জন্মশতবর্ষের নিবেদন
মুনীর চৌধুরীর নাটক কেন এত শক্তিশালী
মুনীর চৌধুরীর অনেক পরিচয়—নাট্যকার, ভাষাতাত্ত্বিক, সাহিত্য সমালোচক, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী। তবে নাটক রচনার মধ্য দিয়েই তিনি নিজের পরিচয়কে কেন্দ্রীভূত করেছেন, বিস্তৃত করেছেন। কেন তাঁর নাটক শক্তিশালী, এমনকি অনুবাদ নাটকের ক্ষেত্রেও—তার বিশ্লেষণ আছে এ লেখায়।
মুনীর চৌধুরীর নাটকের শক্তি কোথায়, এটা বোঝার জন্য তাঁর নাটকে ঢুকতে হবে। আমরা সরাসরি একটা নাটকে ঢুকে এই নাট্যকারকে বোঝার চেষ্টা করি। নাটকের নাম ‘গুর্গণ খাঁর হীরা’। এটি একটি অনুবাদমূলক একাঙ্কিকা। এই নাটক নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়নি। তবে একজন নাট্যকারের শক্তির জায়গা বোঝার জন্য তাঁর যেকোনো পূর্ণ নাটকই অবলম্বন হতে পারে। মুনীর চৌধুরী এটিকে ‘রহস্যময় প্রহসন’ হিসেবে নির্দেশ করেছেন। প্রহসন কি না, যথাস্থানে আলোচনা করা যাবে। আগে নাটকটি পড়া যাক।
নাটকের চরিত্র মাত্র পাঁচটি—মা, বাবা, মেয়ে, আগন্তুক ও আবিদ। কাহিনি সংঘটনের স্থান শহরের উপকণ্ঠে কোনো মধ্যবিত্তের বাড়ি। সেই বাড়ির বসার ঘরেই পুরো ঘটনা ঘটেছে। সেখানে বাবা খবরের কাগজ পড়ছেন, মা সোয়েটার বুনছেন, আর তাঁদের মেয়ে একটা মোটা বইয়ে মনোযোগ দিয়েছে। একই ঘরে পরিবারের তিনজনের উদাস-অবসর সন্ধ্যা কাটানোর ব্যাপারটি ষাটের দশকে, এমনকি পরবর্তী আরও দুই দশকে বাংলাদেশের শহরেও দেখা যেত। তবে সেটি তুলে ধরা নাট্যকারের উদ্দেশ্য নয়। কারণ, মূল নাটকেও সে রকম আছে।
লিখিত নাটক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সংলাপকে প্রধান বিবেচনায় নিতে হয়। সংলাপের মধ্য দিয়ে নাটক এগিয়ে চলে, সংলাপের মধ্য দিয়ে নাট্যিক দ্বন্দ্বও প্রকাশিত হয়। একাঙ্কিকাটি শুরু হয়েছে মায়ের সংলাপের মধ্য দিয়ে। মা বলছেন, ‘এই একঘেয়ে জীবনের মধ্যে কোনো আনন্দ নেই।’ বাবা ‘হুম’ বলে চুপ করে যান। মেয়ে দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে বইয়ে মন দেয়। মা আবার বলে, ‘বিকেল থেকে সময় আর কাটতে চায় না। সেই একই রকম সন্ধ্যা, একই রকম রাত। চা খাও, ঝিমোও। ভাত খাও, ঘুমোও। রোজই এক রকম। কোনো রদবদল নেই।’ বাবা সায় দেন, ‘শুধু তোমার একার নয়, আমাদের সকলের জীবনই ওই রকম।’
‘গুর্গণ খাঁর হীরা’ নাটকটি যেহেতু ‘অ্যালান মংকহাউসের দ্য গ্র্যান্ড চ্যাম’স ডায়মন্ড’-এর রূপান্তর, সুতরাং এটিকে পাঠ করতে হবে মূলের সঙ্গে মিলিয়ে। মূল নাটকের শুরুও একইভাবে, প্রায় একই সংলাপ দিয়ে। তাহলে প্রশ্ন, অনুবাদের মধ্য দিয়েও মুনীর চৌধুরী শক্তিশালী নাট্যকার হয়ে ওঠেন কীভাবে। ভালো নাট্যকারে এটি দুভাবে ঘটে—প্রথমত তাঁর অনুবাদের ভাষা পাঠকের কাছে কখনো খটমট ঠেকে না, দ্বিতীয়ত তিনি দেশীয় সমাজবাস্তবতায় কাহিনিকে সংস্থাপন করতে পারেন।
