রানা নাগ: আমার কান্না শুনে জন্মেছিল যে...

২২ মার্চ মারা গেছেন কবি রানা নাগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কবিতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরব ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক জানিয়েছেন অনেকেই। মৃত্যুর আগের বেশ কয়েক দিন অসুস্থ হয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন রানা নাগ। ১০ মার্চ ফেসবুকে তাঁর শেষ স্ট্যাটাস ছিল, ‘আমার নিজের জন্য বি পজেটিভ রক্তের দরকার।’ তো সেই রানা নাগ মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন? তাঁর ছোটবেলার বন্ধু রুবাইয়াৎ আহমেদের এ লেখায় ধরা আছে তার টুকরো–ছবি।

রানা নাগ
ছবি: সংগৃহীত

আমার বন্ধু রানা নাগ, জন্মেছি একই শহরে, প্রায় পাশাপাশি বাড়িতে। দুজনই নানাবাড়িতে। জন্মলগ্নের ব্যবধান ২৪ ঘণ্টার মতো। আমার ১ জানুয়ারি আর ওর ২ জানুয়ারি। এই তো এবারও জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বলেছি, ‘আমার কান্নার ধ্বনি শুনে জন্ম নিয়েছিল যে...’

অমল ধবল শৈশবে আমরা স্কুলে পড়েছি একই সঙ্গে, নেত্রকোনা জেলার সবচেয়ে নামকরা স্কুল আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। সাদা শার্ট, খাকি প্যান্ট, সাদা জুতা। পিঠে ঝোলানো ব্যাগ। আমাদের প্রত্যেকের দৃশ্যচিত্র। আমরা পরবর্তী সময়ে শহর পেঁচিয়ে যাওয়া অপূর্ব মগড়া নদীর ওইপাশে নাগড়ায় পাড়ি জমাই। বর্ষায় খেয়া পারাপার আর শীতে বাঁশের সাঁকো মাড়িয়ে যে পথ দিয়ে স্কুলে যাওয়া, তার পাশেই রানাদের বাড়ি। কত কত দিন যাওয়া কিংবা আসার সময় ‘রানা, রানা’ বলে চিৎকার। কখনো হয়তো সাড়া মিলত, কখনো মেলেনি। তাতে ডাকাডাকি কমেনি।

রানা মেধাবী ছাত্র ছিল। স্কুলের পরীক্ষায় সব সময় ওপরের দিকেই থাকত ওর ফল। হাতের লেখায় যেন মুক্তো ঝরত। সম্ভবত আমাদের ক্লাসের সবচেয়েয়ে সুন্দর হস্তাক্ষর ছিল ওরই। নাদুসনুদুস ছিল বলে ওর চেহারা ছিল আদুরে, বেশ মায়াভরা। আমরা মাঝেমধ্যে খ্যাপাতাম মোটু-মোটু বলে। কখনো হেসে উড়িয়ে দিত আবার কখনো তেড়েও আসত। খুব ডানপিটে ছিল না কখনোই।

কলেজশিক্ষক বাবা আর গৃহিণী মা ওকে সব সময় চোখে চোখে রাখত, যত্ন করত। আর একটি ভাই থাকার পরও প্রথম সন্তান কিংবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, তাঁদের কাছে রানার আদর ছিল খানিক বেশি। সে কারণে মায়ের শঙ্কাতুর আঁচলের নিচে থেকে দুই বাড়ি দূরত্বে নদী থাকার পরও সাঁতার শেখা হয়নি রানার। সেই ধারাবাহিকতায় তার ছোট ভাইটিরও।

