কবিতা কেবল সৌন্দর্যবোধ বা উচ্চারণশৈলীর অনুশীলন নয়, বরং এটি এমন এক রাজনৈতিক অনুশীলনের ক্ষেত্র, যেখানে ভাষা, দেহ ও চেতনার গঠনপ্রণালি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ‘পোস্ট ল্যাঙ্গুয়েজ’ ও ‘পোস্ট অ্যাবলিস্ট’ নামক নামক ধারণাটি এই প্রশ্নগুলোকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। এ ক্ষেত্রে প্যাট্রিক ডার্গিন ভাষা ও দেহ—এই দুই মৌল উপাদানের মধ্যকার সম্পর্ককে ভেঙে পুনর্গঠনের এক গভীর প্রস্তাব হাজির করেছেন। তিনি দেখাতে চান, কীভাবে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েট্রি’র ভাঙাচোরা, অসম্পূর্ণ ভাষাব্যবহার আর শারীরিক বা মানসিক ভিন্নতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কাব্যিক অভিব্যক্তির মধ্যে একটি গভীর অন্তঃসংযোগ রয়েছে। এই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে একটি নতুন কবিতাচিন্তার জন্ম হয়, যেখানে ‘ক্ষমতা’ ও ‘অক্ষমতা’—এই জোড়াটি ভেঙে যায় এবং কবিতা হয়ে ওঠে অন্তর্ভুক্তির এক নতুন ভূমি।
বিশেষত ‘পোস্ট-ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েট্রি’, যা বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ওঠে—তাদের কাজ ছিল ভাষার ভেতরকার শৃঙ্খলা ও শ্রেণিবিন্যাসকে ভেঙে দেওয়া। চার্লস বার্নস্টেইন, লিন হেজিনিয়ান, রন সিলিম্যান, বব পেরেলমান প্রমুখ পোস্ট-ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েট্রির মূলধারার কবি। তাঁরা শব্দকে ভাবের বাহক হিসেবে নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিরোধের সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। এই কাব্যধারা পাঠককে বাধ্য করে ভাষার তৈরি অর্থ ও অভ্যস্ততা নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে। ভাষার এই ভাঙন একরকম প্রতিবাদ, যেখানে বক্তব্যের চেয়ে প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে বাক্যের গতি ও ধ্বনি অর্থের চেয়ে বেশি রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। এই ভাঙা ভাষার নন্দন মূলত প্রশ্ন তোলে—কে ভাষা ব্যবহার করতে পারে? কে তা বুঝতে পারে? কার ভাষা কবিতার ভাষা হিসেবে বৈধ?
পোস্ট-অ্যাবলিস্ট কবিতাশাস্ত্র আমাদের শেখায়, অক্ষমতা কেবল একটি চিকিৎসা-সংক্রান্ত বা সমব্যথী বিষয় নয়, বরং এটি একধরনের ভাষার সম্ভাবনা। একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর সময় ও স্থান সম্পর্কিত ধারণা, চলাফেরার অভিজ্ঞতা কিংবা দৈনন্দিন বাস্তবতা থেকে এমন এক কবিতা জন্ম নিতে পারে, যা প্রচলিত ছন্দ, ভাষা ও কাঠামোর বাইরেও নতুন ছন্দ খুঁজে পায়।
