আইয়ুব বাচ্চু কেন এত জনপ্রিয়

আজ ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চুর জন্মদিন। কেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন তিনি?

আইয়ুব বাচ্চুছবি: সংগৃহীত

মিথ বা জনশ্রুতি কখনো কখনো সত্য-মিথ্যাকে ছাপিয়ে অংশ হয়ে যায় মানবসমাজের। সেই ‘পুরাণের পাখি’ ফিনিক্সের মতো সময়ের প্রয়োজনে জেগে ওঠে ছাই থেকে। সংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু পৌরাণিক কাহিনি থেকে উঠে আসা কোনো চরিত্র নন। তবে বাংলার রক সিনারিওতে তিনি এমন এক মিথ, যার মৃত্যু নেই। বাংলায় কোনো রকারের জন্ম মানে নবরূপে আইয়ুব বাচ্চুরই ‘পুনরুত্থান’। কিন্তু কেন আইয়ুব বাচ্চু এত জনপ্রিয়?

আমাদের শৈশবে আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি শোনা শ্রুতি হলো, নিউইয়র্কে শো করতে গিয়ে সেখানকার গিটার সেন্টারের সবচেয়ে দামি গিটারটি বাজিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে অপমানের শোধ তোলার তাঁর সেই ঘটনা। আইয়ুব বাচ্চু বাংলাদেশ থেকে এসেছেন শুনে সেই সেন্টারের ব্যবস্থাপক কাচের বাক্সে রাখা গিটারটি শুরুতে তাঁকে দেখাতে চাননি। কিন্তু অপমান সহ্য করার মতো ব্যক্তি নন আইয়ুব বাচ্চু। অনেক অনুরোধের পর গিটারটি হাতে নিয়ে বাজালেন। তাঁর বাদন দেখে অবাক হলেন আশপাশের লোকজন। পরে সেই ব্যবস্থাপক ভুল বুঝতে পেরে অর্ধেক দামে গিটারটি দিতে চেয়েছিলেন তাঁকে। মার্কিন মুলুকে আইয়ুব বাচ্চুর এই জয় আমাদের কাছে ছিল পুরো বাংলাদেশের জয়।

এই সত্য আজ এমন এক মিথে রূপান্তরিত হয়েছে, যা দেশের রকপ্রেমী প্রতিটি প্রজন্মকে আজীবন সাহস জুগিয়ে যাবে। জনশ্রুতি তাঁকে নিয়েই হয়, যিনি জনমানুষের অংশ হতে পারেন। সে জায়গায় আমাদের দেশের সংগীত–ইতিহাসে আইয়ুব বাচ্চু অদ্বিতীয়। তাঁর গান সমাজের ওপরতলা থেকে নিচতলা—প্রতি স্তরের মানুষের কানেই পৌঁছেছে। ‘সেই তুমি’, ‘রুপালি গিটার’, ‘কষ্ট’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘প্রেম তুমি কী’, ‘পালাতে চাই’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘ভাঙা মন নিয়ে’—এসব গানের জনপ্রিয়তা আজও কি কমেছে? আশির দশকের শেষ থেকে আজও বেজে চলেছে বাচ্চুর গিটার।

এত ভালোবাসা নিয়ে চলে যাওয়া আইয়ুব বাচ্চুর জন্মদিন আজ, ১৬ আগস্ট। আর কী আশ্চর্য, দিনটি যে রক অ্যান্ড রোলের আরেক কিংবদন্তি এলভিস প্রিসলির মৃত্যুদিবসও! এ যেন একই দিনে দুই নক্ষত্রের উদয় আর অস্ত। আইয়ুব বাচ্চু নেই। রয়েছে তাঁর গান ও চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে স্থাপিত ‘রুপালি গিটার’।

লিড গিটারে বাংলাদেশে তো বটেই, উপমহাদেশেও আইয়ুব বাচ্চু অতুলনীয় হয়ে আছেন। সেই কীর্তি তাঁর গায়কিকেও ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে আজকের সময়ে গিটারের জনপ্রিয়তার মূলে তিনি। ‘ব্যান্ডশিল্পী’ বলতে মানুষের যে দৃষ্টিকটু চাহনি ছিল, সেটা অনেকটাই পাল্টে দিয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। বিশেষ করে, নব্বই দশকে তরুণ প্রজন্মের ভেতর ব্যান্ডের প্রতি ভালোবাসার বীজ রুয়ে দিয়েছিল আইয়ুব বাচ্চুর ‘এলআরবি’, জেমসের ‘ফিলিংস’ ও হাসানের ‘আর্ক’। পাশাপাশি অন্য ব্যান্ডগুলো তো ছিলই। তবে বাচ্চুর ব্লুজ-জ্যাজের সঙ্গে রকের দুর্দান্ত কম্পোজিশন ছিল ভিন্ন। জেমস-হাসানের লুক ও রকের সঙ্গে আইয়ুব বাচ্চুর পার্থক্য ছিল এখানেই। ‘সোলস’ থেকে বেরিয়ে গেলেও তাদের মেলোডিক প্রভাবও ছিল তাঁর গানে।

