কী অভিপ্রায়ে হিমু-শুভ্র-মিসির আলির সৃষ্টি

তিন শতাধিক গ্রন্থে হুমায়ূন আহমেদ অসংখ্য চরিত্রের জন্ম দিয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয় তিনটি চরিত্র হলো হিমু, শুভ্র ও মিসির আলি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামাজিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতার নিরিখে হুমায়ূনের এই চরিত্রদের অবস্থান খোঁজার চেষ্টা করব। বুঝতে চাইব, ঠিক কী করতে চায় তাঁর এই চরিত্ররা।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তিন শতাধিক গ্রন্থে হুমায়ূন আহমেদ অসংখ্য চরিত্রের জন্ম দিয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয় তিনটি চরিত্র হলো হিমু, শুভ্র ও মিসির আলি। সম্ভবত তাঁর নিজেরও অতি আপন এই তিন চরিত্র। আমাদের বিদ্বৎসমাজে অবশ্য এদের বা এদের উপজীব্য করে রচিত উপন্যাসগুলোর কদর অতি অল্প। প্রশ্ন হলো, হুমায়ূন আহমেদ কেন ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’র ধারা অনুসরণ না করে আপাত হেঁয়ালিপূর্ণ ক্ষুদ্রায়তন এই সব উপন্যাস রচনায় নিরত হলেন? কেন মহৎ সাহিত্য রচনায় না নেমে হাস্যরস উৎপাদনকেই তাঁর সাহিত্যিক ব্রত হিসেবে গ্রহণ করলেন? এসব প্রশ্ন নিয়ে, বিশেষত তাঁর সৃষ্ট তিনটি স্বনামধন্য চরিত্র নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটানোই এ লেখার উদ্দেশ্য।

আমাদের পক্ষে এখন আর জানা সম্ভব নয় এসব চরিত্র সৃষ্টির পেছনে হুমায়ূন আহমেদের অন্তর্গত অভিপ্রায় বা বাসনা কী ছিল। যদিও অনেকে বলে থাকেন যে তাঁর এসব চরিত্রে মূলত তাঁরই নানা বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অর্থাৎ এসব চরিত্রের মধ্য দিয়ে নিজেকেই তিনি বিশদ করেছেন। সে সিদ্ধান্ত আপাতত একপাশে রেখে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামাজিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতার নিরিখে হুমায়ূনের এই চরিত্রদের অবস্থান আমরা খোঁজার চেষ্টা করব। বুঝতে চাইব, ঠিক কী করতে চায় তাঁর এই চরিত্ররা।

১. হিমু

মোটামুটি আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বা নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে হুমায়ূন আহমেদ ‘মিসির আলি’, ‘হিমু’ বা ‘শুভ্র’ চরিত্র নিয়ে কাজ শুরু করেন। কালানুক্রমিক পর্যালোচনায় না গিয়ে ২০০৬ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘হলুদ হিমু কালো র‌্যাব’ উপন্যাস দিয়ে শুরু করা যাক। নামেই বোঝা যায়, হিমুর পাশাপাশি এই উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে ২০০৪ সালে গঠিত বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

২০০৬ সালে আমাদের দেশের বাস্তবতায় র‌্যাব ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে থাকা এক স্পর্শকাতর ব্যাপার। তত দিনে সন্ত্রাস দমনের নামে অকাতরে মানুষ হত্যাকে তারা জায়েজ করতে সক্ষম হয়েছে। এ বিষয়ে কলম ধরা তখনকার বাস্তবতায় সহজ কাজ ছিল না। হিমুকে অবলম্বন করে র‌্যাবকে নিয়ে উপন্যাস লিখলেন হুমায়ূন।

হলুদ হিমু কালো র‌্যাব। প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০০৬। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
ছবি: সংগৃহীত

