‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে,/ কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে’—কবিগুরুর অপূর্ব কাব্যময়তায় বলা অমোঘ সাবধানবাণী! বাস্তবিক অর্থে ফাঁদে আমরা কেই-বা পড়তে চাই। কিন্তু প্রেমের ফাঁদ বড় আকর্ষণীয়, বড় মধুময়। এতে পড়বার জন্য উন্মুখ নয়, এমন নীরস মানুষের দেখা মেলা ভার। এ জগতে আমাদের আটপৌরে জীবনের মর্মমূলে কিন্তু সেই প্রেম। আবার একদিকে সব সৃজন, সব লালন; অন্যদিকে সব বিনাশেরও কারণ কিন্তু এই প্রেম। তবে জীবনের এত সব গূঢ় সত্য পুরোপুরি উপলব্ধি হওয়ার আগেই, এমনকি কবিগুরুর সাবধানবাণী অনুধাবন করারও আগে ষোড়শী আমি কেমন করে যেন নিজের অজান্তেই সপ্তদশী এক কিশোরের প্রেমের ফাঁদে আটকা পড়ে গেলাম আজীবনের জন্য।
এই জীবনভর একই মানুষের সঙ্গে প্রেমের ফাঁদে আটকে থাকা কিন্তু নিছক মুখের কথা নয়। আর আটকাবস্থায় যুগলে চলার পথটাও একেবারেই নিস্তরঙ্গ নয়। চড়াই-উতরাইও কম আসেনি এই জীবনভর একসঙ্গে চলার পথে। কিন্তু এখন যখন এত বছর পর পরিণত বয়সে ফিরে তাকাই, তখন বুঝি ‘চিরজীবন বইব গানের ডালা’ শপথ নেওয়া আমার এই ‘কান্নাহাসির-দোল-দোলানো’ ফাঁদবন্দী যাবজ্জীবন দশা সত্যিকার অর্থেই আমার কাছে ‘সুরের-গন্ধ-ঢালা’। তাই বলে যেন ভেবে নেবেন না, আমার এই যাপন কেবলই উদ্যাপন, একেবারে কুসুমাস্তীর্ণ। তা কি আর হয়, না হতে পারে, না হওয়া সম্ভব! আর দশটা সাধারণ ছাপোষা বাঙালি দম্পতির মতোই আমাদের জীবনও কেবল ‘মুগ্ধ ললিত অশ্রুগলিত গীতে’ কিংবা ‘পঞ্চশরের বেদনামাধুরী দিয়ে’ সাজানো নয়, ‘রুক্ষ দিনে’, ‘দুর্দম বেগে দুঃসহতম কাজে’, ‘দুর্গমপথমাঝে’, ‘পাড়ি দিতে নদী হাল’ ভেঙেছে বারবার, শতসহস্রবার হয়েছে ‘ছিন্ন পালের কাছি’, তবু আমার ভেতরকার সুর, আশৈশব চর্চিত আর চর্যিত রাগসংগীতের স্বরের সাহচর্য আর সুরের অনুষঙ্গ আমার শক্তি হয়ে রয়েছে সবসময়। অসহায়, বিষণ্ণ সময়েও সুরের আশ্রয়েই টের পেয়েছি ‘এ বাণী, প্রেয়সী, হোক মহীয়সী “তুমি আছ আমি আছি”।’
আমার সুরের বোধ, আমার আজীবন বয়ে চলা ‘গানের ডালা’ আমার সুখে–আনন্দে–প্রাপ্তিতে জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ করেছে। সুরের অঞ্জলি নিবেদনে জীবনে প্রাপ্তির উচ্ছলতা আর উজ্জ্বলতা উদ্ধত না হয়ে আনত হয়েছে বহুবার, বারবার। আবার ‘গানের ভেতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি’, তখন আমার যাপিত জীবনের সব গভীর দুঃখে–শোকে–বেদনায়–অভিযোগে–অভিমানে সুর