আবুল হাসনাত সম্পাদিত গণসাহিত্যের কয়েকটি সংখ্যা

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

একটি সাহিত্য পত্রিকার নাম ছিল গণসাহিত্য। সম্পাদক আবুল হাসনাত (জন্ম: ১৭ জুলাই, ১৯৪৫–মৃত্যু: ১ নভেম্বর, ২০২০)। আবুল হাসনাতের কবি নাম—মাহমুদ আল জামান। কবি ও সম্পাদক পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও চিত্রসমালোচক। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে গণমানুষের মাঝে শিল্প-সাহিত্যকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর এক সফল প্রয়াসের নাম গণসাহিত্য। দেশের প্রধান কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীদের পাশাপাশি এক ঝাঁক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল মাসিক মুখপত্রটি। লেখা–সংক্রান্ত ঘোষণায় পত্রিকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল—জীবনমুখী নবীন ও প্রবীণদের লেখা গ্রহণযোগ্য…। 

মাসিক গণসাহিত্য ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু করে ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে। মুদ্রিত হয় জনসন রোডের এসোসিয়েট প্রিন্টার্স লিমিটেড থেকে। প্রকাশের সময় ছিল—প্রতি বাংলা মাসের প্রথম দিন। শুরুতে গায়ের দাম ছিল এক টাকা ২৫ পয়সা, কয়েকটি সংখ্যার পর দেড় টাকা মূল্য ধার্য করা হয়। গণসাহিত্যের উপদেশক ছিলেন ডক্টর আনিসুজ্জামান, শামসুর রাহমান, কাইয়ুম চৌধুরী, মতিউর রহমান, মফিদুল হক ও বেবী মওদুদ। তৃতীয় সংখ্যা থেকে মফিদুল হক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।  

জাতীয় মহাফেজখানা, পুরোনো পত্রিকার সংগ্রহশালা কিংবা গ্রন্থাগারে মাসিক গণসাহিত্যের সবগুলো সংখ্যা একসঙ্গে দেখার সুযোগ নেই। বাংলা একাডেমির পুরোনো পত্রিকা সংগ্রহের ক্যাটালগে গণসাহিত্যের ১৯৭২–১৯৭৯ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত কয়েকটি সংখ্যার তথ্য উল্লেখ আছে।

গণসাহিত্যের প্রথম সংখ্যা

গণসাহিত্যের প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের ৭ আগস্ট। বাংলা সনের হিসাবে প্রকাশের দিনটি ছিল ২২ শ্রাবণ, ঠিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণদিবসে। তবে ঠাকুরের স্মরণে পত্রিকাটি বিশেষ কোনো আয়োজন করেনি। রাবীন্দ্রিক সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে তারা জানান দিয়েছিল এক বৃহৎ ক্যানভাসের। সূচিপত্রের শুরুতেই ছিল পাঁচটি প্রবন্ধ—আনিসুজ্জামানের ‘পৃথিবীর কবি’, রণেশ দাশগুপ্তের ‘কবিতা যেন জীবন্ময়ী নদী’, রঙ্গলাল সেনের ‘মার্কসের সমাজ চিন্তা’, সন্তোষ গুপ্তের ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত ও বিষ্ণু দে’ এবং সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ’। 

প্রবন্ধের পরপরই সাতজন কবির কবিতা—বিষ্ণু দের ‘অসম্পূর্ণ কবিতা বাংলায় বাংলায়’, সানাউল হকের ‘এ ঢাকায় ফুটেছে পলাশ’, শামসুর রাহমানের ‘ভ্রমণে আমরা’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘এখনো জ্যান্ত মানুষের মতো’, মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘শোভাযাত্রা, দ্রাবিড়ার প্রতি’, মাহমুদ আল জামানের ‘শবযাত্রা প্রতিদিন’ এবং শেষ কবিতাটি ছিল খান মোহাম্মদ ফারাবীর ‘ঈশ্বরের কাছে রিপোর্ট’। 