মুনীর চৌধুরীর নাটকের শক্তি কোথায়, এটা বোঝার জন্য তাঁর নাটকে ঢুকতে হবে। আমরা সরাসরি একটা নাটকে ঢুকে এই নাট্যকারকে বোঝার চেষ্টা করি। নাটকের নাম ‘গুর্গণ খাঁর হীরা’। এটি একটি অনুবাদমূলক একাঙ্কিকা। এই নাটক নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়নি।
মুনীর চৌধুরীর নাটকের ভাষা বাংলা বাক্যের সংগঠন ও ধরনকে গ্রহণ করে বাংলাই থেকেছে। মূল নাটকে মা চরিত্রের মিসেস পারকিনস বলছেন, “ইট মেকস আ লং ইভনিং’ অব ইট। সেম এভরি নাইট। উই ’অ্যাভ আওয়ার টি অ্যান্ড দেন উই জাস্ট সেট ডাউন টিল ইটস টাইম টু গো টু বেড। ইটস নট ফেয়ার।” সাধারণ অনুবাদে সংলাপটি এমন হওয়ার কথা: ‘এটা সন্ধ্যাটাকে দীর্ঘ করে দেয়। প্রতি রাতে একই রকম। আমরা চা পান করি এবং তারপর কেবল বসে থাকি বিছানায় শুতে যাওয়ার সময় না হওয়া পর্যন্ত। এটা ঠিক নয়।’
মুনীর চৌধুরী অনুবাদে ইংরেজি ভাষার সংগঠনকে অনুসরণ করেননি, বাংলা ভাষার বাক্যিক গঠন ও বাগ্ভঙ্গিকে গ্রহণ করেছেন। যে কারণে তিনি সংলাপে ‘চা খাও, ঝিমোও। ভাত খাও, ঘুমোও’ এভাবে বলতে পারেন। আবার ইংরেজি নাটকে যেখানে রাতের খাওয়া শেষ হওয়ার পর কাহিনি শুরু হয়েছে, বাংলা নাটকে সেখানে রাতের খাওয়ার আগে, সন্ধ্যায় ঘটনার শুরু। আবার, মূল নাটকে মেয়েটি যেখানে পাজল নিয়ে মেতে ছিল, বাংলা নাটকের মেয়েটি সেখানে গল্পের বই পড়ছে।
নাটকের শুরুই জানান দিচ্ছে, একঘেয়ে জীবনে আজকের সন্ধ্যাটি ব্যতিক্রম। গুর্গণ খাঁ নামের এক আমিরের একটি মহামূল্যবান হীরা চুরি গেছে। সেটি পত্রিকা মারফত বাবার কাছ থেকে পরিবারের অন্য দুই সদস্য জানতে পারে। খানিক বাদে সেই হীরা নাটকীয়ভাবে রাস্তা থেকে বন্ধ জানালার কাচ ভেঙে ঘরের ভেতরে এসে পড়ে! এরপর সামনে উত্তেজনার পারদ চড়তে কেবল বাকি থাকে। নাট্যিক দ্বন্দ্ব ও লক্ষ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে মুনীর চৌধুরীকে এখানে বাড়তি কৃতিত্ব দেওয়া যায় না, কারণ সেটির জন্য তাঁকে আলাদা চিন্তা করতে হয়নি। আবার তিনি এটিকে ‘প্রহসন’ বললেও আদতে প্রহসন নয়। বাংলা প্রহসন শুরু থেকেই সমাজের বদল ও সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়কে অবলম্বন করেছে। তা ছাড়া হাস্যরস থাকলেই তা প্রহসন হয় না। এই নাটকটিকে বরং রহস্য-রোমাঞ্চমূলক নাটক বলা যায়। তবে মূলের অনুকরণে অবধারিতভাবে এখানেও হাস্যরস আছে; সেটি বাংলা সংলাপে রক্ষা করতে পারাটাই পারঙ্গমতার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