সঙ্গে থেকে শক্তি জুগিয়েছে, আলো হাতে আলেয়ার মতো পথ দেখিয়েছে। গানের সঙ্গ আর সুরের বোধ আমাকে বারবার মনে করিয়েছে, প্রতিনিয়ত চর্চা করে, চর্যা করে, আদরে–ভালোবাসায়–মায়ায়–শাসনে সুর–গানকে যেমন আয়ত্তে, কণ্ঠের নাগালে রাখতে হয়, ঠিক তেমনি ‘দাম্পত্যটা একটা আর্ট, প্রতিদিন ওকে নতুন করে সৃষ্টি করা চাই’, যেমনটা স্বয়ং রবি ঠাকুর বলে গেছেন। আশৈশব গানের তালিম থেকে শিখেছি অনভ্যাসে, যত্নের অভাবে গলার সুর বশে থাকে না, মন থেকে গান দূরে পালালে, কণ্ঠেও আর তেমন করে সুরের দেখা মেলে না। সেই গভীর বোধ আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আশঙ্কাটুকুই হয়তো বছরের পর বছর আমাকে তাগিদ জুগিয়েছে প্রেমের ফাঁদের অলিগলিতে ধুলো না জমতে দেওয়ার, নিয়মিত পালিশের অভাবে প্রাঞ্জল দাম্পত্যের অবয়বে মরচে পড়ে নিতান্ত অভ্যাস হয়ে ওঠবার।
একেবারে সেই পাঁচ-ছয় বছর বয়সে আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে কেবল ইমন রাগ শিখেছিলাম। একই রাগ, তার একই আরোহণ–অবরোহণ–পকড় চর্চা করতে করতে শুধু সুরের পাঠই মেলেনি, শিখেছি কী করে গভীর ধৈর্যে, আন্তরিক অধ্যবসায়ে আর প্রবল প্রেমময়তায় চির আরাধ্য সুরকে খুঁজে বেড়াতে হয়। সেই বয়সেই মনে গেঁথে গিয়েছিল, একই রাগের সুর হাজারবার গাওয়ার পরও প্রতিবারই তাতে নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার মতো আনন্দ মেলে, তাকে নতুন করে বোঝার, জানার, চেনার সুযোগ মেলে। আর ঠিক এই শিক্ষাটুকুই এত বছর পার করে দিয়ে আমাকে আজও প্রাণিত করে দাম্পত্যের চিরচেনা অন্দরেও বারবার নতুন কিছু পাওয়ার অভিলাষ করার আর ‘মোহন মরীচিকা-পিছে-পিছে’ না ছুটে বরং ‘আমার যা আছে’, তাকে ঘষেমেজে নতুন আভরণে সাজানোর সতত অভিপ্রায়ের। এই প্রেরণা একান্তভাবেই সুরের থেকে, আমার গানের বোধ থেকে, আমার সাংগীতিক মানস থেকে উৎসারিত।
আর তাই যুগলযাত্রার এই সুদীর্ঘপথ আমার কাছে যেনতেন রঙে রঙিন নয়, বরং বিশেষভাবে রঞ্জিত আর তা সুরের রঙে। আমার কাছে আমার দাম্পত্য একান্ত আমার মতো করে সতত সুরময় আর তাকে কখনো বেসুরো হতে না দেওয়াই আমার সেই সুরময় জীবনের লক্ষ্য হয়ে থেকেছে। আমার সঙ্গে ফাঁদে আটকে পড়া সেই চিরচেনা মানুষটিকে পুরোপুরি আজও বুঝে ফেলিনি, জানতে পারিনি, আর তাতেই বোধকরি সবচেয়ে বড় আনন্দ, ঠিক যেমন করে হাজারবার গেয়েও কোনো চিরচেনা রাগের সুরকে আজও নতুন করে আবিষ্কার করি প্রতিবার গাইতে গেলে। ওই আকাঙ্ক্ষাটুকু, ওই