আলোকচিত্রীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

১৯৭১ সালের আগস্ট। কাজ করছি স্টেটসম্যান পত্রিকায়। দিল্লি ও কলকাতায় পত্রিকাটি ভালো চলত। খুব মর্যাদাবান ছিল। কলকাতা থেকে সম্পাদক আমাকে ফোন করে বললেন, হাজারো শরণার্থী দীর্ঘ লাইন ধরে ভারতে আসছে। তাদের ছবি তোলার জন্য কলকাতায় আসতে হবে।

আমি কলকাতায় এলাম। বিমানবন্দরে নেমে সোজা চলে গেলাম যশোর-খুলনা রোডের দিকে। বর্ষার মৌসুম। প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। সীমান্তের তিন-চার কিলোমিটার দূর থেকে দেখতে পেলাম, হাজার হাজার মানুষ হাঁটছে—শিশু, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, পরিবার। লোক আসছে—সাইকেলে, গরুর গাড়িতে, বেশির ভাগই হেঁটে। প্রবল বর্ষণের মধ্যে মৃত্যুর নীরবতা। সবারই সমস্যা এক। সবাই উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে। প্রত্যেকে একে অপরের গল্প জানে। তাই এ নিয়ে কথা বলার কিছু নেই। অদ্ভুত সেই বিপুল নীরবতা। বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছে। লোকেরাও হেঁটে যাচ্ছে আর হেঁটে যাচ্ছে।

দৃশ্যটা আমার চার বছর বয়সের স্মৃতি ফিরিয়ে আনল। আমরা এসেছিলাম লাহোরের ১০০ কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানের জং থেকে। শরণার্থীশিবিরের উদ্দেশে আমরাও অবিরাম হাঁটছিলাম। ফলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের কষ্টের সঙ্গে আমি একাত্ম হয়ে পড়েছিলাম। আমরা সীমান্তের একেবারে কাছে চলে গেলাম। একই দৃশ্য। অন্তহীন সংখ্যায় তারা আসছে।

১৯৭১ সালের আগস্ট। কাজ করছি স্টেটসম্যান পত্রিকায়। দিল্লি ও কলকাতায় পত্রিকাটি ভালো চলত। খুব মর্যাদাবান ছিল। কলকাতা থেকে সম্পাদক আমাকে ফোন করে বললেন, হাজারো শরণার্থী দীর্ঘ লাইন ধরে ভারতে আসছে। তাদের ছবি তোলার জন্য কলকাতায় আসতে হবে।
বৃৃষ্টিতে যশোর-খুলনা রোডে শরণার্থীদের ঢল। আলোকচিত্র: রঘু রাই
ছবি: সংগৃহীত

পরদিন আমরা অন্য একটা এলাকায় গেলাম। উদ্বাস্তুরা সেখানে স্কুলসহ নানা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিল। যেখানেই খালি জায়গা, সেখানেই ঠাঁই গাড়ার চেষ্টা করছিল। কেউ কেউ তো বড় সিমেন্টের পাইপের মধ্যেও আশ্রয় নিয়েছিল। রান্না চলত সেখানেই। কারণ, বর্ষা চলছে। শিশুদের মন খারাপ। তারা ক্ষুধার্ত। বাস্তবতা তারা বোঝে না। তারা ঠিকঠাক খাবার চাইছিল, কিন্তু কোথায়?

আমি একটি শিশুর ছবি তুলেছিলাম। ওর চোখে পানি টলটল করছে, কিন্তু গড়িয়ে পড়ছে না। অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা।

এক বৃদ্ধাকে দেখলাম। একেবারে ক্লান্ত ও অবসন্ন। আমি তাঁর সামনে বসলাম। তিনি মাথা তুলে যন্ত্রণাবিদ্ধ চোখে তাকালেন। তারপর অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। আমার প্রশ্ন করার সাধ্য ছিল না।

এরপর আমি ত্রিপুরায় চলে গেলাম। বিভিন্ন সময়ে যেতে লাগলাম বিভিন্ন এলাকায়। ছবি তুলতে থাকলাম শরণার্থীদের। অকল্পনীয় এক অভিজ্ঞতা।

