অশ্রুসিক্ত ক্যামেরায় সম্ভ্রমহারার ছবি

গ্রাফিকস: প্রথম আলো
মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই ছবি অ্যারেঞ্জ করে তোলার প্রশ্নই আসে না। কারণ, বাস্তবে ভয়াবহতা ছিল আরও বেশি।
আলোকচিত্রী নাইব উদ্দিন

এলোমেলো চুল আর মুষ্টিবদ্ধ হাতে আড়াল করছেন নিজের মুখ। ওড়নাটা আছে মাথার ওপর ছাতার মতো। জানালার ফাঁক গলে আলো এসে পড়ছে শরীরে। ১৯৭১ সালের মে মাসের কোনো একদিনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাদাকালো ফিল্মে মুখঢাকা মেয়েটির কয়েকটি ছবি তুলেছিলেন নাইব উদ্দিন আহমেদ। কয়েক মাস পর এই সিরিজের একটি ছবি ছাপা হয় বিশ্ববিখ্যাত দৈনিক দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে। এই ছবি ছাপা হওয়ার পর সারা দুনিয়ায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। বিশ্ববাসী জানতে পারে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অসহায় নারীদের সম্ভ্রম হারানোর কথা। ছবিটি প্রকাশের কারণে জীবনঝুঁকিতে পড়েন নাইব উদ্দিন। এ ছবির নেগেটিভ কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি বলেননি সে কথা। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এ ছবি বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের প্রতীকী আলোকচিত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।

মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরও এখনো অনেকে বলাবলি করেন ছবিটি বানানো। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, ছবিটি মুক্তিযুদ্ধের পরে মডেল দিয়ে সাজিয়ে তোলা। অথচ এ ছবি নিয়ে জীবদ্দশাতেই বিস্তারিত বলে গেছেন নাইব উদ্দিন। ১৯৯৮ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রথম আলোর বুধবারের সাময়িকী নারীমঞ্চে ‘কীভাবে তোলা মুক্তিযুদ্ধের এই ছবি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। নাইব উদ্দিনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন প্রতিবেদক মেহেদী মাসুদ। নাইব উদ্দিনের কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ‘বহুল আলোচিত এই ছবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটা কথা শোনা যায়, অভিযোগও বলতে পারেন—ছবিটি নাকি অ্যারেঞ্জ করে তোলা। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?’ জবাবে নাইব উদ্দিন বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই ছবি অ্যারেঞ্জ করে তোলার প্রশ্নই আসে না। কারণ, বাস্তবে ভয়াবহতা ছিল আরও বেশি।’ মেহেদী মাসুদ মেয়েটির নাম জানতে চান। নাইব উদ্দিন নাম প্রকাশ করতে চাইলেন না। বললেন, ‘ধরে নিন না কোনো একটা নাম।’ তবে ছবিটি কেমন করে কিংবা কোন পরিস্থিতিতে তুলেছেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন।

এই ছবি ছাপা হওয়ার পর সারা দুনিয়ায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। বিশ্ববাসী জানতে পারে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অসহায় নারীদের সম্ভ্রম হারানোর কথা। ছবিটি প্রকাশের কারণে জীবনঝুঁকিতে পড়েন নাইব উদ্দিন।

নাইব উদ্দিন তখন ময়মনসিংহে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রধান আলোকচিত্রী। একাত্তরের ২৬ মার্চ এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘স্বাধীন বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে ঘোষণা করলেন উপাচার্য ড. কাজী ফজলুর রহীম। মুহূর্তে এ খবর পৌঁছে যায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। ২৬ এপ্রিল দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য আসে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকে তারা আঞ্চলিক কমান্ড হেড কোয়ার্টার ঘোষণা করে। তাদের সঙ্গে ভিড়ে যায় স্থানীয় বিহারিরা। ময়মনসিংহ শহরে তখন তিন লাখ বিহারির বসবাস ছিল। শহরে তাদের বড় কলোনিও ছিল। বিহারিদের সহযোগিতায় দখলদার বাহিনী শহরজুড়ে হত্যা, লুট, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে থাকে। তাদের তাণ্ডবে প্রাণের ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মচারীরা পালিয়ে যান। ক্লাস বন্ধ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজ চালিয়ে রাখার জন্য তারা বিহারিদের মাধ্যমে আশপাশের গ্রামে আশ্রয় নেওয়া প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের কথায় অনেকেই কাজে এসে যোগ দেন। তাঁদের বেশির ভাগ বিশ্বাস করতেন, পাকিস্তানিরা তাঁদের ভাই, ওরা মুসলমানের কোনো ক্ষতি করবে না। এ রকম বিশ্বাসে তাঁরা নিয়মিত অফিস করতেন, ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠাতেন।