খুঁজে পাওয়ার আনন্দটুকুই এই জীবনের প্রাপ্তি। আবার ‘চিরবন্ধু, চিরনির্ভর’ পরাণপ্রিয় মানুষটিকে নানা রাগের, নানা স্বরবন্ধে, সুরব্যঞ্জনায় প্রতিদিনকার জীবনে যে খুঁজে পাই—অতিসাধারণ এই আমার কাছে সেটুকুই প্রাপ্তি, তারই অপর নাম প্রেম। সেই প্রেমে পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, মিলন, বিরহ, মাথুর থেকে শুরু করে বিরাগ, রাগ, অভিমান, অভিযোগ সব আছে, সবটুকুই আছে। আর তাতে মিলেমিশে আছে নানা রাগের সুর, স্বর, চলন আর গতি, তার সুরময় দ্যোতনা। তাই হয়তো অনেক অভিযোগ-অনুযোগেও সুর এসে ‘বেদরদী’ প্রিয়কে নতুন করে চিনিয়ে যায়, ভালোবাসতে শেখায়।
সময়ের নিয়ম মেনে, কালের পরিক্রমায়, জীবনের চাহিদায়, নানা কর্তব্যে-দায়ে–প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে, অতর্কিতে বা অনিবার্যে আমার প্রেমের সুরে, আমার দাম্পত্যের স্বরবিন্যাসে, সুরের প্রকাশে বদল ঘটেছে, তার চলনে–গতিতে–প্রবৃত্তিতে পার্থক্য এসেছে, শুদ্ধ–কড়ি-কোমল স্বর আর সুরে বহুমাত্রা যুক্ত হয়েছে আর সেটাই খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সেই চিরচলমান পরিবর্তন আর পরিবর্ধনের সব সত্যতা ছাপিয়ে ‘গানের সুরের আসনখানি’ অচলা থেকেছে বলেই হয়তো জীবনে প্রেম আজও ফিকে হয়ে যায়নি। আর আমার সুরময় দাম্পত্য ভাবনাকে অসুর কিংবা বেসুরের উপদ্রব থেকে বাঁচিয়ে চলার এই চিরপ্রয়াসেই ফাঁদবন্দী এই জীবন আজ অব্দি দমবন্ধ করা ফাঁস হয়ে ওঠেনি হয়তো। জীবনের নানা বাঁকে ‘কত বসন্তে কত বরষায়/ খুঁজেছি তোমায় তারায় তারায়’—এর অভিপ্রায়ে, অভিলাষে যোগ হয়েছে নানা রাগের স্বর, সুর আর রসের ব্যঞ্জনা, আর আমি জীবনের এই বাগিচায় বুলবুলি হয়ে গেয়ে চলেছি—‘তোমারেই আমি চাহিয়াছি প্রিয় শতরূপে শতবার।/ জনমে জনমে চলে তাই মোর অনন্ত অভিসার’। আমার সেই অনন্ত অভিসারে সঙ্গ দেয় সুরের রসধারা, আমার গানের ডালি। আর তাই আরও হাজারটা কারণের পাশাপাশি এ কারণেও সুরের কাছে, গানের কাছে আমার আজন্ম ঋণ।
এ জীবনে খুব করে বুঝে গেছি, মেনে নিয়েছি যে সুরের আছে এক অদ্ভুত জাদুকরি ক্ষমতা। এ কারণেই তাকে ভর করে, তার ওপর সওয়ার হয়ে যখন খুশি ফিরে যেতে পারি ফেলে আসা মনরঙিন দিনগুলোতে একান্ত নিজের মতন করে। হৃদয়ের গহিনে তুলায় মুড়িয়ে রাখা সব অনুভূতিকে বারবার করে ফিরে দেখতে পারি, ঝালিয়ে নিতে পারি নানা রাগের সুরের চলন আর স্বরবিন্যাসে। আজ এত বছর পরও তাই শুদ্ধ সারং রাগের ‘স ন ধ স ন র