‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ কেন লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার
‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই’—গানটির রচয়িতা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। আজ তাঁর প্রয়াণবার্ষিকীতে বাংলা গানের এই সফল গীতিকবির অন্যান্য গানের গল্পের সঙ্গে জানা যাক কেন লেখা হয়েছিল বিখ্যাত এই গান?
‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই’—এই গান গুনগুন করে গাননি বা গানটি শোনেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসের আড্ডাকে উপজীব্য করে লেখা গানটি সংগীতপ্রেমী মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে অনেক আগে। তবে যে মানুষটি এই বিখ্যাত গানের রচয়িতা, সেই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার সম্পর্কে কতটা জানি আমরা? আজ ২০ আগস্ট তাঁর মৃত্যুদিন। বলা দরকার, বাংলা গানের অন্যতম সফল এই গীতিকবি শুধু এ গান রচনা করেননি, আরও অজস্র কালজয়ী গানের রচয়িতা তিনি।
কিন্তু কীভাবে এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে তিনি রচনা করেছিলেন ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’?
গানটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুনলে উপলব্ধি করা যায় কফি হাউসের হারানো আড্ডা, দূর পৃথিবীতে থাকা বন্ধু আর আহত কিছু স্মৃতিকে এ গানে বেঁধেছেন তিনি। তবে কেবলই কি হারানো সময়ের বিবরণ ও স্মৃতিকাতরতাকে গানের ফ্রেমে বেঁধে রাখায় ছিল তাঁর উদ্দেশ্য, নাকি গানটি রচনার পেছনে আছে কোনো গল্প? এর উত্তরের আগে একটি নিরূপম সুন্দর বন্ধুত্বের গল্প বলা দরকার।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও নচিকেতা ঘোষ দুজনে ছিলেন বন্ধু। কেবল বন্ধু বললে কম বলা হবে, তাঁরা ছিলেন হরিহর আত্মা। কলেজজীবন থেকে বন্ধুত্ব তাঁদের। জীবনভর বন্ধুত্বের ভার বহন করেছেন দুজনে। কথা–কাটাকাটি, তর্ক-বিবাদ কোনো দিন যে হয়নি, ব্যাপারটা তেমন নয়। দুজনের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে; কিন্তু তা কেবল গান নিয়ে, গানের জন্য। দুজনই ছিলেন গানপাগল মানুষ। একজন সুরকার, সংগীত পরিচালক আর একজন গীতিকার। ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’; ‘না, না, না, আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না’র মতো অসংখ্য কালজয়ী গান রচনা করেছেন দুজন। কিন্তু কেবল গান রচনা পর্যন্ত তাঁদের বন্ধুত্ব সীমাবদ্ধ ছিল না। দুই পরিবারের মধ্যেও ছিল ভালো সম্পর্ক। নচিকেতার মতো তাঁর পরিবারের সবাইও ভালোবাসতেন গৌরীপ্রসন্নকে। গান তৈরির কাজে তো যেতেনই, তা ছাড়া অবসরের অনেকটা সময়ও তিনি বন্ধুর শ্যামবাজারের বাড়িতে কাটাতেন। ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই’ গানটি রচনার পরিপ্রেক্ষিতও এই বন্ধুতা। তবে তা নচিকেতা ঘোষের জন্য নয়, গৌরীপ্রসন্ন গানটি লিখেছিলেন নচিকেতার ছেলে সুপর্ণকান্তি ঘোষের জন্য।
