এই বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া আমায় নেবে কত দূরে?
আকাশে মেঘ করলে আমাদের নাগরিক মনে ভেসে ওঠে অনেক রকম ছবি। আবার ঝোড়ো হাওয়া বইলে, ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে একের পর এক নানান ছবি ওঠানামা করে মনের তরঙ্গে। মন বলে, এই বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়া আমায় নেবে কত দূরে?
‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরানসখা বন্ধু হে আমার...’—তুমুল ঝড়বৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের গান কপচানোর মতো রোমান্টিক কখনোই ছিলাম না। তবু বন্ধুবান্ধবরা যখন ঝড়ে প্রেমিককে চিঠি লিখে ফেলত, কেউ এমপিথ্রি প্লেয়ারে চড়া ভলিউমে গান বাজাত, তখন একটু রোমান্টিক হওয়ার চেষ্টা করতাম।
সেই চেষ্টা অবশ্য বন্ধুদের প্রেমপত্র লিখে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। স্কুল–কলেজে কিংবা বড় হয়েও একটা ডাকাবুকা ইমেজ থাকার কারণে প্রেম কখনোই আমার ওপর পড়েনি। আমিই প্রেমে পড়েছি, আবার উঠেও গিয়েছি। এই সব বৃষ্টিস্নাত দিন কিংবা ঝড়ের বিকেল জানালা আটকানো আর বারান্দা থেকে কাপড় আনার মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে।
আর জীবনের অনেক বসন্ত পার করে ঝড়বৃষ্টিটাকে এখন হ্যাপাই মনে হয়। পত্রিকা অফিসের ফিচারে কাজ করার সময় ঝড়বৃষ্টি দেখলেই খিচুড়ির রেসিপি, ভেজা কাপড় শুকানোর ১০৯ উপায়, নির্বিঘ্নে কর্মস্থলে পৌঁছানোর টিপস—এগুলো লেখার পরিকল্পনাতেই ওই ঝড়বৃষ্টি উদ্যাপন করা হতো। আর নিউজ ডেস্ক তথা খবরের সেকশনে কাজের সময় প্রথম কাজ ছিল, আবহাওয়াবিষয়ক প্রতিবেদককে ফোন দেওয়া, কত মিলিমিটার বৃষ্টি হবে, ঝড়ের গতিবেগ কত থাকবে?—এসব প্রাথমিক সংবাদ শেষ করে রওনা করতাম ক্যাজুয়ালিটির দিকে।
সিটি করপোরেশন বিটের প্রতিবেদককে ফোন দিয়ে বলতাম, ঢাকার কোন কোন এলাকায় পানি জমেছে, জলাবদ্ধতা নিয়ে নিউজ লাগবে। গাছ পড়ে পথচারীর মৃত্যু—এসব সংবাদ ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও হাসপাতাল প্রতিনিধির সূত্র ধরে আসত। এরপর বসা হতো মফস্সলপ্রধানের সঙ্গে—বজ্রপাতে কতজন মারা গেল, নিউজটা টপে যাবে—যখন সংবাদকর্মী ছিলাম, তখন এগুলোই ছিল আমার উদ্যাপন।
এখন হোম ক্যাটারিং চালু করার পর থেকে শুধু মনে হয় আজকে ডেলিভারি টাইমলি পৌঁছাবে তো? মাঝেমধ্যে মনে হয় ঝড়বৃষ্টির কী দরকার। সেদিন এক আম ব্যবসায়ী বন্ধুর স্ট্যাটাস দেখে মনে হলো, প্রেমের জন্য না, সুন্দর ফসল উৎপাদনের জন্যও দরকার ঝড়বৃষ্টি। এবার লিচু ভালো হয়নি। কারণ, বৈশাখে যে বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল, তেমনটা হয়নি। আমের ওপরও প্রভাব পড়ছে। আম পুষ্ট হতে বৃষ্টি আর কালবৈশাখী লাগে যে।
২০২১ সালের আগস্ট মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক পরিবারের ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল বজ্রপাতে। নৌকায় বরযাত্রীরা যাচ্ছিলেন কনে আনতে। ঝড়বৃষ্টির সময় কেন জানি না, আমার এসবই বেশি মনে পড়ে।