স’ স্বরবন্ধে কিংবা অবরোহে কড়ি মধ্যম আর শুদ্ধ মধ্যমের সহাবস্থান পেরিয়ে ঋষভের আগমনে সেই কৈশোরের পূর্বরাগে মন রঞ্জিত হয়। এ রাগের স্বরবিন্যাসের শুদ্ধসরলতায় আর নির্মলতায় সেই ১৭ বছরের কিশোরের মায়াময় চোখ দুখানি মনে ভেসে ওঠে। সেই চোখে যে সরল ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছিলাম, শুদ্ধ সারং যেন আমাকে বারবার সেই প্রাপ্তিটুকু, প্রথম ভালোবাসার অকপট অনুরাগের অনুভবটুকু ফিরিয়ে দেয়।
এ রাগের সুরের চলনের মতোই সেই অনুভূতিতে নেই অতিরিক্ত কোনো অলংকার বা বাহুল্য, নেই বিভ্রম বা অতিনাটকীয়তা। নিষাদ থেকে পঞ্চমের মিড়ে অল্প করে ধৈবতের ছোঁয়া আমার কাছে সেই প্রথম প্রেমের শিহরণের সুরময় অভিব্যক্তি যেন! আর তাই গভীর বিষাদে কিংবা বিরহের কাতরতায় শুদ্ধ সারং রাগের স্বরবিন্যাসে ‘পথে-পথে ঝরা কুসুম ছাড়ায়ে/ রিক্ত শাখায় কিশলয় জড়ায়ে,/ গৈরিক উত্তরী গগনে উড়ায়ে—/ রুদ্ধ ভবনের দুয়ার ঠেলে’ কী এক অপূর্ব মোহময়তায় ‘ধূলি-পিঙ্গল জটাজুট মেলে।/ আমার প্রলয় সুন্দর’ এসে হৃদয়ের গভীর থেকে জানান দেয়—এখনো ঠিক সেই একই রকম ‘কাঁদে তব তরে পিয়াসি হিয়া’।
সংগীতগুরুরা বলেন, কল্যাণ ঠাটে বাঁধা গান্ধারবর্জিত এই রাগের চলনে আর গায়নে আছে শৃঙ্গার রস, আছে সরল শুদ্ধ নিবেদনের মাধুর্য, যাতে তীব্র মধ্যম গভীর অনুরণন যোগ করে। এই রাগের বাদীস্বর ঋষভ আর সমবাদী পঞ্চমের সুরেলা মেলবন্ধনের সঙ্গে সেই প্রথম প্রেমের ভীরু লাজে মাখা ষোড়শী আমার সঙ্গে সেই সপ্তদশবর্ষীয় কিশোরপ্রেমীর হৃদয়ের সমাপতনের সুর মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। দিবা দ্বিতীয় প্রহরের (সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা) এই রাগের সুর আর স্বরের বিন্যাস ঠিক যেন প্রথম প্রেমের পূর্বরাগের মতো নিষ্কলুষ, এ যেন ঠিক ঝকঝকে দীপ্তিময় রোদ্দুর, যাতে নেই সকালের শিশিরভেজা দ্বিধা অথবা মধ্যদুপুর রোদের কড়া তাপ, নেই বিকেলের দীর্ঘ ছায়া কিংবা রাতের আড়াল। গান্ধারবর্জিত এই রাগের বাকি শুদ্ধ স্বরে, তীব্র আর শুদ্ধ মধ্যমের ব্যঞ্জনায় এক গভীর প্রশান্তি আছে, আছে আন্তরিক বিশ্বস্ততার সুর, যা আমাকে বারবার মনে করায়—কী আন্তরিক বিশ্বাস আর ভরসা খুঁজে পেয়েছিলাম সেই কিশোরের সরল দৃষ্টিতে, সহজ ব্যবহারে, সাদাসিধে আলাপচারিতায়। আর আমার কাছে প্রথম প্রেমের সেই মধুময় সময়টুকু তাই শুদ্ধ সারং। অন্য কথায় শুদ্ধ সারং রাগ আমার কাছে প্রথম প্রেমের পূর্বরাগের সুর আর তাই এই রাগের সুরে সওয়ার হয়ে বারবার আমি ফিরে যাই সেই সময়ে, সেই অনুভবে, মন রঙিন হয় এখনো ঠিক তেমনভাবেই।
