মুক্তিযুদ্ধ ও তাজউদ্দীন আহমদ

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

বঙ্গবন্ধু যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে এলেন, তখন আমার কিছু বন্ধুবান্ধবের পরামর্শে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করি। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপ হয়। তিনি আমাকে বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নীতিনির্ধারণী উপায় খুঁজে বের করা এবং বিভিন্ন প্রস্তাবনা রচনার জন্য আপনি আমাদের সঙ্গে কাজ করুন।’

আমি তখন করাচি থাকতাম, কিন্তু ঢাকায় ঘন ঘন আসা হতো। ইতিমধ্যে এখানে একটা ইনফরমাল গ্রুপ হয়ে গেছে। ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, আমি এবং অনেকে সেই গ্রুপের সদস্য। কিন্তু আমাদের সঙ্গে সব সময় বসতেন তাজউদ্দীন সাহেব। তাঁকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের সব কাজ চলত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনা, পর্যালোচনা হতো তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে। আবার আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও বসতাম ৬ দফার খুঁটিনাটি বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনার জন্য, তখনো সেই সভায় তাজউদ্দীন সাহেব ব্যতিক্রমহীনভাবে উপস্থিত থাকতেন। মাঝেমধ্যে থাকতেন সৈয়দ সাহেব (সৈয়দ নজরুল ইসলাম), কামারুজ্জামান, মনসুর আলী ও মোশতাক। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব সব সময় থাকতেন।

এসব আলোচনায় বিভিন্ন দিক বা বিষয় নিয়ে কথা বলায় তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। চমৎকার ছিল তাঁর কাজের ধরন—নিজে বুঝতে পারার এবং অন্যকে বোঝানোর ক্ষমতা। তাই আমাদের আলোচনা-পর্যালোচনা তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গেই বেশি হতো। এভাবেই ওই সব মিটিংয়ের মাধ্যমেই তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয়। এর আগে আমি তাঁর নাম শুনেছি, কিন্তু তাঁকে চিনতাম না। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়েই বুঝলাম, তিনি ছিলেন সবচেয়ে কর্মদক্ষ এবং নিবেদিত মনের মানুষ। অত্যন্ত পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গে তিনি কাজ করতেন। যখন আমাদের কোনো কিছুর বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতেন, তথ্য দিয়ে তার বিশ্লেষণ করতেন।

আমি তখন করাচি থাকতাম, কিন্তু ঢাকায় ঘন ঘন আসা হতো। ইতিমধ্যে এখানে একটা ইনফরমাল গ্রুপ হয়ে গেছে। ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, আমি এবং অনেকে সেই গ্রুপের সদস্য। কিন্তু আমাদের সঙ্গে সব সময় বসতেন তাজউদ্দীন সাহেব। তাঁকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের সব কাজ চলত।

’৭১-এর মার্চে অসহযোগ চলাকালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেশবাসীর জন্য যত নির্দেশ যেত, তার মধ্যে অর্থনৈতিক নির্দেশগুলোর খসড়া তৈরি হতো আমার বাড়িতে। আমি তখন ধানমন্ডির ৮ নম্বর সড়কে মুসা সাহেবের বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতাম। রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে তাজউদ্দীন সাহেব আমার বাসায় চলে আসতেন। ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামও একই সময় উপস্থিত থাকতেন। এদিকে আমি ও অধ্যাপক রেহমান সোবহান দৈনন্দিন অর্থনৈতিক বিষয়গুলো মনিটর করে ঠিক করে রাখতাম কী কী বলা দরকার, আজকের দিনে কী কী ঘটেছে ইত্যাদি। তাজউদ্দীন সাহেবের দায়িত্ব ছিল বিষয়গুলোকে কো-অর্ডিনেট করা। তারপর সেগুলোকে চূড়ান্ত করার পর রাত ১২টার আগে সেই নির্দেশগুলো খবরের কাগজে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। প্রতিদিন খবরের কাগজে নির্দেশ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।