আলোচনা বিভাগে আলী যাকের লিখেছেন ‘বিপন্ন থিয়েটার’ এবং মুনতাসীরের ‘বাঁকুড়ার সেই রঙের জাদুকর’। 

গল্প ছিল দুটি—আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘রূপান্তর’ এবং আজমিরি ওয়ারেশের গল্প ‘একা একা’।

পত্রিকাটির ৮৮ নম্বর পৃষ্ঠার পুস্তক সমালোচনায় বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন ‘কুসুমিত ইস্পাত’ বইটি নিয়ে। 

প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জায় ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।

গণসাহিত্যের প্রথম সংখ্যার সূচি, প্রকাশ: ৭ আগস্ট, ১৯৭২
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

গণসাহিত্যের দ্বিতীয় সংখ্যা

মাসিক গণসাহিত্যের দ্বিতীয় সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে (আশ্বিন, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ)। এ সংখ্যাটিও প্রথম সংখ্যার মতো প্রবন্ধ দিয়ে শুরু হয়। এবার রাখা হয় পাঁচটি প্রবন্ধ—মোহাম্মদ ফরহাদের ‘সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি’, সন্তোষ গুপ্তের ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা: উৎস সন্ধানে’, হায়াৎ মামুদের ‘স্বাধীনতার স্বাদ: ইদানীংকার কবিতা’ এবং হাসান ফেরদৌসের ‘একজন আইরিশ নাট্যকার’। 

গণসাহিত্যের দ্বিতীয় সংখ্যায়ও এক ঝাঁক কবির কবিতা মুদ্রিত হয়। শুরুতেই বিষ্ণু দের কবিতা ‘১৯৭১’, সানাউল হকের ‘শব্দার্থী ভ্রমর’, শামসুর রাহমানের ‘চারটি কবিতা’, মাহমুদ আল জামানের ‘রিপোর্টাজ’, মহাদেব সাহার ‘খেলা’, সিকদার আমিনুল হকের ‘যিশু’, সুব্রত বড়ুয়ার ‘অবধারিত নিষ্কৃতি’, নিয়াম হুসেনের ‘বইয়ের কথাগুলো’, আখতার হোসেনের ‘না’, বেবী মওদুদের ‘আমি অপেক্ষা করি’, কাজী হাসান হাবিবের ‘ঘরে ফেরার সময়’, কঙ্কন নন্দীর ‘এলেনা’, এবং ডন রীডের ‘হে আমার সাহসী এঞ্জেলা’ কবিতাটির অনুবাদ। 

দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘শিল্পকলা’ নামে নতুন বিভাগ যুক্ত হয়। সেই বিভাগে চলচ্চিত্র নিয়ে মাহবুব জামিল লেখেন ‘আজকের পেক্ষাপট: আমাদের চলচ্চিত্র’। 

এই সংখ্যায় গল্পের সংখ্যাও বাড়ানো হয়। শুরুতেই শওকত আলীর গল্প ‘কোথায় আমার ভালোবাসা’, কায়েস আহমেদের ‘প্রতীক্ষিত লন্ঠন’ এবং অনুবাদ গল্পে নগুয়েন সাং–এর ‘চিরুনী’ গল্পটি প্রকাশ করা হয়। সবশেষে ছিল পুস্তক সমালোচনা। 

এই সংখ্যাটিরও প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জায় ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। 

গণসাহিত্যের তৃতীয় সংখ্যা

গণসাহিত্যের তৃতীয় সংখ্যায় সম্পাদক আবুল হাসনাতের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দেখা যায় মফিদুল হককে। প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের অক্টোবরে (কার্তিক, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ)। এই সংখ্যাটি শুরু হয় পাঁচটি প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে—সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘দুই বিচ্যুতির মাঝখানে’, মালেকা বেগমের ‘ভাষা জনগণের জীবনের ফসল’, দিলীপ বসুর ‘সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ’, শামসুদ্দোহার ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজির স্থান’ এবং অনিল মুখার্জির ‘স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতা’। 