এই যে মন রঙিন হওয়ার কথা বললাম, সত্যিই কি ভালোবাসার কোনো রং আছে? কিংবা এই যে আমরা হরহামেশাই বলি অনুরাগের রং—সে আসলে কোন রং? কেমন তার আভা? আমার কাছে অনুরাগের রং আর তিলক কামোদের সুর সমার্থক সত্যিকার অর্থেই। কারণ, তিলক কামোদের অসম্ভব মিষ্টি মধুর সুরের আবেশে এক অদ্ভুত প্রেমাবিষ্টতা রয়েছে, যার রেশ মনের বনে ফুল ফোটায়—অনুরাগের ফুল আর তার রংও বাহারি, মনোহরি। গান্ধারবর্জিত আরোহণে ঋষভ আর পঞ্চমের প্রাণস্পর্শী স্বরসংগতি ‘সৃজন ছন্দে আনন্দে’ এক প্রেমময় দোলাচল তৈরি করে হৃদয়ে, আর সেটাই আমার কাছে অনুরাগের ছোঁয়া। তিলক কামোদের ‘পা-নি-সা-রে-গা-সা-রে-পা-মা-গা-সা-রে-গা-সা’ স্বরবিন্যাস উজ্জ্বল, আনন্দময় এবং প্রেমময় আবেগে উদ্ভাসিত এক ছোটগল্প, যার প্রতি পরতে আমি খুঁজে পাই প্রিয় মানুষের আলোমাখা হাসিমুখ, প্রেমকাতর দৃষ্টি আর আলতো হাতের ছোঁয়া—নিষ্কলুষ, অমলিন। এই রাগের সব শুদ্ধ স্বরে কোনো কালিমা নেই, নেই কোনো বিচ্ছেদ বা বেদনার সুর। অবরোহে কদাচিৎ কোমল নিষাদের ব্যবহার যেন ঠিক প্রথমবারে হাতে হাত রাখার সেই অভূতপূর্ব অনুভবের মতোই অমূল্য, অনুপম।
শুদ্ধ কল্যাণের মতোই এই রাগের সুরের চলনে আর স্বরের বিন্যাসেও খোঁজ মেলে শৃঙ্গার রসের। এই রাগের চলনে এক উচ্ছলতা আছে, আছে আহ্লাদ, আছে উচ্ছ্বাস, আছে হরষিত এক রসময়তা—এসবই বারবার করে ‘পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল’। আরোহণে গান্ধার আর ধৈবত বাদ দিয়ে পঞ্চসুর আর অবরোহে সপ্তসুরের বক্রচলন কী অনায়াস জাদুমন্ত্রে যেন ‘হঠাৎ–আলোর ঝল্কানি লেগে/ ঝলমল করে চিত্ত’। রাত্রি দ্বিপ্রহরের (রাত ৯টা থেকে দুপুর ১২টা) রাগ এই তিলক কামোদ বাদীস্বর ষড়জ থেকে সমবাদী পঞ্চম হয়ে ধৈবত–মধ্যম–গান্ধারের বিন্যাস যেন ঠিক আমাদের প্রেমের গল্প, যেখানে ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,/ আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী’। এই রাগের সুরে আছে গভীর বিশ্বাস, আছে অপার আশা আর আনন্দময় স্বপ্নের আশ্বাস। ঠিক যেমন করে সেই কাঁচা বয়সে ‘নাই আমাদের সঞ্চিত ধনরত্ন,/ নাই রে ঘরের লালনললিত যত্ন’ জেনে নিয়ে, মেনে নিয়ে প্রিয় সেই মানুষের হাত ধরে, তার কাঁধে মাথা রেখে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলাম—‘তুমি আছো, আমি আছি’। তিলোক কামোদের সুরের মতোই সেই বোধ, সেই বিশ্বাস আজও অমলিন আছে, অক্ষয় আছে, আর তাই তিলক কামোদের সুর আমার কাছে অনুরাগের সুর, গভীর প্রেমের সুর, বিশ্বাসে ভর করে স্বপ্ন দেখার সুর।
