মাখোঁর রাহুলদর্শনে আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাল পড়ল কেন

রাহুল আনন্দের স্টুডিওতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁছবি: রাহুল আনন্দের সৌজন্যে

আজ থেকে ৫১ বছর আগে নৃবিজ্ঞানী জি এম ফস্টার তাঁর ‘দ্য অ্যানাটমি অব এনভি: আ স্টাডি ইন সিম্বলিক বিহেভিয়ার’ (ইউসি বার্কলে প্রকাশিত ‘সাম্প্রতিক নৃবিজ্ঞান’ সাময়িকীর ১৩তম সংখ্যা) শিরোনামের লেখায় ঈর্ষার অঙ্গব্যবচ্ছেদ করে দেখিয়েছেন যে ঈর্ষা একটি ‘প্যান-হিউম্যান’ বা সব মানুষের মধ্যে বিদ্যমান প্রপঞ্চ। এ লেখায় তিনি মূলত চার রকম ঈর্ষার বহিঃপ্রকাশের কথা বলেছেন—সরাসরি, অসরাসরি, প্রকাশ্য ও প্রতীকী। পাশাপাশি এখানে তিনি তিন রকমের ঈর্ষার কথাও উল্লেখ করেন—সম, অসম এবং স্রষ্টা ও মৃতের প্রতি।

এবার ভাদ্র মাসে তাল পেকেছে ভালোই, আবার সেই তাল একটা ফেসবুকেও পড়েছে ২৬ ভাদ্র ১৪৩০ তারিখে, মানে ১০ সেপ্টেম্বর। তাতেই তালগোল পেকে যাচ্ছে আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ কোন তাল মাখতে বাংলাদেশে এসেছিলেন আর একতারায় কোন তাল বাজিয়েছেন, তা নিয়ে এর মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কথা–চালাচালি হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এ লেখার অবতারণা। ঘটনার প্রেক্ষাপট হলো, ফরাসি রাষ্ট্রপতির আগমনে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ চেয়েছিল তাদের সেন্টারটি তাঁকে একবার পরিদর্শন করাতে। পরে তারা চিন্তা করল, সেন্টারে তাঁকে না নিয়ে এবং শিল্পীদের না ডেকে বরং তাঁকেই কোনো শিল্পীর কাছে যদি নিয়ে যাওয়া যায়, তা মন্দ হয় না। সেখানেই তো তারা আমন্ত্রণ জানাতে পারে বিভিন্ন মাধ্যমের কয়েক শিল্পীকে। এ বাস্তবতায় বর্তমান সময়ে বাঙালি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে সারা দুনিয়ায় সমাদৃত যে কটি ব্যান্ড আছে, তাদের মধ্যে অন্যতম ‘জলের গান’-এর সদস্য রাহুল আনন্দের বাসায় ফরাসি রাষ্ট্রপতি যেতে পারেন কি না, এই প্রস্তাব রাহুল আনন্দকে দিলে তিনি সানন্দে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন এবং তাঁদের স্বাগত জানান। আর এ সাক্ষাতের আমন্ত্রণে সাড়া দেন সারা হোসাইন (অ্যানিমেটর), আশফিকা রহমান (আলোকচিত্রী) ও কামরুজ্জামান স্বাধীন (ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট)। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন।

তো এ ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই নানা মন্তব্য ব্যক্ত করছেন। কিছু বিরূপ মন্তব্যও আছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, একজন শিল্পীর বাসায় ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধানের যাওয়ায় যে উচ্ছ্বাস, তা মূলত মধ্যবিত্তের উচ্ছ্বাস। এ ছাড়া দেখা গেছে, কেউ বলেছেন যে ‘জলের গান’-এর গান খুবই স্থূল। কেউ কেউ এ গানের দলের লিরিকস বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছেন যে এই লিরিকস আমাদের দেশের বিপ্লবে কোনো কাজে আসে না ইত্যাদি।

এসব দেখে মনে হচ্ছে, যে লোকটা—রাহুল আনন্দ—তিন দশক ধরে প্রাচ্য ও বাংলার আদি নাট্যরূপ নিয়ে কাজ করছেন এবং বাংলা লোকসংগীত নিয়ে কাজ করছেন, তাঁর কাজের ব্যাপারে হঠাৎ এত আগ্রহ কি ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধানের তাঁর বাসায় যাওয়ার কারণেই তৈরি হলো? আমরা কি রাহুল আনন্দের ভেতর লালন ফকিরকে খুঁজছি কিংবা সূর্যসেনকে?

সমসাময়িক দুনিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কতখানি ‘যোগাযোগ’মাধ্যম আর কতখানি হুজুগ ছড়ানোর উপকরণ, সে প্রশ্নের সূত্র ধরে আমার ‘বাংলা ফাইভ’ ব্যান্ডের ‘দেয়াল’ নামের একটি গানে বলেছিলাম, ‘জীবনটা লটকে দেই দেয়ালের হাতে, আমরা কথা কই দেয়ালের সাথে।’ কেননা ‘ডি-ক্লাসড’ও মতপ্রকাশের আর কোনো জায়গা পাচ্ছে না, তা সে যতই ছোট-মধ্য বা বড়লোককে গালি দিক।

মিডিয়াকে মানুষের ‘মন নিয়ন্ত্রণ’ করার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করার বিশ্লেষণ সমাজবিজ্ঞানে হয়েছে। অনেকই হয়েছে। তবে এখনকার বাস্তবতা দেখে, শুনে ও বুঝে নৃবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার মনে হচ্ছে, উপনিবেশ–প্রভাবিত মিডিয়া এজেন্সিগুলোর হুজুগ ছড়ানোর বিকল্প হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঈর্ষাপরায়ণ মানসিকতার নতুন চর্চা কি তৈরি হচ্ছে, নাকি এ ঈর্ষার চল এর মধ্যেই বেশ ভালোভাবেই তৈরি হয়েছে? এই চর্চাকে জি এম ফস্টার কোন ক্যাটাগরিতে ফেলতেন!
মাখোঁর রাহুলদর্শনে আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এত সাড়া, এত তাল পড়ল কেন, বাঙালির জনসংস্কৃতিকে বুঝতে বিষয়টির বিশ্লেষণ করা জরুরি।