নাইব উদ্দিনের সঙ্গে একটি মেয়ের প্রায় রাস্তায় দেখা হয়। মেয়েটি একটু চঞ্চল স্বভাবের। বাবার সহকর্মী বলে স্নিগ্ধ মেয়েটি নাইব উদ্দিনকে ‘চাচা’ বলে ডাকতেন। একদিন সালাম দিতেই নাইব উদ্দিন মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সারা ক্যাম্পাসে এত এত সৈন্য ঘোরাফেরা করে, ওদের মধ্য দিয়ে কলেজে যেতে তোমার ভয় করে না?’ মেয়েটি বললেন, ‘ক্লাস হয় না, তবু বাবা জোর করে পাঠায়।’ আরেক দিন দেখা হতেই মেয়েটি বললেন, ‘চাচা, ব্রহ্মপুত্রের চরে সাদা কাশ ফুলে ভরে গেছে। সেখানে আমার একটা ছবি তুলে দেবেন?’ নাইব উদ্দিন বললেন, ‘অবশ্যই।’ মেয়েটি হাসতে হাসতে বললেন, ‘চাচা, সেদিন কিন্তু আমিও আপনাকে একটা গান শোনাব।’ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ—আমরা/ গেঁথেছি শেফালি-মালা’ গানের কলিটি গুনগুন করে গাইতে গাইতে মেয়েটি চলে গেল।

কয়েক দিন পরের ঘটনা। মেয়েটিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর হানাদারদের এক দোসর জানাল, পাকিস্তানি সৈন্যরা মেয়েটিকে ধরে নিয়ে গেছে। তার সহযোগিতায় ক্যাপ্টেন আনজুমের বাংকার থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করা হলো। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ভর্তি করা হলো ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শুনে নাইব উদ্দিনের মনটা ভার হয়ে গেল। তিনি মেয়েটিকে দেখতে হাসপাতালে গেলেন। বেডের সঙ্গে মেয়েটির হাত-পা বাঁধা। মাঝে মাঝে উন্মাদিনীর মতো ছটফটিয়ে ওঠে। মেয়েটির মা পাশেই দাঁড়ানো। তাঁর চোখে পানি। মেয়েটিকে দেখে নাইব উদ্দিনের কান্না পেয়ে যায়। হু হু করে কাঁদতে চান, কিন্তু পারেন না। ব্যথায় বুকটা ভার হয়ে আসে।

মেয়েটির মা বললেন, ‘ওর তো সবই গেছে, কিছুই আর বাকি নাই, কিন্তু ওর ছবি ছাপা হলে যদি অন্য মেয়েদের ওপর অত্যাচার বন্ধ হয়; তাহলে তা–ই করুন।’ ক্যামেরা তাক করতেই মেয়েটি দুই হাত আর চুল দিয়ে তাঁর মুখ ঢেকে ফেলেন।
মুখঢাকা মেয়েটি [ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মে ১৯৭১]। আলোকচিত্র: নাইব উদ্দিন আহমেদ
লেখকের সৌজন্যে

নাইব উদ্দিন মেয়েটির একটি ছবি তুলতে চাইলেন। মেয়েটির মা বাঁধা দিয়ে বললেন, ‘দয়া করে এ অবস্থায় ওর ছবি তুলবেন না।’ নাইব উদ্দিন তাঁর মাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘ওর ছবি আমি পত্রিকা অফিসে পাঠাব। এই ছবি ছাপা হলে পাকিস্তানিদের অত্যাচারের কাহিনি সবাই জানবে।’ নাইব উদ্দিনের কথা শুনে মেয়েটির মা বললেন, ‘ওর তো সবই গেছে, কিছুই আর বাকি নাই, কিন্তু ওর ছবি ছাপা হলে যদি অন্য মেয়েদের ওপর অত্যাচার বন্ধ হয়; তাহলে তা–ই করুন।’ তিনি মেয়ের হাতের বাঁধন খুলে দিলেন। ক্যামেরা তাক করতেই মেয়েটি দুই হাত আর চুল দিয়ে তাঁর মুখ ঢেকে ফেলেন। যেন কাউকে আর মুখ দেখাতে চান না; এই পৃথিবীর মানুষের ভিড় ছেড়ে পালাতে চাইছেন তিনি। রোলিফ্লেক্স ক্যামেরায় মেয়েটির এই ভঙ্গির কয়েকটি ছবি তুললেন নাইব উদ্দিন।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিনিধি তখন ময়মনসিংহে আসেন। নাইব উদ্দিন এই খবর পান তাঁর বন্ধু শিল্পী শাহতাবের (কর্নেল তাহেরের ভাগনে) কাছে। শাহতাবকে দিয়েই তিনি তাঁর ছবিটির একটি প্রিন্ট পাঠান ওই বিদেশি সাংবাদিকের কাছে। অনুরোধ করেন ছবিটি ছাপতে। ছবিতে যেন তাঁর নাম ব্যবহার না করা হয়, সে অনুরোধও করলেন। কিছুদিন পর ওয়াশিংটন পোস্টে ছাপা হয় ছবিটা। ছবিটা দেখে দুনিয়ার মানুষ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।

