প্রেমে পড়লে এখনো কি সবাই কবি হয়ে যায়

প্রেমে পড়েছে, কিন্তু কাঁপা কাঁপা হাতে কবিতা লেখেননি, এই কিছুদিন আগেও এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর। তবে আজকাল প্রযুক্তিকে সঙ্গী করে যে প্রজন্ম বেড়ে উঠছেন, তাঁরা কি প্রেমে পড়লে কবি হয়ে যান? হলে কেমন থাকে তাঁর প্রকাশভঙ্গি?

এমনও বলা যায়, যখন কেউ কবিতা লিখতে শুরু করে প্রিয় মানুষের জন্য, তখন মূলত প্রেমটা প্রতিষ্ঠিত হয়
ছবি: প্রথম আলো

বিশ্বখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো বলেছেন, ‘প্রেমের স্পর্শে প্রত্যেকেই কবি হয়ে ওঠে!’ কিংবা এমনও বলা যায়, যখন কেউ কবিতা লিখতে শুরু করে প্রিয় মানুষের জন্য, তখন মূলত প্রেমটা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রেম নিজের মতো করে একটা প্রতিশ্রুতির চেহারা খুঁজে নেয়, পেয়ে যায় চিরকালীন প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র। হ্যাঁ, বিয়ের মতো প্রেমেরও একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আছে। মিলেনিয়ালস প্রজন্ম পর্যন্ত মনে করা হতো একটা কবিতা হলো হৃদয় থেকে নিঃসৃত হওয়া প্রেমের প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা।

অন্যভাবে যদি ব্যাখ্যা করি, প্রেমে পড়লে ছেলে-মেয়ে—সবারই শরীরের ভেতরে একধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। যাঁকে ভালোবেসে ফেলেছেন, তাঁকে দেখলে বুকের ভেতর এক অদ্ভুত চাপ অনুভূত হয়। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় কিংবা তাঁকে ফোন করার আগে প্রচণ্ড আবেগ-অনুভূতির সৃষ্টি হয়। এ অনুভূতিকেই ইংরেজিতে সুন্দর একটা ফ্রেজে বলা হয়—‘বাটারফ্লাইস ইন স্টোমাক’। এ অনুভূতির কারণ অবশ্য কেউ ব্যাখ্যা করতে পারেননি। কারণ, এমন অনুভূতি হয় শুধু প্রেমে পড়লে।

এ রকম কঠিন ‘প্রেমে’ এখনকার ছেলেমেয়েরা কি কখনো পড়ে? কেমন থাকে তাদের প্রকাশভঙ্গি, জানতে চেয়েছিলাম তাদের একজনের কাছে। প্রিয় মানুষ যখন কাঁদায়, হাসায়, উৎফুল্ল করে, পাগল করে, বিষণ্ন করে, আত্মবিশ্বাস তৈরি করে বা নষ্ট করে দেয়, তেমন সময় নিজের অনুভূতি কীভাবে প্রকাশ করে নতুন প্রজন্ম? অন্তর্জাল ও ডিজিটাল বার্তার আধিপত্যের এ যুগে প্রেমের কবিতা লেখার মতো ‘সেকেলে’ প্রকাশভঙ্গিগুলো কি হারিয়ে গিয়েছে? এখনকার প্রজন্ম প্রেমের এই সব জটিল আবেগগুলো কেমন করে প্রকাশ করে! তারা কি তাদের আগের প্রজন্মের অনেকের মতো কখনো শব্দ গুনে গুনে মোবাইল কোম্পানির দেওয়া ফ্রি মেসেজে কবিতা লিখে পাঠিয়েছে প্রিয়জনকে?