‘গুর্গণ খাঁর হীরা’ প্রকাশিত হয় পাকিস্তানি ‘খবর’ পত্রিকায় ১৯৬৯ সালে। তবে হাস্যরস ও রঙ্গব্যঙ্গের প্রতি মুনীর চৌধুরীর আগ্রহের ব্যাপারটি অনেক পরের ব্যাপার নয়। লেখালেখির প্রায় শুরু থেকেই তিনি হাস্যরসকে লেখার উপজীব্য করেছেন। এটি তাঁর প্রবন্ধের মধ্যেও দেখা যায়। যেমন তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা ‘আসুন চুরি করি’ নামের একটি প্রবন্ধ ‘সওগাত’–এর ১৩৫০ সালের আষাঢ় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি সাহিত্যের চুরিকে রীতিমতো সরস ব্যঙ্গে প্রকাশ করেছেন। অনুবাদে তাঁর আগ্রহের সূত্র এই প্রবন্ধ থেকেও পাওয়া যাবে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘সাহিত্যে চুরি, চুরি নয়’। বিশ্বসাহিত্যের উপাদান চুরির কৌশলও প্রাবন্ধিক শিখিয়েছেন: ‘আপনি একটা বিদেশি বই পড়ুন—ইংরেজি, উর্দু, ফারসি—যেটা আপনার আসে। কোনো একটা বিশেষ রচনা পছন্দ করে নিন। অন্য একটা রচনার টেকনিক টেনে এনে ফিট করে দিন এটায়। তারপর ঐ বইটা না দেখে নিজের ভাষায় স্বচ্ছন্দ গতিতে লিখে যান ওই প্লটটা।’ এভাবে তৈরি হওয়া সাহিত্যকে ‘সম্পূর্ণ মৌলিক’ বলে স্বীকৃতি দিতে চান মুনীর চৌধুরী।
রূপান্তরের কৌশল সম্পর্কে মুনীর চৌধুরী বলেছেন, ‘বিদেশি বই থেকে প্লট আপনার হলো। সেটা মনের পেছনে রেখে সেই বিদেশি চরিত্রের অস্তিত্বকে ভুলে যান। টেনেহিঁচড়ে নিজের চেনা দু–একটা মুখ এনে দাঁড় করিয়ে দিন শূন্য স্থানগুলোতে। বিদেশিতে আলখাল্লা থাকলে, দিশিতে [দেশি] আপনি পাঞ্জাবি করে দিন—সুট থাকলে আচকান ইত্যাদি। ইংরেজিতে আপনি যদি অর্গান পেলেন, বাংলায় হারমোনিয়াম কি কাঁসরঘণ্টা পর্যন্ত নাবতে পারেন। উর্দুতে যদি রাবড়ি পেলেন, তবে ইংরেজিতে চকলেট রাখুন, আবার বাংলায় সময় বুঝে ডালমুট অবধি বসিয়ে দিতে পারেন।’
‘আপনি একটা বিদেশি বই পড়ুন।... কোনো একটা বিশেষ রচনা পছন্দ করে নিন। অন্য একটা রচনার টেকনিক টেনে এনে ফিট করে দিন এটায়। তারপর ঐ বইটা না দেখে নিজের ভাষায় স্বচ্ছন্দ গতিতে লিখে যান ওই প্লটটা।’ এভাবে তৈরি হওয়া সাহিত্যকে ‘সম্পূর্ণ মৌলিক’ বলে স্বীকৃতি দিতে চান মুনীর চৌধুরী।
রচনাকে সরস করার একটি কৌশল—অসংগতিকে স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে তুলে আনা। মুনীর চৌধুরী সেটি তো করেছেনই, আবার সমাজের সংকীর্ণতাকেও সরস রচনার বিষয় করেছেন। আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘জীবনের নানাবিধ অসংগতি এবং সমাজের বিভিন্নমুখী অনুদারতা নিয়ে তীব্র রঙ্গব্যঙ্গের প্রবণতাই ছিল মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যচর্চার আদিপর্বের মূল বৈশিষ্ট্য।’ রঙ্গব্যঙ্গের এই ধারা প্রবাহিত হয়েছিল তাঁর রচিত স্বল্পসংখ্যক ছোটগল্পেও।