জীবনে ‘প্রেম এসেছিল নিঃশব্দচরণে’ সত্য, কিন্তু ভাগ্যের জোরে তা ‘রক্তিম মরীচিকা’র মতো অধরা থাকেনি—এ আরও বড় সত্য। তবে সেই প্রেমে প্রীতি, অনুরাগ, অভিসার যেমন জীবনভর ফিরে ফিরে এসেছে, তেমনি বারবার এসেছে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, প্রতীক্ষার যাতনা, অদর্শনের বেদনা। প্রেম এলে বিরহ অবশ্যম্ভাবী। জীবনের যাত্রাপথে কখনো পড়াশোনার প্রয়োজনে, কখনো–বা পেশাগত আবশ্যকতায় ভৌগোলিক দূরত্ব এসেছে লম্বা সময়ের জন্য, তাই বিরহদহনে দগ্ধ হয়েছি—এও কঠিন সত্য। কিন্তু সুরকে ভর করে বারবার ‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,/ সে কখনো করে না বঞ্চনা’। তাই বিরহও আমাদের প্রেমকে বরং আরও শুদ্ধই করেছে, প্রবলতর করেছে—সেই কিশোরবেলা থেকে এই পরিণত মধ্যবয়সেও ‘পুরাতন নাহি হয় প্রেম-প্রীতি’ আর ‘মিলনে নাহি যেন রহে অবসাদ’—তাও কম পাওয়া নয়! ‘রবে অভিমান রহিবে না বিরহ’ অধীর প্রত্যাশায়, ‘ফিরে যেন আসে প্রিয়া মাগিয়া বিদায়’ গভীর অভিলাষে পরিপূর্ণ আমার জীবনের বিরহগাথার পরতে পরতে বাগেশ্রী সুর। সেই সুরে ‘কেঁদেছে আকাশে চাঁদের ঘরণী’ আর ‘চির-বিরহিণী রোহিণী’ আমার সজল অশ্রু মিশে আছে; ‘ছুটে তরঙ্গ বাসনা-ভঙ্গ সে অঙ্গ পরশিতে’ হৃদয়ের গভীর ব্যাকুলতা জড়িয়ে আছে, একাকার হয়ে আছে ‘চকোর উতলা চাঁদের লাগিয়া’র মতো কাতর প্রতীক্ষা; ‘চাঁদ হেরিছে চাঁদ-মুখ তার’ দেখার জন্য মিলনের অধীর আকাঙ্ক্ষা।
রাত্রি দ্বিপ্রহরের নিস্তব্ধতার মধ্যে বাগেশ্রীর কোমলগান্ধার আর নিষাদ যেন নীরব অশ্রুজলের একান্ত অনুষঙ্গ আমার। মনে হয়, আমি একা নই, আমার সঙ্গে বাগেশ্রীর সুরে ‘কাঁহা পিউ কাঁহা ডাকিছে পাপিয়া, কুমুদীরে কাঁদাইতে’। বাদীস্বর শুদ্ধ মধ্যম আর সমবাদী ষড়জের মিত্রতায় কোমল নিষাদ–ষড়জ–মধ্যম, ষড়জ–কোমলগান্ধার–মধ্যম, কোমলগান্ধার–ঋষভ–ষড়জ—এই স্বরবন্ধে আমি যে কত শতসহস্রবার ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে কুড়াই ঝরা ফুল একেলা’। কাফি ঠাটের এই রাগেও শৃঙ্গার রসের প্রকাশ ঘটে। সেই শৃঙ্গারে বিরহের বেদনা হতাশার নয়, এতে মিশে আছে ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা আর পুনর্মিলনের অভীপ্সা। বাগেশ্রীর স্বরবিন্যাসে, সুরের চলনে তাই প্রেমের যে