কালজয়ীদের চিঠিপত্রে ভাস্বর আবুবকর সিদ্দিক

গ্রাফিকস: প্রথম আলোছবি: পারিবারিক সূত্রে পাওয়া

মানুষের ব্যক্তিগত বিভিন্ন উপকরণকে যদি নিবিড় গবেষণার আওতায় আনা সম্ভব হয় তাহলে ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে ইতিহাসের নিরিখে নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হতে দেখি। অতীতে লিখিত ব্যক্তিমানুষের চিঠি এ ক্ষেত্রে আরও একটি অনন্য উদাহরণ। আর তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছিন্নপত্র’–এর কথা সবার আগে উচ্চারিত হতে দেখি। আবার রবীন্দ্র-উত্তর যুগে স্বতন্ত্র পরিচয়ে উদ্ভাসিত আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিঠিগুলোতে কবির যাপিত জীবনের টানাপোড়েন, প্রেম, ক্ষোভ, যন্ত্রণার পাশাপাশি আমরা কবির মানসজাত দর্শন, সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্যকে বিশ্বপরিমণ্ডলের আবহাওয়ায় বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়াস দেখতে পাই। কিন্তু গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এসে তথ্যপ্রযুক্তির অবারিত প্রসার পোস্ট অফিসকে প্রত্ন বিভাগে ঠাঁই দিয়েছে, আর চিঠিপত্র সোনার পাথরবাটি যেন! বর্তমান সময়ে তাই বিভিন্ন ভাষার কালজয়ী মনীষীদের চিঠিপত্র পাঠকের মনোজগতে নতুন করে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বসাহিত্য তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও আজ চিঠির কদর অনস্বীকার্য। 

তিরিশোত্তর বাংলা সাহিত্যে সাতচল্লিশের দেশভাগ বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জীবনে এক মর্মন্তুদ ঘটনা। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষের অধীন পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জীবনব্যবস্থায়ও পরিবর্তন ঘটে নানা আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক অবদমনের ভেতরে। ফলে তার ছায়াপাত লক্ষ করা যায় দুই প্রান্তের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে। সেই প্রেক্ষাপটে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবিকতার পরাকাষ্ঠায় জাজ্বল্যমান যে সাহিত্য গোটা পাকিস্তান পর্বে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কলমের আঁচড়ে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র প্রোথিত করেছিল—সেখানেই নাম লেখালেন বাংলাদেশের অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক, যাঁদের অন্যতম আবুবকর সিদ্দিক।

শৈশব কাটে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি ও বর্ধমান শহরে। সেখানকার জনপদ তাঁর কৈশোরের মনোভূমিকে ভিত্তি দিয়েছিল। বর্ধমান শহরের টাউন হলের রাজনৈতিক সভায় যে চারজন কিশোর উদ্বোধনী সংগীত গাইত, তাদেরই একজন ছিলেন আবুবকর সিদ্দিক।

বাম ঘরানার এই লেখকের শৈশব কাটে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি ও বর্ধমান শহরে। সেখানকার জনপদ তাঁর কৈশোরের মনোভূমিকে ভিত্তি দিয়েছিল। বর্ধমান শহরের টাউন হলের রাজনৈতিক সভায় যে চারজন কিশোর উদ্বোধনী সংগীত গাইত, তাদেরই একজন ছিলেন আবুবকর সিদ্দিক। নেহরু-গান্ধীর জনসভায় থাকার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল। সেই তখন কংগ্রেসের মিছিলে কিশোর বাহিনীতে থেকে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, স্লোগান দিয়েছেন। তা ছাড়া তাঁর বাবা একজন রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক সচেতন মানুষ ছিলেন বিধায় পিতার কাছ থেকেও কবি এ বিষয়ে দীক্ষা পেয়েছেন। আবুবকর সিদ্দিকের ভাষায়:

 ...। এই রাজনৈতিক বাতাবরণ—নেহরু-গান্ধী-সুভাষ বোসের দর্শন, বিশ্বযুদ্ধের চাপ, ’৭৬-এর মন্বন্তর, দাঙ্গার মতো ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে ফিরে এলাম জন্মভিটে বাগেরহাটের বৈট্পুর গ্রামে। আর এ সমস্ত কিছুই পরবর্তীতে আমার লেখক হয়ে ওঠার ভিত্তি রচনা করেছে।...