এখানে হুমায়ূন আহমেদ পাশাপাশি দুটো কাজ করছেন। একদিকে তিনি রসিকতার ছলে ক্ষমতার দম্ভে বেপরোয়া র‌্যাব বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে অনাবৃত করছেন এবং তাদের মিথ্যা বয়ানের সমালোচনা করছেন, অন্যদিকে তিনি তাদের সঙ্গে আম-মানুষের দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করছেন।

উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায়, এক সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে র‌্যাবের হাতে আটক হন হিমু। তাঁকে নিয়ে রাখা হয় এক গোপন ঘরে। সেই ঘরে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ‘মুরগি ছাদেক’ নামক এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর। হিমু তার সঙ্গে আলাপ করতে চান: ‘আমরা একসাথে আছি, আসুন আলাপ পরিচয় হোক। আমার নাম হিমু। আপনার নাম কী?’ মুরগি ছাদেক নিজের নাম না বলে প্রথমেই তার উদ্বেগ প্রকাশ করে, ‘এরা আমাকে মেরে ফেলবে। আজ রাতেই মারবে।’

মুরগি ছাদেকের উদ্বেগ সত্য হয়। পরদিন যথারীতি সে ক্রসফায়ারে নিহত হয়। ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী মুরগি ছাদেক ক্রসফায়ারে নিহত’ শিরোনামে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়: ‘গোপন খবরের ভিত্তিতে কারওয়ান বাজার এলাকা থেকে র‌্যাব সদস্যরা মুরগি ছাদেককে গত পরশু ভোর পাঁচটায় গ্রেপ্তার করে। তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। তার দেওয়া তথ্যমতো গোপন অস্ত্রভান্ডারের খোঁজে র‌্যাব সদস্যরা তাকে নিয়ে গাজীপুরের দিকে রওনা হয়। পথে মুরগি ছাদেকের সহযোগীরা তাকে মুক্ত করতে র‌্যাবের প্রতি গুলিবর্ষণ শুরু করে। র‌্যাব সদস্যরা পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করে। এই সুযোগে গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে পালিয়ে যাওয়ার সময় ক্রসফায়ারে মুরগি ছাদেক নিহত হয়। তার মৃতদেহের সঙ্গে পাঁচ রাউন্ড গুলিসহ একটি পিস্তল পাওয়া যায়।’

২০০৬ সালে আমাদের দেশের বাস্তবতায় র‌্যাব ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে থাকা এক স্পর্শকাতর ব্যাপার। তত দিনে সন্ত্রাস দমনের নামে অকাতরে মানুষ হত্যাকে তারা জায়েজ করতে সক্ষম হয়েছে। এ বিষয়ে কলম ধরা তখনকার বাস্তবতায় সহজ কাজ ছিল না। হিমুকে অবলম্বন করে র‌্যাবকে নিয়ে উপন্যাস লিখলেন হুমায়ূন।

হিমু প্রশ্ন করেন, ‘সবই ঠিক আছে, একটা শুধু সমস্যা। মুরগি ছাদেক পাঁচ রাউন্ড গুলি এবং পিস্তল নিয়ে র‌্যাবের সঙ্গে গাড়িতে বসেছিল? এত জিজ্ঞাসাবাদের পরেও কেউ বুঝতে পারেনি মুরগি ছাদেকের সঙ্গে গুলিভরা পিস্তল আছে?’

হিমুকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, তখন আমরা র‌্যাবের কয়েকটি রূপ দেখতে পাই। হিমুর হেঁয়ালির প্রতিক্রিয়ায় এক র‌্যাব সদস্য বলছে, ‘ফাজলামি ধরনের কথা বলে র‌্যাবের হাত থেকে পার পাওয়া যায় না, এটা জানো?’ তার উত্তরে হিমু বলে, ‘জানি স্যার। ওপরে আছেন রব আর নিচে আছেন র‌্যাব।’ অনুপ্রাসের মধ্য দিয়ে এই রসিকতার সৃষ্টি হলেও চূড়ান্ত ক্ষমতার প্রতি প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ আকারেও আমরা একে বুঝতে পারি।