এই কাজগুলো করতে গিয়েই বুঝলাম, তাজউদ্দীন সাহেব কী ধরনের মানুষ। সাংঘাতিক পরিশ্রম করতে পারতেন। অসম্ভব রকমের ধৈর্য ছিল তাঁর। অসাধারণ সহিষ্ণুতা দেখেছি তাঁর মধ্যে। তাঁর সঙ্গে খুব সহজে আলোচনা করা যেত। দিনের পর দিন তাঁর সঙ্গে বিতর্ক করেছি আমরা। তিনি সব সময় অন্যকে কথা বলার সুযোগ দিতেন। মতের মিল না হলে বলতেন, ‘আপনি বলে শেষ করেন, তারপর আমি বলছি কেন হবে না।’ ওই সময়ই বোঝা যেত তাঁর পাণ্ডিত্য। তাজউদ্দীন সাহেব সাংঘাতিক ভালো বাংলা লিখতেন। খুবই সুন্দর ছিল তাঁর লেখা। আমার খুব ভালো লাগত দেখতে, তিনি কীভাবে আর্গুমেন্টগুলো সাজিয়ে লিখতেন। যেমন আর্গুমেন্টগুলো লেখার পর সেগুলোর সমাধান দেওয়া, তারপর বিভিন্ন সুপারিশ লিখে ফেলা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাজউদ্দীন সাহেব অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী আর আমি সে সময় প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। তখন আমাদের রোজ দেখা হতো। সে সময়ও দেখেছি, অফিসের কাজেও তিনি ছিলেন আমার দেখা সবচেয়ে তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক জগতেও তিনি ছিলেন সম্ভবত সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও ক্ষুরধার বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব।

আলোচনায় বিভিন্ন দিক বা বিষয় নিয়ে কথা বলায় তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। চমৎকার ছিল তাঁর কাজের ধরন—নিজে বুঝতে পারার এবং অন্যকে বোঝানোর ক্ষমতা। তাই আমাদের আলোচনা-পর্যালোচনা তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গেই বেশি হতো। এভাবেই ওই সব মিটিংয়ের মাধ্যমেই তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয়।

শুরুতেই বলেছি, তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় ’৬৯ সালে। ১৯৭১-এ আমি মুজিবনগরে খুব বেশি দিন ছিলাম না। অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, আমি বিদেশে ছিলাম; সেখানে আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লবি করেছিলাম। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল।

আমার সঙ্গে তাজউদ্দীন সাহেবের আসল কাজ শুরু হলো স্বাধীনতার পর। তখন প্রতিদিন তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল, কাজ ছিল। এ দেশের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি দেশ গড়ে উঠবে—এই ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু দেশের দায়িত্বে তো তিনি একা ছিলেন না এবং ক্যাবিনেটে সবাই একই রকম ধারণার মানুষ ছিল না—এক কথায় হারমোনিয়াস ছিল না। তাঁর শত্রুও ছিল, মিত্রও ছিল। বিপক্ষের লোকজন বেশি শক্তিশালী ছিল, কাজেই তাঁর কার্যকর ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখা সম্ভব ছিল না।

মুক্তাঞ্চল পাটগ্রাম পরিদর্শনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। অক্টোবর ১৯৭১
ছবি: সংগৃহীত

দেশের প্রয়োজনে যা করা দরকার, কিন্তু তেমন হচ্ছে না বা করতে পারছেন না এবং কেন পারছেন না, এর কারণগুলো তিনি প্রায় সময়ই বলতেন। তিনি বলতেন কিছু কিছু মানুষের কথা যে ‘ওরা আমার বিরুদ্ধে লেগে আছে, কাজ করতে দিচ্ছে না।’ তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের সম্পর্ক কোনোকালেই ভালো ছিল না। তাজউদ্দীন সাহেব খুব সরাসরি এবং খোলামেলা কথা বলতেন, ডিপ্লোমেসি করতেন না। এমন সহজ খোলাখুলি আচরণে স্বাভাবিকভাবে শত্রু তো তৈরি হয়েই যাবে। আমি তো রাজনীতিবিদ নই, তাই তাঁর স্ট্রেটফরোয়ার্ড বক্তব্যে আমার কাজ করতে সুবিধাই হতো।

