বাংলা সাহিত্যে ওসি এবং হারুনেরা

হারুন নামটি সাধারণ হলেও এ সময়ের বাংলাদেশে এই হারুন নামের সঙ্গে পরিচিত নন, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর হবে। সম্প্রতিকালে ওয়েব সিরিজ ‘মহানগর’–এর ওসি হারুন চরিত্রের মধ্য দিয়ে চারপাশে হারুন হারুন যে রব উঠেছে, নানামাত্রিক ঘটনায় সেই রব এখনো চলমান। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখে নেওয়া যাক বাংলা সাহিত্যে ওসি এবং হারুনেরা কেমন?

আশফাক নিপুণের ‘মহানগর’ সিরিজে ওসি হারুন চরিত্রে মোশাররফ করিম
ভিডিও থেকে নেওয়া

আপনি যদি কাউকে বলেন ‘আসুন’, তিনি আসবেন। যদি বলেন ‘বসুন’, তিনি বসবেন। কিন্তু যদি বলেন ‘হারুন’, তিনি হারতে চাইবেন না। হারুনকে হারানো কঠিন। কারণ ‘হারুন’ শব্দের অর্থ যোদ্ধা সিংহ। শব্দটি খ্রিষ্টপূর্ব চার হাজার বছর আগে প্রাচীন মিসরীয় ভাষাতেও পাওয়া যায়। আর হাল আমলে ‘হারুন’ নামটি ব্যক্তির নাম হিসেবে পৃথিবীজুড়ে দেখতে পাবেন। বর্তমান পৃথিবীর অন্তত চার লাখ মানুষের নাম ‘হারুন’। এর মধ্যে খ্যাত-অখ্যাত সবাই আছে। বাংলাদেশের শহর-গ্রামেও হারুনেরা ঘুরে বেড়ায় বিচিত্র চরিত্রের ধরন নিয়ে। কেউ হয়তো ওসি হারুন—প্রবল ক্ষমতার অধিকারী, কেউ হয়তো চা-বিক্রেতা হারুন—ওসি হারুনের হাতে নির্যাতনের শিকার!

বাস্তব দুনিয়ায় ওসি আছে, হারুনও আছে। উভয়েই প্রবল প্রভাব বিস্তার করে আছে—কি ক্ষমতায় কি নামে। তবে ‘ওসি’ আর ‘হারুন’কে সব সময় একসঙ্গে পাবেন না। তার মানে ওসি হলেই তাঁর নাম হারুন হবে, তা নয়। আবার নাম হারুন হলেই তিনি ওসি হবেন, তা–ও নয়। এই ‘ওসি’ আর ‘হারুন’কে যদি দুটি আলাদা সত্তা ধরেন, তবে বাংলা সাহিত্যে এঁদের হামেশা দেখতে পাবেন। তবে মনোযোগ দিয়ে না পড়লে টেরও পাবেন না এঁরা আছেন। কারণ, চেনা দুনিয়ার সাধারণ চরিত্র-বৈশিষ্ট্য নিয়ে এঁরা সাহিত্যে হাজির থাকেন। আর বাস্তব জগতে হারুন নামের অনেকে আছেন বিভিন্ন পেশায়। সেসব পেশায় তাঁরা তাঁদের কাজে রত। যেমন ‘পুলিশ করে পুলিশের কাজ’। বস্তুত হারুন নাম বাঙালি সমাজে বহুল শ্রুত; তাই সে–ও নাম দিয়ে আলাদা হয়ে ওঠে না। দুই ক্ষেত্রেই পদ এবং নাম ছাপিয়ে প্রধান হয়ে ওঠে কাহিনি।

হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের কাহিনি স্মরণ করুন। পড়া থাকলে রাবেয়ার কথা মনে আছে নিশ্চয়। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েটি একজনের লালসার শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এরপর গর্ভপাত ঘটাতে গেলে রাবেয়া মারা যায়। এ ঘটনার জন্য রাবেয়ার ছোট ভাই মন্টু দায়ী করে মাস্টার কাকাকে, যিনি ওই পরিবারেই থাকতেন। তারপর একদিন মন্টু বাড়িভর্তি লোকের সামনে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে লোকটাকে খুন করে। ‘নন্দিত নরকে’র কাহিনিতে হারুনও ছিল। কোথায় ছিল, সেটা হয়তো অনেকের মনে নেই। হারুন প্রতিবেশী হয়ে ছিল রাবেয়াদের পাশের বাড়িতে। উচ্চবিত্ত পরিবারের এই তরুণটি পছন্দ করত রাবেয়াকে।