বেদনাময়তা ভালোবাসার যে অপূর্ণতা, তা কখনো আশা হারায় না, তা সতত মিলনপিয়াসী, স্বপ্নবিলাসী। আরোহণে ঋষভ আর পঞ্চমকে না পেলেও অবরোহণে সপ্তসুরের আবহে এই সুর পরম বিরহে, না পাওয়ার বেদনাবিধুরতাতেও এক গভীর ভরসায় চিরন্তন প্রেমের ব্যাকুল প্রতীক্ষায় নিমগ্ন হয়ে আশাপথ রচনা করতে শেখায় আমাকে। আর তাই বাগেশ্রী সুরেই আমার বিরহের দহন, বিচ্ছেদের বেদনা গেয়ে উঠেছে বারবার—‘জনম জনম গেল আশা-পথ চাহি,/ মরু-মুসাফির চলি, পার নাহি নাহি।/ বরষ পরে বরষ আসে যায় ফিরে,/ পিপাসা মিটায়ে চলি নয়নের নীড়ে।/ জ্বালিয়া আলেয়া-শিখা, নিরাশার মরীচিকা/ ডাকে মরু-কাননিকা শত গীত গাহি।’
সত্যিই ‘বরষ পরে বরষ আসে যায় ফিরে’ আর এভাবেই সময়ের ফোঁড়ে গাঁথা হয় জীবনের গল্প। সেই গল্প দুজনের একসঙ্গে পথ চলার। এতে প্রাপ্তি আছে, অপ্রাপ্তিও আছে; অভিযোগ–অনুযোগও আছে, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি করে আছে একে অপরকে জড়িয়ে বাঁচার, ভরিয়ে রাখার সাতকাহন। অনুরাগ–অভিমান–অভিসার–বিরহ এসব মিলিয়েই বয়ে চলে যে যাপিত জীবন, যার পোশাকি নাম দাম্পত্য, আমার সেই দাম্পত্যের প্রতিদিনের সুরের জোগানদার রাগ মালকোষ। আমার কাছে এই রাগ যেন এক নিভৃত, গভীর, অথচ দুর্বোধ্য এক শক্তির আধার। জীবনে যেমন সব পাওয়া হয়ে ওঠে না, ওই খানিক অপ্রাপ্তি বরং জীবনকে, এর প্রতিদিনকার যাপনকে আরও ঋদ্ধ করে, শুদ্ধ করে। ঠিক তেমনি ঋষভ আর পঞ্চম বর্জিত পঞ্চস্বরের এই মালকোষ আমাকে প্রতিনিয়ত মনে করায় দুই স্বরের অনুপস্থিতিতে বাকি পঞ্চস্বর দুর্বল হয় না কখনো, তাদের ঔজ্জ্বল্য মোটেও ম্লান হয় না, বরং এই পঞ্চস্বরে লুকিয়ে থাকা অনন্ত স্পন্দনকে খুঁজে নিতে পারলে মালকোষের পূর্ণ প্রকাশ গভীরতর, উজ্জ্বলতর হয়। এই না-থাকাটুকু কোনোভাবেই খামতি নয়, এতে থাকতে নেই আফসোস, বরং এতে যা আছে, তা যেন আরও অপূর্বময়তায় পরিস্ফুট হয়। ঠিক সেই কারণেই এই মালকোষ আমার প্রেরণার উৎস, আমাকে প্রাণিত করে সতত। আর এই সুরময় প্রেরণাতেই, এর থেকে পাওয়া শক্তিতেই আমি হয়তো জীবনের মাঝেও কখনো অপ্রাপ্তিকে বঞ্চনা না ভেবে ‘যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই’কে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে, ভেবে নিয়ে, জেনে নিয়ে ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’ দিয়ে এই জীবনের দাম্পত্যের গল্প, একসঙ্গে পথ চলার মন্ত্র মালকোষের সুরে সাজিয়েছি। আর সে কারণেই হয়তো প্রতিদিন ভাবতে পারি—‘এই জ্যোতিঃসমুদ্র-মাঝে/ যে শতদল পদ্ম রাজে/ তারই মধু পান করেছি/ ধন্য আমি তাই’।
