সোভিয়েত–পরবর্তী দুনিয়ায় জেমস বন্ডের অভিযোজন

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

ব্রিটিশ সিক্রেট এজেন্ট জেমস বন্ডের স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিংয়ের (১৯০৮-৬৪) বহুদিন থেকেই একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখার শখ। সময়, সুযোগ বা উদ্যমের অভাবে যা এত দিন হয়ে ওঠেনি, তাই তিনি করতে পারলেন ১৯৫২ সালে। কিছুটা বাধ্য হয়েই বলা যায়। প্রেমিকা এয়ান কার্টেরিস তখন গর্ভবতী। এরই মধ্যে চলছে তাঁদের বিয়ের আয়োজন। এত শোরগোল ভালো লাগছিল না আর। তিক্তবিরক্ত হয়ে সমস্ত কিছু থেকে দূরে গিয়ে লিখতে বসে গেলেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত সেই ডিটেকটিভ উপন্যাস। প্রথম দিনেই লিখে ফেললেন দুই হাজার শব্দ। সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে গেল এক মাসে। নাম দিলেন ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’।

জেমস বন্ডের স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিং (১৯০৮-৬৪)
ছবি: সংগৃহীত

জেমস বন্ড সিরিজের এই সূচনা উপন্যাসটিকে প্রথমে ফ্লেমিংয়ের কাছে মনে হয়েছিল ‘বেকুবির মাস্টারপিস’। ব্যাপারটা আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য পাণ্ডুলিপি পড়তে দিলেন সাবেক প্রেমিকা ক্লেয়ার ব্যাংচার্ডকে। ক্লেয়ার পাণ্ডুলিপি পড়ে পরামর্শ দিলেন, ভুলেও এটা প্রকাশ করতে যেয়ো না। আর করলেও তা যেন কোনো ছদ্মনামে প্রকাশ করা হয়, শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে দিলেন সে পরামর্শও।

অবশ্য ফ্লেমিং সাবেক প্রেমিকার কথা কানেই তুললেন না। ক্যাসিনো রয়্যাল তো প্রকাশ করলেনই, একে একে লিখে ফেললেন এই সিরিজের ১২টা উপন্যাস। ভাগ্যিস তিনি তাঁর সাবেক প্রেমিকার কথা পাত্তা দেননি। নইলে আমরা কোথায় পেতাম জেমস বন্ড, জিরো জিরো সেভেনকে!

তাই বলি, পুরোনো বান্ধবী হতে সাবধান!

ক্লেয়ার পাণ্ডুলিপি পড়ে পরামর্শ দিলেন, ভুলেও এটা প্রকাশ করতে যেয়ো না। অবশ্য ফ্লেমিং সাবেক প্রেমিকার কথা কানেই তুললেন না। ক্যাসিনো রয়্যাল তো প্রকাশ করলেনই, একে একে লিখে ফেললেন এই সিরিজের ১২টা উপন্যাস। ভাগ্যিস তিনি তাঁর সাবেক প্রেমিকার কথা পাত্তা দেননি। নইলে আমরা কোথায় পেতাম জেমস বন্ড!

২.

পুরোনো বান্ধবী থেকে নাহয় সাবধান হলেন, কিন্তু পুরোনো শত্রুর ক্ষেত্রে কী বিবেচনা?

আগে দেখা যাক শত্রুতা কী কী ভাবে শেষ করা যেতে পারে। এক. শত্রুকে পরাজিত করে তাকে ধ্বংস করে দেওয়া। অথবা তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা। সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ঠিক কী পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা বলা দুষ্কর। কিন্তু নব্বই দশকের শুরুতে এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে দেখল সোভিয়েত ইউনিয়ন আর নেই। পূর্ব ইউরোপে সাধের সমাজতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে সে–ও মুছে গেল বিশ্বের মানচিত্র থেকে। বৃহৎ রাশিয়ার সঙ্গে ক্ষুদ্র আরও কিছু দেশ রেখে গেল বটে, কিন্তু আগের সেই রমরমা আর থাকল না। পশ্চিমা বন্ধুদের সঙ্গে শত্রুতা দূরের ব্যাপার, মর্যাদাপূর্ণ বন্ধুত্ব বজায় রাখাই দুরূহ হয়ে পড়ল তাদের জন্য।

নয়া রাজনৈতিক মেরুকরণ, বিশ্ব অর্থনীতিতে তার প্রভাব—এসব নিয়ে দিস্তার পর দিস্তা আলোচনা করা যাবে। বিদগ্ধজনেরা তা করেও থাকেন। কিন্তু আমাদের আগ্রহের বিষয়, নতুন এই মেরুকরণের ফলে বিপদে পড়ে গেল কি আমাদের স্বপ্নের নায়ক জেমস বন্ড!