একটি সাইকেল ছিল রানার। শৈশবে আমাদের প্রায় সবারই স্বপ্নের সাইকেল ছিল চায়না মেড ফিনিক্স সাইকেল। সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে, সেই সাইকেল যখন রানার ঘর উজ্জ্বল করে এল, খানিক ঈর্ষা তৈরি হয়েছিল বটে, তবে সেই সঙ্গে ওই সাইকেলে আমিও চড়তে পারব ভেবে আনন্দও হয়েছিল। কত কত দিন সেই সাইকেল নিয়ে নেত্রকোনার অলিগলি, শহর ছাড়িয়ে মেঠো পথে হারিয়ে গিয়েছি, হিসাব জানা নেই। রানার বাবা আমার দেখা সেরা শিক্ষকদের একজন। তাঁর কাছে রানার পাশে বসে পাঠ নিয়েছি বহু–বহুদিন। এই পরিবার শৈশব থেকেই আমাকে তাঁদের আরেক সন্তানরূপে গণ্য করত। ভিন্ন ধর্মীয় পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার পরও তা বাদ সাধেনি কখনো। মাধ্যমিক পরীক্ষার ঠিক দুই মাস আগে আকস্মাৎ পিতৃহারা হলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে চাইলে, যাঁদের প্রেরণায় পরীক্ষার হলে প্রবেশ করি, তাঁদের মধ্যে রানার পরিবারও ছিল। রানা আর আমি ওর মায়ের দেওয়া একই ছাপের শার্ট পরে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি।

উচ্চমাধ্যমিকে রানা চলে গেল ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। আমি ভর্তি হলাম নেত্রকোনা সরকারি কলেজে। তখন থেকে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ কমে যেতে থাকে। ছুটিছাটায়, ঈদ, পূজা–পার্বণে দেখা, আড্ডা। সেই একই অপরিবর্তিত রানা। চিকিৎসক হতে চেয়েছিল সে। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর রানা ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগে আর আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে।

রানা মেধাবী ছাত্র ছিল। স্কুলের পরীক্ষায় সব সময় ওপরের দিকেই থাকত ওর ফল। হাতের লেখায় যেন মুক্তো ঝরত। সম্ভবত আমাদের ক্লাসের সবচেয়েয়ে সুন্দর হস্তাক্ষর ছিল ওরই। নাদুসনুদুস ছিল বলে ওর চেহারা ছিল আদুরে, বেশ মায়াভরা। আমরা মাঝেমধ্যে খ্যাপাতাম মোটু–মোটু বলে। কখনো হেসে উড়িয়ে দিত আবার কখনো তেড়েও আসত। খুব ডানপিটে ছিল না কখনোই। কলেজশিক্ষক বাবা আর গৃহিণী মা ওকে সব সময় চোখে চোখে রাখত, যত্ন করত। আর একটি ভাই থাকার পরও প্রথম সন্তান কিংবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, তাঁদের কাছে রানার আদর ছিল খানিক বেশি। সে কারণে মায়ের শঙ্কাতুর আঁচলের নিচে থেকে দুই বাড়ি দূরত্বে নদী থাকার পরও সাঁতার শেখা হয়নি রানার। সেই ধারাবাহিকতায় তার ছোট ভাইটিরও।

ভর্তির পর রানা প্রায়ই আসত জাহাঙ্গীরনগরে। একসময় শহীদ সালাম-বরকত হলের ৩৪৯ নম্বর কক্ষটি ওরও ঠিকানা হয়ে উঠল যেন। সবাই মনে করত, রানা এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। আমার রুমমেট একই বিভাগের বন্ধু উল্লাসের সঙ্গে গড়ে ওঠে ওর চমৎকার বন্ধুত্ব। আমিও দু–একবার জগন্নাথ হলে ওর রুমে গিয়ে থেকেছি, আড্ডা দিয়েছি। রানা নিজের মতো করে জাহাঙ্গীরনগরে যেত-আসত, আড্ডা দিত, ঘুরে বেড়াত। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা ওরও বন্ধু হয়ে ওঠে। সহজাত একটি ক্ষমতা ছিল রানার, সবাইকে আপন করে নিত। কিছুটা মুখচোরা, স্বল্পভাষী হলেও ওর উপস্থিতি ছিল সহজ। যে কারণে সবাই ওকে কাছের মনে করত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে যখন ক্যাম্পাস ছেড়ে ঢাকায় চলে আসি, তখন থেকে বেশ কিছুদিন রানার খোঁজ আমি পাইনি। আমার কাছ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করেছিল কোনো কারণে। সেই রানা একসময় ব্যবসায় প্রশাসনে ডিগ্রি অর্জন করে যোগ দেয় দেশের স্বনামখ্যাত একটি ওষুধ কোম্পানিতে। এরপর বিয়ে করে, বাবা হয়। সুন্দর আর গোছানো সংসার। আবার আমাদের যোগাযোগ সহজ হয়। তবে তা–ও কিছুদিনের জন্যই।

