তসলিমা নাসরিন বললেন, মনে হচ্ছে নতুন করে হাঁটতে শিখছি

অপারেশনের পর নতুন করে হাঁটতে শিখছেন তসলিমা নাসরিন
ছবি: লেখকের ফেসবুক থেকে

‘মনে হচ্ছে, নতুন করে হাঁটতে শিখছি।’ দিল্লির হাসপাতালে তাঁর অস্ত্রোপচারের পর তসলিমা শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, তিনি আর কোনো দিনও হয়তো হাঁটতে পারবেন না। সর্বশেষ খবর, তিনি আস্তে আস্তে হাঁটতে পারছেন।

সফেদ দেয়াল। ইয়োলা ফ্রেমে ঝুলছে ধূসর রবীন্দ্রনাথ। পাশে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল তসলিমা নাসরিন। এ রকম একটা ছবি ২ এপ্রিল লেখক তসলিমা নাসরিন তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রকাশ করেছেন। ছবির ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন, ‘মনে হচ্ছে নতুন করে হাঁটতে শিখছি।’

এই ফেসবুক পোস্টের পরম্পরা জানতে চাইলে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। গত ২০ জানুয়ারি তসলিমা নাসরিন ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘কিন্তু আপাতত বেঁচে তো আছি। এ-ইবা কম কিসে!’ ওই ফেসবুক পোস্ট পড়ে জানা যায়, হোঁচট খেয়ে পড়ে হাঁটুতে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন লেখক। তাঁর অভিযোগ, চিকিৎসকেরা ঠিকমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই একটি এক্স-রের ভিত্তিতে বলে দিয়েছিলেন তাঁর হিপ ভেঙেছে, হিপ রিপ্লেসমেন্ট করতে হবে। এরপর তড়িঘড়ি করে টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট করে দেন চিকিৎসক। এখন তাঁর হিপ জয়েন্ট আর ফিমার গেছে চিরতরে, জীবন আর আগের জীবন নেই, চলাফেরা শ্লথ হবে যদি কোনো দিন হাঁটতে পারেন, স্থবির জীবনে অজস্র রোগশোকে আক্রান্ত হবেন।

দিল্লির হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর তাঁর ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তোলেন তসলিমা। একই অভিযোগ তিনি ৩০ মার্চ ২০২৩ আবারও তুলেছেন। তসলিমা নাসরিন তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইল আবারও লেখেন, ‘বড় প্রাইভেট হাসপাতালগুলোয় যে টার্গেট মার্কেট চলে, আমার জানা ছিল না। আমার জানা ছিল না যে হাসপাতালের পরিচালকেরা ডাক্তারদের আগেই টার্গেট দিয়ে দেন যে এতগুলো সার্জারি চাই মাসে, এতগুলো টেস্ট চাই, এত কোটি টাকা চাই। শুনেছি টার্গেট পূরণ করতে না পারলে ডাক্তারদের চাকরি থাকে না। শুনেছি, সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের চেয়ে প্রাইভেট হাসপাতালের ডাক্তারদের মাইনে কম, কিন্তু নানা রকম কমিশন এবং নানা পারসেন্টেজের হিসেবে মাসের শেষে টাকার পরিমাণ সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের চেয়ে প্রাইভেট হাসপাতালের ডাক্তারদের অনেক বেশি। বড় করপোরেট হাসপাতালে বসে মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জন করতে হলে কিছু রোগীকে রেভিনিউ টার্গেটের ভিকটিম বানাতে হয় ডাক্তারদের। দুর্ভাগ্য আমার, আমি ...নামের বড় এক করপোরেট হাসপাতালের টার্গেট মার্কেটের ভিকটিম হয়েছি।

‘আমার জানা ছিল না বড় প্রাইভেট হাসপাতালগুলোয় ম্যালপ্র্যাকটিসের ভিকটিমের সত্যিকারের টেস্ট রেজাল্ট, রোগীর সত্যিকারের হিস্ট্রি—সবকিছুকে লুকিয়ে ফেলে একরাশ মিথ্যে লিখে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। মেডিকেল ক্রাইম যেন ধরা না পড়ে সে জন্য এক্স-রে, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি জালিয়াতি করে বদলে দেওয়া বা ফেব্রিকেট করার ব্যবস্থা আছে আমার জানা ছিল না। আমার জানা ছিল না কোনো দামি ইমপ্ল্যান্টের কথা বলে সস্তা ইমপ্ল্যান্ট শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলে এখানে। দুর্ভাগ্য আমার, আমি বড় এক প্রাইভেট হাসপাতালে ভয়ংকর এক চক্রান্তের শিকার হয়েছি।