সাতচল্লিশের দেশভাগের ফলে আবুবকর সিদ্দিকের পরিবার ফিরে এলেন নিজ গ্রাম বাংলাদেশের মফস্‌সল শহর বাগেরহাটের বৈট্পুরে। এরপর একজন পরিপূর্ণ লেখক হিসেবে আবুবকর সিদ্দিক প্রথম পশ্চিমবঙ্গে পা রাখলেন ১৯৬৩ সালে। সেবারই তাঁর সখ্য হলো তিরিশের মহিরুহ কবি বিষ্ণু দের সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে চিঠির আদান-প্রদান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বন্ধুতা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ বসু, বুদ্ধদেব বসু ও প্রতিভা বসু; এ দেশে সিকান্‌দার আবু জাফর, হাসান হাফিজুর রহমান—এঁদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের বিষয় ও আড্ডা আবুবকর সিদ্দিকের লেখক সত্তাকে করেছিল দেদীপ্যমান। এঁদের পাশাপাশি চিঠির যোগাযোগ ছিল সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক সেন, অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে। এমনই কয়েকজন কালজয়ী মনীষী সাহিত্যিকের আবুবকর সিদ্দিককে লিখিত চিঠিপত্রের ভেতরে তাঁর লেখনীশক্তির সারবত্তা উন্মোচিত হতে দেখি।

নয়টি খণ্ডে প্রকাশিত ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থের রচয়িতা ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক, গবেষক এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সাবেক সভাপতি অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আবুবকর সিদ্দিকের প্রথম উপন্যাস ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘জলরাক্ষস’ পড়ে একটি চিঠি লেখেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন:

আবুবকর সিদ্দিককে লেখা অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি
লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত

...। আপনার গল্প-উপন্যাস, কবিতা পড়েছি, শওকত ওসমান ঠিকই বলেছেন, ‘আবুবকর সিদ্দিক যে অমিত তেজ এবং সাহসের সঙ্গে বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন-ধারার আলেখ্য তুলে ধরেছেন, তা মনে রাখার মতো ঘটনা।’ তার সঙ্গে আমি আর একটি কথা যোগ করতে চাই। তেজ ও সাহসের সঙ্গে আছে অন্তহীন প্রেম। উপদ্রুত, অবহেলিত, ধূসর মানুষগুলি আপনার ভালোবাসার আতপ্ত স্পর্শে পঙ্ক-শয্যা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে নতুন অস্তিত্বের সন্ধানে। সার্থক হোক, ফলবান হোক, অনাগত জীবনের সর্বতোভদ্র বার্তা বহন করে আনুক আপনার লেখা।...

ঠিক একইভাবে ভারতীয় বিশিষ্ট বাঙালি চিন্তক ও সাহিত্য সমালোচক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৮৭-তে প্রকাশিত আবুবকর সিদ্দিকের সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘খরাদাহ’ প্রসঙ্গে লেখককে একটি চিঠি লিখেন। যেখানে তিনি বলেছেন যে বইটি সময়মতো হাতে না আসার দরুন ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য ‘সময়ের দাগ ও বিদীর্ণ দর্পণ’ লিখতে গিয়ে এমন ‘ভয়ংকর’ বইয়ের কথা না লিখতে পারায় দুঃখিত হয়েছেন। তবে বই আকারে প্রকাশের আগে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিক্ষণে প্রকাশের সময়েই তিনি এটি পাঠান্তে মজে গিয়েছিলেন। সবশেষে তিনি উল্লেখ করেন:

...। টোপোগ্রাফির উপর আপনার দখল অনন্যসাধারণ। তবে তার থেকেও আপনার বড়ো ব্যাপার মানবিক বাস্তবতা সম্বন্ধে অভ্রান্ত জ্ঞান। সোনার দ’ত কলম হোক—এ শুভেচ্ছা আপনাকে জানাবো না। শুধু বলবো—আপনার লোহার দ’ত কলম অটুট থাকুক।

অন্য একজন লেখক কর্তৃক এভাবে সম্মানিত হওয়া একজন লেখকের জন্য এর থেকে বড়ো প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! আবুবকর সিদ্দিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার কবিতা কখনো আমার গদ্যকে শাসন করেনি।’ আর তাই বাংলা ভাষার কথাসাহিত্যে আমরা পেয়েছি তাঁর মতো একজন দলিত শ্রেণির অনন্য ক্ষুরধার কথাকারকে। সুতরাং তাঁর গল্প নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের লেখক থেকে পাঠক পর্যন্ত উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। তেমনি দুটি চিঠি আমরা পাই অশোক সেন ও অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে।

সাহিত্যিক অশোক সেন আবুবকর সিদ্দিকের ‘জালযোদ্ধা’ গল্পটির উল্লেখ করেন। এটি তিনি ‘বারোমাস’ পত্রিকার নববর্ষ সংখ্যায় (এপ্রিল-মে ’৭৬) ছেপে দেবেন বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা, পূজা সংখ্যার অনেক দেরি। অন্যদিকে সাহিত্যিক ও সম্পাদক অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও আবুবকর সিদ্দিকের একটি গল্প আকাশবাণীর স্বপ্নময় চক্রবর্তীর মাধ্যমে হাতে পান এবং তাঁর ‘এবং এই সময় পত্রিকা’য় ছাপার সংবাদ দেন। তিনি আরও জানান যে পশ্চিমবঙ্গে আবুবকর সিদ্দিকের গল্পের খুব সমাদর।

