আজ ভাষাসংগ্রামী তোফাজ্জল হোসেনের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে শ্রদ্ধা।
তোফাজ্জল হোসেন, নামটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হাসান হাফিজুর রহমানের ‘একুশের সংকলন’–এর মাধ্যমে। ওই সংকলনে তাঁর একটি গান ছিল। সংকলনটি ছাপার ইতিবৃত্ত, এর উপস্থাপনশৈলী—সবটা মিলিয়ে যে দুঃসাহসিকতা, তা ষাটের দশকের তরুণদের রোমান্টিক করত।
ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার সমাজ-রাজনীতিতে আসলে তিনটি সমান্তরাল ধারা চলছিল। সবচেয়ে বেগবান ছিল ছয় দফা ঘোষণার সমকালীন জাতীয়তাবাদী ধারা। তরুণদের অংশগ্রহণ তাতে অবিশ্বাস্য গতিতে বাড়ছিল। এর বিপরীতে ছিল ক্ষীয়মাণ পাকিস্তানি ধারা। এই ধারার কারিগরেরা তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য নানা পন্থার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিল। এনএসএফ-এর দৌরাত্ম্য তখন চ্যালেঞ্জের মুখে। তৃতীয় ধারাটি ছিল বামপন্থী, তবে তখন তারা জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে একত্রে চলছিল।
সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বেশ কয়েকটি সংস্থা গড়ে তুলেছিল। এর মধ্যে পরিপক্ব সাহিত্যিকদের জন্য ছিল পাকিস্তান লেখক সংঘ। কেন্দ্রে এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, কুদরতউল্লাহ শাহাব প্রমুখ; পূর্বাঞ্চলে মুনীর চৌধুরীরা। দ্বিতীয় সংস্থাটি ছিল জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো বা বিএনআর, এর পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক হাসান জামান; উপপরিচালকদের একজন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। ১৯৬৭-৬৮ সালের দিকে বিএনআর তরুণ লেখকদের বই ছাপার এক প্রকল্প নিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি তাহজিব তমদ্দুনের প্রসার। আমাদের পরিচিত বেশ কয়েকজন তাতে ছড়া-কবিতার বই জমা দিয়ে এক হাজার টাকা করে পেয়েছিলেন। সে সময়ে পরিমাণটা ছিল রীতিমতো চমকে ওঠার মতো।
সে সময়েই পাকিস্তান কাউন্সিল—পুরো নাম পাকিস্তান ফর ন্যাশনাল ইনট্রিগেশন, তরুণ সাহিত্যিকদের জন্য সাহিত্যসভার আয়োজন করে। মতিঝিল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে আমাদের জ্যেষ্ঠ ছাত্র সালেহ আহমদের আগ্রহে আবু হোসেন, ফজলে বারী ও আমি তাতে যোগ দিই। সাহিত্যসভার নামটিতে ‘সংহতি’র সংযুক্তি ছিল, পুরো নাম ভুলে গেছি। প্রথম তিনটি সভায় সভাপতি ছিলেন কবি জসীমউদ্দীন, বিচারপতি আবদুল মওদুদ ও কবি হাবীবুর রহমান। সঙ্গে সাংস্কৃতিক আয়োজন থাকত। তাতে একবার গান গাইলেন জারিকা জোয়ারদার, একবার নাচলেন সম্ভবত লুবনা মরিয়ম। প্রেসক্লাবের উল্টো দিকের পাঁচতলা ভবনের দুটি তলা ছিল পাকিস্তান কাউন্সিলের। তার দোতলার হলে বসত এই সাহিত্যসভা। ভালো গল্প-কবিতার জন্য পুরস্কার দেওয়া হতো। তবে উপস্থিত সবার জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল বাড়তি পাওনা।