অন্য এক জায়গায় র‌্যাবকে নিয়ে রচিত হিমুর ছড়া: ‘খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল/ র‌্যাব এল দেশে/ সন্ত্রাসীরা ধান খেয়েছে/ খাজনা দিব কিসে।’ এর মধ্য দিয়ে র‌্যাবকে বর্গীর সমতুল্য হিসেবে সাব্যস্ত করল হিমু, যাকে শেষ বিচারে শোষকের সমান্তরাল শ্রেণি হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া যায়।

কিন্তু হুমায়ূন–কল্পিত এই নিষ্ঠুর র‌্যাবের সঙ্গে আলাপও এগোনো যাচ্ছে। এমন না যে হিমুকে তারা ধমক দিয়ে পুরোপুরি খামোশ করে দিচ্ছে। তারা খেপে যাচ্ছে তা সত্য, কিন্তু আবার শান্ত হচ্ছে। হিমুকে ছেড়ে দেওয়ার আগমুহূর্তে আমরা দেখি, র‌্যাব বেশ নমনীয়। হিমু বেশ কিছু দাবিদাওয়া পেশ করছেন এবং র‌্যাব তা আমলেও নিচ্ছে। তার কথামতো তাঁকে গাড়ি করে মেসে নামিয়ে দিয়ে আসা হয়। তাঁর ছয় কাপ কফির দাম হিসেবে ষাট টাকা ফেরত দেওয়া হয় এবং সম্ভবত তাঁর কথা অনুযায়ী মুরগি ছাদেককে ক্রসফায়ারের আগে মুরগির ডিমের ভর্তাও খাওয়ানো হয়। যদিও উপন্যাসে তা উহ্য রয়েছে। কিন্তু ঘটনার পরম্পরায় মনে হয়, তাঁর এ অনুরোধও তারা আমলে নিয়েছে।

তবে এখানে বলে রাখা ভালো, আলাপের জায়গাটুকু তৈরি করার জন্য কথার মাধ্যমে র‌্যাবকে হিমুর চমকে দিতে হয়েছে। চমকে দিতে না পারলে তাঁর কথা এতটা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়া হতো কি না, তা বলা যায় না। তার মানে, একটা সীমার মধ্যে পারস্পরিক সংলাপের জায়গাটা তৈরি হচ্ছে, যা আদতে সাধারণের অগম্যই থেকে যাচ্ছে। কিন্তু এই যে হিমুর মধ্য দিয়ে জায়গাটাকে হুমায়ূন কিছুদূর এগিয়ে নিলেন, এটাই বা কম কী!

২. মিসির আলি

জগতের নানা রহস্যের অন্তসারশূন্যতা প্রমাণ করার জন্য হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্টি করেন ‘মিসির আলি’ চরিত্র। মিসির আলি সিরিজের সর্বশেষ উপন্যাস ‘যখন নামিবে আঁধার’ প্রকাশিত হয় হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর বছর, ২০১২ সালে। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক এ মল্লিক সাহেবের রহস্যঘেরা পরিবারকে নিয়ে এ উপন্যাস। মল্লিক সাহেবের দুই পুত্র: ছক্কা আর বক্কা। প্রথম রহস্য হলো, এই দুই ভাই তাদের পিতাকে দুইটা দেখে: এক পিতা ভালো, আরেক পিতা খারাপ। পিতার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বেশ শত্রুতাপূর্ণ। কর্তৃত্বপরায়ণ পিতা তার দুই পুত্রকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। চুন থেকে পান খসলে তাদের কান ধরে ওঠবস করান, মারধর করেন।

