?—দেরিদাকে এসব প্রশ্ন যেমন আচ্ছন্ন করে রাখে, একইভাবে প্রশ্নগুলোর প্রাসঙ্গিকতাও বেড়ে চলেছে বলে তাঁর ধারণা। এমনকি প্রযুক্তি-সংস্কৃতির ভিড়ে এসব প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতও বর্তমানে পরিবর্তনশীল হিসেবে দেখেন তিনি।

দেরিদা ‘বিনির্মাণবাদ’কে ইউরোপীয়করণের বিরুদ্ধে জেহাদি কাজ বলে স্বীকার করেছেন। নাৎসিবাদ বা ফ্যাসিবাদকে ইউরোপীয় বিবেকের একটা বড় ক্ষত হিসেবে তিনি দেখেন। একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ও ইউরোপীয় কবল থেকে অপর দেশগুলোর লড়াইও আরেকটা বিষয়। তাই ইউরোপের ‘টোটালিটারিয়ান নীতি’ শুধু মাথাব্যথার কারণ নয়, দেরিদা মনে করেন ইউরোপকে নিজের পেছনের দিকে তাকিয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্তে আসার সময় এসে গেছে। বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষপটে দেরিদার স্পষ্ট কথা হলো তাই—ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষপটে যে ধরনের রাজনীতি চলমান, তাতে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর উচিত কাজ হবে আমেরিকার নানামুখী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। অপর দিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান আরব-ইসলামি শক্তিগুলোকে ‘রাজনৈতিকভাবে অনিশ্চিত’ ও ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যা দিয়ে তাদেরকেও প্রতিহত করার কথা বলেন। আমেরিকান ও ইসলামি সন্ত্রাসবাদ দেরিদার চোখে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আর তিনি মনে করেন না যে ‘নয়া উদারবাদী নীতি’ দিয়ে ইউরোপীয় কমিউনিটিগুলো বিদ্যমান সমস্যার মোকাবিলা করতে পারবে। যেখানে এদের অনেকে আবার ইউরোপের অভ্যন্তরে যুদ্ধ জিইয়ে রাখতেও পছন্দ করে। সুতরাং দেরিদা একটা নতুন ইউরোপের স্বপ্ন দেখেন, যে ইউরোপ হবে বিশ্বায়ন পরিপন্থী; এদের কাজ হবে আগ্রাসনের পরিবর্তে মনুষ্যত্ব রক্ষায় দায়িত্ব পালন করা। আর এর জন্য প্রয়োজন পড়বে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহিষ্ণুতার মতো বিষয় দুটি। তাঁর কথা—এটা তখনই সম্ভব হবে যদি ইউরোপিয়ানরা স্বার্থহীনভাবে রাজনীতি করে। এই অর্থে দেরিদা ‘আমরা ইউরোপিয়ানরা’ বলতে দ্বিধা করেন না। দেরিদা বিনির্মাণ সম্পর্কে আরও বলেন, এটা ইউরোপীয় ধারণা হলেও এখন আর ইউরোপে সীমাবদ্ধ নয়। অন্যদিকে তা ইউরোপকে কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েও দিয়েছে—যেখানে বিশ্বজগতের অধঃপতনের জন্য অপরাধের আঁতুড়ঘর হিসেবে ইউরোপের প্রতি সব অঙ্গুলি নির্দেশ করে। অতএব তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস—বিনির্মাণ ভবিষ্যৎ মুক্তির পথ প্রশস্ত করার দারুণ উপায়ও।

২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিস্থিতিই পাল্টে যায়। স্বাভাবিকভাবে ইউরোপীয় রাজনীতিও মোড় নিতে থাকে—বাড়ে ইউরোপীয় রাজনীতির দায়দায়িত্ব। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেরিদা খোদ গ্রিকজাত ‘পলিটিকস’ শব্দটাকেই কেন্দ্র করে কথা জোড়েন। ইতিহাসের আলোকে দেখান যে যখনই ভৌগোলিক সীমারেখা জিনিসটা মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে, তখনই কোনো কোনোভাবে তীব্র সাম্রাজ্যবাদ বা উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি তাকে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করেছে। বর্তমান পৃথিবীতে জাতীয় সার্বভৌমত্ব নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখার মুখাপেক্ষীও নয়। তথ্যপ্রযুক্তিগত কারণে সামরিক বিষয়গুলোরও ব্যাপক রূপান্তর হয়েছে। ‘রাজনীতি’ বা ‘যুদ্ধ’ প্রভৃতি শব্দেরও ব্যঞ্জনা পাল্টে গেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনী আর জনগণের মধ্যেও তফাত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাহলেও সর্বগ্রাসী বিশ্বায়নকে ঠেকাতে দেশীয় সীমারেখার দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার প্রয়োজন হয়েছে। আর জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে জাতীয়তাবাদও আবশ্যিক হয়ে পড়ে। তাই ইউরোপীয় ঐতিহ্যকে পরিত্যাগের বদলে দেরিদা বিনির্মাণের কথাই বলেন। একইভাবে গণতন্ত্র প্রসঙ্গে একে ‘অপুষ্ট’ বিবেচনা করে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাও বলেন।