বছর পাঁচেক আগে শেরাটনের সামনে গাছের ডাল ভেঙে মারা গেলেন এক মোটরবাইকযাত্রী। লোকটার হাতে বেলিফুল ছিল। ছবিটা ভুলতে পারি না। নিশ্চয় বৃষ্টিভেজা রাতে প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য ফুল নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেদিন নিশ্চয় তাঁর বাসায় খিচুড়ি রান্না হয়েছিল? বেগুনভাজা হয়েছিল কি? ফ্রিজ থেকে গরুর মাংসের প্যাকেট বের করে একটু গরুও কি রান্না করেছিলেন তাঁর স্ত্রী? তাঁদের কি কোনো ছেলেমেয়ে ছিল? একটা ছোট্ট মেয়ে বোধ হয় ছিল, যার জন্য কিনে নেওয়া বেলুনটা ঝড়ে উড়ে গেছে।
২০১০ সালে সৌদি আরবের জেদ্দায় ভয়াবহ এক ঝড়বৃষ্টি সামলেছিলাম আমরা। আমি তখন জেদ্দার বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক। স্কুল ছুটি হওয়ার কিছু আগে, আকাশ কালো করে ঝড় উঠল। স্কুলে ঘোষণা দেওয়া হলো, কেউ ক্লাস থেকে বের হবে না। শিক্ষকেরা বসে থাকবে প্রতিটা ক্লাসে। এক–দেড় ঘণ্টার বৃষ্টিতে বিশ্বের অন্যতম আধুনিক শহরকে ভেসে যেতে দেখেছিলাম। কত লাশ ভেসে ওঠার গল্প শুনেছি। স্কুলে আটকা পড়েছিল দুই হাজার শিশু। বিভিন্ন স্থানে তাদের অভিভাবকেরা। শুধু গাড়ি ভেসে গেছে ১৫–২০ হাজার। আন্ডারপাস, এলিভেটেড এক্সপ্রেস হয়ে কত কিছু তলিয়ে গেল! স্কুলের উঠানে খিচুড়ি রান্না হলো সেই ছাত্রছাত্রীদের জন্য। আশপাশে থাকা বাংলাদেশি পরিবার ও শিক্ষকদের বাড়িতে ভাগ করে করে ছাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা হলো। টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন। মোবাইল টাওয়ার পড়ে যাওয়ায় নেটওয়ার্ক নেই। স্কুলের এক শাখা থেকে আরেক শাখায় শিশুদের নিরাপদে পার করতে তীব্র স্রোতের মধ্যে মানবঢাল বানানো হয়েছিল। কী যে দুঃসহ ঝড়বৃষ্টি ছিল সেটা!
বছর পাঁচেক আগে শেরাটনের সামনে গাছের ডাল ভেঙে মারা গেলেন এক মোটরবাইকযাত্রী। লোকটার হাতে বেলিফুল ছিল। ছবিটা ভুলতে পারি না। নিশ্চয় বৃষ্টিভেজা রাতে প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য ফুল নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেদিন নিশ্চয় তার বাসায় খিচুড়ি রান্না হয়েছিল? বেগুনভাজা হয়েছিল কি? ফ্রিজ থেকে গরুর মাংসের প্যাকেট বের করে একটু গরুও কি রান্না করেছিলেন তার স্ত্রী? তাদের কি কোনো ছেলেমেয়ে ছিল? একটা ছোট্ট মেয়ে বোধ হয় ছিল, যার জন্য কিনে নেওয়া বেলুনটা ঝড়ে উড়ে গেছে।
কাঁঠালবাগানের ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের রাস্তাগুলো ডুবে যায় ঝড়বৃষ্টি একটু বেশি হলেই। ৯ বছর ধরে আমি এই এলাকায় থাকি। একদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি কতগুলো ছেলে গলাপানির মধ্যে হন্যে হয়ে কিছু একটা খুঁজছে। সারা রাত অঝোরে বৃষ্টি ঝরেছে, এত আরামে ঘুমিয়েছি!