অথচ শীতল যুদ্ধের দিনগুলোতে ইঙ্গ–মার্কিন ক্ষমতাবলয়কে সুরক্ষিত রাখতে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তৎপরতা আর গুরুত্বপূর্ণ কতই–না অভিযান সে করে এসেছে এত দিন ধরে। কত শত্রু নিধন হলো। কত নীল নয়নার বক্ষযুগলে মুখ ঘষতে ঘষতে খালি করে দিল কত মায়ের বুক। নিজেও জখম হলো। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখোমুখি, শত্রুর সঙ্গে বসবাস—এই তো জেমস বন্ডের জীবন।

বিশ্বরাজনীতির মেরুকরণের ফলে বিপদে পড়ে গেল কি আমাদের স্বপ্নের নায়ক জেমস বন্ড! অথচ শীতল যুদ্ধের দিনগুলোতে ইঙ্গ–মার্কিন ক্ষমতাবলয়কে সুরক্ষিত রাখতে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তৎপরতা আর গুরুত্বপূর্ণ কতই–না অভিযান সে করে এসেছে এত দিন ধরে।

মনের ওপর দিয়েই কি কম ঝড় বয়ে গেল! দেশপ্রেমের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এত এত মৃত্যুর দায় নিতে হলো তাকে, সে গ্লানিবোধই–বা কম কিসের! এসব নিয়ে আলোচনা ও এর জবাব অবশ্য জেমস বন্ড তৎক্ষণাৎ দেননি। দিয়েছেন একবিংশ শতাব্দীতে, ভিন্ন আরেক বাস্তবতায়। সেটাতে পরে আসছি। আগে দেখি শীতল যুদ্ধের অবসানে জেমস বন্ডের বিপদটা ঠিক কোথায় হলো।

অথচ আকস্মিক এ কর্মহীনতায় তার তো স্বস্তির নিশ্বাস নেওয়ার কথা। বিপদটা বন্ড যে অর্গানাইজেশনের হয়ে কাজ করে সেই ‘এমআই সিক্স’রও। অপরাধীহীন পৃথিবীতে পুলিশের কী কাজ? তাহলে জেমস বন্ড কি নাই হয়ে যাবে? মৃত্যুর সমান অবসরে চলে যাবে এই রোমাঞ্চের নায়ক! এমন দোদুল্যমান পরিস্থিতিতেই শুরু হলো জেমস বন্ড সিরিজের সতেরোতম সিনেমা গোল্ডেন আইয়ের (১৯৯৫) নির্মাণকাজ।

প্রথম জেমস বন্ড, গোল্ডফিঙ্গার চলচিত্রে শন কনোরি
ছবি: সংগৃহীত

আধুনিক বিশ্বে চরিত্রটির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সন্দেহ ছিল। বন্ড ফ্র্যাঞ্চাইজির শেষ সিনেমা ‘লাইসেন্স টু কিল’র মাত্র ছয় বছর পর ‘গোল্ডেন আই’ মুক্তি পেলেও এর মধ্যেই নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে গেছে বিশ্বরাজনীতিতে। বার্লিন দেয়াল ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং সেই সূত্রে শীতল যুদ্ধের সমাপ্তির পর এটি ছিল জেমস বন্ড সিরিজের প্রথম সিনেমা। ইন্ডাস্ট্রির অনেকে মনে করেছিলেন বন্ড সিরিজের প্রত্যাবর্তন অর্থহীন। বরং চরিত্রটিকে ‘অতীতের আইকন’ হিসেবে রেখে দেওয়াই উত্তম।

প্রযোজকেরা সিরিজের জন্য নতুন কনসেপ্টগুলোও বিবেচনায় নিতে শুরু করেছিলেন। কেউ প্রস্তাব করলেন, জেমসকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক—তার অরিজিন ষাটের দশকের কোনো টাইম জোনে। কেউ তো আরও বৈপ্লবিক ধারণা নিয়ে এলেন। জেমস বন্ডের চেহারা চরিত্রই পাল্টে ফেলতে চাইলেন! একজন মেয়ে বা কৃষ্ণাঙ্গ জিরো জিরো সেভেন কেমন হয় এমনও ভাবা শুরু করলেন কেউ কেউ।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য তেমন কিছু হয়নি। জেমস বন্ড থেকে গেলেন ক্ল্যাসিক চরিত্রেই। যদিও সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিলেন তিনি। দুটি ফিকশনাল ক্যারেক্টার থেকে ব্রিটিশ মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়—একজন আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস, আরেকজন এই জেমস বন্ড। ব্রিটিশরা ঐতিহ্য যেমন ধরে রাখতে পারে, সময়ের প্রয়োজনে তেমনই খাপ খাইয়ে নিতে ওস্তাদ।

৩.