মজার বিষয় হলো, পিতা ও দুই পুত্র ছক্কা-বক্কা তাদের সব অভিযোগ–অনুযোগ জানাতে কিংবা পরামর্শ করতে প্রায় প্রতিদিনই মিসির আলির সঙ্গে দেখা করে। মিসির আলিও তাদের কথা মন দিয়ে শোনেন। কথা মনঃপূত না হলে বিরোধিতা করেন। নিজের মত দেওয়ার চেষ্টা করেন। মল্লিক সাহেবের ধারণা, তার দুই পুত্র তাদের মাকে কুয়ায় ফেলে খুন করেছে এবং তারা তাকেও কুয়ায় ফেলে খুন করবে। এ আশঙ্কার কথা তিনি মিসির আলিকে জানান। মিসির আলি তার মতো করে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু মল্লিক সাহেব বুঝতে চান না। তাতেও মিসির আলি খুব একটা বিরক্ত হন না।

যখন নামিবে আঁধার। প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০১২। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
ছবি: সংগৃহীত

একদিন হঠাৎ মল্লিক সাহেব নিখোঁজ হয়ে যান। কিন্তু দুই পুত্রের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তাদের বরং খুশিই মনে হয়। তারা প্রচার করতে থাকে যে তাদের পিতা মারা গেছেন। তারপরও একদিন তারা একটা হ্যান্ডবিলের খসড়া নিয়ে মিসির আলির সঙ্গে দেখা করতে আসে। লোকে কী বলবে, এ আশঙ্কা থেকে তারা ‘পিতা হারানোর বিজ্ঞপ্তি’ বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু হ্যান্ডবিলের নিচে ঠিকানা নেই, তাদের পিতা দেখতে কেমন, সে বিষয়েও ইঙ্গিত নেই। শুধু বিশ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা আছে। মিসির আলি তাদের এ দুটি বিষয় যুক্ত করার পরামর্শ দিলেও তারা তা গ্রহণ করে না। কিন্তু হ্যান্ডবিল যখন ছাপা হয়, তখন দেখা যায়, মিসির আলির পরামর্শ আমলে নেওয়া হয়েছে, তারা নিচে ঠিকানা যোগ করেছে।

পিতা ফিরে না আসায় ছক্কা-বক্কা তাঁর কুলখানির আয়োজনও সম্পন্ন করে ফেলে। কিন্তু কুলখানির দিনই তাদের পিতা ফিরে আসেন। কিন্তু একপর্যায়ে তাঁর আশঙ্কা সত্য হয়: দুই পুত্র তাদের পিতাকে কুয়ায় ফেলে হত্যা করে। যদিও তার পুত্রবধূরা দাবি করে যে এ হত্যা ছক্কা-বক্কা করেনি, করেছে তার দুই বোন। এ নিয়ে একটা ব্যাপক ধোঁয়াশা তৈরি হয়। একপর্যায়ে মিসির আলি এ বাড়ি ছেড়ে এক হোটেলে ওঠেন। সেখানে উঠেও রক্ষা হয় না। পিতা হত্যার দায়ে দুই ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর পুত্রবধূ পারুল মিসির আলির সঙ্গে দেখা করতে আসে এবং জানায় যে প্রয়াত শ্বশুরকে ইদানীং তারা দেখতে পাচ্ছে। তিনি খাওয়াদাওয়া করছেন, স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন, দুই পুত্রবধূকে আগের মতো ছোটকুত্তি আর বড়কুত্তি বলে ডাকছেন।

আরও রহস্যাবৃত হয়ে পড়ে ঘটনা। বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারুল মিসির আলিকে আবার মল্লিক সাহেবের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পর তাঁকে এক ঘরে আটকে ফেলা হয়। ছয় দিন পর সেই ঘর থেকে তাঁকে উদ্ধার করে পুলিশ। শেষমেশ মিসির আলি আবিষ্কার করেন যে মল্লিক সাহেবের এক সৎভাই রয়েছে এবং সেই সৎভাই মূলত খুন হয়েছে। তাঁর সেই সৎ ভাই-ই এত দিন ছক্কা-বক্কার পিতার প্রতিরূপ হিসেবে হাজির ছিল। দুই ভাইয়ের সাদৃশ্যের ফলেই এই বিভ্রম তৈরি হয়।