সেই পাকিস্তান কাউন্সিলের কোনার একটা ঘরে বসে আছেন তোফাজ্জল হোসেন, রেসিডেন্ট ডিরেক্টর। দেয়ালে কয়েকটা রুচিশীল পোস্টার। তখনো জানতাম না তিনি আর ‘একুশে সংকলন’–এর ওই গীতিকার একই মানুষ। কয়েকটি সাহিত্যসভায় যোগ দেওয়ার পরই আমি জড়িয়ে পড়লাম খেলাঘরের লেখালেখি আর সাংগঠনিক কাজের সঙ্গে। এর মধ্যে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিএনআর পাকিস্তান কাউন্সিল, ইসলামিক একাডেমির সবুজ পাতা, দৈনিক পাকিস্তান—সবই পড়ল মিছিলের বিপরীত স্রোতে। পাকিস্তানি তাহজিদ-তমদ্দুন সংহতির বিরুদ্ধে সৃষ্টিশীল তরুণদের উচ্চকণ্ঠ হতে দেরি হলো না। সংবাদ-এর খেলাঘর আর পূর্বদেশ–এর চাঁদের হাটের পাতা তাতে সামনের সারিতে। উনসত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারির সংকলনগুলোতে তমদ্দুন-সংস্কৃতির সমাধি হয়ে গেল। এর চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটল আখতার হুসেন ও আবু সালেহ সম্পাদিত ‘চিচিং ফাঁক’ সংকলনে। বিএনআর-এ বোমা পড়ল। তখন শুনেছিলাম যে ওই বোমা মারার দলের কয়েকজন আশ্রয় নিয়েছে পাকিস্তান কাউন্সিল কার্যালয়ের আশপাশে এবং তোফাজ্জল হোসেন তাঁদেরকে বিপদ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান কাউন্সিল রূপান্তরিত হয় বাংলাদেশ পরিষদে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ সংস্থার নামে পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশ পরিষদ নতুন করে কার্যকলাপ শুরু করে। এ সময় তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ হয় অন্য সূত্রে। কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের বেশ কিছু সাহিত্যসভা ও সাংগঠনিক সভা হয় বাংলাদেশ পরিষদ মিলনায়তনে। তবে ১৯৭৩–পরবর্তী পটভূমিতে বাংলাদেশ পরিষদ একীভূত হয় তৎকালীন পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে। সম্পাদক সত্তর দশকের শেষ দিকে তোফাজ্জল হোসেন ফিরে যান তথ্য মন্ত্রণালয়ে।
সেই বিরূপ পরিস্থিতিতে তোফাজ্জল হোসেন তাঁর তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার সিলমোহর পকেটে করে এনে প্রতি সন্ধ্যায় বিসিএস অফিসে বসে শত শত ব্যালট পেপার সত্যায়ন করেছিলেন। বর্তমান অবস্থায় ওই প্রতিকূলতার মধ্যে তোফাজ্জল হোসেনের কাজটি যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তা বোঝা দুরূহ।
সে সময়ে আমি বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ি। সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহমদ হোসেন অ্যাডভোকেট হলেও আদালতপাড়ায় তাঁর সক্রিয়তা ছিল কম। তাঁর মূল অবস্থান ছিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক জগতে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির সভাগুলো বেশির ভাগ হতো বাংলাদেশ পরিষদ মিলনায়তনে। তোফাজ্জল হোসেনই ওগুলো গুছিয়ে দিতেন। পরে জেনেছি যে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি করার কাগজপত্র সৈয়দ আহমদ হোসেনকে দিয়েছিলেন তোফাজ্জল হোসেনই। জাতিসংঘ সমিতির প্রথম কমিটিতে এর সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্যও ছিলেন তিনি।
অবসর গ্রহণের পর তোফাজ্জল হোসেন সমিতিতে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা নেন। তখন এবং এখনো, সমিতি থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে পুস্তিকা প্রকাশ করা হতো। একসময় জাতিসংঘ নিজেও এ ধরনের প্রচুর পুস্তিকা মুদ্রণ করে বিতরণ করত। ইংরেজি থেকে সেগুলোর মূলভাব নিয়ে বাংলায় আমরা নানা পুস্তিকা প্রকাশ করতাম।