স্কুল-কলেজজীবনে রানা নিভৃতে কবিতা লেখার চেষ্টা করত। স্মৃতির আঁধার সরিয়ে উঁকি দিলে মনে পড়ে, খুব আবেগজড়ানো প্রেম-প্রকৃতি-স্বদেশ ইত্যাদি ছিল ওর লেখার বিষয়। পরবর্তী সময়ে চাকরিজীবনে প্রবেশের আগে ওর এই সত্তা প্রবলরূপে ধরা দেয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ওর লেখাপত্র নজর কাড়ে। দেখতে পাই, শুধু কবিতা নয়, ওর আগ্রহের ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত। ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, যুক্তি ইত্যাদি নানা বিষয়ে চিন্তা উদ্রেককারী লেখা একনাগাড়ে লিখে যাচ্ছে। ‘অদ্ভুত মানুষের গল্প’, ‘রহস্যময় মহাবিশ্ব’, ‘ক্ষুদিতা’, ‘ধ্যান’ শিরোনামে কয়েকটি বইও প্রকাশ পায়। বেশ পড়াশোনা করত রানা। নিজের বাড়িতে বানিয়ে নিয়েছিল ছোটখাটো একটা পাঠাগার। যে কাউকে ওর গ্রন্থসংগ্রহ মুগ্ধ করবে।

আমার সেই আলাভোলা, বিশাল আকাশ হৃদয়ের সহজ বন্ধুটি ২২ মার্চ চলে গেল অদেখালোকে। যদিও রানার চলে যাওয়া স্বেচ্ছামৃত্যুর নামান্তর, তবে তা অভিমানজাত বলে বিশ্বাস করি না। প্রণয়ব্যর্থতা তার ছিল, ছিল কাঙ্ক্ষিত পেশা নির্বাচনে অপারগতা। কিন্তু ওর মতো যুক্তিমনস্ক, সুন্দরের পূজারি মানুষ শুধু এসব কারণেই স্বেচ্ছামৃত্যুর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে না। ও ছিল প্রবৃত্তিতাড়িত। এই তাড়নাই ওকে শেষ পর্যন্ত এই অকাল প্রস্থানের পথে নিয়ে যায়।

রানা নাগ
ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘদিন ধরেই নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিল রানা। নিজেরই করা সেই সব জটিলতা থেকে আর উত্তরণ ঘটল না। শেষের কয়েক দিন আইসিইউতে থাকাকালীন এই জাগে আশার আলো, এই আবার শঙ্কা। এই দোলাচলের কালে খুব বিশ্বাস জেগেছিল, ও ফিরবে। গেল কয়েক বছর পালিয়ে বেড়াত আমার কাছ থেকে। কোনোভাবেই ওর সাক্ষাৎ পাইনি। আইসিইউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কান্না চেপে মনে মনে প্রার্থনা করেছি, আমার আয়ুর অংশ ওকে দিয়ে ফিরিয়ে দাও কিছুকালের জন্য। আমার যে ওকে কিছু বলার ছিল। সেই প্রার্থনা কবুল হয়নি।

রানা লিখেছিল:
‘জন্ম আমাকে জীবন দেয়নি
মৃত্যু আমার জীবন নেবে না
জন্ম–মৃত্যুতে আমার জীবন
নির্ভর কিংবা নির্বল কখনোই নয়...।’

হয়তো তা-ই সত্যি। সেই সত্যি প্রকাশ্য হলো বড় অসময়ে রানার এই চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। মহাকালের অনন্ত অংশে অবশেষে মিলিত হলো সে। কী অবাক, যে ল্যাপটপে কি-বোর্ডে আঙুল চেপে এই লেখা লিখছি, সেটিও তারই দেওয়া!

আমার কান্না শুনে তোর জন্ম, একাকী কান্নার শব্দ নিজের কোটরে আটকে নিঃশব্দে দিন কয়েক আগে বিদায় জানালাম তোকে—বিদায় বন্ধু, বিদায় সময়ের সহোদর, বিদায় ভাই আমার...।