মুনীর চৌধুরীর নাটকের আসল জোর ছিল সংলাপে। অনুবাদের সময়ে প্রয়োজনে তিনি চরিত্রের নামও বদলে দিয়েছেন। যেমন, রিচার্ড শেরিডানের ‘দ্য স্কুল ফর স্ক্যানডাল’ নাটকের সংলাপের ভেতরে থাকা চরিত্রের নাম বদলে দিয়েছেন এভাবে: ক্যাপ্টেন বোসটল হয়ে গেছে ক্যাপ্টেন বেপরোয়ারী, মিসেস ক্লাচকিট হয়ে গেছে মিসেস বাচালী, লর্ড বাফেলো হয়ে গেছে নওয়াবজাদা মহীষুল্লাহ। এই নাটকটি অবশ্য মুনীর চৌধুরী শেষ করেননি। হয়তো তিনি মনে করেছিলেন শেরিডানের নাটকের আঠারো শতকের সমাজবাস্তবতায় বিশ শতকের পূর্ব বাংলাকে হাজির করা যায় না, কিংবা ঠিক হবে না।
মুনীর চৌধুরী হাস্যকৌতুকের জগতে স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন। বার্নার্ড শর ‘ইউ নেভার ক্যান টেল’ নাটকের রূপান্তর করেন ‘কেউ কিছু বলতে পারে না’ নামে। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত নাটক। এই নাটকেও তিনি হাস্যরসের জগতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এখানেও তিনি বিদেশি নাটকের চরিত্রের নাম ও ঘটনার পটভূমি পাল্টে দেশজ রূপ দিয়েছেন। যেমন, মূল নাটকের পরিচারিকা রূপান্তরিত নাটকে কম্পাউন্ডারে পরিণত হয়েছে। আবার মূল নাটকের ক্যাম্পটন চরিত্র ইয়ট বানায়, অনুবাদে সে হয়েছে ইয়াজদানী—কাঠের ব্যবসাদার। নাটকে ওয়েটার তাঁকে পাবলিক হাউসের মালিক ক্যাম্পটনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে, আর রূপান্তরে সৈয়দ চরিত্র তাঁকে হেকিমি দাওয়াখানার ট্যারা ইয়াজদানীর সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে।
‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ নাটকটির ভাষান্তরের ব্যাপারে মুনীর চৌধুরীর বিশেষ আত্মবিশ্বাস ছিল। এর আগের অনুবাদমূলক নাটকগুলোকে তিনি রূপান্তর বলেছেন, বড়জোর বলেছেন ভাবানুবাদ। ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ নাটকেই তিনি প্রথম প্রায় হুবহু মূলের অনুসরণ করেছেন। তবে এখানে সংকট ছিল আরেক রকম। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের পদ্য সংলাপের নাটক তিনি অনুবাদ করেছেন গদ্যে। অথচ সেখানে সাধ্যমতো মূলের শব্দ ও চরণকে অনুসরণ করেছেন। গদ্য অনুবাদে ভাষা বিস্তৃত হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে, মুনীর চৌধুরী সেটি সতর্কতার সঙ্গে পরিহার করেছেন। মূল নাটকে চরিত্রের পারস্পরিক বাগ্যুদ্ধ লক্ষণীয়। এই নাটকের অনুবাদে মুনীর চৌধুরীর আগ্রহের মূল কারণ হয়তো এটিই। তিনি নাটকের সংলাপ রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন; অপরের নাটকের সংলাপ-পরম্পরায়ও মুগ্ধ হয়েছেন।