তিরিশের পঞ্চপাণ্ডব হিসেবে খ্যাত কবি বিষ্ণু দের (১৯০৯-১৯৮২) সঙ্গে শুধু সম্পর্কই ছিল না, কালপ্রবাহে তা চিঠির আদান–প্রদানের ভেতর দিয়ে হয়েছিল ঘনিষ্ঠ, গাঢ়তর। ১৯৬৩-এর ফেব্রুয়ারি মাসে বিষ্ণু দের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ।
আবুবকর সিদ্দিককে লেখা সিকান্‌দার আবু জাফরের চিঠি
লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত

সিকান্‌দার আবু জাফর বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে এক উল্লেখযোগ্য কালজয়ী নাম। সাতচল্লিশের দেশভাগের পটভূমিতে তাঁর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকাকে ঘিরেই উঠে আসে একঝাঁক তরুণ মেধাবী কবি-লেখক। নতুন বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্য নির্মাণের পথে স্মরণযোগ্য শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আনিসুজ্জামান, আবুবকর সিদ্দিক, শহীদ কাদরী প্রমুখ সমকালকে ঘিরেই আবর্তিত হন।

বাংলাদেশের স্বাধিকারের প্রশ্নে উত্তাল মধ্য-ষাটে আবুবকর সিদ্দিক তখন বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক। ওই সময় রাজনীতির ‘ভিলেজ পলিটিকসের’ শিকারে আবুবকর সিদ্দিকের ব্যক্তিজীবনেও নেমেছিল কালো আঁধার। সামাজিক প্রতিষ্ঠা তাঁকে রক্ষা করে। সেই বিষাদকথা সিকান্‌দার আবু জাফরের কাছেও পৌঁছে যায়। তার উল্লেখ ছিল ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে লিখিত একটি চিঠিতে। পাশাপাশি সমকাল পত্রিকার জন্য নতুন গল্প পাঠানোর কথাও বলেন, সঙ্গে ওখানকার পাঠক প্রতিক্রিয়াও। তিনি লেখেন:

স্নেহভাজন সিদ্দিক,
তোমার সবগুলো চিঠি পেয়েছি। তোমার দুর্ঘটনার কথাও জেনেছি। অন্যের কাছ থেকে ও বিষয়ে আরও বিস্তারিত বিবরণ শুনেছি। যা–ই হক যা হবার তা হয়ে গেছে। সুতরাং তা নিয়ে দ্বিতীয় চিন্তার কোনো প্রয়োজন নেই। 

তোমাকে কিছু কিছু বিনিময় মূল্য দেবার চেষ্টা করব। কিন্তু সমকালের আর্থিক অবস্থা তুমি ত জানোই। তোমার গল্প ছেপেছি। কবিতাও পরের সংখ্যার জন্যে ছাপা হয়ে গেছে। ছাপা গল্পটি অবশ্য ছাপা চলবে না। আরও নতুন গল্প পাঠিও। তোমাদের ওদিক থেকে ‘পাঠকের প্রতিক্রিয়া’ পাঠিও। 

আশা করি কুশলে আছো। ইতি—
সিকান্‌দার আবু জাফর

শেষ করছি আবুবকর সিদ্দিককে লিখিত বিষ্ণু দের একটি চিঠির প্রসঙ্গ টেনে। তিরিশের পঞ্চপাণ্ডব হিসেবে খ্যাত কবি বিষ্ণু দের (১৯০৯-১৯৮২) সঙ্গে শুধু সম্পর্কই ছিল না, কালপ্রবাহে তা চিঠির আদান–প্রদানের ভেতর দিয়ে হয়েছিল ঘনিষ্ঠ, গাঢ়তর। ১৯৬৩-এর ফেব্রুয়ারি মাসে বিষ্ণু দের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ। আবুবকর সিদ্দিক তাঁর এক লেখায় বর্ণনা করেছেন: ‘বিষ্ণু দে সন্দর্শন আমার কাছে মনে হয়েছিল রাজদর্শন। হাইব্যাক চেয়ারে উপবিষ্ট দীর্ঘদেহী ঈষৎ কুঁজো, টানা চোখ তীক্ষ্ণ নাক স্মিত হাসি সিল্কের পাঞ্জাবি—রাজকীয় ব্যক্তিত্ব।’ 