বাঙালিদের সম্পর্কে একটি কথা বলতেই হয়। মানুষ হিসেবে তারা খুবই আবেগপ্রবণ ও সংবেদনশীল। কলকাতার রাস্তায়ও যদি গ্রাম থেকে কোনো চেনা পরিবার কারও বাড়ির কাছে এসে দরজার সামনে তাদের বোঁচকা রাখে, কেউ এ কথা বলবে না যে ‘আপনি এখানে বসবেন না’ বা ‘থাকতে পারবেন না’। বলবে, ‘আচ্ছা, একটু জায়গা করে নিন।’ বাঙালিদের সংস্কৃতি এই রকম। তাই সর্বত্রই তারা সাহায্য করছিল। কারণ, নৃশংসতা ছিল অবিশ্বাস্য।

উদ্বাস্তু শিবিরে রান্না। আলোকচিত্র: রঘু রাই
ছবি: সংগৃহীত

সামরিক বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা কোনো জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তাদের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করে, তাদের নির্যাতন ও হত্যা করে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ক্রমাগত সেটাই করছিল। এমনকি তারা বুদ্ধিজীবীদেরও হত্যা করেছিল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের কাউকে রেহাই দেওয়া হয়নি। নির্যাতন ছিল অন্তহীন ও নির্মম।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে একজন ক্যাপ্টেনকে যুক্ত করে দেওয়া হলো। তাঁরা লেখক ও আলোকচিত্রীদের ভেতরে যেতে সাহায্য করছিলেন। আমি অবশ্য দিল্লি থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে এসেছিলাম। সেনাশিবিরটি খুলনা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিল। আমি যাত্রা করলাম প্রথম কলামটির সঙ্গে, অর্থাৎ একটি ট্যাংক আর শ খানেকের মতো সৈন্য। ট্যাংকটি খুলনার দিকে যাচ্ছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা তখন পিছু হটতে শুরু করেছে। আমাদের জওয়ানদের ভূসংস্থান ও ভূদৃশ্য সম্পর্কে ধারণা ছিল। আমরা আমাদের ট্যাংক ও জওয়ানদের সঙ্গে হাঁটছিলাম। হঠাৎ এয়ার বার্স্ট শুরু হলো। এয়ার বার্স্ট একরকমের গোলাগুলি ও শেলের হামলা। মাথার ৪০-৫০ ফুট ওপরে ছোট ছোট শেল ফেটে গিয়ে মানুষ মেরে ফেলে। তাদের প্রথম শেল আমাদের থেকে ১০০ মিটার দূরে গিয়ে পড়ল। দ্বিতীয়টি ৫০ মিটার দূরে। তৃতীয়টি মাত্র ২০ মিটার দূরে। কেউ তাদের পথ দেখাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন আমাকে বললেন, ‘আপনি কি কোনো ছবি পাচ্ছেন?’ আমি বললাম, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘পরের আক্রমণটা আমাদের দিকে লক্ষ্য করে হতে পারে।’ আমরা হঠাৎ ট্যাংক আর জওয়ানদের ছেড়ে অন্যদিকে দৌড়াতে শুরু করলাম। সেই সময়টা ছিল আতঙ্কের।

বাঙালিদের সম্পর্কে একটি কথা বলতেই হয়। মানুষ হিসেবে তারা খুবই আবেগপ্রবণ ও সংবেদনশীল। কলকাতার রাস্তায়ও যদি গ্রাম থেকে কোনো চেনা পরিবার কারও বাড়ির কাছে এসে দরজার সামনে তাদের বোঁচকা রাখে, কেউ এ কথা বলবে না যে ‘আপনি এখানে বসবেন না’।
মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থী। আলোকচিত্র: রঘু রাই
ছবি: সংগৃৃহীত

সেনাবাহিনী এগিয়ে চলেছে ঢাকার দিকে। যুদ্ধ তখনো চলছে। কোথাও কোনো মানুষ দেখা যাচ্ছিল না। চা বা রাস্তার পাশের খাবার দোকান—কোথাও কেউ নেই। সবাই লুকিয়ে ছিল। কারও দরজায় টোকা দিলে তারা আগে দেখে, তারপর দরজা খোলে। যশোর খুব খারাপভাবে ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেখানে বহু ঘর ভাঙা ও পোড়া অবস্থায় ছিল। মৃতদেহও পড়ে ছিল। আমরা তার ছবি তুলেছিলাম।

জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব খুবই চালাক একটি খেলা খেলেছিলেন। তিনি পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজিকে বললেন, ‘আমরা চারদিক থেকে আপনাদের ঘিরে ফেলেছি। কোনো বড় বিপর্যয় ঘটার আগে আমরা বরং একসঙ্গে বসে কথা বলি?’ জ্যাকব তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। তাঁকে বললেন, ‘আপনারা বরং আত্মসমর্পণ করুন। অযথা রক্তপাতের আর দরকার নেই।’ নিয়াজি জানিয়ে দিলেন, তাঁদের ৯০ হাজার সৈন্য আছে। জ্যাকব বললেন, ‘দেখুন, আপনাদের আমরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছি। আমাদের বিমানবাহিনীও প্রস্তুত।’ তিনি নিয়াজি ও তাঁর পরিবারকে শতভাগ নিরাপত্তা গ্যারান্টি দিয়ে বললেন, ‘আত্মসমর্পণ করলে আপনার সৈন্যদের কিছু হবে না। আমরা খেয়াল রাখব।’

জেনারেল জ্যাকব নিয়াজিকে ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়ে বললেন, তাঁরা আত্মসমর্পণ না করলে লড়াই শেষ পর্যন্ত চলবে। পরে জ্যাকব আমাদের বলেছিলেন, ‘ঢাকা শহর ঘিরে আমাদের সৈন্য ছিল মাত্র ১৮ হাজার। ওঁরা লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিলে পেরে ওঠা কঠিন হতো।’

জেনারেল অরোরা ও জেনারেল জ্যাকব দলবল নিয়ে হেলিকপ্টার থেকে নামলেন। জেনারেল নিয়াজিও তাঁদের সঙ্গে এলেন। তিনি মাথা নিচু করে হাঁটছিলেন। আমাদের সেনানায়কেরা হাঁটছিলেন আত্মমর্যাদার সঙ্গে। আত্মসমর্পণপত্রে স্বাক্ষর করা হলো। সবাই ছবি তুলছিলেন।
ভারতীয় ট্যাংক ও জওয়ান। আলোকচিত্র: রঘু রাই
ছবি: সংগৃহীত

পরদিন ফোন করলে নিয়াজি বললেন, ‘কে আপনাকে বলল যে আমরা আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছি?’ জ্যাকব বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনার পছন্দ। কিন্তু আমি দুঃখিত, এটাই আমাদের শেষ বার্তা।’ নিয়াজি বললেন, ‘দাঁড়ান, দাঁড়ান, এক মিনিট অপেক্ষা করুন।’ তারপর জানতে চাইলেন, ‘আত্মসমর্পণ কীভাবে হবে? কী করা হবে?’ তাঁকে বলা হলো, ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকার একটি উদ্যানে যথাযথ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ হবে। নিয়াজি বললেন, তিনি সে ধরনের কোনো অনুষ্ঠানের জন্য রাজি নন। তিনি একটি ব্যক্তিগত আত্মসমর্পণ ধাঁচের কিছু একটা চান। এ নিয়ে আলোচনা চলতে থাকল। অবশেষে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করল।

জেনারেল অরোরা ও জেনারেল জ্যাকব দলবল নিয়ে হেলিকপ্টার থেকে নামলেন। জেনারেল নিয়াজিও তাঁদের সঙ্গে এলেন। তিনি মাথা নিচু করে হাঁটছিলেন। আমাদের সেনানায়কেরা হাঁটছিলেন আত্মমর্যাদার সঙ্গে। আত্মসমর্পণপত্রে স্বাক্ষর করা হলো। সবাই ছবি তুলছিলেন। ঘটনাটা যেন অন্য একটি পৃথিবীতে ঘটছিল। আত্মসমর্পণের পরে আমরা ঢাকার রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কী উল্লাস, কী আনন্দ! একেবারে অন্য রকম একটা পরিবেশ।

নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে শরণার্থীদের দীর্ঘ মিছিল। আলোকচিত্র : রঘু রাই
ছবি: সংগৃহীত

রোম, লন্ডন, প্যারিস, ওয়াশিংটন, হংকং—বিশ্বের রাজধানী শহরগুলোয় আমি আমার তোলা ছবির প্রদর্শনী নিয়ে গিয়েছিলাম। মানুষ জানতে পেরেছিল, সেখানে কী ঘটেছে; কী দুর্দশা, কষ্ট ও নির্যাতন সেখানে চলেছে। লে মঁদ, লা ফিগারো, নিউইয়র্ক টাইমস—নানা জায়গায় আমার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। আমি ভারতে ফেরার পর প্রথমবারের মতো একজন আলোকচিত্রশিল্পীকে পদ্ম পুরস্কার দেওয়া হলো। কারণ, একজন আলোকচিত্রশিল্পী বড় একটা পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন। কারণ, ইতিহাসের ভিজ্যুয়াল রেকর্ড এক অনস্বীকার্য প্রমাণ।

• লেখক: ভারতীয় আলোকচিত্রশিল্পী