‘আপনি সারাক্ষণ বাইনোকুলার ফিট করে রাখছেন, এটা কি ঠিক? আপনার ওপর কেউ বাইনোকুলার ফিট করে রাখলে আপনার ভালো লাগত?’ যদিও হ্যালুসিনেশনের ছলে কাকের সঙ্গে এই কথোপকথন হচ্ছে, তারপরও এই অনন্ত সারভেইল্যান্সের যুগে সপ্রাণ সব সত্তাই তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে শঙ্কিত এবং এই উদ্বেগ মিসির আলিকেও ভাবাচ্ছে।

মিসির আলির যে ব্যাপার আমরা হুমায়ূনের সব উপন্যাসেই পাই, তা হলো, তিনি প্রচুর সংলাপে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ উপন্যাসেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। তিনি তাঁর কাজের ছেলে জসুর সঙ্গে নানা গুরুতর বিষয়ে আলাপে লিপ্ত হন। মল্লিক সাহেবের রহস্যঘেরা পরিবারের বিবদমান প্রতিটি পক্ষের সঙ্গেই ঠান্ডা মাথায় তিনি কথা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের নানা ভ্রান্ত ধারণাকে যুক্তির মাধ্যমে খণ্ডনের চেষ্টা করেন। এমনকি আমরা তাঁকে কাকের সঙ্গেও কথা বলতে দেখি। হোটেলের জানালা দিয়ে বাইনোকুলারে কাকের বাচ্চা ফোটানোর দৃশ্য দেখছিলেন মিসির আলি। কাক এসে তাকে জানায়, ‘আপনি সারাক্ষণ বাইনোকুলার ফিট করে রাখছেন, এটা কি ঠিক? আপনার ওপর কেউ বাইনোকুলার ফিট করে রাখলে আপনার ভালো লাগত?’ একটু পর কাক আবার জানাচ্ছে: ‘সবারই অনেক প্রাইভেট ব্যাপার আছে। হাগামুতা আছে। ঠিক কি না স্যার, আপনি বলেন?’ মিসির আলি জবাবে বলেন, ‘অবশ্যই ঠিক। আমি দুঃখিত। আর বাইনোকুলার ধরব না।’

যদিও হ্যালুসিনেশনের ছলে কাকের সঙ্গে এই কথোপকথন হচ্ছে, তারপরও এর একটা আলাদা তাৎপর্য আছে বলে মনে করি। নির্বাক কাকের এ সবাক রূপ থেকে আমরা অন্য একটি ইশারাও পাই। তা হলো, এই অনন্ত সারভেইল্যান্সের যুগে সপ্রাণ সব সত্তাই তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে শঙ্কিত এবং এই উদ্বেগ মিসির আলিকেও ভাবাচ্ছে।

উপন্যাসের শেষে আমরা দেখি, রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে মিসির আলি কূলকিনারা করতে পারছেন না; তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু তিনি যে থেমে যাচ্ছেন, তা–ও নয়। মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়েও আবার নেমে পড়ছেন অন্যের সঙ্গে কথা বলার অভিযানে, রহস্য অনাবৃত করার যাত্রায়। কিন্তু সব রহস্য তিনি ভেদ করতে পারেন না। ‘অমীমাংসিত রহস্য’ নামে তাঁর একটা নোটখাতা আছে, যাতে তিনি সুরাহার বাইরে থাকা রহস্যগুলো লিপিবদ্ধ করে থাকেন। মিসির আলি বলছেন না যে জগতের সব রহস্য মীমাংসাযোগ্য। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এ–ও বলছেন, যেসব রহস্য উদ্‌ঘাটন করা যাচ্ছে না, তার পেছনে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকেই বরং বেশি দায়ী। তার মানে তিনি রহস্যময়তাকে যতটা না আদি ও অকৃত্রিম রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তার চেয়ে বেশি বলার চেষ্টা করছেন যে রহস্য ভেদযোগ্য এবং রহস্য বিষয়ে এটাই মিসির আলির মীমাংসা। কিন্তু রহস্য উন্মোচনে মিসির আলির টুল হলো সংলাপ। সংলাপের মধ্য দিয়েই তিনি রহস্য উন্মোচনের দিকে এগোতে থাকেন। শুধু তা–ই নয়, যুক্তি ও অভিজ্ঞতার নিকষে সবকিছুকেই তিনি পরখ করেন। তার অস্তিত্ব নিয়ে ভিন্ন ধারণা পোষণ করেন।

