পত্রিকায় মণি সিংয়ের প্রথম ছবি

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

কমরেড মণি সিং গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে হাইকোর্টে হাজির করা হবে। তখন মণি সিং নামটা অনেকেই জানত। তবে দেশের মানুষ তাঁকে চোখে দেখেনি। অবশ্য ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের যে এলাকায় তিনি আত্মগোপনে ছিলেন, সেখানকার গারো সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ তাঁকে চিনত।

রশীদ তালুকদার [২৪ অক্টোবর ১৯৩৯-২৫ অক্টোবর ২০১১]। আলোকচিত্র: সাহাদাত পারভেজ

রশীদ তালুকদারকে দৈনিক সংবাদের কার্যনির্বাহী সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার বললেন, ‘আজ মণি সিংকে হাইকোর্টে তোলা হবে। তুমি তাঁর ছবি তুলে আনবে।’ রশীদ তালুকদার বললেন, ‘আমি তো তাঁকে কখনো দেখিনি।’ শহীদুল্লা কায়সার বললেন, ‘বোকা ছেলে! মণি সিংকে কি চেনা লাগে? বিরাট জমিদারের ছেলে, কেমন হতে পারে বুঝে নাও। উঁচু লম্বা গড়ন; দুধে–আলতায় গায়ের রং।’ শহীদুল্লা কায়সারের কথায় আদালতে গেলেন রশীদ তালুকদার।

তখন আইয়ুবের আমল। দেশজুড়ে চলছে দুঃশাসন। আদালতের ভেতর ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ঢাউস সাইজের টুইন লেন্স রিফ্লেক্সে ছবি তোলা অকল্পনীয় ব্যাপার। ধরা পড়লেই নিশ্চিত জেল। জেল-জুলুম তুচ্ছ করে রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা নিয়ে রশীদ তালুকদার গেলেন হাইকোর্টের ভেতর। তুললেন পুলিশ পরিবেষ্টিত কারারুদ্ধ মণিং সিংয়ের ছবি। পরের দিন সংবাদের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হলো সেই ছবি। মণি সিংয়ের ছবি তুলতে পারা ছিল পেশাগত জীবনের শুরুর দিকের এক বিশাল সাফল্য। পাক্ষিক অনন্যায় (প্রকাশকাল: ২০০২, ১৫ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, পৃষ্ঠা: ৯) ‘আলোকচিত্রীর তিক্ত মধুর অভিজ্ঞতা’ শিরোনামের এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন রশীদ তালুকদার। ১৯৯৭ সালের ১৬ অক্টোবর পাক্ষিক অনন্যায় ‘অনন্য রশীদ তালুকদার’ শিরোনামে এক বিশেষ রচনা প্রকাশিত হয়। এ রচনায়ও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে মণি সিংয়ের ছবি তুলতে পারার কথা বর্ণনা করেছেন।

শহীদুল্লা কায়সার বললেন, ‘আজ মণি সিংকে হাইকোর্টে তোলা হবে। তুমি তাঁর ছবি তুলে আনবে।’ রশীদ তালুকদার বললেন, ‘আমি তো তাঁকে কখনো দেখিনি।’ শহীদুল্লা কায়সার বললেন, ‘বোকা ছেলে! মণি সিংকে কি চেনা লাগে? বিরাট জমিদারের ছেলে, কেমন হতে পারে বুঝে নাও।’

১৯ বছর আত্মগোপনে ছিলেন প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা মণি সিং। জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স বলে ১৯৬৭ সালের ৮ নভেম্বর তাঁকে ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর প্রেরণ করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়, তাঁকে ঢাকার মোহাম্মদপু্র এলাকার একটি রাস্তা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর মুক্তির দাবিতে দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। প্রতিদিনই ঢাকায়, ঢাকার বাইরে সভা-সমাবেশ হচ্ছে। পত্রপত্রিকায় বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। গ্রেপ্তারের ৪১ দিন পর রিভিউ বোর্ডের সামনে পেশের জন্য ১৯ ডিসেম্বর তাঁকে হাইকোর্টে হাজির করা হয়।

মণি সিং [২০ ডিসেম্বর ১৯৬৭]। আলোকচিত্র: রশীদ তালুকদার
লেখকের সৌজন্যে

ওই দিন বেলা তিনটার দিকে হাইকোর্টে গেলেন রশীদ তালুকদার। কিন্তু জমিদারের ছেলের মতো কাউকে দেখতে পেলেন না। তবে একজনকে দেখে তাঁর মনে হলো, তিনিই মণি সিং হতে পারেন। পায়জামার ওপর শার্ট পরা, চোখে চশমা আর হাতে একটা লাল গোলাপ। লোকটা খাটো, তবে গায়ের রং দুধে-আলতা। সরাসরি ছবি তোলার কোনো উপায় নেই। হাইকোর্টের এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ের বিশেষ আদালতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো।