এ দলে মূলত কাজ করতেন কলাম লেখক এ জেড এম আবদুল আলী, তোফাজ্জল হোসেন, অধ্যাপক ও কবি মুহম্মদ সামাদ, নাট্যকার অধ্যাপক আবদুল সেলিম ও আমি। সৈয়দ আহমদ হোসেনের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির মহাসচিবের দায়িত্ব (২০০২) আমার ওপর অর্পিত হয়। তোফাজ্জল হোসেন সমিতির সহসভাপতি নির্বাচিত হন। সমিতির সভা, বিশেষত সাংগঠনিক সভাগুলোতে তিনি অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা নিতেন। একবার সমিতির গঠনতন্ত্র হালনাগাদ করেছিলেন প্রচণ্ড পরিশ্রম করে। শেষ দিকে অসুস্থতার মধ্যেও সভায় আসতেন। দুবার ভারতবর্ষে গিয়েছিলেন জাতিসংঘ সমিতির প্রতিনিধি দ্বারা সদস্য হয়ে।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এ দেশের পাকিস্তান–যাত্রার পথে প্রথম প্রতিবাদ গড়ে উঠেছিল সাংস্কৃতিক মহলে। বঙ্গবন্ধুর প্রথম আনুষ্ঠানিক শোক প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে। এর বছর দেড়েক পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন হয়। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের পক্ষে এর জন্য যে প্যানেল তৈরি করা হয়, তাতে নেতৃত্ব দেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছোট পুত্র মুহম্মদ সফিয়ুল্ল্যাহ ও মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান। খান বাহাদুর আবদুল হাকিম ও আবুল কাসেম এফসিএ প্রমুখ এর একটা সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছিলেন। প্যানেলে কর্নেল (অব.) শওকত আলী, অধ্যাপক পান্না কায়সার, অ্যাডভোকেট আমিনুল হক, শহিদ আসাদের ভাই প্রকৌশলী রশীদ, বর্তমানে সংসদ সদস্য ফিরোজ রশীদ প্রমুখ খুবই আগ্রহ নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন। আবার এর ১০ জনের মতো প্রার্থী ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি মনোনীত। এর পুরো সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল অধ্যাপক ম আখতারুজ্জামান ও অ্যাডভোকেট সৈয়দ আহমদ হোসেনের নেতৃত্বে। ৫৫ দিলকুশায় বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিসের কার্যালয়ের অঘোষিত দপ্তর। বামপন্থী নেতা কালীরঞ্জন শীল ও আমি ছিলাম এ দপ্তরের অঘোষিত সমন্বয়ক। নির্বাচনের আগে কয়েক শ ব্যালট আমরা সংগ্রহ করি। কারণ, এসব ব্যালটের স্বত্বাধিকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবনে ব্যালট জমা দেওয়ার ঝামেলা করতে চাচ্ছিলেন না। তখনো সিনেট নির্বাচনে সরাসরি ভোট দিতে হতো না।
কিন্তু এসব ব্যালট জমা দেওয়ার আগে একজন গেজেটেড অফিসারের সত্যায়ন অপরিহার্য ছিল। অথচ তখন কোনো কর্মকর্তা এসব ব্যালটের সত্যায়ন করতে রাজি হচ্ছিলেন না। সেই বিরূপ পরিস্থিতিতে তোফাজ্জল হোসেন তাঁর তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার সিলমোহর পকেটে করে এনে প্রতি সন্ধ্যায় বিসিএস অফিসে বসে শত শত ব্যালট পেপার সত্যায়ন করেছিলেন। বর্তমান অবস্থায় ওই প্রতিকূলতার মধ্যে তোফাজ্জল হোসেনের কাজটি যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তা বোঝা দুরূহ। সে নির্বাচনে উল্লিখিত প্যানেল জয়লাভ করেছিল ৪-১ অনুপাতে। মির্জা গোলাম হাফিজের নেতৃত্বাধীন প্যানেলকে হারিয়ে।
১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ঢাকায় ফিরে এলে তাঁর চারদিকে বন্ধুমহল আড্ডায় মেতে ওঠে। তাঁদের মধ্যে আমি নতুন করে তোফাজ্জল হোসেনকে খুঁজে পাই। তিনি আমারও তোফাজ্জল ভাইয়ে পরিণত হন। ক্রমে সে সম্পর্কের সম্প্রসারণ ঘটল তাঁর পরিবারের মধ্যে; বিশেষ করে তাঁর বড় ছেলে আরিফ ও মেজ ছেলে তারিকের মাধ্যমে। তাঁদের মধ্য দিয়েই তোফাজ্জল ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখনো বহমান।