শব্দের জাদুকর, সত্যের কারিগর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাঙালির শিল্পসংস্কৃতির বিস্তৃত প্রাঙ্গণে সৈয়দ শামসুল হক এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাম। ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামের মাটিতে যে প্রাণের স্পন্দন শুরু হয়েছিল, তা পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এক পলিমাটির সুবাস ছড়িয়ে দিয়েছে। সৈয়দ হকের সাহিত্যিক সত্তাকে বুঝতে হলে প্রথমে আমাদের তাকাতে হবে তাঁর শিকড়ের দিকে। উত্তরবঙ্গের ব্রহ্মপুত্র নদ আর তিস্তার বিশালতা তাঁর মানসপটে যে নিঃসঙ্গতা ও শক্তির বীজ বুনে দিয়েছিল, তারই ফসল তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম। তিনি যখন সাহিত্যে পদার্পণ করেন, তখন ঢাকাকেন্দ্রিক একটি আধুনিক সাহিত্যিক পরিমণ্ডল সবে গড়ে উঠছে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি কেবল নিজেকে একজন লেখক হিসেবে নয়, বরং একজন কারিগর হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।

সৈয়দ হকের কবিতার জগৎ এক অনন্য গহন অরণ্য। তাঁর ‘একদা এক রাজ্যে’ (১৯৬১) কিংবা ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ পাঠ করলে বোঝা যায়, তিনি শব্দের শরীর নিয়ে কতটা নিপুণভাবে খেলতে জানতেন। তাঁর কবিতায় নাগরিক মনস্তত্ত্ব আর গ্রাম্য লোকজ ঐতিহ্যের এক অদ্ভুত মিলন ঘটেছে। তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন, ‘কবিতা হলো আমার কাছে নিশ্বাসের মতো স্বাভাবিক, আর গদ্য হলো আমার পরিশ্রমের ফসল।’ তাঁর কবিতার প্রধান উপজীব্য ছিল মানুষের নিঃসঙ্গতা এবং অস্তিত্বের সংকট। তিনি আধুনিক কবিতার সেই ধারাকে ধারণ করেছিলেন, যেখানে ব্যক্তিমানুষের হাহাকার সামষ্টিক যন্ত্রণার সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। ‘প্রতিধ্বনিগণ’ কিংবা ‘পরানের গহীন ভিতর’ কাব্যগ্রন্থে তিনি যেভাবে আঞ্চলিক শব্দভান্ডারকে আধুনিক কবিতার কাঠামোয় স্থাপন করেছেন, তা বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ঘটনা। বিশেষ করে ‘পরানের গহীন ভিতর’ গ্রন্থে তিনি কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় যে সনেটগুলো রচনা করেছেন, তা প্রমাণ করে যে ভাষার শুদ্ধতা কেবল প্রমিত রূপের ওপর নির্ভর করে না, বরং আবেগের সততার ওপর নির্ভর করে।

সৈয়দ শামসুল হক যখন সাহিত্যে পদার্পণ করেন, তখন ঢাকাকেন্দ্রিক একটি আধুনিক সাহিত্যিক পরিমণ্ডল সবে গড়ে উঠছে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি কেবল নিজেকে একজন লেখক হিসেবে নয়, বরং একজন কারিগর হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।

কবিতার আঙিনা পেরিয়ে যখন তিনি উপন্যাসের বিশাল ক্যানভাসে পা রাখেন, তখন সেখানেও তিনি প্রথাগত ধারার বাইরে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। তাঁর ‘দেয়ালের দেশ’ (১৯৫৯) থেকে শুরু করে ‘খেলারাম খেলে যা’ (১৯৭৩) পর্যন্ত প্রতিটি বাঁকে তিনি মানুষের অবদমিত কাম, লালসা ও অস্তিত্বের সংকটকে নিপুণভাবে ব্যবচ্ছেদ করেছেন। ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসটি প্রকাশের পর তৎকালীন সমাজে প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি হলেও আজ তা বিশ্বসাহিত্যের নিরিখে একটি গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বাবর আলীর মাধ্যমে তিনি আধুনিক মানুষের ভেতরের এক শূন্যতাকে উন্মোচন করেছেন, যে শূন্যতা গ্রাস করে নিতে চায় চারপাশের সবকিছুকে। তাঁর গদ্যের এই শৈলী সম্পর্কে প্রখ্যাত সমালোচক ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, সৈয়দ হকের গদ্য যেন ধারালো ছুরির মতো, যা এক আঘাতেই সত্যের গভীরে পৌঁছে যায়। তিনি ভাষাকে মেদহীন করেছেন এবং প্রতিটি বাক্যের ভেতর একধরনের অন্তর্নিহিত গতিশীলতা সৃষ্টি করেছেন।