গল্পের কথক খোকা—যে কিনা রাবেয়ার পিঠাপিঠি ভাই, সে ভাবে: ‘রাবেয়া যদি কোনো দিন ভালো হয়ে ওঠে তবে তাকে খুব একজন হৃদয়বান ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব। হারুন ভাইয়ের মতো একটি নিখুঁত ছেলে।’ খোকা ভাবে; কিন্তু খোকা ঠিকই জানে, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, এর ওপর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, তার সঙ্গে হারুনের বিয়ের সম্ভাবনা আদৌ নেই। তাই ভাবে ওই পর্যন্তই—‘হারুন ভাইয়ের মতো’, তবে হারুন নয়।

হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের কাহিনি স্মরণ করুন। পড়া থাকলে রাবেয়ার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েটি একজনের লালসার শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এরপর গর্ভপাত ঘটাতে গেলে রাবেয়া মারা যায়। এই ঘটনার জন্য রাবেয়ার ছোট ভাই মন্টু দায়ী করে মাস্টার কাকাকে, যিনি ওই পরিবারেই থাকতেন। তারপর একদিন মন্টু বাড়িভর্তি লোকের সামনে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে লোকটাকে খুন করে। ‘নন্দিত নরকে’র কাহিনিতে হারুনও ছিল। কোথায় ছিল, সেটা হয়তো অনেকের মনে নেই। হারুন প্রতিবেশী হয়ে ছিল রাবেয়াদের পাশের বাড়িতে।

এটা তো বোঝাই যায়, বাস্তবের হারুন যেহেতু নানা রকমের, তাই সাহিত্যেও হারুনেরা হবে নানা রকম। হুমায়ূন আহমেদের ‘হৃদয়বান’, ‘নিখুঁত’ হারুনকে ছেড়ে আরেকটু পেছনে যাওয়া যাক। কাজী নজরুল ইসলামের তৃতীয় উপন্যাস ‘কুহেলিকা’য় হারুন আছে। কেমন সেই হারুন? সেই ‘হারুন টিউশনি করিয়া নিজের খরচ চালায় এবং বাড়িতে ছোট ভাইটিকে নিজে না খাইয়াও দশটি করিয়া টাকা পাঠায়।’ এই হারুনের গ্রামের বাড়িতেই উপন্যাসের নায়ক জাহাঙ্গীর গিয়ে ওঠে। বিপ্লবী জাহাঙ্গীর এরপর হারুনের বোন তহ্‌মিনা ওরফে ভূণীর প্রেমে পড়ে। হ্যাঁ, এখানেও হারুন হৃদয়বান, এমনকি নিখুঁতও। কারণ, জাহাঙ্গীরের মা হারুনের বাবাকে বলে, ‘হারুন আর তহ্‌মিনাই তো আপনার সোনার চেয়েও অমূল্য রত্ন—আমি ঐ সোনাই তো চাচ্ছি!’

কিন্তু শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’র হারুন? এখানে হারুন খলিফা—খলিফা হারুনর রশীদ। এই হারুন প্রবল ক্ষমতা আর নির্মমতা নিয়ে হাজির। এক রাতে হাসির শব্দ শুনে বন্ধুস্থানীয় মশ্‌রুরকে খলিফা হারুন বলেন, ‘মশ্‌রুর। শুনেছ এমন হাসি? কে হাসছে আমার মহলের দেওয়ালের ওদিকে?’ হাবসি গোলাম তাতারীর হাসির প্রেমময় ধ্বনি শুনে অসুখী খলিফা অস্থির হন, হিংসা করতে শুরু করেন। বলেন, ‘কিন্তু কে এই সুখীজন—আমার হিংসা হয়, মশ্‌রুর। আমি বাগদাদ-অধীশ্বর সুখভিক্ষুক। সে তো আমার তুলনায় বাগদাদেরর ভিক্ষুক, তবু সুখের অধীশ্বর! কে, সে?’ উপন্যাসের শেষে খলিফা হারুন তাঁর ‘আত্মতৃপ্তি’র খোঁজে ক্রীতদাস তাতারীকে ‘রিমান্ডে’ নেন। সেই রিমান্ডে তাতারী মারা যায়। তার মানে হারুন নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। এর সঙ্গে খলিফা কিংবা ওসি-পুলিশ-দারোগার মতো ক্ষমতাধর পদ যুক্ত হলেই সমস্যা তৈরি হয়।