‘গোল্ডেন আই’–এর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে এই অভিযোজনের গল্প। সিনেমার সূচনা-দৃশ্যেই দেখা যায়, ভেঙে পড়ছে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের গ্রেটেস্ট আইকনগুলো। লেলিন, স্টালিনের মূর্তি ধসে পড়ছে, কোথায় যে তলিয়ে যাচ্ছে দাবা বোর্ডের সব বড় বড় প্লেয়ার। রশি টেনে খানখান করা হচ্ছে রাজা, মহারাজাদের। সমাজতন্ত্র আর নেই, নেই তাই সোভিয়েতও। পুরোনো শত্রুতার দিন শেষ।

পুরোনো শত্রু তো শেষ হলো, এবার জেমস বন্ডের কী হবে? ইয়ান ফ্লেমিং তো আর জানতেন না একদিন ভেঙে যাবে সোভিয়েত! সমাধান এল সহজেই। ফ্লেমিংয়ের গল্পই যে লাগবে তা তো না, চরিত্র হিসেবে বন্ডকে পেলেই হলো। এ ভাবনা থেকে লেখা হলো আনকোরা নতুন গল্প। নতুন প্রেক্ষাপটে। অনেকটা আনোয়ার হোসেনের সৃষ্ট চরিত্র মাসুদ রানার মতো। লিখছেন অনেকেই কিন্তু মাসুদ রানা চরিত্রের নির্মাতা আনোয়ার হোসেনই।

ব্রিটিশ বৈশিষ্ট্য অনুসারে নতুন গল্পেও কিন্তু পুরোনো দিন কিছু থেকেই গেল। দেখা গেল অফিশিয়ালি সোভিয়েতের সঙ্গে না হলেও সোভিয়েতের ভূতদের সঙ্গেই লড়তে হচ্ছে বন্ডকে। এবার আর ভিলেন কোনো কেজিবি এজেন্ট নয়; বরং সাবেক কেজিবি সদস্য। মূল যুদ্ধক্ষেত্র সোভিয়েত আমলের এক পরিত্যক্ত পারমাণবিক স্থাপনা।

‘ক্যাসিনো রয়েল’ (২০০৬) চলচ্চিত্রে ‘এম’ চরিত্রে জুডি ডেঞ্চ
ছবি: সংগৃহীত

এ তো গেল গল্পের প্লট ও অনুষঙ্গ। চরিত্রগুলাকেও নতুন রূপে ঢেলে সাজানো হলো। ‘এমআই সিক্স’র প্রধান ‘এম’ চরিত্রে এলেন একজন নারী। প্রসঙ্গত একটা বিষয় মনে রাখা যেতে পারে, ওই সময় জেমস বন্ড সিরিজের প্রযোজক পদেও পরিবর্তন এসেছিল। বয়সের ভারে অ্যালবার্ট ব্রকলি সরে দাঁড়ানোর পর তারই মেয়ে বারবারা ব্রকলি পান প্রযোজক হিসেবে নতুন দায়িত্ব। অবশ্য শুধু নারী প্রযোজকের প্রভাব বা পরামর্শেই এমনটা হয়েছে, তা নয়। মূল কারণ ছিল জেমস বন্ড চরিত্রের স্টেরিওটাইপ ভাঙা।

তৎকালীন পৃথিবীতে বন্ডসহ অনেক গোয়েন্দা চরিত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পুরুষতান্ত্রিক নায়কোচিত আচরণ। এ প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই সিনেমার শুরুতে নবনিযুক্তা ‘এম’ পরিষ্কারভাবে বন্ডকে জানিয়ে দিলেন, ‘সেক্সিস্ট, মিসোজনিস্ট ডাইনোসর’ জিরো জিরো সেভেন তার কাছে ‘শীতল যুদ্ধের বিগত স্মারক’ ছাড়া আর কিছু নয়।

