সুফিয়া কামালের প্রথম ছবি

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

এমন একটা সময় ছিল, যখন ছবি তোলাকে গর্হিত কাজ বলে মনে করা হতো। সেই সময় মুসলমান পুরুষরাও ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর সাহস দেখাতেন না। আর অন্তঃপুরের নারীদের ছবি তোলা তখন ছিল এক কল্পনাতীত ব্যাপার! ওই রকম একটা রুদ্ধ সময়ে রক্ষণশীল সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলেন কবি সুফিয়া কামাল। কলকাতার বিখ্যাত সি. গুহ স্টুডিওতে তোলা হয় ছবি। সেই ছবি ছাপা হয় ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, মাসিক সওগাত পত্রিকার মহিলা সংখ্যায়। ছবিটি যখন তোলা হয়, তখন সুফিয়া কামালের বয়স ১৮। সওগাতের পাঠকের কাছে তিনি তখন পরিচিত ছিলেন সুফিয়া এন. হোসেন নামে।

সুফিয়া কামাল। সওগাত [মহিলা সংখ্যা], ভাদ্র ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত। আলোকচিত্র: চারু গুহ
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ছবিটি কেন কিংবা কোন পরিস্থিতিতে তোলা হয়—তার আদ্যোপান্ত লিখে গেছেন নারীজাগরণের পথিকৃৎ ও সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। ‘বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ’ গ্রন্থের ৫৬৫ থেকে ৫৬৭ নম্বর পৃষ্ঠায় রয়েছে এ ঘটনার বিবরণ। সুফিয়া কামাল তখন সওগাতে নিয়মিত লিখতেন। সওগাত তখন কলকাতার প্রভাবশালী সাহিত্য সাময়িকপত্র। এই পত্রিকার প্রায় প্রতি সংখ্যায় কবিতা ছাপা হওয়ার কারণে সুফিয়া এন. হোসেন নামটি তখন অনেকের কাছেই পরিচিত। কিন্তু তখন পর্যন্ত কেউ তাঁর ছবি দেখেনি। ওই সময় অন্য নারীদের মতো তিনিও ঘরের ভেতর বোরকা পরে থাকতেন।

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন একদিন সুফিয়া এন. হোসেনের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন। সুফিয়ার বাড়িতে এটাই তাঁর প্রথম যাওয়া। সুফিয়ার স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন নাসিরউদ্দীন সাহেবকে সাদরে তাঁর ঘরে বসালেন। সুফিয়াকে ডেকে বললেন, ‘দেখে যাও কে এসেছেন!’ সুফিয়া তাড়াতাড়ি এসে সম্পাদক সাহেবকে সালাম জানালেন। কুশল বিনিময় করলেন। সম্পাদক সাহেব বললেন, ‘মুসলমান নারীদের রচনা ও তাঁদের ফটো দিয়ে মহিলা সওগাত বের করব। তার জন্য ছবি দরকার।’ সুফিয়া বললেন, ‘আমার ফটো তো কোনো দিন তোলাই হয়নি।’

রক্ষণশীল সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলেন কবি সুফিয়া কামাল। কলকাতার বিখ্যাত সি. গুহ স্টুডিওতে তোলা হয় ছবি। সেই ছবি ছাপা হয় ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, মাসিক সওগাত পত্রিকার মহিলা সংখ্যায়। ছবিটি যখন তোলা হয়, তখন সুফিয়া কামালের বয়স ১৮।
আরও পড়ুন

নাসিরউদ্দীনের পরিকল্পনা শুনে নেহাল হোসেন খুবই আশ্চর্য হলেন। বললেন, ‘মুসলমানদের কেন, হিন্দু সমাজেরও কোনো পত্রিকার মহিলা সংখ্যা আজ পর্যন্ত বের হয়নি। আমাদের গোঁড়া সমাজে আপনি এ কাজ করে যাচ্ছেন, আপনার সাহসকে ধন্যবাদ। আর সুফিয়ার ফটোর কথা বলছেন, আপনিই তো তাঁকে কবি করেছেন [বানিয়েছেন]। তাঁর ফটো তুলতে চান, তুলুন। এর জন্য আমার অনুমতি নিতে হবে না। সে ভার আপনার ওপরই রইল। তবে এ ছবি নিয়ে বাড়িতে যে ঝামেলা বাঁধবে, তার মোকাবিলা আমি করব।’ নাসিরউদ্দিন বললেন, ‘আপনিও চলুন। আমি আর আপনি মিলে ওকে নিয়ে যাই ফটো তুলতে।’ নেহাল হোসেন হেসে বললেন, ‘আপনার ওপর আমাদের যতটুকু বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা আছে, তা ক্ষুণ্ন করতে চাই না। আমি যাব না, আপনিই ওকে নিয়ে যান। ফটো তুলে আবার ঘরে দিয়ে যাবেন।’ সুফিয়াকে বললেন, ‘বিলম্ব কোরো না, তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নাও।’