এবারে তবে গল্পটা বলি, গৌরীপ্রসন্ন বন্ধুপুত্র সুপর্ণকান্তিকে পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। সময় গড়াতে গড়াতে শিলালিপি ক্ষয়ে যায়, মানুষও ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠে। সুপর্ণকান্তিও বড় হলেন। তখন চারদিকে বাবা নচিকেতা ঘোষের জয়জয়কার। তিনিও বাবার পথে হাঁটবেন বলে মনস্থির করলেন। শুরু হলো সুর সাধনার কাজ। তখন মাত্র কয়েকটি গানের সুর করেছেন। একদিন বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় গৌরীপ্রসন্নর প্রশ্নের মুখে পড়লেন। সেদিন গান তৈরির কাজে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার তাঁদের বাড়িতে ছিলেন। ঘরে ঢুকতেই প্রশ্ন করলেন, ‘কী, বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছ?’ কথার পালকি এগোতে এগোতে অনেক দূর এগোল। একপর্যায়ে সুপর্ণকান্তি কফি হাউসের আড্ডা নিয়ে গান লেখার জন্য চ্যালেঞ্জ করলেন গৌরীপ্রসন্নকে। গৌরীপ্রসন্নও কম যান না, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে লিখতে শুরু করলেন তিনি। বিবিসির শ্রোতা জরিপে শ্রেষ্ঠ বাংলা গানের খেতাব পাওয়া গানটির প্রথম দুই চরণ, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই’ রচিত হলো কয়েক মুহূর্তেই। তবে সম্পূর্ণ গানটি সময় নিয়েই রচনা করেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন।
এই গান ছেড়ে এখন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের জীবনের দিকে তাকানো যাক। সঙ্গে সঙ্গে বলা যাক গোপালনগর গ্রামে শৈশব ও কৈশোর কাটানো মেধাবী গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের বাংলা গানের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হয়ে ওঠার গল্পটাও।
১৯২৫ সালের ৫ ডিসেম্বর। পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগর গ্রামের উদ্ভিদবিদ গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার ও সুধা মজুমদার দম্পতির কোল আলো করে জন্ম নিল এক পুত্রসন্তান। বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে নাম রাখা হলো গৌরীপ্রসন্ন। প্রেসিডেন্সি কলেজের খ্যাতনামা অধ্যাপক বাবা ও গৃহিণী মায়ের আদরে বেড়ে ওঠা গৌরীপ্রসন্ন শিশুকাল থেকেই মেধাবী ছিলেন। গ্রামে শৈশব ও কৈশোর কাটিয়ে উচ্চতর পড়ালেখার জন্য তিনি পড়ি জমালেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে, ইংরেজি বিষয়ে। প্রথম প্রথম গ্রামের বাড়িতে আসা–যাওয়া থাকলেও কালে কালে যাতায়াতে ভাটা পড়ে। একে একে পরিবারের অন্যরাও ভারতে চলে যায়। পড়ালেখায় মনোযোগী গৌরীপ্রসন্ন ইংরেজি ও বাংলা দুই বিষয়েই স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছিলেন।
গানের প্রতি গৌরীপ্রসন্নর ভালো লাগা কবে থেকে?