ক্ল্যাসিক বাংলা সাহিত্যে ঠিক ওসি পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় দারোগা, পুলিশ। রবীন্দ্রসাহিত্যে অন্তত সোয়া তিন শবার ‘দারোগা’ ‘পুলিশ’ শব্দ দুটি আছে। তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই দারোগা-পুলিশকে কীভাবে দেখেছেন? ‘দুর্বুদ্ধি’ নামের গল্পের শুরুটা দেখলেই বুঝতে পারবেন: ‘ভিটা ছাড়িতে হইল। কেমন করিয়া, তাহা খোলসা করিয়া বলিব না, আভাস দিব মাত্র। আমি পাড়াগেঁয়ে নেটিভ ডাক্তার, পুলিশের থানার সম্মুখে আমার বাড়ি। যমরাজের সহিত আমার যে পরিমাণ আনুগত্য ছিল, দারোগাবাবুদের সহিত তাহা অপেক্ষা কম ছিল না।’ কেন, ভিটা কেমন করে ছাড়তে হলো, সেটা বলতে ভয় কেন? ভিটামাটি ছাড়তে বাধ্য হওয়া ‘দুই বিঘা জমি’র উপেনও সবকিছু খোলসা করে বলেছে, কিছু বাকি রাখেনি। আর ‘নেটিভ’ ডাক্তার খোলসা করে বলতে সাহস পান না কেন? সাহস পান না, কারণ অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে তিনি একজন দারোগা। দারোগা ললিত চক্রবর্তীর অন্যায় দেখে তাঁর মুখের ওপর একদিন এই ‘নেটিভ’ ডাক্তার বলেছিলেন—‘আপনারা মানুষ না পিশাচ?’ এই অবগুণ্ঠনহীন প্রকাশের কারণে ডাক্তারকে ভিটা ছাড়তে হয়েছে। দেখার বিষয়, ওসি-দারোগা-পুলিশরা চরিত্রের দিক থেকে একবচনের ‘আপনি’ হন না, এরা সব সময়ের জন্য বহুবচনের ‘আপনারা’ হয়ে যান।  

এবার বঙ্কিমরচনায় দারোগা-পুলিশ কীভাবে আছে, দেখা যাক। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রজনী’ উপন্যাসের মহাদেব দারোগা রবীন্দ্রনাথের ‘দুর্বুদ্ধি’ গল্পের ললিত দারোগার চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু নন।

রজনীর বাবা হরেকৃষ্ণ দাস মারা গেলে বেওয়ারিশ লাশের ব্যবস্থা করতে মহাদেব দারোগা এসে হাজির হন। হরেকৃষ্ণ মারা যাওয়ার আগে তাঁর অলংকারগুলো জমা রেখেছিলেন গোবিন্দ দত্তের কাছে। গোবিন্দ দত্তের বয়ান শুনন: ‘...তখন আমার দুই একজন শত্রু সুযোগ মনে করিয়া বলিয়া দিল যে, গোবিন্দ দত্তের কাছে ইহার স্বর্ণালঙ্কার আছে। আমাকে তলব হইল। আমি তখন দেবাদিদেবের কাছে আসিয়া যুক্তকরে দাঁড়াইলাম। কিছু গালি খাইলাম। আসামীর শ্রেণিতে চালান হইবার গতিক দেখিলাম। বলিব কী?

ঘুষাঘুষির উদ্যোগ দেখিয়া অলঙ্কারগুলি সকল দারোগা মহাশয়ের পাদপদ্মে ঢালিয়া দিলাম। তাহার উপর পঞ্চাশ টাকা নগদ দিয়া নিষ্কৃতি পাইলাম।’ এখানে ‘দেবাদিদেব’ বলতে বঙ্কিমচন্দ্র দারোগা মহাদেব আর তাঁর দলবলকে শুধু বোঝাননি, বুঝিয়েছেন তাঁদের দেবতাদের মতো ক্ষমতাকেও। দারোগারা কখনো হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলেন না; সুতরাং মহাদেব দারোগা তাঁর পায়ে থাকা অলংকার হাতে তুলে নিলেন এবং সেগুলো নিজের মেয়ের ব্যবহারের জন্য নিজের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন।

তো উদাহরণ বাড়িয়ে বিশেষ লাভ নেই। উপনিবেশকালের ওসি-পুলিশ-দারোগা পাকিস্তানপর্বে, এমনকি হালের বাংলাদেশেও সাধারণভাবে একই চরিত্র নিয়ে আছে—কি সাহিত্যে কি বাস্তব জগতে। আর হারুনেরা নানা চরিত্র নিয়ে মিশে গেছে সমাজে, সাহিত্যে। তবে হারুনদের নামের সঙ্গে যদি ক্ষমতার পদপদবি যুক্ত হয়, তবে সেই পদপদবি ছাপিয়ে অনেক সময়ই এঁরা ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে যান। তবে এতটা সাধারণীকরণ করাও আবার সমীচীন হবে না। যেকোনো জায়গায়, যেকোনো পেশাতেই ভালো ও মন্দ—দুই–ই আছেন। ফলে এক্ষেত্রে এত সহজেই শেষকথা বলা যাবে না।