মিলান কুন্ডেরার সত্য আবিষ্কার

১১ জুলাই মঙ্গলবার মারা গেছেন বিশ্বখ্যাত চেক ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা। জীবদ্দশায় তিনি যেমন আলোচিত ছিলেন, তেমনি সমালোচনাও কম ছিল না তাঁকে নিয়ে। লেখালেখির মধ্য দিয়ে আদতে কোন সত্য আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন তিনি?

মিলান কুন্ডেরা
ছবি: সংগৃহীত

বৎসরের পূজা শেষে রেখে গেছে তাকে ওরা গাছের তলায়
সে একাকী অধীশ্বর—আলো করে আছে এই জনহীন বন
—মনীন্দ্র গুপ্ত

৯৪ বছর! যেকোনো বিবেচনায় বাঁচার জন্য যথেষ্ট বয়স। এত দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকাটাও কখনো কখনো  ক্লান্তির বিষয় হতে পারে। হতে পারে বলছি, কারণ আমার তো আর অত বছর বাঁচার অভিজ্ঞতা নেই৷ আশপাশেও ওই বয়সী কেউ নেই যাকে জিজ্ঞেস করে নেব, এত লম্বা সময় বাঁচার অভিজ্ঞতা কেমন। মিলান কুন্ডেরার জন্য কেমন ছিল এত বছর বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা?

শেষ দিকে এসে অস্ত্বিত্বের লঘুতা নিয়ে তিনি কি নতুন কোনো উপলব্ধিতে পৌঁছাতে পেরেছেন? গতকাল অস্তিত্ববিষয়ক সব প্রশ্ন-উত্তর, শঙ্কা কিংবা ধারণাকে হাওয়ায় ছুড়ে দিয়ে এই ঔপন্যাসিক পাড়ি জমিয়েছেন অন্যলোকে। কে জানে, দীর্ঘ জীবনে অস্তিত্বের লঘুতাকে কুন্ডেরা আরেকটু ভালো করে বুঝেছিলেন কি না; কিংবা ভালোবাসাবিষয়ক সমস্ত অবিশ্বাস নিয়েই তিনি পৃথিবী নামক গ্রহকে ভালোবেসে দীর্ঘ সময় বেঁচে ছিলেন।

কুন্ডেরাই তো লিখেছিলেন, একজন মানুষ যেখানে থাকেন, মানুষটি যদি সে স্থান ছাড়তে চান, তবে তিনি একজন অসুখী মানুষ। হয়তো সেই ভালোবাসার কারণে জরাজীর্ণ পৃথিবী নামের গ্রহকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন কুন্ডেরা। অবশ্য এই ভালোবাসা কুন্ডেরার নিজের প্রতিও হতে পারে। কারণ, তিনি নিজেকে সুখী দেখাতে চেয়েছিলেন।

যার ভেতর দিয়ে তিনি হয়তো আড়াল করতে চেয়েছিলেন প্রাগ ছেড়ে আসার যন্ত্রণাকেও। অথবা এমনও হতে পারে, বেঁচে থাকার যে যন্ত্রণা, সেটাকে আরও ভালোভাবে তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন। কারণ যা–ই হোক,  বাস্তবতা হলো কুন্ডেরা আর বেঁচে নেই। তিনি এখন মৃতদের তালিকাভুক্ত।

মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে যখন লিখতে বলা হলো, আমি ভাবছিলাম কী নিয়ে লেখা যায়? কারও প্রতি মুগ্ধতা নিয়ে খুব বেশি লেখা যায় না। এটা কঠিন কাজ। কিছুটা বিশ্লেষাত্মক অবস্থানে থেকে লেখা উচিত। কুন্ডেরা নিয়ে আমার মধ্যে যা আছে, তা শুধুই মুগ্ধতা। প্রায়ই বলতাম, জীবিত লেখকদের মধ্যে কুন্ডেরা আমার সবচেয়ে পছন্দের। তবে ১১ জুলাই মঙ্গলবারের পর থেকে এ কথা আর বলা যাবে না। মৃতদের দলে যোগ দেওয়া কুন্ডেরা মৃত্যু নিয়ে লিখেছেন, ‘ম্যান ডাজন্ট নো হাউ টু বি মর্টাল। অ্যান্ড হোয়েন হি ডাইজ, হি ডাজন্ট ইভেন নো হাউ টু বি ডেড।’

কুন্ডেরা চলে যাওয়ার পর আমার জীবিত প্রিয় লেখক কে তা নিয়ে ভাবছিলাম। ওরহান পামুক বা পিটার বিকসেলের কথা বলা যায়। তবে কুন্ডেরা যেভাবে অস্তিত্বের সবকিছু গ্রাস করে নিয়েছিলেন, ততটা নিশ্চয় নয়। কুন্ডেরা যখন লেখেন, ‘দেয়ার ইজ এ সার্টেইন পার্ট অব অল অব আস দ্যাট লিভস আউটসাইড অগ টাইম। পারহ্যাপস উই বিকাম অ্যাওয়াইর অব আওয়ার এজ অনলি অ্যাট এক্সেপশনাল মোমেন্টস অ্যান্ড মোস্ট অব দ্য টাইম উই আর এজলেস।’

মিলান কুন্ডেরা
ছবি: সংগৃহীত

এসব কথা আমাদের অভূতপূর্ব এক অভিজ্ঞতার মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। এমন কিছু, যা শুধুই কুন্ডেরার কাছ থেকেই পাওয়া সম্ভব।

কুন্ডেরার যে বইটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করেছে, সেটি ‘ইমমরটালিটি’ বা অমরত্ব। অমরত্বের ধারণাকে নানা দিক থেকে আলো ফেলে দেখার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু আমি বইয়ের রিভিউ লিখতে বসিনি। তাই আপাতত সেদিকে যাব না। তবে এই উপন্যাস উপন্যাসের প্রচলিত ধরনকে কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।

আরেকটি চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে কুন্ডেরার মৃত্যুর দিনই অমরত্বের কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে। ‘ইমমরটালিটি’তে মহাকবি গ্যাটের সঙ্গে বেটিনার সম্পর্কের ভেতর দিয়ে অমরত্বের ধারণাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কুন্ডেরা যে কৌতুকপূর্ণ বয়ানের আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁর ক্ষেত্রে আমাদের অতটা রূপকের আশ্রয় না নিলেও চলছে। এমনকি নোবেল না পাওয়ার ঘটনাও তাতে কোনো আঁচড় বসাতে পারছে না। বরং না পাওয়াটাই কুন্ডেরাকে আরেকটু আলাদাভাবে চিনতে সাহায্য করছে। যিনি বলেছিলেন, ‘লেখক হওয়া মানে সত্য আবিষ্কার করা।’ কিংবা ‘ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই হচ্ছে ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে মনে রাখার লড়াই।’ সত্য আবিষ্কার এবং ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাশুল তো মানুষকে গুনতেই হয়। কুন্ডেরাও গুনেছেন। সেটাই আবার কুন্ডেরাকে কুন্ডেরা বানিয়েছে। আর সে কারণেই তিনি অনন্য। জীবনানন্দের কবিতার ভাষায়, ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’