১৮১৮ ও ১৮১৯ সালে রামমোহন রায় ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ ও ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ’ নামক দুটি প্রবন্ধ রচনা করেন। সংলাপধর্মী এ দুই প্রবন্ধে আমরা দেখি, রামমোহন কীভাবে শাস্ত্রাশ্রয়ী ও প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সে সময় লড়াই করছেন। যদিও তিনি প্রবর্তককে ঘায়েল করতে শাস্ত্র বা স্মৃতির আশ্রয় নিচ্ছেন, কিন্তু এ লড়াইয়ে তাঁর প্রধান অস্ত্র যুক্তি। যদিও ইংরেজদের মাধ্যমে আমরা সতীদাহ প্রথাবিরোধী আইন পাই, তবে যুক্তি ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এ আইনের সামাজিক ভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন রামমোহন।

যে ভিত্তিপুরাণ বা ফাউন্ডেশন মিথের ওপর সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে, তার বিরুদ্ধে যুক্তিনির্ভর লড়াই চালিয়ে যাওয়া সে যুগে যেমন কঠিন ছিল, এ যুগেও একই রকম কঠিন। তাতে সামান্য হেরফের ঘটেনি। হুমায়ূন আহমেদও এই সব মিথের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে নিজেকে শামিল করেছেন; মিসির আলি তাঁর সেই লড়াইয়ের অবলম্বন।

৩. শুভ্র

হিমু ও মিসির আলির তুলনায় হুমায়ূনের ‘শুভ্র’ চরিত্র কিছুটা আলাদা। হিমু ও মিসির আলির জীবনে যে অপার স্বাধীনতা, তা শুরুতে শুভ্রর জীবনে থাকে না। যদিও পিতার মৃত্যুর পর স্বাধীনতা উপভোগ করার সুযোগ পান তিনি।

হুমায়ূন আহমেদ (জন্ম: ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—মৃত্যু: ১৯ জুলাই ২০১২)
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

শুভ্রকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলোতেও দেখব, হুমায়ূন নানা বর্গের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সংলাপের জায়গা তৈরির চেষ্টা করছেন। তাদের মধ্যকার দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করছেন। শুভ্রর যিনি পিতা, তাঁকে আমরা কঠোর বৈষয়িক লোক আকারে পাই। কিন্তু সেখানেও দেখা যাচ্ছে, একটা সংলাপের জায়গা তৈরি হচ্ছে। পুত্রের যোগ্যতা ও সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান পিতা মাঝেমধ্যে পুত্রের কথা মেনে নিচ্ছেন। যদিও নানা শর্ত জুড়ে দিয়ে তারপর মানছেন, তারপরও একে আমরা অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনায় নিতে পারি।

শুভ্র চরিত্রের আরেকটি বিশেষ দিক হলো, এর মধ্য দিয়ে হুমায়ূন ধনী-গরিবের ব্যবধান ঘোচানোর চেষ্টা করছেন। দেখা যায়, বিত্তবান শুভ্রর বেশির ভাগ বন্ধুই দরিদ্র, ব্যর্থ। তাদের সঙ্গে শুভ্র দিনাতিপাত করছেন। মা–বাবার কথা অগ্রাহ্য করে তাদের বাড়িতে থাকছেন। এমনকি শেষ দিকে আমরা দেখছি, তিনি তাঁর পিতার গড়া ‘বেশ্যালয়ে’র দায়িত্ব নিচ্ছেন এবং তাদের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করছেন, তাদের কথা শুনছেন, তাদের দুঃখের ভাগীদার হচ্ছেন।

৪.