সংসারজীবন নিস্তরঙ্গ নয়, এর পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর টানাপোড়েনেই সোনা পুড়ে খাঁটি হওয়ার মতো ভালোবাসাও পরিশীলিত হয়, দৃঢ় হয়, হয় পোক্ত। ঠিক যেমন করে ভৈরবী ঠাটে বাঁধা কিন্তু মধ্যরাত পেরিয়ে রাত্রি তৃতীয় প্রহরের (রাত ১২টা থেকে ৩টা) রাগ এই মালকোষের স্বরে আর সুরে এক অভূতপূর্ব এক টানাপোড়েন প্রকাশ পায়। এর সুরপ্রবাহে মধুরতা ও বেদনার দ্বৈত অভিঘাত এক অনুপম পারস্পরিক প্রতিস্পর্ধার আবেশ তৈরি করে। পুরাণমতে, মালকোষ রাগ গেয়েই প্রলয়ংকর শিবকে শান্ত করে করুণাময় করেছিলেন পার্বতী। তাই এই রাগের বীররসের সঙ্গে মিশে আছে স্নিগ্ধ করুণাধারা। এই রাগ তাই একই সঙ্গে পার্বতীর কমনীয় তাপসী রূপের তেজোদীপ্ততার সঙ্গে একেবারে বিপ্রতীপ দুর্নিবার সর্ববিনাশী শিবের করুণাসিন্ধু, মঙ্গলময় রূপের সম্মিলন ঘটায়। এই রাগ তাই সত্যিকার অর্থেই আমাদের মতো এই ছাপোষা সাধারণ পার্বতী আর শিবের দাম্পত্যের সুর হয়ে ওঠে।
সংগীতগুরুরা বলেন, এই রাগের চলনে দৃঢ়তা আছে, ঋজুতা আছে, আবার এর সক্ষম গায়নে আত্মত্যাগ, সংযম, গভীর নিবেদনের প্রকাশ ঘটে। দাম্পত্যও দিনশেষে তা–ই, দৃঢ় হয়ে একে অপরের পাশে দাঁড়ানো যেমন আছে, ঠিক তেমন করেই হেরে গিয়ে, ছেড়ে দিয়ে জিতে যাওয়াও আছে। আর আমার এই প্রেমময় আত্মসমর্পণের সুরই বাঁধা হয় মালকোষ রাগে। বাদী মধ্যম আর সমবাদী ষড়জের ঋজুতাকে ঘিরে থাকা কোমলগান্ধার, কোমল ধৈবত আর কোমল নিষাদের মোলায়েম স্নিগ্ধতা কখনো কদাচ বিচ্ছিন্নতার নয়, বরং সতত সংযুক্তির কথা বলে। ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, এই রাগের শান্ত মোহনীয় রূপে এক অভূতপূর্ব বীররস আছে, যা ‘এমন শক্তি দেয় যেন পাহাড়ও সরানো যায়’। আমার কাছে আমার সংসার, আমার দাম্পত্যও ঠিক তা–ই। এ এক এমন শক্তির আধার, যা আমার সব বিঘ্নহারী, বিপত্তারণ। তাই হয়তো ‘প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে’ মালকোষের সুরে সুরে আমি যাপিত জীবনকে প্রতিদিন উদ্যাপন করে হৃদয় দিয়ে কণ্ঠ ছেড়ে গেয়ে বেড়াই—‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে,/ দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে।/ পান করি রবে শশী অঞ্জলি ভরিয়া—/ সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি—/ নিত্য পূর্ণ ধরা জীবনে কিরণে।’