ডার্গিনের আলোচনায় এই ভাঙা ভাষার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয় দেহের রাজনীতি, বিশেষ করে অক্ষম দেহের। আধুনিক সমাজে একটি অদৃশ্য ‘অক্ষম–শরীর’ আদর্শের চারপাশে গড়ে উঠেছে ক্ষমতা, উপস্থাপন, ভাষা ও অভিজ্ঞতার কাঠামো। তার বাইরে যারা—দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী, স্বরপ্রতিবন্ধী কিংবা নিউরোডাইভারজেন্ট ব্যক্তি—তাদের অভিজ্ঞতা প্রায়ই সাহিত্য ও বিশেষত কবিতায় উপেক্ষিত হয়। পোস্ট-অ্যাবলিস্ট পোয়েটিকস এই অভিজ্ঞতাকে কেবল অন্তর্ভুক্ত করতেই চায় না, বরং তা থেকে নতুন কবিতার ছন্দ, গতি ও ভাষা তৈরি করতে চায়। যে কবিতা নির্ভরতার চিহ্নকে দুর্বলতা নয়, বরং সহনশীলতার, পারস্পরিকতার এবং বিকল্প চেতনার সম্ভাবনা হিসেবে তুলে ধরে। এই ধারার মূল কবি হচ্ছেন জিলিয়ান ওয়েইস, পেট্রা কুপার্স, র্যামন্ড এন্ট্রোবাস, কেনি ফ্রিয়েস, জিম ফেরিস প্রমুখ।
এই আলোচনাকে যদি আমরা বাংলা ভাষার কবিতার প্রেক্ষাপটে বসাই, তাহলে এর তাৎপর্য গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়। বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে ভাষার রাজনৈতিক ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ। নজরুলের বিদ্রোহী উচ্চারণ কিংবা হেলাল হাফিজের দ্রোহ, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে কাব্যিক প্রতিবাদ হিসেবে দেখা যায়।
আবুল হাসানের কবিতাতেও পোস্ট-ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েট্রির ভাষা ও অনুষঙ্গ লক্ষ করা যায়। পশ্চিমবঙ্গেও সত্তর দশকের কবিতায় ভাষা একধরনের অস্ত্র হয়ে উঠেছিল, বিশেষত নকশাল আন্দোলনের সময়। কিন্তু সেই ভাষার রাজনীতিতে দেহ, বিশেষ করে শারীরিক বা মানসিকভাবে ভিন্নতর দেহ প্রসঙ্গের বাইরে থেকেছে। বাংলা কবিতার মূলস্রোত যে দেহকে ধারণ করেছে, তা একধরনের ‘ক্ষমতাবান’ আদর্শ দেহ—সক্ষম, সুস্থ, মানসিকভাবে স্থিত। ফলত ভিন্নতা কাব্যিক উচ্চারণে খুব কমই পরিস্ফুট হয়েছে।
পোস্ট-অ্যাবলিস্ট কবিতাশাস্ত্র আমাদের শেখায়, অক্ষমতা কেবল একটি চিকিৎসা-সংক্রান্ত বা সমব্যথী বিষয় নয়, বরং এটি একধরনের ভাষার সম্ভাবনা। একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর সময় ও স্থান সম্পর্কিত ধারণা, চলাফেরার অভিজ্ঞতা কিংবা দৈনন্দিন বাস্তবতা থেকে এমন এক কবিতা জন্ম নিতে পারে, যা প্রচলিত ছন্দ, ভাষা ও কাঠামোর বাইরেও নতুন ছন্দ খুঁজে পায়। একইভাবে দৃষ্টিশক্তিহীন কারও কাব্যিক বোধ, অন্ধকারের মধ্যকার দৃশ্যমানতা কিংবা শব্দগ্রহণের পরিসর—সবই নতুন ধরনের কাব্যিক ভাষা তৈরি করতে সক্ষম। এটি কেবল ভাষার ভাঙন নয়, এটি দেহভিত্তিক অভিজ্ঞতার এক বিকল্প কবিতা।
পশ্চিমবঙ্গেও কবিতার ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা এখনো তুলনামূলকভাবে অনুপস্থিত। যদিও বামপন্থী কবিদের একাংশ সমাজের নিম্নবর্গ, শ্রমজীবী বা প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠকে কবিতায় স্থান দিয়েছেন, তথাপি অক্ষমতা বা নিউরোডাইভার্সিটির নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা নিয়ে সচেতন কাব্যিক চর্চা গড়ে ওঠেনি। এর ব্যতিক্রমস্বরূপ কিছু স্বর উঠে এসেছে—যেমন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার প্রমুখ, যাঁরা মানসিক স্বাস্থ্য ও বিভ্রান্তির