রশীদ তালুকদার বুঝতে পারলেন, বিচার শেষে এ পথেই তাঁকে নিয়ে আসা হবে। তিনি বিপরীত পাশের ভবনের একটা স্টোর রুমে ঢুকলেন। স্টোর কিপারের সঙ্গে ভাব জমালেন। তাঁকে বুঝিয়ে বললেন সব কথা। স্টোর কিপার তাঁকে সাহায্য করতে রাজি হলেন। স্টোর রুমের দরজায় একটা ছিদ্র ছিল। দরজাটা চাপিয়ে সেই দরজার ছিদ্র দিয়ে ক্যামেরার ওপরের লেন্সে ২০ ফুট দূরত্ব ফোকাস করে নিলেন। এরপর নিচের লেন্সটা সেই ছিদ্রে ফিক্সড করে দিলেন। স্টোর কিপার তাঁর কথামতো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। মণি সিংহ কাছে এলেই তিনি দরজার টোকা দেবেন।

কমরেড মণি সিং
ছবি: সংগৃহীত

ঘণ্টাখানেক পর দরজায় টোকা পড়ল। রশীদ তালুকদার দরজার পেছন থেকে ছবি তুলতে শুরু করলেন পুরো আন্দাজে। সে আমলে এক রোল ফিল্ম দিয়ে ১২টি ছবি তোলা যেত। তিনি পুরো রোল তুললেন। কথা ছিল সবাই চলে যাওয়ার পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে স্টোর কিপার দরজা খুলে দেবেন। কিন্তু তিনি এসে দরজা খুললেন দুই ঘণ্টা পর। এদিকে অন্ধকার আর মশার কামড়ে তিনি অতিষ্ঠ। রশীদ তালুকদারের নিরাপত্তার কথা ভেবেই ছুটির পর সবাই আদালত থেকে চলে যাওয়ার পর স্টোর কিপার দরজা খুললেন।

ওই দিন বেলা তিনটার দিকে হাইকোর্টে গেলেন রশীদ তালুকদার। কিন্তু জমিদারের ছেলের মতো কাউকে দেখতে পেলেন না। তবে একজনকে দেখে তাঁর মনে হলো, তিনিই মণি সিং হতে পারেন। পায়জামার ওপর শার্ট পরা, চোখে চশমা আর হাতে একটা লাল গোলাপ।

সংবাদের অফিস ছিল তখন ২৬৩ নম্বর বংশাল রোডে। অফিসে এসে ডার্করুমে ঢুকে নেগেটিভ ডেভেলাপের পর দেখা গেল, ১২টি ছবির মধ্যে ১টিতে কেবল ছবি উঠেছে। ছবি দেখে শহীদুল্লা কায়সার, সন্তোষ গুপ্ত, রণেশ দাশগুপ্ত খুবই উত্তেজিত। তাঁরা ছবি নিয়ে গেলেন সম্পাদকের রুমে। সংবাদের সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী ছবি দেখে বললেন, ‘সেরেছে, এই ছবি ছাপলে কালই আমাকে হাজতে ঠেলে দেবে। ছবিতে হাইকোর্ট পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বরং এক কাজ করো, এক্ষুনি কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটের ছবি তুলে আনো। ব্যাকগ্রাউন্ডে কারাগারের ছবি জোড়া লাগিয়ে ছাপব।’

রাতের বেলা রশীদ তালুকদার গেলেন কারাগারের গেটের সামনে। ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি তুললে মহাবিপদ। তাই একটা শক্ত জায়গায় ক্যামেরা রেখে টাইমারে ছবি তুললেন। অফিসে গিয়ে নেগেটিভ ডেভেলেপ করলেন। ছবি বানালেন। মণি সিংয়ের ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড ফেলে দিয়ে জেলগেটের ছবি জোড়া লাগালেন। পরের দিন অবশ্য জোড়া ছাড়া ছবিটাই ছাপা হলো। দেশের মানুষ প্রথম দেখল মণি সিংয়ের চেহারা।

দৈনিক সংবাদের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ছবি [২০ ডিসেম্বর ১৯৬৭]। আলোকচিত্র: রশীদ তালুকদার
লেখকের সৌজন্যে

১৯৬৭ সালের ২০ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদের প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৬৬ বছর বয়সী মণি সিংকে পুলিশের ভ্যানে করে আদালতে আনার সঙ্গে সঙ্গে খবরটি বিদ্যুতের গতিতে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাঁকে একনজর দেখতে হাইকোর্টের সামনে শত শত ছাত্র-জনতা ভিড় করে। বিকেল চারটা পর্যন্ত তাঁকে রিভিউ বোর্ডে রাখা হয়। এরপর তাঁকে কেন্দ্রীয় কারাগারে ফেরত নেওয়ার জন্য পুলিশের ভ্যানে তোলা হয়। এ সময় উকিল-ব্যারিস্টার-মক্কেলসহ সবাই মণি সিংকে দেখার জন্য ছুটে আসেন। হাইকোর্টের ফটকের সামনে অপেক্ষমাণ জনতা ‘মণি সিংয়ের মুক্তি চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’ প্রভৃতি স্লোগানে ফেটে ওঠে। তাঁরা মণি সিংকে একটি পুষ্পস্তবক উপহার দিতে চাইলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়।

এরপর জনতার ভিড় ঠেলে পুলিশের ভ্যানটি নাজিমুদ্দিন রোডের দিকে চলতে শুরু করে।