মুখরা রমণী বশীকরণ নাটক সে সময় জনপ্রিয়তা পায়—মঞ্চে, এ ছাড়া টেলিভিশনে প্রচারের কারণেও। এই উদ্দীপনা থেকে মুনীর চৌধুরী হাত দেন শেক্সপিয়াসের ‘ওথেলো’, ‘রোমিও জুলিয়েট’ ও ‘মাচ আদো অ্যাবাউট নাথিং’ নাটকের অনুবাদে। নাটকগুলো শেষ করে যেতে পারেননি। যেসব খণ্ডাংশ পাওয়া যায়, তা থেকে স্পষ্ট যে এসব নাটকের ক্ষেত্রেও তিনি মূলকে হুবহু অনুসরণ করার পদ্ধতি অবলম্বন করতে চেয়েছেন।
মুনীর চৌধুরীর নাটকের আসল জোর ছিল সংলাপে। অনুবাদের সময়ে প্রয়োজনে তিনি চরিত্রের নামও বদলে দিয়েছেন। চরিত্রের নাম বদলে দিয়েছেন এভাবে: ক্যাপ্টেন বোসটল হয়ে গেছে ক্যাপ্টেন বেপরোয়ারী, মিসেস ক্লাচকিট হয়ে গেছে মিসেস বাচালী। লর্ড বাফেলো হয়ে গেছে নওয়াবজাদা মহীষুল্লাহ।
কথার পিঠে কথা তৈরি করতে পারার দক্ষতা মুনীর চৌধুরীর মধ্যে প্রবল ছিল। যেমন, ‘জমা খরচ ইজা’ নাটকে জয়নাব বলে, ‘আমি জীবনে কারও কাছ থেকে এ রকম কথা শুনিনি।’ জবাবে জামাল বলে, ‘না শোনারই কথা। হিসেবের এই নিয়ম আমিই প্রথম চালু করলাম।’ আবার মহারাজ নাটকে গমীর বলে, ‘না না ওকে গুলি করবেন না। ও তো এমনিতেই আমাদের জন্য মরতে চায়।’ জবাবে মহারাজ বলে, ‘বেশি বকবক করলে ওকে চাইতে হবে না, আমিই খতম করে দেব।’
সরসতা ও ব্যঙ্গবিদ্রূপের বাইরে নাটকে বিষাদ ও বেদনার ব্যাপারটিও অবলম্বন করেছেন মুনীর চৌধুরী। এ দুটি ব্যাপার নাটকের রস বিবেচনা ও শ্রেণিকরণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। বিষাদের ব্যবহার ‘রূপার কৌটা’ নাটকেই প্রথম দেখা যায়। তবে অনুবাদ নাটক হওয়ার কারণে এখানেও নানামুখী রূপান্তর ঘটেছে। মূল নাটকে মি. জোনস কথা বলে ককনি টানে, মিসেস জোনস কথা বলে প্রমিত ভাষায়। রূপান্তরে সোনার মা কথা বলে ঢাকাইয়া ভাষায়, কুদ্দুস কথা বলে প্রমিত বাংলায়। মৌলিক নাটকেও ট্র্যাজেডির প্রকাশ ঘটেছে। রক্তাক্ত প্রান্তর এর আদর্শ নমুনা। সেখানে যুদ্ধবিরোধী চেতনা আছে, গোষ্ঠীগত সংঘাতবিরোধী মনোভাব আছে, তবে আরও বেশি আছে ব্যক্তিহৃদয়ের দ্বন্দ্ব ও হাহাকার। মানুষের অনুভূতিকে এভাবে ধরার চেষ্টা মানুষ এবং অন্য নাটকেও পাওয়া যাবে।
হর্ষ ও বেদনা—দুটিই মুনীর চৌধুরী নাটকে প্রবলভাবে বিরাজ করে। সংলাপে এ দুটির প্রকাশেই তাঁর কৃতিত্ব। বাক্স্ফূর্তির মধ্য দিয়েই তিনি নাটককে এগিয়ে নেন এবং এর মধ্য দিয়েই তিনি নাট্যিক দ্বন্দ্বকে ধরে রাখেন।