নিউইয়র্ক বইমেলায় যেসব মজার ঘটনা ঘটেছিল
মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের আয়োজনে নিউইয়র্কে ৩২ বছর ধরে বইমেলা হচ্ছে। সেই মেলায় নিয়মিত অংশ নিতেন সাহিত্যিক অনিসুল হক। কিন্তু কাজ থেকে ছুটি না মেলায় এবারে মেলার ৩২তম আসরে অংশ নিতে পারেননি তিনি। মুক্তধারার বইমেলা ঘিরে অতীতের নানা স্মৃতি লেখককে নস্টালজিক করেছে। সেই সব মিষ্টি স্মৃতি পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেছেন তিনি।
নিউইয়র্কে বইমেলা হচ্ছে। মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজন করছে। লেখক-প্রকাশকেরা নিউইয়র্কে পৌঁছে গেছেন অনেকেই। তাঁদের ছবি দেখছি ফেসবুকে। অনন্যা প্রকাশনীর মনিরুল হক, বাতিঘরের জাফর আহমেদ রাশেদ আমেরিকায় কী কী করছেন, সেসব ছবি দেখে মনটা আনচান করে উঠছে। এ সময়ে আমার তো নিউইয়র্কে থাকার কথা।
মুক্তধারার বইমেলা ঘিরে আমার কত স্মৃতি। একবার তো, ২০০৬ সালে, মানে ১৭ বছর আগে, এই বইমেলা উদ্বোধনের জন্য আয়োজকেরা আমাকেও ডেকেছিলেন। কী বিশাল সম্মান। আমি আমার গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই সে জন্য উদ্যোক্তাদের। সে বছর আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন সমরেশ মজুমদার। তাঁর সঙ্গে আমার সেবারই পরিচয় হলো।
সাংবাদিক-বন্ধু মঞ্জুরুল ইসলাম আর নাসিমা খানের বাড়িতে রাতের বেলা এক চমৎকার আড্ডা জমেছিল। এর পর থেকে সমরেশ মজুমদার ঢাকা এলে আমাকে ফোন করতেন, ‘আমি এসেছি। কোথায় দেখা করা যায়!’ সমরেশ মজুমদার প্রয়াত হলেন!
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ নিজে যখন ছাত্র ছিলেন, তখন একদিন তাঁদের ক্লাসে একজন শিক্ষক এলেন ক্লাস নিতে। স্যারকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তিনি ভীষণ কাহিল। গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। দাঁড়াতেও পারছেন না। ছাত্ররা বলল, স্যার, আপনি বসে বক্তৃতা করুন। স্যার বললেন, না, তা হয় না। কারণ, আমি যখন ক্লাসরুমে ঢুকেছিলাম, তখন তোমরা দাঁড়িয়ে আমাকে সম্মান দেখিয়েছ। এখন আমার কর্তব্য হলো, সেই সম্মান তোমাদের ফিরিয়ে দেওয়া।
সেভাবে ভাবলে দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হতে থাকে! আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে মুক্তধারার বইমেলা উপলক্ষে কত দিন একসঙ্গে ট্যুর করেছি। বিমানে একসঙ্গে ভ্রমণ করেছি। আনিসুজ্জামান স্যারের হাতের ব্যাগটা শত টানাটানি করেও নিজের হাতে নিতে পারিনি।
কত গল্প স্যার আমাদের শোনাতেন আড্ডার ছলে! আমরা, এমনকি মঞ্জুরুল ইসলামের গাড়িতে আটলান্টিক সিটিতে পর্যন্ত গেছি। ক্যাসিনো ঘুরে দেখেছি রাতের বেলা। সঙ্গে ছিলেন মাহমুদুজ্জামান বাবু, কবি তারিক সুজাত। প্রকাশক ফরিদ আহমেদ, মনিরুল ইসলাম—আমরা তো আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস, ডালাসে বইমেলা করতে বেড়িয়েছি, সঙ্গে ছিলেন ফেরদৌস ওয়াহিদ আর হাবিব। আমরা এমনকি টরন্টোতে গেছি, নায়াগ্রা জলপ্রপাতে গেছি একসঙ্গে।
সেই নক্ষত্রপ্রতিম মানুষগুলো, যাঁরা নিউইয়র্কের বইমেলা উদ্বোধন করেছেন, তাঁদের অনেকেই আজ নক্ষত্রলোকে! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ, হাসান আজিজুল হক, হুমায়ূন আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, রাবেয়া খাতুন, এ টি এম শামসুজ্জামান খান উদ্বোধন করেছেন বইমেলা। তাঁদের আমরা কোথায় পাব আর!