দেরিদার লেখায় বারবার জ্ঞান ও ক্ষমতার সমীকরণের বিনির্মিত ব্যাখ্যা দেখা যায়। একই সঙ্গে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে রাজনীতিমুক্ত ‘আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়’ গড়ার কথাও তিনি বলেছেন; যেখানে শর্তহীন বিশ্ববিদ্যালয়টি নবজাগরণ ঘটানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিতে পারে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেরিদা আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় বলতে এমনটি বোঝাতে চান, যেখানে রক্ষণশীলতা থাকবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র থাকবে শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সত্যের সন্ধান করতে গিয়ে আরোপিত শর্তের শৃঙ্খল ভেঙে দেওয়াই হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র কাজ—রাজনৈতিক বা ধর্মীয় অনুশাসনের পরিবর্তে মুক্তভাবে চিন্তাচর্চা করার অধিকার থাকবে। তিনি উদাহরণ হিসেবে নিয়ে এসেছেন ইমানুয়েল কান্টকে। ক্ষমতার উৎস থেকে দূরে অবস্থান করে বলে কান্ট চিকিৎসাশাস্ত্র, আইন ও ধর্মশাস্ত্রের নিচে দর্শনকে রাখতে চেয়েছেন। দেরিদা বরং বলেন, দর্শন সত্যের একনিষ্ঠ অনুসারী বলে দর্শনের স্বকীয় একটা মর্যাদা আছে এবং সেই মর্যাদা অনুযায়ী এর স্থান সবার ঊর্ধ্বে। অবশ্য কান্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে আশ্রয় করে দর্শনচর্চার কথাও বলেছেন। দেরিদা কান্টের এই মতের বিারোধিতা করেন। কান্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মুক্তচিন্তার বীজতলা’ বলে মনে করতেন। সুতরাং দেরিদার শর্তহীন বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাত্র বাধাহীনভাবে চিন্তা, সমালোচনা ও সৃষ্টি সম্ভব হবে।

দেরিদা একটা নতুন ইউরোপের স্বপ্ন দেখেন, যে ইউরোপ হবে বিশ্বায়ন পরিপন্থী; এদের কাজ হবে আগ্রাসনের পরিবর্তে মনুষ্যত্ব রক্ষায় দায়িত্ব পালন করা। আর এর জন্য প্রয়োজন পড়বে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহিষ্ণুতার মতো বিষয় দুটি। তাঁর কথা—এটা তখনই সম্ভব হবে যদি ইউরোপিয়ানরা স্বার্থহীনভাবে রাজনীতি করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস নিয়ে একদল ইতিহাসবিদ জার্মান গ্যাসচেম্বারের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে দেখা যায়। এঁদের ব্যাপারে দেরিদার বক্তব্য হলো, একটা বিষয়ে যে কেউ নিজের দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করতেই পারেন। তার মানে এই নয় যে ইতিহাসবিদকে অসত্যের ধারক হতে হবে। এ ধরনের গবেষকদের দেরিদা অসৎ, অযোগ্য ও ক্ষতিকর বলে অভিহিত করেন—যারা অশুভ শক্তির ইশারায় নিজেদের মত তুলে ধরেন। এ প্রসঙ্গে তিনি অধ্যাপক ফরিঁসের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তথ্যপ্রমাণ হাতের কাছে থাকার পরও তিনি মনগড়া বয়ান তৈরি করেছিলেন—দেরিদা তাঁর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন। ফরিঁসকে তিনি ‘অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, ওই অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়কে কালিমালিপ্ত করেছেন, কেননা, তিনি বিতর্কের সব রাস্তা বন্ধ করে দিতে চান। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল আদর্শ হচ্ছে প্রশ্ন করার অধিকার দেওয়া—বিতর্কের পথ তৈরি করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যগত এই ধারার উল্লেখ করে নিজেকে এর পৃষ্ঠপোষক বলে দাবি করেন দেরিদা। গ্রিক দর্শন ও ইউরোপীয় ধারাও ওই একই কথা বলেছে বলে তিনি জানেন।