কেবল গান নয়, সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিও তাঁর আগ্রহ ছিল। শিশুকাল থেকেই বিখ্যাত শিল্পীদের গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন। বাড়িতে সকাল-সন্ধ্যা গ্রামোফোনে বিভিন্ন ঘরানার গান বাজত। পাশাপাশি ছিল বই পড়ারও আবহ ছিল। দেশি-বিদেশি নানা বই স্কুলজীবনেই হাতের কাছে পেয়েছিলেন। আর পড়তে পড়তে, শুনতে শুনতে ছাত্রজীবনেই অনুভব করেছিলেন লেখার তাগিদ। ছাত্রজীবনেই কালিদাসের শ্রেষ্ঠ খণ্ডকাব্য ‘মেঘদূতম’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন।
তাঁর গান লেখার স্বপ্নে আলো দিয়েছিলেন শচীন দেববর্মন। ওই সময়ে শচীন দেববর্মনের গানের রমরমা অবস্থা। তাঁর গায়কিতে গৌরীপ্রসন্ন এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে একটি গান লিখে দেখা করতে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। শচীন দেববর্মনও হিরে চিনতে ভুল করেননি। গানটা বেতারে গেয়েছিলেন। সেই থেকে শুরু, আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক নিজেকে অতিক্রম করে গেছেন গৌরীপ্রসন্ন। লিখেছেন যুগজয়ী সব গান। আজীবন শচীন দেববর্মনের সঙ্গে শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক অটুট ছিল তাঁর। ‘মালাখানি ছিল হাতে ঝরে তবু ঝরে নাই’, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই/ সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’, ‘দূর কোন পরবাসে তুমি চলে যাইবা রে, কবে আইবা রে’—এসব গৌরীপ্রসন্ন ও শচীন দেববর্মনের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
নিজের মতো লেখার পাশাপাশি সুরের ওপর কথা বসিয়ে গান লেখার কাজটিও সুনিপুণ হাতে করেছেন গৌরীপ্রসন্ন। সিনেমার ক্ষেত্রে বরাবরই গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এমনকি কথিত আছে যে গান হিট তো সিনেমা হিট। আর গৌরীপ্রসন্নর শব্দের দীপ্তি এতটাই প্রবল ছিল যে তাঁর গানের জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছে অনেক সিনেমা, সুপারহিট হয়েছে। বিশেষ করে গৌরীপ্রসন্ন ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় জুটির স্পর্শে সিনেমা ও সংগীতাঙ্গন আলোকিত হয়েছে। ‘এই মেঘলা দিনে একলা’, ‘কেন দূরে থাকো শুধু আড়াল রাখ/ কে তুমি কে তুমি আমায় ডাকো’, ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো/ দুটি দিকে গেছে বেঁকে’, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়/ তবে কেমন হতো তুমি বলো তো’ গৌরী-হেমন্ত জুটির উল্লেখযোগ্য সৃজন।
‘যদি কাগজে লেখ নাম’ শিরোনামের বিখ্যাত গানটির রচয়িতাও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। গানটি গেয়েছেন মান্না দে। মান্না দের কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হয়েছিলেন গৌরীপ্রসন্ন। অনবদ্য সব গান লিখেছেন তাঁর জন্য। ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা/ রাতটাকে যে দিন করেছে’, ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে/ ভাতিছ গগন মাঝে’সহ অসংখ্য কালজয়ী গান রয়েছে এ জুটির।
কে গাননি গৌরীপ্রসন্নর গান? শচীন দেববর্মন থেকে আরতি মুখোপাধ্যায়—প্রত্যেকেই গেয়েছেন। ‘এবারে যাওয়াই ভালো/ তুমি থাকো, আমি যাই।’ গানটি লিখেছিলেন শ্যামল মিত্রের জন্য। আর আরতি মুখোপাধ্যায়ের জন্য লিখেছিলেন ‘এই মোম জোৎস্নায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি’।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার সূর্যসন্তানদের অনুপ্রাণিত করতে কলম ধরেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন। বাঙালির অবিসংবাদী নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুনে লিখেছিলেন, ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি/ বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ পরবর্তীকালে ‘আ মিলিয়ন মুজিবর সিঙ্গিং’ শিরোনামে গানটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়। ‘মাগো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/ তোমার ভয় নেই মা আমরা/ প্রতিবাদ করতে জানি।’ চোখে জল আনা বিখ্যাত এই গানটির রচয়িতাও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।
অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা, বাংলা সংগীতের আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র এই গীতিকবি দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট না–ফেরার দেশে পাড়ি জমান। কীর্তিমানের মৃত্যু নেই, কাজ দিয়েই তাঁরা কালকে জয় করে নেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারও কালজয়ী। সংগীতপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে, অনুভবে সব সময় থাকবেন তিনি। আকাশে উড্ডীন সূর্যের মতো শ্রদ্ধা, ভালো লাগা ও ভালোবাসায় সুর-লয়-ছন্দে তাঁকে নিয়ে আয়োজন হবে সর্বত্র।