কফি নিয়ে বারান্দায় বসে ভাবলাম, মাছ ধরছে নাকি? নিচে পরিচিত একজনকে জিজ্ঞাসা করায় যা জানলাম, তা সারা জীবনের জন্য গলার কাঁটা হয়ে গেল। টিনশেড বাড়ির বিছানা থেকে গড়িয়ে পানিতে তলিয়ে গেছে একটা আড়াই বছরের মেয়ে। সেবার ওদের ঘরে খাট পর্যন্ত পানি উঠে গিয়েছিল সারা রাতের বৃষ্টিতে। দুপুরের একটু আগে ওর ফুলে ওঠা লাশ ভেসে ওঠে। তৎকালীন মেয়র সাহেব এসেছিলেন। আড়াই বছরের সেই শিশুর মা–বাবাকে ৩০ হাজার বা তার বেশি কিছু টাকা দেওয়া হয়েছিল। সন্তানহারা পিতা-মাতা তাই নিয়ে খুশি থেকেছেন।
রাতে ঝড় এলে এখন শুধু মনে হয়, মাঝনদীতে যে ফেরিটা আছে, তার কী হবে। আমার স্বজনেরা সব ঘরে তো? ঝিনাইদহে আমার শ্বশুরবাড়ির বরইগাছটা ভেঙে পড়বে না তো? কিংবা পান্থপথ সিগন্যালে ওয়েলফুডের নিচে যে রিকশাওয়ালা বা ভাসমান মানুষ ঘুমান, তারা কোথায় যাবে এই ঝড়ের রাতে? আমি খুব নিরাপদে নিজের ঘরের জানালা বন্ধ করতে করতে ভাবি কোথায় ঘুমাবে এরা।
আগে ভাবতাম, শুধু বাংলাদেশেই আছে এসব ভাসমান মানুষ। শুধু আমাদের দেশের স্টেশনগুলোতেই ঘুমায় ঘরহীন মানুষ। ইউরোপ আমার সেই ধারণা বদলে দিয়েছে। কোথাও তুষার ঝড়ের প্রকোপ দেখলে জার্মানির বন শহরের প্লিটার্সডর্ফ মেট্রো স্টেশনের সেই বুড়িটার কথা মনে পড়ে আমার। প্রায়ই স্টেশনের বাইরে ঘুরে বেড়ায় সে। আচ্ছা, সে ঠিক আছে তো? কিংবা ১৯–২০ বছর বয়সী সেই কুকুরওয়ালা মেয়েটা, যার মাত্র একটা ওভারকোট ছিল। ঘুমন্ত ওর পাশে একটা ওভারকোট রেখে এসেছিলাম। ও পেয়েছিল তো?
তবু দিন শেষে রোমান্টিক বাঙালি হিসেবে আমরা সব দুর্যোগ, দুঃসময় টপকে ঝড়বৃষ্টির আভাস পেলেই এক কাপ চা বানিয়ে চালে-ডালে খিচুড়ি বসিয়ে দিই চুলায়। আর গুনগুন করে করি ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরও দিনে।’
ও হ্যাঁ, ঝড়বৃষ্টি হলেই আমার অনেক বেশি রসুন আর মরিচকুচি দিয়ে চালভাজা খেতে ইচ্ছা করে। নানুবাড়িতে অনেক বৃষ্টির মধ্যে আমার নানি বানিয়ে দিয়েছিলেন। এখনো স্বাদ মুখে লেগে আছে।