নাসিরউদ্দীন সুফিয়াকে নিয়ে গেলেন কলেজ স্ট্রিটে। সেখানকার অ্যালবার্ট হলের তিনতলায় সি. গুহ স্টুডিও। সুফিয়াকে দেখেই সি. গুহ সম্পাদক সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইনি কে?’ সম্পাদক সাহেব বললেন, ‘ইনি একজন কবি, নাম সুফিয়া এন. হোসেন। সওগাতে বোধ হয় এর কবিতা দেখেছেন।’ গুহ বাবু বললেন, ‘এর নাম অনেকের মুখেই শুনেছি।’ নাসিরউদ্দীন বললেন, ‘সওগাতে এর ফটো ছাপব।’ গুহ বাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘তাতে আপনার দশাটা কী হবে, ভেবে দেখেছেন? আপনাদের ধর্মান্ধ সমাজের কথা ভালো করেই জানি। আমি তো এখন পর্যন্ত কোনো মুসলমান মেয়ের ফটোই তুলিনি। এর ফটো সওগাতে বের করলে আপনার পিঠের চামড়া থাকবে তো?’ নাসিরউদ্দিন বললেন, ‘আমাদের সমাজের এসব কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধে নেমেছি। এবার মহিলাদের ছবিসহ সওগাতের মহিলা সংখ্যা বের করব।’

নাসিরউদ্দীনের পরিকল্পনা শুনে নেহাল হোসেন খুবই আশ্চর্য হলেন। বললেন, ‘মুসলমানদের কেন, হিন্দু সমাজেরও কোনো পত্রিকার মহিলা সংখ্যা আজ পর্যন্ত বের হয়নি। আমাদের গোঁড়া সমাজে আপনি এ কাজ করে যাচ্ছেন, আপনার সাহসকে ধন্যবাদ। সুফিয়ার ফটো তুলতে চান, তুলুন।

সেদিন সি. গুহ অতি যত্নসহকারে সুফিয়ার বেশ কয়েকটি ছবি তুললেন। পারিশ্রমিক তো নিলেনই না, বরং নিজ থেকেই ছবিগুলো প্রিন্ট করে সওগাত অফিসে পাঠিয়ে দিলেন। ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে সওগাতের মহিলা সংখ্যা প্রকাশিত হলো। সেই সংখ্যায় ‘বিড়ম্বিতা’ শিরোনামে সুফিয়ার একটি দীর্ঘ কবিতা ছাপা হয়। কবিতার পাশাপাশি ছাপা হয় ছবিও। পত্রিকায় নারীদের ছবি ছাপানোর কারণে লোকজনের তীব্র নিন্দা আর সমালোচনার মুখে পড়লেন নাসিরউদ্দীন। অপর দিকে মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হতে থাকল সওগাতের মহিলা সংখ্যা। বাজারে পত্রিকা না পেয়ে যাঁরা সমালোচনায় মেতে উঠেছিলেন, তাঁরাও মহিলাদের ছবি দেখার জন্য সওগাত অফিসে এসে ভিড় জমান। সেই ভিড় সামাল দিতে নাসিরউদ্দীনকে বেশ হিমশিম খেতে হয়।

চারুচন্দ্র গুহ। আলোকচিত্র: সি. গুহ স্টুডিও
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

পত্রিকায় ছবি ছাপানের জন্য সুফিয়াকে কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। তবে কবিতা লেখার কারণে তাঁকে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। তাঁর আত্মীয়রা এটিকে কাব্য হিসেবে না নিয়ে ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনি বলে বিবেচনায় নেন। কবিতার যে যে অংশে দুঃখ ও বেদনার কথা আছে, তা সুফিয়ার ব্যক্তিগত দুঃখকষ্ট মনে করে পরিবারের লোকজন বলাবলি করতে লাগলেন, আমরা সুফিয়াকে কোন বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলেছি, কিংবা কী এমন কষ্ট দিয়েছি যে তাঁকে এ ধরনের কবিতা লিখতে হলো!

নাসিরউদ্দীনের লেখার সূত্র ধরেই আমি আলোকচিত্রী সি. গুহকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। সিদ্ধার্থ ঘোষের ‘ছবি তোলা: বাঙালির ফোটোগ্রাফি-চর্চা’ বইয়ে তাঁর সম্পর্কে সামান্য তথ্য পাই। জানতে পারি তাঁর পুরো নাম চারুচন্দ্র গুহ [২৪ এপ্রিল, ১৮৮৪-৩ নভেম্বর ১৯৫৭]। এরপর ২০০৭ সালে ‘চারু গুহ: জীবন ও আলোকচিত্র’ নামের যে সংকলনটি প্রকাশিত হয়, সেটি আমাকে পাঠান গবেষক তারেক আজিজ। ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া গ্রামে জন্ম নেওয়া চারু গুহর পৈতৃক বাড়ি বরিশালে আর নানাবাড়ি বিক্রমপুরের হাঁসাড়ায়। যে কয়েকজন পথিকৃতের হাত ধরে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে স্টুডিও ফটোগ্রাফির গোড়াপত্তন হয়, চারু গুহ তাঁদের অন্যতম। ১৯০৮ সালে ঢাকার সদরঘাটের কাছে তিনি একটি স্টুডিও স্থাপন করেছিলেন। এর আগে ঢাকায় দুটি স্টুডিও ছিল। একটি ‘ক্যাপ ফ্রিৎস ফটোস’, আরেকটি ‘বেঙ্গল স্টুডিও’। ১৯১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন চারু। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরূপ পরিস্থিতিতে তিনি আর স্টুডিওটি চালিয়ে রাখতে পারলেন না। ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেলেন কলকাতায়। সেই থেকে নিজের দেশেই পুরোপুরি বিস্মৃত স্টুডিও ফটোগ্রাফির এই পথিকৃৎ!