প্রবন্ধের পর ৩৮ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে শুরু হয় কবিতা—শামসুর রাহমানের ‘তিনটি কবিতা’, হাসান হাফিজুর রহমানের ‘শেষ দ্বৈরথের কোলে জন্মদিন’, শহীদ কাদরীর ‘তিনটি কবিতা’, আল মাহমুদের ‘ম্যাকসিম গর্কি স্মরণে’, মাহমুদ আল জামানের ‘অনিষ্ট লোকালয়ে’, সেলিম সারোয়ারের ‘উদ্ধার, আমার উদ্ধার’, মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘জনৈক রোবট বলছে’, খান মোহাম্মদ ফারাবীর ‘কবিতার মুখ’, দাউদ হায়দারের ‘সম্পন্ন মানুষ নই’ এবং তো হুর ‘আমার কথাগুলো মনে রেখো’ কবিতাটির অনুবাদ।

শিল্পকলা বিভাগে কামরুল হাসান লেখেন ‘কুটির শিল্পে আজকের চিন্তা’। 

গণসাহিত্যের তৃতীয় সংখ্যায় নতুন একটি বিভাগ খোলা হয়—আত্মকথন। সেই বিভাগে আবুল ফজল লেখেন ‘অবস্থা বনাম ব্যবস্থা’। 

এর পরই ৬৭ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে গল্প শুরু—প্রথমেই হাসান আজিজুল হকের গল্প ‘ঘর–গেরস্তি’ তারপর বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের গল্প ‘ঘরে ফেরা’। এবং সবশেষে পুস্তক সমালোচনা নিয়ে নিয়মিত বিভাগটি ছিল। 

বরাবরের মতো তৃতীয় সংখ্যাটিরও প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জায় ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। 

গণসাহিত্যের অষ্টম ও নবম সংখ্যা

গণসাহিত্যের অষ্টম ও নবম সংখ্যা একটি মলাটেই প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালের মার্চ–এপ্রিলে। পত্রিকার মূল্য ২৫ পয়সা বাড়িয়ে দেড় টাকা করা হয়। এই সংখ্যার শুরুতেও যথারীতি প্রবন্ধ—অজয় রায়ের ‘শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি ও ঐতিহ্যবিচার’ এবং মতিউর রহমানের লেখা ‘চিলির কবি পাবলো নেরুদা’। 

কবিতা বিভাগে সানাউল হকের ‘দুটি কবিতা’, শামসুর রাহমানের ‘তবে মননেও’, আল মাহমুদের ‘নদী তুমি’, মাহমুদ আল জামানের ‘মাই মাস্ক, মাই ইরিনা’, জাহিদুল হকের ‘প্রিয়তমাসু’, খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের ‘প্রস্তর নিকুঞ্জ’, আবুল কাসেমের ‘তিনটি কবিতা’ এবং হায়াৎ মামুদ অনূদিত ‘লিয়েমস্তকের কবিতা’ প্রকাশিত হয়। 

শিল্পকলা বিভাগে পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মফিদুল হক লেখেন ‘সংগীতে বিম্বিত ভুবন’ নামে একটি নিবন্ধ। ওই সংখ্যার বিশেষ ক্রোড়পত্র বিভাগে লিখেছেন জ্ঞান চক্রবর্তী, রণেশ দাশগুপ্ত, সোমেন চন্দ, আবুল ফজল ও হাসান ফেরদৌস।

প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জায় ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী।