সৈয়দ হকের ছোটগল্পের বিষয়বৈচিত্র্যও বিস্ময়কর। ‘তাস’, ‘শীতলক্ষ্যা’ কিংবা ‘রক্তগোলাপ’—প্রতিটি গল্পেই তিনি মধ্যবিত্ত সমাজের ভণ্ডামি আর নিম্নবিত্তের জীবনসংগ্রামকে জীবন্ত করে তুলেছেন। তাঁর লেখায় কেবল গল্প বলা উদ্দেশ্য ছিল না, বরং গল্পের আড়ালে সময়ের যে ক্রূর হাসি থাকে, তাকেও তিনি ফ্রেমবন্দী করেছেন। তাঁর সাহিত্যে কুড়িগ্রামের সেই আঞ্চলিক পটভূমি বারবার ফিরে এসেছে, যা তাঁর রচনাকে একধরনের মাটির ঘ্রাণে সিক্ত রেখেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন, বিশ্বজনীন হতে হলে নিজের শিকড়কে অস্বীকার করতে হয় না, বরং শিকড়ের গভীরে গিয়েই আকাশের বিশালতাকে স্পর্শ করা যায়। এই প্রথম পর্বে আমরা তাঁর সেই প্রাথমিক সৃজনশীলতা আর আধুনিকতার ভিত্তিপ্রস্তরকে উপলব্ধি করি, যা পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে এক বিশাল ইমারত হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

প্রতিটি গল্পেই তিনি মধ্যবিত্ত সমাজের ভণ্ডামি আর নিম্নবিত্তের জীবনসংগ্রামকে জীবন্ত করে তুলেছেন। তাঁর লেখায় কেবল গল্প বলা উদ্দেশ্য ছিল না, বরং গল্পের আড়ালে সময়ের যে ক্রূর হাসি থাকে, তাকেও তিনি ফ্রেমবন্দী করেছেন।

সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যের দ্বিতীয় ও সম্ভবত সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশটি হলো তাঁর নাটক এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনা। বাংলা নাটকের ইতিহাসে তিনি একাই একটি প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে কাব্যনাট্যের যে ধারাকে তিনি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন, তা রবীন্দ্রনাথের পর আর কেউ এত সার্থকভাবে করতে পারেননি। তাঁর ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ (১৯৭৬) নাটকটি বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। যুদ্ধের শেষ লগ্নে একটি গ্রামের মানুষের মনের দ্বিধা, ভয় এবং অবশেষে মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে তিনি যেভাবে কাব্যিক সংলাপে বেঁধেছেন, তা আজও দর্শককে শিহরিত করে। এই নাটকের বিখ্যাত সংলাপ—‘মানুষ তো সত্যই চায়, কিন্তু সত্য কজন পায়?’ মানুষের চিরকালীন সত্য অনুসন্ধানের আকুতিকে তুলে ধরে।

ইতিহাসের ধূলিমলিন পাতা থেকে নায়ককে খুঁজে বের করে সমকালের আয়নায় দাঁড় করানোয় সৈয়দ হক ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ (১৯৮২) নাটকটি এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ১৭৮৩ সালের রংপুর অঞ্চলের কৃষক বিদ্রোহের নায়ক নূরলদীনকে তিনি যে তেজস্বী ভাষায় মঞ্চে ফিরিয়ে এনেছিলেন, তা তৎকালীন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এক নতুন শক্তির জোগান দিয়েছিল। নূরলদীনের সেই কালজয়ী ডাক—‘জাগো বাহে কুনঠে সবায়’ এখন কেবল একটি সংলাপ নয়, বরং নিপীড়িত মানুষের জেগে ওঠার এক শাশ্বত মন্ত্র। এই নাটকে তিনি ইতিহাসকে বর্তমানের সঙ্গে এমনভাবে গেঁথেছেন যে দর্শক বা পাঠকের মনে হয় এই নূরলদীন আসলে আমাদেরই ভেতরের এক ঘুমন্ত চেতনা। বিশিষ্ট নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুন তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, সৈয়দ হক নাটকে যে ছন্দ ও যতি ব্যবহার করেন, তা অভিনেতাদের জন্য যেমন চ্যালেঞ্জের, তেমনি সার্থকভাবে করতে পারলে তা শিল্পের এক শিখর স্পর্শ করে।