তৎকালীন পৃথিবীতে বন্ডসহ অনেক গোয়েন্দা চরিত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পুরুষতান্ত্রিক নায়কোচিত আচরণ। নায়কোচিত হওয়া দোষের কিছু না, কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় সেসব প্রায় নারীবিদ্বেষী আকার ধারণ করত। পশ্চিমা দুনিয়াতেও তখনো নারীদের ‘অবজেক্টিফাই’ করা একটা নিয়মিত ঘটনা ছিল। এ প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই সিনেমার শুরুতে নবনিযুক্তা ‘এম’ পরিষ্কারভাবে বন্ডকে জানিয়ে দিলেন, ‘সেক্সিস্ট, মিসোজনিস্ট ডাইনোসর’ জিরো জিরো সেভেন তার কাছে ‘শীতল যুদ্ধের বিগত স্মারক’ ছাড়া আর কিছু নয়।

এ মুভি থেকেই বন্ড চরিত্রের কিছু মৌলিক পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই। নারীদের প্রতি সে আরও সংবেদনশীল, আরও বেশি মানবিক হয়ে ওঠে। সিরিজের আগের মুভিগুলোতে বন্ডকে প্রায় অমর ও অজেয় দেখানো হতো। এ মুভিতেই প্রথম দেখা গেল তার ব্যতিক্রম, তিনিও জখম হন—বুলেট বা রমণীর মোহিনী পরাক্রমে।

৪.

তবে বন্ডকে আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়া–অধ্যুষিত সময়ে এসে। যে প্রশ্ন কোনো দিন করা হয়নি, এমনকি করার কথা ভাবাও হয়নি, এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো। ওয়ান–ইলেভেন পরবর্তী বৈশ্বিক রাজনীতি, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় পররাষ্ট্র আক্রমণ, কথিত সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র গুলি তথা এনকাউন্টারের নির্দেশনা ইত্যাদির নতুন পরিস্থিতি ও প্রতিকারে সোচ্চার মানবতাবাদ অনেকটাই দায়ী নতুন এসব প্রশ্ন উত্থাপনের পেছনে।

জেমসকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হলো এই যে তার ‘লাইসেন্স টু কিল’ সার্টিফিকেশন, এটা আসলে কতটা যৌক্তিক। অপরাধী যেই হোক, অপরাধের মাত্রা যত গুরুতরই হোক বিনা বিচারে এভাবে কাউকে খুন করা যায় কি না?

আধুনিক পৃথিবীতে বন্ডের ওপরেই–বা এসবের সাইকোলজিক্যাল ইফেক্ট কী রকম। মৃত্যুর আগে আগে, এত এত মানুষের এত শীতল চোখ কীভাবে মোকাবিলা করেন তিনি? মৃতের পরিবারের আহাজারি তার কানে পৌঁছায় কি? মূল প্রশ্নটা মূলত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়েই। আমরা দেখি অধিকাংশ ক্ষমতাকাঠামোই এ বিষয়ে নিশ্চুপ থেকে যায়। যেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে কিছু নেই।

স্পেক্টার (২০১৫) চলচ্চিত্রের পোস্টার
ছবি: সংগৃহীত

উত্থাপিত জিজ্ঞাসাগুলোকে শুধু আমলেই নিল না, যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়ারও চেষ্টা করল বন্ড কর্তৃপক্ষ। বুলেটের বিরুদ্ধে বন্ডের মতো ইয়ন প্রোডাকশনও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেল এসব প্রশ্নের সামনে। এড়িয়ে না গিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলাকেই শ্রেয় ভেবেছে তারা।

তবে এ ক্ষেত্রেও কিছুটা ব্রিটিশ বুদ্ধির পরিচয় তারা দিয়েছে। প্রশ্নগুলো কোনো মানবাধিকারকর্মীর মুখ দিয়ে উত্থাপন না করিয়ে, করিয়েছে ২০১৫–তে মুক্তি পাওয়া বন্ড সিরিজের পেনাল্টিমেট মুভি ‘স্পেক্টার’র এক ভিলেন চরিত্র দিয়ে। দর্শক যেহেতু সে ভিলেনের প্রতি স্বভাবতই বিরক্ত, জবাবগুলো কনভিন্সিং লাগার গ্রাউন্ড আগে থেকেই তাই প্রস্তুত ছিল কিছুটা।

৫.

বিশ্বজুড়েই মৃত্যুদণ্ডবিরোধী প্রচারণা এখন বেশ জোরালো। বিচারবহির্ভূত তো নয়ই, বিচারিক মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধেও মানবাধিকারকর্মীরা সোচ্চার। কোনো সিক্রেট এজেন্ট বা যেকোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেই মানুষ হত্যার অধিকার প্রদান করা যায় কি না, তা নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াই ও বিবেচনা জারি আছে। ব্রিটিশ রচিত ফৌজদারি কার্যবিধিতে নিজের বা অন্যের জীবন বাঁচানোর মতো কিছু ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেওয়া থাকলেও এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে জেমস বন্ডের মানুষ হত্যার জাস্টিফিকেশনগুলো কী?