‘ধীরে ধীরে আমি জেনেছি, যে রোগ আমার কোনোকালেই ছিল না, যে রোগ আমার ধারেকাছে কোনো দিন ঘেঁষেনি, যে রোগ আমার নেই, যে রোগ আমার হবে না, সেই রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে আমাকে ভুল বুঝিয়ে, মিথ্যে বলে, ফাঁকি দিয়ে, চক্রান্ত করে। এক লোভী এবং অসৎ সার্জন আত্মীয়-পরিজনহীন একা আমাকে আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই চটজলদি আমার সুস্থ শরীর থেকে শরীরের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অংশ কেটে ফেলে দিয়ে আমার রোগশোকহীন স্বনির্ভর জীবনের চিরসমাপ্তি ঘটিয়ে দিয়েছে। কেউ আমার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করার আগে, শুভাকাঙ্ক্ষীরা কেউ ভিজিট করার আগে, এক্স-রে রিপোর্ট আমি দেখার আগে, সিটি স্ক্যান রিপোর্ট হাতে আসার আগে লোকটি এই দুষ্কর্মটি করেছে, যেন টার্গেট পূরণ করার সুযোগ হাত ফসকে বেরিয়ে না যায়।...

‘আমার দুঃখ এই, আমার যা বয়স ছিল, সেই বয়সকে তিরিশ বছর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, অন্যভাবে আমার জীবনের আয়ু করপোরেট ক্রিমিনালরা তিরিশ বছর কেড়ে নিয়েছে। যে জীবন আমি যাপন করতে বাধ্য হচ্ছি, সেটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত জীবন।’

তসলিমা এই পোস্টে নিউদিল্লির এক বড় হাসপাতাল এবং একজন সার্জনের নাম উল্লেখ করেন।

তসলিমা যখন হাসপাতালে ছিলেন
ছবি: সংগৃহীত

যা বললেন ডা. আব্দুন নূর তুষার

২০ জানুয়ারি তসলিমা নাসরিনের পোস্টের পর ডা. আব্দুন নূর তুষার নিজের ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘তিনি (তসলিমা নাসরিন) নিজে ভুল বা ইচ্ছাকৃত অতিচিকিৎসার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। ঘটনা ভারতে। তিনি পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়ে ডাক্তার দেখাতে গেলে তাকে ডাক্তার ফিমার ফ্র্যাকচার হয়েছে এই কথা বলে হিপ রিপ্লেস করে দিয়েছেন।

‘এখন তিনি বলছেন, এটা দরকার ছিল না। তিনি নাকি নিজের এক্স–রেটাও সার্জারির আগে দেখেন নাই। এখন দেখে বুঝতে পেরেছেন তার কোনো রকম সার্জারির দরকার ছিল না।

এবারও তস্কর য পলায়তি, বুদ্ধি ত আগমতি।

১. তিনি কি সার্জারির আগে অনুমতিপত্র বা কনসেন্ট ফর্মে সই করেননি? কী দেখে করলেন?

২. হিপ কি হাসপাতালে মজুত থাকে? টাকা ছাড়াই আগে লাগিয়ে দেয় আর পরে টাকা নেয়? মোটেও না। হিপ কিনে এনে দিতে হয়। টাকা আগে না দিলে এটা প‍্যাকেট থেকে বেরই করবে না। উনি তাহলে না জেনেই ও অনিচ্ছাকৃতভাবে টাকা দিলেন?

৩. ফেসবুকের পাশাপাশি উনি আইনি লড়াই কেন করছেন না?

৪. একজন ডাক্তার কী করে নিজের বিষয়ে একটা এক্স–রে পর্যন্ত না দেখে একটা সার্জারি করতে দেন?

৫. লিখেছে বাংলাদেশের রোগী। এ কথা বলে তিনি কি বোঝালেন যে ভারতীয় ডাক্তাররা বাংলাদেশের রোগীদের এভাবেই চোষে ও ভুলভাল কাজ করে অতিরিক্ত বিল নেয়?

নাকি উনি নিজেই বাংলাদেশের বহু বুদ্ধু রোগীর মতো ভারতের ডাক্তারদের ওপর অন্ধবিশ্বাসে; কিছু না দেখেই সার্জারিতে রাজি হয়ে গেলেন?

৬. এই ঘটনার তদন্ত করে হাসপাতালের ও ডাক্তারের দোষ থাকলে সেটার বিচার দরকার।

সমস‍্যা হলো তসলিমা হাসপাতাল ও ডাক্তার কারও নাম বলেন নাই। অন‍্য সকল ক্ষেত্রে তিনি নাম বলে দিলেও এখানে নাম না বলার কারণ কী?

এই ডাক্তার কে আমাদের দূতাবাসের লোকজন দিয়ে খুঁজে বের করে দেখা উচিত; তসলিমার প্রতি এই আচরণের কারণ কী?