নিউইয়র্কের বইমেলায় নির্মলেন্দু গুণের কণ্ঠে শুনেছি তাঁর ‘হুলিয়া’ কবিতার পুরোটা। এ টি এম শামসুজ্জামান খান স্যারের সঙ্গে আড্ডায় মেতেছি। রামেন্দু মজুমদার কিংবা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সঙ্গে নৌভ্রমণে গেছি। কুইন্স লাইব্রেরিতে আমার আলোচনা অনুষ্ঠানে শ্রোতার আসনে দয়া করে হাজির ছিলেন গোলাম মুরশিদ।
তারিক সুজাত আর আমি মঞ্চে অনর্গল কবিতা পড়েছি। রাবেয়া খালাম্মার সঙ্গে এক টেবিলে বসে দুপুরের খাবার খেয়েছি। গাড়িতে করে নিউজার্সিতে যাওয়ার পথে গাড়ি গেল নষ্ট হয়ে, আমাদের পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলেন কে? নবনীতা দেবসেন! এ রকম সুযোগ আর কি জীবনে আসবে?
এ লেখায় আমার নিজের পুরোনো লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিই! ‘গল্পগুলো নিউইয়র্ক বইমেলায় শোনা’ নামের একটা লেখা লিখেছিলাম ২০১৮ সালে। সেখান থেকে তুলে ধরি—
১.
‘আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কখনো বসে বক্তৃতা করেন না। তাঁর শরীর যতই অসুস্থ থাকুক না কেন।
কেন করেন না?
সেই গল্পও জানা গেল নিউইয়র্কে বসে। ওখানে অনুষ্ঠিত হলো বইমেলা। তাতে ঢাকা থেকে প্রকাশকেরা যোগ দিয়েছেন, লেখক-শিল্পীরা গেছেন, উত্তর আমেরিকা তো বটেই, জার্মানি থেকে পর্যন্ত গেছেন বাংলা ভাষার লেখকেরা। নিউইয়র্কে ৩২ বছর ধরে হয়ে আসছে এই বাংলা বইমেলা। এর আয়োজক মুক্তধারা নিউইয়র্ক। এতে একটা পর্বে বক্তা ছিলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আমি স্যারের সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইলাম, কেমন আছেন?
স্যার বললেন, নাহ। বেশ খারাপ।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ নিজে যখন ছাত্র ছিলেন, তখন একদিন তাঁদের ক্লাসে একজন শিক্ষক এলেন ক্লাস নিতে। স্যারকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তিনি ভীষণ কাহিল। গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। দাঁড়াতেও পারছেন না।
ছাত্ররা বলল, স্যার, আপনি বসে বক্তৃতা করুন।
স্যার বললেন, না, তা হয় না।
কারণ, আমি যখন ক্লাসরুমে ঢুকেছিলাম, তখন তোমরা দাঁড়িয়ে আমাকে সম্মান দেখিয়েছ। এখন আমার কর্তব্য হলো, সেই সম্মান তোমাদের ফিরিয়ে দেওয়া। কাজেই আমি যতক্ষণ ক্লাস নেব, ততক্ষণ আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদও নিউইয়র্কের বইমেলার মঞ্চে অসুস্থ শরীর নিয়েও দাঁড়িয়ে কথা বললেন।
আর অধ্যাপক সায়ীদ যখন কথা বলেন, তখন শুধু তাঁর নিজের অসুস্থতাই যে উড়ে পালিয়ে যায়, তা নয়, তাঁর শ্রোতারাও সজীব-সতেজ হয়ে পড়েন।
তা-ই হলো।
২.