তাজউদ্দীন সাহেব খুব দুঃখ করে বলতেন, ‘বঙ্গবন্ধু কোনো দিনও আমার কাছ থেকে শোনেননি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ হলো, কীভাবে কী করলাম।’ বলতেন, ‘আমি যে একটা মানুষ আছি, কোনো দিনও ডেকে বললেন না, “আচ্ছা, বলো দেখি তাজউদ্দীন, কী হয়েছিল সেই ’৭১-এ। আমাকে সেই সম্পর্কে সমস্ত খুলে বলো, এক দিনে না হয় কয়েক দিনে বলো। কীভাবে সেখানে তুমি গেলে, কীভাবে কাজ করলে আমাকে বলো।”’ এটা বোধ হয় তাঁদের মান-অভিমানের কোনো ব্যাপার ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই বুঝতে পারছিলাম, এই দুজনের সম্পর্কটা যেন টেন্সড। আমি মনে করি, তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে শত্রুতা করে কেউ বোধ হয় বঙ্গবন্ধুকে কানকথা বলত। কিন্তু আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে তাজউদ্দীন সাহেব সম্পূর্ণভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্য নিবেদিত ছিলেন এবং অকৃত্রিম ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য তাঁর ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধুর ভালো চেয়েই বিশ্বাস করে হয়তো তিনি কিছু বলেছেন; কিন্তু কেউ হয়তো উল্টো কথা বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বুঝিয়ে এসেছেন। সেই সময়ের সব ঘটনা দেখে আমার যেটুকু ধারণা, শেখ মনি তাজউদ্দীন সাহেবের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, এ বিষয়ে আমি প্রমাণ করতে পারব না। কারণ, আমার সঙ্গে শেখ মনির কোনো সম্পর্ক ছিল না। সে আদৌ কিছু বলেছে কি না, তা–ও জানি না। কিন্তু আমার একটা ধারণা, হয়তো আমার ভুলও হতে পারে, কানকথা বলায় মোশতাকের চেয়ে শেখ মনির ভূমিকা বেশি ছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাজউদ্দীন সাহেব অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী আর আমি সে সময় প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। তখন আমাদের রোজ দেখা হতো। অফিসের কাজেও তিনি ছিলেন আমার দেখা সবচেয়ে তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি এবং রাজনৈতিক জগতেও তিনি ছিলেন সম্ভবত সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব।
নুরুল ইসলাম; তাজউদ্দীনের মন্ত্রণালয়ে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় জোরালো সমর্থন এবং ভূমিকার কারণে আমেরিকার প্রতি তাজউদ্দীন সাহেব ভয়ানকভাবে সন্দিহান ছিলেন। আমরা প্রাণপণে স্বাধীনতাসংগ্রাম করছি আর ওই দিকে আমেরিকা আমাদের বিরুদ্ধে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে দিল। তারা আমাদের যুদ্ধকে স্যাবোটাজ করার জন্য খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ করেছে। এসব সন্দেহ থেকেই তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা আমেরিকার সাহায্য নেব না।’ তাঁর মনোভাবটা অত্যন্ত কঠোর ছিল আমেরিকার ব্যাপারে; কিন্তু আমার ধারণা, রাষ্ট্র চালাতে গিয়ে তিনি দেখলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আর তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি এক জিনিস নয়। মানবিক অনুভূতি দিয়ে রাষ্ট্র চালানো যায় না। কাজেই তিনি তাঁর ভাবনাচিন্তা রিকনসাইল করেছিলেন। এখানেই তাজউদ্দীন ছিলেন অন্য সবার চেয়ে আলাদা, সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী মানুষ।

তাজউদ্দীন ভারতঘেঁষা, কিছু লোকের এমন একটি প্রচারণা ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীন একজন মানুষ। যুদ্ধের পর প্রথম ছয় মাসে আমি দেখেছি, আমেরিকার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার কারণেই তাঁর মনোভাব আমেরিকাবিরোধী, কিন্তু পরে তিনি সম্পূর্ণ প্র্যাগম্যাটিক। ভারতকে খাতির করব, রাশিয়াকে খাতির করব, আমেরিকানদের খাতির করব না—এই মনোভাব তাঁর কোনো দিনই ছিল না। তাঁর মনোভাব ছিল, যুদ্ধের সময় কার সাহায্য নিয়েছি, কার সাহায্য পাইনি বা এমন সাহায্য দেশের স্বার্থে সবাই নেয়, তার মানে এই নয় যে সাহায্যের বদলে ওরা যা বলবে, আমরা তা–ই করব। এটি হবে না। তিনি কোনো দিনই কারও প্রতি নতজানু ছিলেন না। তাঁর কোনো রকম দুর্বলতা ছিল না। তাঁর যা কিছু দুর্বলতা ছিল, তা ছিল তাঁর নিজের দেশ বাংলাদেশের জন্য।

বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন সাহেবের মধ্যে যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, তার পরিণাম ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য রকম হতো, যদি এই দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য, দূরত্ব বা বিচ্ছেদ না ঘটত। কিন্তু এ দেশের দুর্ভাগ্য, দুজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হলো, তাজউদ্দীন সাহেব চলে গেলেন। দেশের সর্বনাশ আরম্ভ হলো।

বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন সাহেবের মধ্যে যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, তার পরিণাম ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য রকম হতো, যদি এই দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য, দূরত্ব বা বিচ্ছেদ না ঘটত।

• লেখক: অর্থনীতিবিদ; প্রথম পরিকল্পনা মিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান

(সংক্ষেপিত)
প্রথম আলো ঈদসংখ্যা ২০০৫ থেকে গৃহীত
বিজয় দিবস ২০২৫ উপলক্ষে প্রকাশিত ক্রোড়পত্রে পুনর্মুুদ্রিত