তবে হিপ রিপ্লেস করলে কেউ পঙ্গু হয় না। এটা একটি ভুল তথ‍্য দিয়েছেন তসলিমা।’

এসেছে তসলিমার ‘আত্মজীবনী’ অষ্টম খণ্ডের ঘোষণা

তসলিমা নাসরিন অসুস্থ শরীর নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বরাবরের মতো সরব রয়েছেন। এসেছে তাঁর ‘আত্মজীবনী’ অষ্টম খণ্ডের ঘোষণা। গত ৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘ভেবেছিলাম আত্মজীবনী যথেষ্ট লিখেছি, আর নয়। প্রকাশকের অনুরোধ বারবার উপেক্ষা করেছি। সপ্তম খণ্ডের পর আর লিখিনি। কিন্তু জীবনে যে বিপর্যয় ঘটে গেল, তাতে মনে হচ্ছে লিখতেই হবে অষ্টম খণ্ড। আত্মজীবনীর অষ্টম খণ্ডের নাম এখনই দিয়ে দিচ্ছি—‘দ্বিতীয় জীবন’।

অস্ত্রোপচারের পর ঘণ্টার ঘণ্টার বিছানায় শুয়ে থাকতে হচ্ছে লেখককে। লেখালেখিতে খুব একটা মন বসাতে পারছেন না। এখন তাসলিমার দিন কাটছে নানা ধরনের সিনেমা ও সিরিজ দেখে। গত ১৯ মার্চের পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘কাল রাতে “অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট” ছবিটা দেখছিলাম আর ভাবছিলাম ক্ষমতাসীনদের বিবেকহীনতা আর হিংস্রতার কারণে ইতিহাসের শুরু থেকে কত অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে! মানুষের বিশেষ করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের এক পয়সার মূল্য কখনো ছিল না। গরিবকে গরিবের বিরুদ্ধে চিরকালই লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘দেশপ্রেম’ নামের এক দুর্বোধ্য শব্দ উচ্চারণ করে ক্ষমতাসীনেরা গরিবদের বোকা বানাতেন। ক্ষুধার্ত পেটে দেশপ্রেম ধুয়ে খেতে হতো গরিবদের। যুদ্ধবাজ লোকেরা এই ছবিটি দেখার পর কি কিছুক্ষণের জন্য হলেও নির্বাক হন না?’

তসলিমা নাসরিন
ফাইল ছবি

এর মধ্যে বাংলা সাহিত্যের দুই কেন্দ্র ঢাকা ও কলকাতা দুই স্থান থেকেই তসলিমা নাসরিনের বই প্রকাশিত হয়েছে। দিল্লির নিস্তরঙ্গ জীবনে ঢাকার বই হাতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত তসলিমা ২১ মার্চের পোস্টে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ থেকে এবার আমার একটিই বই বেরিয়েছে, বইটি ছোটগল্পের বই। নাম “চুম্বন”। বইটি আজ প্রথম হাতে পেলাম। বইটি দেখতে ভালো। প্রচ্ছদ আরও ভালো হতে পারত, ভেতরের গেটআপ, মেকআপ আরও ভালো হতে পারত। ছাপা আরও ভালো হতে পারত। হ্যাঁ, পারত। কিন্তু তারপরও বইটি হাতে নিয়ে আমার ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে এই জন্য যে বইটি আমি যে দেশে যে সমাজে যে সাহিত্যজগতে অচ্ছুত, সেখান থেকে বেরিয়েছে। এক সাহসী প্রকাশক বুকের পাটা দেখিয়েছেন বটে...’

‘আমি কোথাও একা একা শেষনিশ্বাস ত্যাগ করব’

৪ এপ্রিল ২০২৩ ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখছেন, ‘আমি খুব ভালো জানি, আমি স্বজন বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে মরব না, আমি কোথাও একা একা শেষনিশ্বাস ত্যাগ করব। সেই জন্য কোনো দুঃখ নেই। মানুষ একা আসে, একা যায়। যতই ঘিরে থাকুক শুভাকাঙ্ক্ষীরা, কেউ সঙ্গে যায় না। মৃত্যু নিয়ে আমার কল্পনাবিলাস নেই। একে উদ্‌যাপন করার কোনো শখ আমার নেই। বিলাস বা শখ যা আছে, তা জীবন নিয়ে। জীবনের প্রতিটি দিন নিয়ে। যদিও দিনগুলো আঙুলের ফাঁক গলে ঝরে যাচ্ছে প্রতিদিন। জীবন বোধ হয় এমনই, একে নিয়ে ভাবি বা না ভাবি, এর মাথায় মুকুট পরাই বা একে পায়ের তলায় পিষি, এ ঝরবেই।’

তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি তাঁকে খুদে বার্তা পাঠান। তসলিমা তার জবাব দেননি।