জিজ্ঞেস করেছিলাম ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে পড়ুয়া অন্তু নামের একজনকে। প্রশ্ন শুনেই প্রথমে ভুবন কাঁপিয়ে হেসে নিলেন অন্তু। তারপর তিনি বললেন, ‘কবিতা লেখা খুব ন্যাকা আর ক্রিঞ্জি লাগে। খ্যাত ছেলেদের দেখেছি কবিতা লিখে মেয়েদের ইনবক্সে পাঠায়।’ তাঁর কাছে ‘ক্রিঞ্জ’ শব্দের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে বললেন, ‘এই ধরেন গাছ-লতাপাতা কিংবা তুমি আমার চাঁদের টুকরা—এই সব লেইম ব্যাপার–স্যাপারকে ক্রিঞ্জ বলে।’

অন্তুর সঙ্গে কথা বলার পর ভাবলাম, ‘লেইম’-এর ব্যাখাও জানা দরকার। তাই চলে গেলাম ধানমন্ডির এক কফির দোকানে, যেখানে এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা আড্ডা দেন। পরিচিত এক যুগলকে দেখতে পেয়ে আলাপের একপর্যায়ে একই প্রশ্ন করলাম, প্রেমিকার জন্য উৎসর্গ করা তাঁর কোনো কবিতা আছে কি না। আতিক নামের তরুণটি বললেন, ‘অনেকগুলাই লিখেছি উৎসর্গ করে। আমি মনে করি, কবিতা একটি প্রাচীন মাধ্যম, যা মানুষের আবেগের সূক্ষ্মতাকে সুন্দর শব্দে ক্যাপচার করার ক্ষমতা রাখে।’

আসলেই কবিতা ঐতিহাসিকভাবে প্রেম প্রকাশের একটি বাহক হিসেবে কাজ করেছে। এখন ডিজিটাল অগ্রগতি আমাদের যোগাযোগের উপায়কে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের প্রেমিক-প্রেমিকারা কবিতাকে যোগাযোগের একধরনের মাধ্যম মনে করতেন।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, ২০ থেকে ৩২ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে এখনো প্রেমের জন্য কবি হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি বিদ্যমান। এই বয়সের তরুণদের মধ্যে ৬০ শতাংশ এখনো সৃজনশীল অভিব্যক্তিকে তাঁদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করেন। যদিও প্রেমের কবিতাই প্রধান পছন্দ না–ও হতে পারে তাঁদের। অনেকে আছেন, যাঁরা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে কবিতা লিখে প্রেমিকাকে পাঠিয়েছেন মুগ্ধ করার জন্য—দেশ কিংবা দ্রোহ নিয়ে।

আগেও যেমন কবিতা পাঠালে প্রিয় মানুষ খুশি হতো, এখনো তেমনটা রয়েছে। বিসিএস পরীক্ষার্থী এবং প্রস্তুতি গ্রহণকারী জান্নাত বললেন, ‘আমি বেশ কয়েকবারই কবিতা পেয়েছি ইনবক্সে, বেশির ভাগ কবিতাই অখাদ্য হয়। মুখের ওপর তো কিছু বলা যায় না, তখন “সিন” করে রেখে দিই। এরপর অনেকে আছে, সিন করে অখাদ্য কবিতার প্রশংসা না করলে “আনসেন্ট” করে দেয়।’

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে একটি ছোট মাইক্রো-কবিতা, হৃদয়গ্রাহী ক্যাপশন এবং চিত্তাকর্ষক শিল্পকর্মের একটি ক্যাপশনকে প্রেমের মূল সারাংশ হিসেবে প্রকাশ করে এখনকার প্রেমিক–প্রেমিকারা। সেই ‘ট্রেন্ড’ মূলধারার কবিরাও অনুসরণ করছেন।

মনস্তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, অনেকে হারিয়ে যাওয়া সাবেক প্রেমিক–প্রেমিকাকেও কবিতা উৎসর্গ করে। এতে মানসিক প্রশান্তি আসে হয়তো।

প্রেমের কবিতা প্রেমের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতির প্রতিফলন। ডিজিটাল যুগে অনুভূত প্রেম বহুমুখী এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা ক্ষণস্থায়ী। এসব কারণে কবিতা লেখার মতো বিষয় থেকে দূরেই থাকে এখনকার ছেলেমেয়েরা, এমনটা মনে করেন অনেকে। আবার কেউ কেউ লেখেনও বটে। ক্ষণস্থায়ী মিথস্ক্রিয়ার এ যুগে প্রেমের কবিতা মানুষের আবেগের নিরন্তর শক্তি এবং অবিরাম আকাঙ্ক্ষার একটি মর্মস্পর্শী প্রমাণ হিসেবে কাজ করে, ভবিষ্যতেও করবে—কাগজে, নয়তো ইনবক্সে কিংবা রিলস ভিডিওতে।