আইয়ুব বাচ্চু

তবে আইয়ুব বাচ্চুর বিপুল জনপ্রিয়তার পেছনে বড় অনুঘটক ছিল আইয়ুব বাচ্চুর গানের কথা ও মাস্টার গিটার প্লেয়িং। সে সময়ের বাঙালির মধ্যবিত্ত সমাজ তো এরিক ক্ল্যাপটনকে সরাসরি দেখেনি। তারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রায় তাঁর মতো গিটার বাজাতে ও গাইতে দেখেছে আইয়ুব বাচ্চুকে। আবার ওপেন হোক বা ক্লোজডোর; জনসমুদ্র হয়ে যাওয়া কনসার্টে ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষ দেখেছেন আরেক আইয়ুব বাচ্চুকে, যিনি নিজে এবং যাঁর গান মিশে যেতে পেরেছে সবার সঙ্গে। শ্রোতারা সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছেন তাঁর গানের সঙ্গে। বিরহকাতর বা নস্টালজিক যুবকের জন্য ‘সেই তুমি’ বা ‘এখন অনেক রাত’-এর মতো গান যেমন তিনি গেয়েছেন, তেমনি একটু ক্ল্যাসিক ঘরানার শ্রোতাদের জন্য ‘রাজকুমারী’। ভবঘুরে, রকপ্রেমী বা প্রেমিক তরুণের জন্য ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘বারো মাস’ ও ‘আরও বেশি কাঁদালে’র মতো গানও উপহার দিয়েছেন বাচ্চু। এমনকি জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘বনলতা সেন’ও পুনর্নির্মিত অবয়বে কথা বলেছে আইয়ুব বাচ্চুর গিটারের জাদুতে।

আইয়ুব বাচ্চু ব্যান্ড সংগীতে নির্দিষ্ট একটি ঘরানায় আবদ্ধ থাকেননি। আজম খানের মতো ‘পপসম্রাট’ বা জেমসের মতো ‘গুরু’ উপাধি পাওয়া হয়নি বটে তাঁর, তবে অবিসংবাদিতভাবে তিনিই ছিলেন ব্যান্ড সংগীতের প্রাণপুরুষ। তরুণ থেকে সমবয়সীদের আগলে রাখার জন্য তাঁর একটা হাত ছিল বরাদ্দ, যার কারণে ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট আইয়ুব বাচ্চুর আকস্মিক মৃত্যুতে স্কয়ার হাসপাতালের সামনে সকালে ভিড় জমিয়েছিলেন দেশের অসংখ্য ব্যান্ড সংগীত তারকা থেকে সাধারণ মানুষ। সে সময় জেমস এক কনসার্টে আইয়ুব বাচ্চুকে হারিয়ে কান্না ধরে রাখতে পারেননি। কেঁদেছিলেন সংগীতপ্রেমী সর্বস্তরের মানুষ। মৃত্যুর পর তাঁর এই প্রাপ্তি কেবল জনপ্রিয় গান উপহার দেওয়ার জন্য নয়, মানুষ আইয়ুব বাচ্চুকে ভালোবেসেছে, শ্রদ্ধা করেছে সংগীতের প্রতি তাঁর নিরেট আবেগ, ভালোবাসা, প্রতিশ্রুতি আর আত্মত্যাগের জন্য। মৃত্যুর পরও তাতে ভাটা পড়েনি।

আইয়ুব বাচ্চু

এত ভালোবাসা নিয়ে চলে যাওয়া আইয়ুব বাচ্চুর জন্মদিন আজ, ১৬ আগস্ট। আর কী আশ্চর্য, দিনটি যে রক অ্যান্ড রোলের আরেক কিংবদন্তি এলভিস প্রিসলির মৃত্যুদিবসও! এ যেন একই দিনে দুই নক্ষত্রের উদয় আর অস্ত। আইয়ুব বাচ্চু নেই। রয়েছে তাঁর গান ও চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে স্থাপিত ‘রুপালি গিটার’। ভবিষ্যতে হয়তো এই গিটার মিসরের পিরামিডের মতো কালের সাক্ষী হয়ে বলে যাবে অসংখ্য কথা। আর আমাদের এই মিথের দুনিয়ায় রয়ে যাবে আইয়ুব বাচ্চুর ‘হাসি শেষের নীরবতা’। পাখির মতো স্টেজে ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’ গাইতে গাইতে আজম খানের মতো কেউ আর ডাক দেবেন না ‘গা বাচ্চু’। এই ‘বাচ্চু’ গান দিয়েই বাংলাদেশের মানুষের ঘরের সন্তান হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে কীভাবে ভুলবে মানুষ!