নিউইয়র্কের বইমেলায় গিয়েছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। বইমেলা উদ্বোধন করেছেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। উদ্বোধনের পরের বক্তৃতায় শামসুজ্জামান খান জানালেন, বইমেলা ঢাকায় প্রথম শুরু করেন সরদার জয়েন উদ্দীন।
তাঁর কাছে বিদেশি বইমেলার চিঠি এসেছিল। তিনি তখন ভাবলেন, বাহ, এ তো ভীষণ আশ্চর্য এক মেলা, কত কিছুর মেলার কথা শুনেছি, বারুণীর মেলা, রথের মেলা, হাঁড়িকুঁড়ির মেলা, তরমুজের মেলা—বইয়েরও মেলা হয়! তিনি নারায়ণগঞ্জে বইমেলার আয়োজন করেন। সেখানে একটা গরু বাঁধা ছিল। তার গায়ে লেখা ছিল—‘আমি বই পড়ি না’।
৩.
আনোয়ারা সৈয়দ হকও গিয়েছিলেন মেলায়। তিনি যেমন কবি ও কথাসাহিত্যিক, তেমনি তিনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। একটা ঘরোয়া সেমিনারে তিনি বললেন, লেখালেখি একধরনের মানসিক ব্যাধি! ওসিডি—অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার। এ ধরনের রোগীরা একটা জিনিস নিয়ে বারবার করে বলতে থাকে, একই জিনিস বারবার করতে থাকে।
কারও হয়তো মনে হয়, বাসা থেকে বেরিয়েছি, ঘরে তালা দেওয়া হয়নি। তিনি বারবার করে ফিরে আসেন। দেখেন, তালা দেওয়া হয়েছে তো। কেউবা শুধু হাত ধোয়। বারবার করে হাত ধোয়। তারপরও মনে হয়, হাতে ময়লা লেগেই আছে। তো যার এ রোগ আছে, সে হয়তো একবার হাত ধুলো, দুবার হাত ধুলো, পাঁচবারের পর মনে হলো, এবার পরিষ্কার হয়েছে। সে শান্ত হলো। শান্তি পেল। কিন্তু কতক্ষণ আর। একটু পর সে আবার হাত ধুতে শুরু করল।
লেখকেরাও এ রকম। একটা লেখা লিখে মনে হবে, হয়নি। আবার লিখতে হবে। আবারও লিখল। তারপর মনে হলো, না, হয়নি। আবার লিখল। একবার মনে হলো, হ্যাঁ, হয়েছে। খানিকক্ষণ শান্তি। কিন্তু সে–ও ক্ষণিকের। আবারও লিখতে শুরু করল।
৪.
নিউইয়র্কের কবি আবু রায়হান আমার বন্ধুমানুষ। গাড়িতে করে তিনি আমাদের নানা জায়গায় নিয়ে গেছেন। ওসিডি নিয়ে তিনি এবার একটা কৌতুক বলেছেন, প্রসঙ্গত বলে ফেলা যায়। এক রোগী মানসিক চিকিৎসককে বলল, আমার সমস্যা হলো সব সময় মনে হয়, খাটের নিচে চোর লুকিয়ে আছে।
আমি তাই রাতের বেলা বিছানা থেকে নেমে খাটের নিচে তল্লাশি করি, দেখি চোর আছে কি না, তখন মনে হয় চোর আমার পেছনে। তখন খাটে বসি, দেখি সামনে চোর নেই, তাহলে নিশ্চয়ই খাটের নিচে আবার লুকিয়েছে। সারা রাত এই করি। আর ঘুম হয় না।
ডাক্তার বললেন, আপনার ওসিডি হয়েছে, সেরে যাবে, আপনি সপ্তাহে দুই দিন সেশন দেবেন আমার সঙ্গে। প্রতি সেশনে লাগবে ৫০০ ডলার।
পরে রোগী আর আসেন না। ডাক্তারের সঙ্গে পথে তাঁর দেখা।
ডাক্তার বললেন, কই, আর তো এলেন না।
রোগী বললেন, আপনি সপ্তাহে ১ হাজার ডলার চেয়েছেন, বছরে ৫২ হাজার। আমি ১০ ডলারে কাজ সেরে ফেলেছি।
কী রকম?
আমি ১০ ডলার দিয়ে একটা করাত কিনে খাটের পায়া চারটা কেটে ফেলেছি। এ রকম কত মজার ঘটনা যে ঘটে নিউইয়র্ক বইমেলায়। সেই মেলায় এবার আমি যেতে পারলাম না। কী আফসোস হচ্ছে। ছুটি পেলাম না।
তবে আবার আমি যাব নিউইয়র্কের বইমেলায়। নিশ্চয়ই যাব।