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯৯ সালে সক্রেটিসের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নগরের সঙ্গে দার্শনিকের যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, তা আমরা প্রথম টের পেলাম। সক্রেটিসের ইচ্ছা ছিল, সমাজে পারস্পরিক সংলাপের একটা জায়গা তৈরি করা। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যে সংলাপের জায়গা তৈরি করা সহজ কর্ম নয়।

সমাজের নানা বর্গের মানুষের সহাবস্থানের অন্যতম শর্ত হলো পারস্পরিক সংলাপের জায়গা তৈরি করা। নাহয় সংঘাত অবধারিত। সাহিত্যিক তাৎপর্যের বাইরে হুমায়ূন আহমেদের তিন চরিত্র হিমু, মিসির আলি ও শুভ্রের তাৎপর্য মনে হয় এখানেই। হুমায়ূন মূলত সংলাপের জায়গা তৈরির চেষ্টা করছেন, যে সংলাপের মধ্য দিয়ে সমাজের নানা মেরুতে থাকা মানুষের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচে আসবে।

শুভ্রকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলোতেও দেখব, হুমায়ূন নানা বর্গের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সংলাপের জায়গা তৈরির চেষ্টা করছেন। তাদের মধ্যকার দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করছেন। শুভ্রর যিনি পিতা, তাঁকে আমরা কঠোর বৈষয়িক লোক আকারে পাই। কিন্তু সেখানেও দেখা যাচ্ছে, একটা সংলাপের জায়গা তৈরি হচ্ছে।

তার এসব চরিত্রকে মাসকুলিনিটি বা প্রথাগত হিরোইজমের অ্যান্টিথিসিস আকারে আমরা বিবেচনা করতে পারি। এ চরিত্ররা খুব একটা আবেতাড়িত হয় না, তাদের ভেতর একধরনের দার্শনিক নির্লিপ্ততা থাকে। চিন্তায় কিংবা মেজাজের দিকে সম্পূর্ণ বিপরীত লোকজনের সঙ্গেও তারা সংলাপে লিপ্ত হচ্ছে। তাদের কটু কথা নিস্পৃহতার সঙ্গে হজম করছে। একই সঙ্গে বাজে প্রতিক্রিয়ার ভয় না পেয়ে নিজের কথাটাও বলছে।

হুমায়ূনের চরিত্ররা কোনো স্থিরবি শ্বাসে অটল নয়। এমনকি তারা নিজেই নিজের অবস্থানকে খণ্ডন করে। হুমায়ূন মানবের যে নির্বিকারত্ব প্রদর্শন করছেন, তা কেবলই তাঁর নিজের প্রণীত নির্বিকারত্ব নয়। এই নির্বিকারত্বের রসদ তিনি চারপাশ থেকে সংগ্রহ করেছেন।

অ্যাবসার্ডের জন্ম কীভাবে হয়, তা বলতে গিয়ে আলব্যের কামু বলেছিলেন, ‘মানুষ সব সময় যুক্তিহীনতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। সে সুখ চায়। ভাবে, একদিন হয়তো সবকিছু তার পক্ষে আসবে। তার এই বাসনা এবং পৃথিবীর নিখিল নীরবতার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে অ্যাবসার্ডের জন্ম হয়।’ হুমায়ূনের চরিত্রদের মধ্যেও আমরা হয়তো এই অ্যাবসার্ডের উপাদান পাব। কারণ, অ্যাবসার্ডের শর্তের মধ্যেই তার চরিত্রদের বসবাস।

মেহেদী হাসান
লেখক ও গবেষক, mehedi7119@gmail. com