এদিকে রাগে গরগর করে উঠলেন হানাদাররা, ‘কে পাঠাল এই ছবি? কার এত বুকের পাটা?’ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্সের মেজর বুখারি ও মেজর কাইয়ুম এ ঘটনা তদন্ত করতে ময়মনসিংহে এলেন। ছবিতে আলোকচিত্র গ্রাহকের নাম না থাকলেও ইন্টেলিজেন্সের ওই দুই কর্মকর্তা নাইব উদ্দিনকেই সন্দেহ করেন। তাঁরা নিশ্চিত, এ রকম ছবি নাইব উদ্দিন ছাড়া ময়মনসিংহ শহরের আর কারও পক্ষে তোলা সম্ভব নয়। তাঁরা নাইব উদ্দিনের অফিস কক্ষে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। এরপর তাঁকে জিপে তুলে নেন। জিপটি গিয়ে থামে তাঁর বাসার সামনে। সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খোঁজেন; আসবাব তছনছ করেন। কিন্তু নেগেটিভটি খুঁজে না পাওয়ায় বেঁচে গেলেন নাইব উদ্দিন। যাওয়ার আগে শাসিয়ে গেলেন। এ ঘটনার পর নাইব উদ্দিন ক্যাম্পাস ছেড়ে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে চরহরিপুর গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখান থেকেই জীবনের মায়া তুচ্ছ করে পাকিস্তানি বর্বরতার চিত্র ধারণ করতে থাকেন তাঁর ক্যামেরার মায়াময় ফিতায়।

‘কে পাঠাল এই ছবি? কার এত বুকের পাটা?’ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্সের মেজর বুখারি ও মেজর কাইয়ুম এ ঘটনা তদন্ত করতে ময়মনসিংহে এলেন। আলোকচিত্রীর নাম না থাকলেও তারা নাইব উদ্দিনকেই সন্দেহ করেন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলো। মেয়েটির এক খালাতো ভাই তখন লন্ডনে থাকতেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য মা–বাবা ও আত্মীয়স্বজন মিলে মেয়েটিকে লন্ডনে পাঠান তাঁর সেই ভাইয়ের কাছে। সেখানকার চিকিৎসায় মেয়েটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন। পরে এই ভাইয়ের সঙ্গেই তাঁর বিয়ে হয়। প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাইব উদ্দিন বলেছিলেন, তিনি শুনেছেন মেয়েটির দাম্পত্য জীবন বেশ সুখের হয়েছিল। দুটি সন্তানের মা হয়েছিলেন। স্বাধীন দেশে আর কখনো ফিরে আসেননি মেয়েটি।

দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক পূর্বদেশ স্বাধীনতা সংখ্যা প্রকাশ করে। সেই সংখ্যার প্রচ্ছদে নাইব উদ্দিনের এই ছবিসহ চারটি ছবি ছাপা হয়। ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলার বিজয় দিবস সংখ্যায় ‘ভুলি নাই’ শিরোনামে যে দৃশ্য-গল্প ছাপা হয়, সেই গল্পের ওপরের দিকেও ডিসপ্লে করা হয় ছবিটি। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলার স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায়ও ‘একাত্তরের সেই দিনে’ ক্যাপশন দিয়ে ছবিটি প্রকাশ করা হয়। কোথাও মেয়েটির নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেননি নাইব উদ্দিন। মৃত্যুর ২০ দিন আগে ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় নাইব উদ্দিনের ফটো অ্যালবাম ‘আমার বাংলা’। সেই অ্যালবামের অজেয় বাংলা অধ্যায়ে নাইব উদ্দিন লিখেছেন, ‘শাহানার কথা মনে হলে এখনো নিজেকে স্থির রাখতে পারি না। হাসপাতালে শাহানার অসহায় চিৎকার এখনো কানের দেয়ালে বাড়ি মারে।’

আরেকটি ছবি নাইব উদ্দিনের শিল্পীহৃদয়কে বিচলিত করে তোলে। সম্ভ্রম হারানো এক অসহায় বাঙালি নারীর মর্মস্পর্শী ছবিটিই তাঁর সৃজনশীল আলোকচিত্রীজীবনের শেষ নিদর্শন। এরপর প্রিয় রোলিফ্লেক্স হাতে তিনি মাঝেমধ্যে ছবি তুলতে বের হয়েছেন। কিন্তু আগের মতো আর ছবি তুলতে পারেননি। সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে যখন এই ছবির প্রসঙ্গ আসত, তখন তাঁর ব্যথাতুর চোখ নোনা হয়ে যেত। বিড়বিড় করে বলতে থাকতেন, ‘কী বীভৎস, কী বীভৎস কাজ করেছে হানাদার বাহিনী, অথচ দেশের মানুষ সব ভুলে গেছে!’