গণসাহিত্যের পাবলো পিকাসো সংখ্যা

গণসাহিত্যের প্রথম বর্ষের দশম সংখ্যাটি ছিল একটি বিশেষ সংখ্যা। স্পেনের চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর মৃত্যুর পর গণসাহিত্য অল্প সময়ের মধ্যে সংখ্যাটি বাজারে নিয়ে আসে। পিকাসো সংখ্যাটিও অন্যান্য সংখ্যার মতো প্রবন্ধ দিয়ে শুরু হয় এবং শেষ হয় পিকাসোকে নিবেদিত কবিতার অনুবাদ দিয়ে। এ বিশেষ সংখ্যায় অন্যান্য নিয়মিত বিভাগ বাদ দেওয়া হয়। 

প্রবন্ধ অংশে রণেশ দাশগুপ্ত লেখেন ‘কমরেড পিকাসো: শিল্পী ও জীবনচরিত’, এরপরই ইলিয়া এলেন বুর্গের একটি স্মৃতিগদ্যের অনুবাদ—‘পিকাসো: আমার স্মৃতি’, বিষ্ণু দে লেখেন ‘মস্কভা–পিকাসো সংবাদ’, রশিদ চৌধুরী লেখেন ‘পিকাসো’, নজরুল ইসলাম লেখেন ‘গঠন–পর্বে পিকাসো’, সন্তোষ গুপ্তের  রচনায় উঠে আসে ‘পিকাসোর শিল্পকলায় নান্দনিক বৈভব’, শামসুর রাহমান লেখেন ‘আমৃত্যু তাঁর জীবনানন্দ’, রফিকুন নবীর রচনা ‘সুনামে, দুর্নামে পিকাসো’, মতিউর রহমান লেখেন ‘ছবির কবিতা, কবিতায় ছবি’, আবদুর রাজ্জাক লেখেন ‘পিকাসোর শ্রেষ্ঠতম প্রদর্শনী’, মুনতাসীর মামুন লেখেন ‘পুস্তক শিল্পী পিকাসো’ এবং শেষ প্রবন্ধটি আখতার হুসেনের—‘পিকাসো এবং পোস্টার’। 

সংখ্যাটির কবিতা বিভাগে পল এলুয়ারের ‘পাবলো পিকাসো’, রাফায়েল আলবেতির ‘নীল–বৃষ’, এবং স্বয়ং কবি পিকাসোর লেখা ‘জেনারেল ফ্রাঙ্কোর স্বপ্ন’ কবিতাটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়। 

পিকাসোর সাড়াজাগানো কাজ ‘গোয়ের্নিকা’র অংশবিশেষ দিয়ে প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেন কাইয়ুম চৌধুরী। সংখ্যাটির প্রকাশকাল মে–জুন, ১৯৭৩। তখন সংখ্যাটি বোদ্ধা পাঠকমহলে সাড়া ফেলে দেয়। তাই এই সময়ের পাঠকের কথা বিবেচনা করে ২০২৫ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রথমা প্রকাশন থেকে গণসাহিত্যের আলোচিত ‘পাবলো পিকাসো’ সংখ্যাটির পুনর্মুদ্রণ করা হয়।

২০২৫ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রথমা প্রকাশন থেকে গণসাহিত্যের আলোচিত সেই ‘পাবলো পিকাসো’ সংখ্যাটি পুনর্মুদ্রণ হয়
ছবি: প্রথমা

গণসাহিত্য ছাড়াও আবুল হাসনাতের সম্পাদনায় সংবাদ সাময়িকী একসময় এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল, তারপর কালি ও কলমসহ আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শিল্প–সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেছেন। মৌলিক রচনা ও সম্পাদনাসহ তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সত্তরের অধিক। গণসাহিত্যের আবুল হাসনাত ছিলেন সেই বিরলপ্রজ কবি ও সম্পাদক—যিনি তাঁর লেখা ও কর্মের মধ্য দিয়ে আমৃত্যু শিল্প–সংস্কৃতির সঙ্গে মানুষের মুক্তি ও মূল্যবোধের চেতনাকে ধারণ করে গেছেন।