সৈয়দ হকের সাহিত্যের দ্বিতীয় ও সম্ভবত সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশটি হলো তাঁর নাটক এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনা। বিশেষ করে কাব্যনাট্যের যে ধারাকে তিনি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন, তা রবীন্দ্রনাথের পর আর কেউ এত সার্থকভাবে করতে পারেননি।

মুক্তিযুদ্ধ সৈয়দ হকের চেতনার মূলে সব সময় কাজ করেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ১৯৭১ সাল বাঙালির জীবনের একমাত্র মহাকাব্য। তাঁর ‘নিষিদ্ধ লোবান’ (১৯৮১) উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধকালীন এক কিশোরী ও তার চারপাশের বিভীষিকার এক অসামান্য আখ্যান। যুদ্ধের ভয়াবহতা ও মানুষের পৈশাচিক রূপ যেমন এখানে আছে, তেমনি আছে রক্তের সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক সম্পর্কের জয়গান। এই উপন্যাসের বিলকিস চরিত্রটি আমাদের সাহিত্যের এক অমর নারী চরিত্র, যে পরিস্থিতির চাপে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার চেয়ে বড় সত্যকে বেছে নেয়। এ ছাড়া তাঁর ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ উপন্যাসেও আমরা দেখি মুক্তিযুদ্ধের এক বিশাল ক্যানভাস, যেখানে সমাজ ও রাজনীতির নানা সমীকরণ এক সুতোয় বাঁধা পড়েছে।

সৈয়দ হকের সাহিত্যের একটি বড় উপজীব্য হলো রাজনীতি। তবে তাঁর রাজনীতি কোনো বিশেষ দলের নয়, বরং তা ছিল মানবতার এবং অধিকার আদায়ের। তিনি যখন ছোটগল্পে বা উপন্যাসে রাজনীতির ছোঁয়া দেন, তখন তা কেবল তাত্ত্বিক তর্কে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা রক্ত-মাংসের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। তাঁর সাহিত্যের প্রধান চরিত্রগুলো, যেমন নূরলদীন, বিলকিস কিংবা বাবর আলী—প্রত্যেকে কোনো না কোনোভাবে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অথবা নিজের ভেতরের এক অমোঘ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। এই নিরন্তর লড়াই সৈয়দ হকের সাহিত্যকে এক অনন্য উচ্চতা দিয়েছে। তিনি মনে করতেন, লেখকের দায়বদ্ধতা কেবল শিল্পের কাছে নয়, বরং ইতিহাসের কাছেও। আর সেই দায় থেকেই তিনি একের পর এক সৃষ্টি করেছেন এমন সব সাহিত্যকর্ম, যা আমাদের জাতীয় পরিচয়ের দলিল হয়ে আছে। তাঁর রচনার এই ব্যাপ্তি ও গভীরতা তাঁকে সমসাময়িক অন্য লেখকদের চেয়ে আলাদা করে চেনার সুযোগ করে দেয়। তিনি কেবল বর্তমানের কথা লেখেননি, তিনি বর্তমানের ভেতর দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তর্জনী নির্দেশ করেছেন।

সৈয়দ হকের সাহিত্যের একটি বড় উপজীব্য হলো রাজনীতি। তিনি যখন ছোটগল্পে বা উপন্যাসে রাজনীতির ছোঁয়া দেন, তখন তা কেবল তাত্ত্বিক তর্কে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা রক্ত-মাংসের মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে ওঠে।

সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যের শেষ পর্বে আমরা যখন তাঁর বহুমুখী প্রতিভার দিকে তাকাই, তখন বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। তিনি কেবল বড়দের জন্য লেখেননি, তাঁর কিশোর সাহিত্যও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ‘হাতেম তাই’ বা ‘সীমানা ছাড়িয়ে’র মতো রচনায় তিনি কিশোর মনস্তত্ত্বকে দারুণভাবে স্পর্শ করেছেন। আবার চলচ্চিত্রের জন্য তিনি যখন গান লিখেছেন, তখন তা আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলেই ঠুস’—এই একটি গানের চরণের মাধ্যমেই তিনি জীবনের নশ্বরতাকে যেভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তা কোনো দার্শনিক প্রবন্ধের চেয়ে কম নয়। তিনি সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন বলেই তাঁকে ‘সব্যসাচী’ বলা হয়।

বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হকের অবদান মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রখ্যাত সমালোচক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছিলেন, সৈয়দ হক এমন এক লেখক, যিনি ভাষাকে বশ করতে জানতেন। তাঁর লেখা যেমন সুশীল ও মার্জিত ছিল, তেমনি প্রয়োজনে তা হয়ে উঠত তীব্র ধারালো। তাঁর প্রাপ্তি ও স্বীকৃতির তালিকাও অনেক দীর্ঘ। ১৯৬৪ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন, যা আজ অবধি একটি রেকর্ড। এ ছাড়া একুশে পদক (১৯৮৪) ও স্বাধীনতা পদক (২০০০) তাঁর কাজের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। কিন্তু পুরস্কারের চেয়ে বড় কথা হলো, তিনি সাধারণ পাঠকের মনে যে স্থান করে নিয়েছেন। বিশেষ করে তরুণ লেখকদের কাছে তিনি ছিলেন এক অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর ‘হৃৎকলমের টানে’ কলামটি কয়েক প্রজন্ম ধরে সৃজনশীল লেখকদের লেখার কৌশল ও শৈলী শিখিয়েছে।

তাঁর প্রাপ্তি ও স্বীকৃতির তালিকাও অনেক দীর্ঘ। ১৯৬৪ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন, যা আজ অবধি একটি রেকর্ড। এ ছাড়া একুশে পদক (১৯৮৪) ও স্বাধীনতা পদক (২০০০) তাঁর কাজের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫—২০১৬)
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

বর্তমান সময়ে সৈয়দ শামসুল হকের প্রাসঙ্গিকতা আরও বেড়েছে। আমরা যখন একটি অস্থির ও পরিচয়–সংকটের সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তখন তাঁর লেখা আমাদের স্থিতধী হতে সাহায্য করে। তাঁর ‘পরানের গহীন ভিতর’-এর কবিতাগুলো বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশনের যুগেও নিজের আঞ্চলিকতাকে বিশ্বমানের শিল্পরূপান্তরের পথ খুলে দেয়। তাঁর ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ আজ যখন আমরা পড়ি বা দেখি, তখন তা আমাদের চারপাশের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করে। সাহিত্যে তিনি যে চরিত্রগুলো সৃষ্টি করেছেন, তারা কেবল কাল্পনিক সত্তা নয়, বরং তারা আমাদের সমাজেরই বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি।

সৈয়দ হক বলতেন, ‘আমি তো আমার সময়কে লিখে যেতে চাই, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বুঝতে পারে আমরা কেমন ছিলাম।’ তাঁর সেই উদ্দেশ্য সার্থক হয়েছে। তাঁর উপন্যাস ‘দূরত্ব’, ‘শীতলক্ষ্যা’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’ কিংবা কাব্যনাট্য ‘ঈর্ষা’—সবই আমাদের জাতিসত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর রচনার শিল্পশৈলী ছিল অত্যন্ত আধুনিক, যেখানে তিনি পশ্চিমা আঙ্গিকের সঙ্গে দেশীয় উপাদানের এক চমৎকার মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন।

সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যের সেই মহিরুহ, যাঁর ছায়ায় বসে আগামীর সাহিত্যিকেরা শিল্পের পাঠ গ্রহণ করবেন। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন কীভাবে একই সঙ্গে মাটির মানুষ ও বিশ্বের নাগরিক হওয়া যায়। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা হয়তো কোনো দিন পূরণ হবে না, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া সাহিত্যসম্ভার আমাদের পথ দেখাবে অনন্তকাল। তিনি ছিলেন শব্দের জাদুকর, সময়ের সাক্ষী এবং সত্যের কারিগর।