নির্যাতিতা নারী [বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ, ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১]। আলোকচিত্র: নাইব উদ্দিন আহমেদ
লেখকের সৌজন্যে
কী বীভৎস, কী বীভৎস কাজ করেছে হানাদার বাহিনী, অথচ দেশের মানুষ সব ভুলে গেছে!
আলোকচিত্রী নাইব উদ্দিন

প্রথম আলোর নারীমঞ্চের সাক্ষাৎকারেও এ ছবির কথা বিস্তারিত বলেছেন নাইব উদ্দিন। একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সারা দিন হানাদারদের যুদ্ধ চলল। বিকেল চারটায় যুদ্ধে হেরে গিয়ে হানাদাররা লেজ গুটিয়ে পালাল। বিজয়ের আনন্দে মিত্রবাহিনী আর মুক্তিসংগ্রামীরা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ওড়াল বাংলাদেশের পতাকা। এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সনৎ সিংয়ের নেতৃত্বে শুরু হলো উদ্ধার অভিযান। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তীর্ণ এলাকার বিভিন্ন বাংকার থেকে ১৫ জন নির্যাতিতা মেয়েকে উদ্ধার করা হলো। পরদিন সকালে ক্যামেরা হাতে বের হন নাইব উদ্দিন। বধ্যভূমির পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেই শুনতে পান, ‘ছেলেপেলেরা বলছে—দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে; আপনারা ভেতর থেকে বের হয়ে আসেন। কয়েকজন নারী মুখ ঢেকে এদিক-ওদিক দৌড়ে চলে গেলেন। একটি মেয়ে উপুড় হয়ে বাংকার থেকে বের হলেন। তাঁর গায়ে সামান্য কাপড়। মেয়েটি হাঁটতে পারছেন না। একটু সামনে গিয়ে একটা লাইটপোস্টের কাছে গিয়ে বসে পড়লেন। একটি ভাঙা পিলারে ঠেস দিয়ে ওপরের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলেন। সূর্যের আলো তাঁর মুখে এসে পড়ছে। কিন্তু মেয়েটি কোনোভাবেই তাকাতে পারছেন না। ক্লান্তিতে তাঁর চোখ বুজে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

নাইব উদ্দিন মেয়েটির কাছে গিয়ে তাঁর পেটিকোটের ফিতাটি বেঁধে দিলেন। মেয়েটি বুঝতে পারলেন কেউ একজন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটি কোনো কথা বললেন না, শুধু মাথাটি নুইয়ে রাখলেন। তাঁর হাতে-শরীরে নখের আঁচড়। নাইব উদ্দিন মেয়েটির কয়েকটি ছবি তুললেন। দূর থেকে ব্যাপারটা খেয়াল করলেন কয়েকজন ভারতীয় সৈন্য। তাঁরা দৌড়ে এসে বললেন, ‘আরে, আপনি করছেন কী...!’ ছবি তুলতেও বাধা দিলেন। এরই মধ্যে একজন সৈন্য এলেন একটা কম্বল নিয়ে। মেয়েটিকে কম্বল পেঁচিয়ে ট্রাকে তোলা হলো।

আরও পড়ুন

বছর দুয়েক পরের ঘটনা। একদিন সকালে একটি অপরিচিত মেয়ে নাইব উদ্দিনের সরকারি বাসায় আসেন। পোশাক-আশাক দেখে তিনি বুঝলেন, মেয়েটি সনাতন ধর্মের। দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে মেয়েটি বললেন, ‘আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’ নাইব উদ্দিন মাথা নাড়লেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেয়েটি বললেন, ‘অনেকের কাছে খোঁজ নিয়ে আপনার ঠিকানা পেয়েছি।’ ওই দিনের ঘটনাটাও মনে করিয়ে দিলেন। বললেন, ‘কয়েক মাস আগে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছি। স্বামী আমাকে ঘরে তুলে নেয়। কিন্তু এটা আমাদের সমাজের লোকেরাই বিষয়টাকে ভালোভাবে নেয় নাই। তাই আমরা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যাবার আগে মনে হলো, আপনাকে বলে যাই।’

সমাজচ্যুত মেয়েটির মুখের দিকে পাথরের মতো নিশ্চল তাকিয়ে রইলেন নাইব উদ্দিন।