‘বিদায় এবং মুক্তি’, যাকে ফরাসিতে ‘Salut’ বলে তা নিয়ে আলোচনা করা সবচেয়ে প্রয়োজন বলে মনে করেছেন দেরিদা। জীবনের উপান্তে এসে লেখা দুটি রচনায় একধরনের শোক পালনের কথা বলেছেন, যা বেঁচে থাকার পরবর্তীকালীন। বিষয়টা এমন; দর্শন যদি মৃত্যুর অনুধ্যান হয়, তাহলে বিনির্মাণকে কেন জীবিত থাকাকালীন অনুসরণযোগ্য নীতি হিসেবে স্থির করা যাবে না—যাতে জীবনের সমাপ্তি হলেও তা শেষ পর্যন্ত সমাপ্তি ঘটবে না! এ প্রসঙ্গে দেরিদা সোরেন কিয়ের্কেগার্ডের আব্রাহামের পুনঃ পাঠের বিষয়টি টেনে আনেন। যেখানে কিয়ের্কেগার্ড আইজাকের পাহাড়ের ওপরে বাঁধা অবস্থার গল্পটিকে গোঁড়া খ্রিষ্টানের দৃষ্টিতে দেখেছেন। অথচ মুক্ত দৃষ্টিতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মৃত্যুর দিকে তাকালে উপলব্ধি করা যাবে এটা আসলে ‘টিকে থাকা’র গল্প। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বিষয়টা দেরিদা ভালোভাবেই অনুভব করতে পারেন। তাই তাঁর অভিজ্ঞান-অস্তিত্বের ধারণার মধ্যে প্রোথিত রয়েছে টিকে থাকার বিষয়টি। মার্টিন হাইডেগার যে পরিস্থিতির নাম দিয়েছিলেন ‘দাসেন’ (Dasein)। দেরিদার অভিজ্ঞতায় গঠনগতভাবেই মানুষের মধ্যে টিকে থাকার প্রবল জেদ বিদ্যমান। আর মৃত্যু? দেরিদার মতে, মৃত্যু শারীরিক বিনাশ ঘটায়। অন্যদিকে কোনো বিনির্মাণই সর্বক্ষেত্রে মৃত্যুচিন্তা ও সদর্থক জীবনের কথা বলে না। সুতরাং তিনিও বলেননি। বরং বেঁচে থাকা কিংবা টিকে থাকা বলতে তাঁর ভাষায়, ‘জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে দড়ি–টানাটানি থেকে উদ্ভূত এক জটিলতা’ মাত্র। আর এই জটিলতাই মানুষকে জীবনের প্রতি অনুরাগী করে তোলে।

বিনির্মাণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জীবনকে দেখতে শেখায় না বলেও দেরিদার জোর দাবি। টিকে থাকাটা জীবনকে অতিক্রম করে, ‘জীবনের অতিরিক্ত এক জীবন’ উপহার দেয়। দেরিদা এখানে দৃঢ় বিশ্বাসী, ‘আমার লেখা মৃত্যুর খতিয়ান নয়। বরং আমি একজন জীবন্ত মানুষের জীবনের প্রতি প্রবল আসক্তির রক্তিমতাই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি।’ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও জীবনকে অব্যাহত রাখা—জীবনকে উপলব্ধি করাটাকে তিনি ‘বেঁচে থাকা’ হিসেবে আখ্যা দেন। শুধু ‘থাকা’টাই বেঁচে থাকা নয়, তাঁর কাছে জীবনের তীব্রতার মধ্যেই বেঁচে থাকার সত্য নিহিত।

দেরিদা মৃত্যুকে একটা প্রয়োজন মনে করেছেন। যদিও মৃত্যুচিন্তা তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাই বলে জীবনের টুকরা টুকরা আনন্দকে তিনি সামান্য বলে মনে করেন না। আনন্দের অনুভব ও আসন্ন মৃত্যুর ভাবনাকে দেরিদা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয় হিসেবে দেখেছেন—এদের মধ্যে কোনো সীমারেখা টানতে তিনি নারাজ। আর জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন সুন্দর মুহূর্তগুলোও কীভাবে বারবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে—মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ-ই তাঁর টিকে থাকা—বেঁচে থাকা—জীবন ও মৃত্যু!