ডেঙ্গুর ভয়ে কলকাতা থেকে যেভাবে পালিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের পরিবার
এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ চারপাশে, সবাই তটস্থ ডেঙ্গুর ভয়ে। আজ থেকে দেড় শ বছর আগে ডেঙ্গু জ্বরের ভয়ে ভীত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের পরিবারও। এই জ্বর থেকে বাঁচতে পরিবারসমেত কলকাতা থেকে পালিয়েছিলেন তাঁরা। কীভাবে তাঁরা পালিয়েছিলেন, সেই কাহিনিটি আবার প্রকাশিত হলো।
আজ থেকে দেড় শ বছর আগে রবীন্দ্রনাথের পরিবার ডেঙ্গুর ভয়ে তটস্থ হয়ে কলকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। কী, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে? ঘটনাটি কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সত্য।
১৮৭২ সাল। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ১২ বছর। স্কুলে বাংলা শিক্ষা শেষ করে সবে বেঙ্গল স্কুলে ভর্তি হয়েছেন। এমন সময় কলকাতায় বিভীষিকা আকারে দেখা দিল ডেঙ্গু জ্বর; ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ল পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও।
১৮৭২ সালের ৮ মে নব গোপাল সম্পাদিত পত্রিকা ‘ন্যাশনাল পেপার’-এ লেখা হলো, ডেঙ্গু রোগ কলকাতার আবালবৃদ্ধবনিতা কাউকে ছাড়ছে না। এমনকি ইউরোপিয়ানরাও আক্রান্ত হচ্ছে। দেশীয় এমন কোনো পরিবার বাকি নেই যেখানে কেউ না কেউ এ রোগের শিকার হয়নি। ‘ন্যাশনাল পেপার’-এ ডেঙ্গু নিয়ে প্রথম সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭১ সালে। ওই সংবাদে ৫০০ জনের এতে রোগে আক্রান্ত হওয়ার উল্লেখ ছিল। বাংলায় ১২৭৮ বঙ্গাব্দের (১৮৭১ সাল) আষাঢ়-শ্রাবণে এ ব্যাধির প্রকোপ বেড়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়।
তখনো ডেঙ্গু হলে এখনকার মতো জ্বর, গায়ে ব্যথা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিত। মাত্র তিন-চার দিনে রোগী এমন দুর্বল হয়ে যেত যে পরে কিছুদিন তাকে একরকম পঙ্গু জীবন যাপন করতে হতো।
তখনো ডেঙ্গু হলে এখনকার মতো জ্বর, গায়ে ব্যথা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিত। মাত্র তিন-চার দিনে রোগী এমন দুর্বল হয়ে যেত যে পরে কিছুদিন তাকে একরকম পঙ্গু জীবন যাপন করতে হতো। ডেঙ্গুর প্রভাব সে সময় কতটা ভয়াবহ ছিল তা অনুমান করা যাবে একটি তথ্যে—তখনকার জনপ্রিয় ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার কর্মচারীরা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় পত্রিকাটি কয়েক দিন হ্রস্ব-আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রপত্রিকা সূত্রে আরও জানা যায়, এই ব্যাধির প্রকোপে সে সময় বহু স্কুল-কলেজে ছাত্র-শিক্ষক উপস্থিতি কমে গিয়েছিল। ফলে একসময় প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হয়েছিল ছুটি ঘোষণা করতে।
১৮৭২-৭৩ সালের বেঙ্গল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৮৭১ ও ’৭২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে কলকাতায় নোটিশ জারি করা হয়। মারাত্মক এ রোগ শীতের শেষে শুরু হয়ে গরমে বৃদ্ধি পেত এবং গ্রীষ্ম ও বর্ষায় সেটি মহামারি আকার ধারণ করত। অবশ্য বর্ষা শেষে কমতে থাকত এর প্রকোপ।
১৮৭২ সালের (১২৭৯ বঙ্গাব্দ) গ্রীষ্মে যখন রোগটির সংক্রমণ সর্বব্যাপী হতে শুরু করে, সে সময় কলকাতার অবস্থাপন্ন পরিবারগুলো আশ্রয় নিয়েছিল শহর থেকে কিছু দূরে, গঙ্গাতীরবর্তী বাগানে। আর ডেঙ্গুর কারণেই জীবনে প্রথমবারের মতো কলকাতার বাইরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
‘জীবনস্মৃতি’তে তিনি লিখেছেন, ‘একবার কোলকাতায় ডেঙ্গুজ্বরের তাড়ায় আমাদের বৃহৎ পরিবারের কিয়দংশ পেনেটিতে (পানিহাটিতে) ছাতুবাবুদের বাগানে আশ্রয় লইল। আমি তাহার মধ্যে ছিলাম।’
ঠাকুরবাড়ির হিসাব খাতার তথ্য অনুযায়ী, ১৮৭২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত পানিহাটির বাগানবাড়িটি ভাড়া করেছিল ঠাকুর পরিবার। পরে ১ জুলাই সেখান থেকে তাঁদের নিয়ে আসার জন্য গাড়ি পাঠানো হয়েছিল বলেও খাতায় উল্লেখ রয়েছে।
এসব তথ্য বিশ্লেষণ করলে এটি বেরিয়ে আসে যে রবীন্দ্রনাথসহ ঠাকুরবাড়ির বৃহৎ পরিবারের অনেকে ডেঙ্গু থেকে আত্মরক্ষার জন্য ১৮৭২ সালের ১৪ মে মঙ্গলবার থেকে ৩০ জুন রোববার পর্যন্ত পানিহাটির বাগানবাড়িতে ছিলেন। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমলে তাঁরা জোড়াসাঁকোয় ফিরে যান। রবিঠাকুরের লেখার তথ্যমতে, এ সময় ঠাকুর পরিবারের আরেকটি অংশ ডেঙ্গু জ্বরের আশঙ্কায় রিষড়ার (গঙ্গাতীরের একটি প্রাচীন পল্লি, যেখানে ওয়ারেন হেস্টিংসের একটি বাগানবাড়ি ছিল) বাগানে আশ্রয় নিয়েছিল।
সূত্র: প্রশান্তকুমার পালের ‘রবিজীবনী’ (১ম খণ্ড)