ওই ’৬৩ সালেই প্রথম পশ্চিমবঙ্গ সফরে তিনি কাছাকাছি এসেছিলেন বিষ্ণু দের। দুই–তিন দিন করে গিয়েছিলেন বিষ্ণু দের বাসায়। কবিতা, বইপত্র, পত্রিকা বিনিময় হয়েছিল দুই কবির। এরপর ১৯৮৪ সালে দ্বিতীয়বার আবুবকর সিদ্দিক যখন পশ্চিমবঙ্গে বিষ্ণু দের বাড়িতে যান, তখন আর কবি বেঁচে নেই। ঠিক তার দুই বছর আগেই গত হয়েছেন বাংলা কবিতার মহিরুহ বিষ্ণু দে। কিন্তু তত দিনে আবুবকর সিদ্দিক ও বিষ্ণু দের মধ্যে গড়ে উঠেছিল প্রীতির বন্ধন, বিনিময় হয়েছে অসংখ্য চিঠির। তাই তো ১৯৮২ সালে কবির মৃত্যুর পরেও যার সাক্ষ্য মেলে কবিপত্নী প্রণতি দেকে লেখা আবুবকর সিদ্দিকের চিঠির ভেতরে। কবি আবুবকর সিদ্দিকের ভাষাতেই বলা যাক: 

...। বুঝতে পারি, গণ-আন্দোলনের রক্তসড়ক ধরে ক্রমজায়মান একটি স্বাধীন দেশের সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে শামসুর রাহমান বা আমি তাঁর কাছে প্রতীকী-চরিত্রে পরিণত হয়ে উঠেছিলাম।...   

আবুবকর সিদ্দিককে লিখিত বিষ্ণু দের অসংখ্য চিঠির মধ্যে যে চিঠির উল্লেখ করছি, সেটি আরও একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ, এই চিঠির মাধ্যমে আজকের পাঠক জানতে পারবে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষণজন্মা কবিপুরুষ বিষ্ণু দে প্রাক্‌-স্বাধীনতাপর্বে ১৯৬৯ সালেই তাঁর ‘সংবাদ মূলত কাব্য’ কবিতাগ্রন্থটি আবুবকর সিদ্দিককে উৎসর্গ করেছিলেন। সঙ্গে শামসুর রাহমান। বিষ্ণু দে যার উৎসর্গে লেখেন: ‘শামসুর রাহমান, আবুবকর সিদ্দিক—পূর্ববঙ্গের সহকর্মীদের উপহার’। বাংলাদেশের কাব্যযাত্রায় এ এক অনন্য নিদর্শন।

আবুবকর সিদ্দিককে লেখা বিষ্ণু দে–র চিঠি
লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত

১/১০ প্রিন্স গোলাম মহম্মদ রোড, কলকাতা-২৬
৪/৮/৬৯

প্রিয়বরেষু
আপনার ২১/৭-এর চিঠি পেয়ে খুশি লাগল, অনেক দিন কোনও জবাব না পাওয়ার পরে। যা হোক পুরোনো দুটো চিঠি পেয়েছেন। ইতিমধ্যে ‘সংবাদ মূলত কাব্য’ নামক কবিতার বই বেরিয়েছে সাহিত্যপত্র-গ্রন্থমালায়। অরুণ পাঠাবেন বা পাঠিয়েছেন কপি। আপনাকে এবং শামসুর রাহমান-কে। দুজনে উৎসর্গপত্রে নামাঙ্কিত, আশা করি কিছু ভুল হয়নি। শামসুর-কে তাঁর প্রকাশকের ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে।

আপনার কবিতা পরিচয় ও সাহিত্যপত্র-তে প্রকাশিত। অনেক দিন আগে পাঠানো হয়েছে। পাননি? দেখি, যদি পৃষ্ঠা কেটে পাঠানো যায়।

ডেভিড ছুটিতে দেশে যান। ফিরেছেন এবং এসেছিলেন, আপনার কথা বলেছি। তিনি আপনাকে যে পত্রিকা পাঠান, সেটি কি পাননি?

‘পূর্বমেঘ’ পত্র কি পাওয়া যায়? মনে হচ্ছে আমি চোখে দেখিনি, অন্তত বেশ কিছুকাল।

শহীদুল্লাহ ও হাই সাহেবের মৃত্যুতে এখানে লেখা ও সভা হয়েছে। তাঁরা নমস্য পণ্ডিত ছিলেন, যা একান্ত দুর্লভ।

জসীমউদ্‌দীনের সঙ্গে অনেককাল পরে দেখা হলো। সভায় তাঁর পাশেই বসতে হয়েছিল। জসীম বললেন ভালো। বিজ্ঞপ্তি সামান্য হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রসদনে তিলধারণের জায়গা ছিল না।

আশা করি দেখাসাক্ষাৎ হবে—কোনো দিন।

শুভাকাঙ্ক্ষী
বিষ্ণু দে