অভিজ্ঞতাকে তাঁদের কবিতায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন কিংবা মল্লিকা সেনগুপ্ত, যিনি নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেহের দুর্বলতা ও যন্ত্রণাকে ভাষার অস্ত্র করেছেন। দেবারতি মিত্রের কবিতাতেও নারীর সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণাভোগের ভাষা অন্বেষণে প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। তবে সামগ্রিকভাবে পোস্ট-অ্যাবলিস্ট চেতনার পূর্ণাঙ্গ কবিতা এই ভূখণ্ডে এখনো অপেক্ষমাণ।
কিছু কবি মানসিক স্বাস্থ্য, মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা, যৌন অবদমন এবং নারীর অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করছেন; তবে শারীরিক অক্ষমতা ও ভাষার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে কার্যকর কাব্যিক চর্চা এখনো গড়ে ওঠেনি। এই অনুপস্থিতির পেছনে রয়েছে সাংস্কৃতিক চেতনায় একটি ‘স্বাভাবিকতা’র মানদণ্ড, যেখানে কবি মানেই একটি নির্দিষ্ট মননের অধিকারী শক্তিশালী চেতনার প্রতিনিধি।
বাংলাদেশের কবিতার ভেতরেও একই ছবি। যদিও তসলিমা নাসরিন, নাসিমা সুলতানা, রোকসানা আফরিন প্রমুখের মতো কিছু কণ্ঠ মানসিক স্বাস্থ্য, মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা, যৌন অবদমন এবং নারীর অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করছেন; তবে শারীরিক অক্ষমতা ও ভাষার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে কার্যকর কাব্যিক চর্চা এখনো গড়ে ওঠেনি। এই অনুপস্থিতির পেছনে রয়েছে সাংস্কৃতিক চেতনায় একটি ‘স্বাভাবিকতা’র মানদণ্ড, যেখানে কবি মানেই একটি নির্দিষ্ট মননের অধিকারী শক্তিশালী চেতনার প্রতিনিধি। এই মানদণ্ড ভাঙতে হলে, কবিতা ও কবিতাশাস্ত্র উভয় ক্ষেত্রেই প্রয়োজন পুনর্বিন্যাস।
ডার্গিনের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি—বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ কেবল ভাষার নতুন রূপ আবিষ্কারের মধ্যে সীমিত নয়, বরং দেহ ও অভিজ্ঞতার যে পরিসর এত দিন উপেক্ষিত থেকেছে, সেটিকে কেন্দ্রে এনে এক নতুন রাজনৈতিক কাব্যভাষা গঠনের মধ্যেও নিহিত। এই কবিতা হবে এমন এক চর্চা, যেখানে নিঃশব্দতা, টালমাটাল ছন্দ, অসম্পূর্ণ বাক্য কিংবা মন্থর উচ্চারণও অর্থবহ হয়ে উঠবে। কবিতা এখানে একপ্রকার নির্ভরতার ভাষা—যেখানে সহাবস্থান, সহমর্মিতা ও অসম্পূর্ণতা একধরনের শক্তি হয়ে ওঠে।
এই নতুন কাব্যচেতনায়, গ্রামীণ ও প্রান্তিক অভিজ্ঞতা যেমন স্থান পায়, তেমনি দেহ ও ভাষার ভিন্নতা নিয়েও সাহসী উচ্চারণ সম্ভব। বাংলা কবিতার নতুন অধ্যায়ে যদি এই ভাবনার অনুরণন প্রবেশ করতে পারে, তবে তা হবে কেবল একটি নতুন কাব্যিক চর্চার সূচনা নয়, বরং সাহিত্যের ভেতর মানবিকতার নতুন পরিসরের উন্মোচন। কেননা কবিতার প্রকৃত শক্তি কেবল বলার মধ্যে নয়, শোনার ও গ্রহণ করার মধ্যেও নিহিত—সেই শোনার পরিসর যত বিস্তৃত হবে, ততই কবিতা হয়ে উঠবে সবার।