যেহেতু অনেক নৈতিক ও মানবতাবাদী বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও বিচারিক হত্যাকাণ্ড (আইনের ভাষায়-মৃত্যুদণ্ড) এখনো মেনে নেয় মানুষ, সেহেতু বন্ডের করা খুনগুলো বিচারিক ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আনা গেলে একটা জাস্টিফিকেশন তৈরি করা যেতে পারে।

এ জন্য হত্যার আগে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে, খুন হতে যাওয়া ব্যক্তিই প্রকৃত অপরাধী এবং কৃতকর্মের জন্য মৃত্যুদণ্ডই তার প্রাপ্য। একজন বিচারক দণ্ড নির্ধারণের পর এক্সিকিউশনার এসে সেই দণ্ড বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু হিট অব দ্য মোমেন্টে, যেখানে সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশের ভেতর এসব সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সেখানে এত আয়োজন কীভাবে সম্ভব! সম্ভব হতে পারে, যদি একজন ব্যক্তিই একই সঙ্গে প্রসিকিউটর, জাজ ও এক্সিকিউশনারের কাজ করতে পারেন। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব!

এখানেই জবাব হয়ে আসতেছেন জেমস বন্ড। তবে জবাবটা তার হয়ে দিচ্ছেন, ‘এম’। প্রশ্নকর্তার চোখে চোখ রেখে তিনি বলতেছেন, ‘তুমি কি কখনো একজন মানুষকে মারতে বাধ্য হয়েছ ম্যাক্স? ট্রিগার টানার আগে, তোমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে লোকটা সত্যিই হত্যাযোগ্য।’ নৈতিক বা মানবিক পাটাতন ছাড়াও, যেহেতু ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে, হত্যার যথাযথ জাস্টিফিকেশন দিতে না পারলে সে–ও খুনের দায়ে অভিযুক্ত হবে।

ইয়ান ফ্লেমিং অনুমোদিত বন্ডের পোর্ট্রেট
ছবি: সংগৃহীত

এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণপূর্বক সঠিক রায় দেওয়াই শুধু নয়, রায়টা বাস্তবায়নও তাকেই করতে হয়। অর্থাৎ শীতল চোখের চাহনি উপেক্ষা করে অকম্পিত হৃদয় ও হাতে সেই হত্যাটাও সম্পন্ন করতে হয়। সারা বিশ্বের সমস্ত নজরদারি, সমালোচনা ও মোরাল অবলিগেশন কেয়ার না করে। ‘লাইসেন্স টু কিল’ এক অর্থে তাই ‘লাইসেন্স নট টু কিল’ও।

ব্যাপারটা সহজ নয় মোটেও। কারও পক্ষে কি এমন সুপারম্যানসুলভ ক্ষমতা নিয়ে জন্ম নেওয়া সম্ভব, যিনি একটা সম্ভাব্য হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পূর্বমুহূর্তে সেকেন্ডের এক–দশমাংশ ভাগে পুরো বিষয়ের সঠিক পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও যথাযথ মূল্যায়ন সম্পন্ন করে তা নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবেন! মনে হয় না। কিন্তু নিশ্চয়ই, আপনি যদি বাধ্য হন কারও ওপর এমন ব্যাপারে আস্থা রাখতে, তাহলে জেমস বন্ডের কথা ভাবতে পারেন!

এমন ইন্টেন্স মোমেন্টেও নিখুঁত ও নির্ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলেই তিনি, বন্ড, জেমস বন্ড।

স্পেক্টারের শেষ দৃশ্যে এসে মূল অপরাধীকে মেরে ফেলার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বুলেট সংবরণ করে নেয় বন্ড, তুলে দেয় আইনের হাতে। ভিলেন বারবার তাকে প্রলুব্ধ করছে, গুলি করো, গুলি করো, মেরে ফেলো আমাকে। বন্ড যে আসলে একজন খুনিই শেষ পর্যন্ত, দুনিয়ার সামনে তা তুলে ধরতেই যেন ভিলেনের সেই অন্তিম প্রয়াস। কিন্তু সব উসকানি উপেক্ষা করে পিস্তল সংবরণ করতে করতে ভিলেনের দিকে তাকিয়ে বন্ড বলে, তোমাকে মারার চেয়েও জরুরি কাজ আছে আমার।

বলেই ছুটে যায় অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকা প্রেমিকার কাছে, খুনের মতোই তীব্র কোনো আলিঙ্গনে তাকে বেঁধে ফেলতে।