আদিবাসী সন্তানদের যেভাবে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল কানাডা

১৯৫০-এর মাঝামাঝি সময় থেকে আশির দশক পর্যন্ত কানাডা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হতো আদিবাসী সন্তানদের। এক অনালোচিত অধ্যায়ের উন্মোচন।

ক্রিস্টিন ও তাঁর বোন ক্লিও। আদিবাসী পরিবারের এই দুই ভাইবোন বড় হয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন পরিবারেছবি: সংগৃহীত

অনেক দিন আগের কথা। হঠাৎ একটি খবরে নজর পড়ল, কানাডার ম্যানিটোবা প্রদেশের একটি হাসপাতালে ৬০ বছরের বেশি সময় আগে জন্মের সময় পাল্টে যায় দুটি শিশু। তাদের একজন কানাডার আদিবাসী মেতি পরিবারে বড় হয়, অন্যজন এক ইউক্রেনীয় অভিবাসী পরিবারে। শ্বেতাঙ্গ হিসেবে বেড়ে ওঠা এডওয়ার্ড অ্যামব্রোসের বোন একটি ঘরোয়া ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারেন, তাঁর ভাই মেতি পরিবারে বেড়ে ওঠা রিচার্ড বোভে। তিনি আরও জানতে পারেন, রিচার্ড ও এডওয়ার্ড একই দিনে একই হাসপাতালে জন্মেছিলেন। কিন্তু গল্পের যে অংশে চোখ আটকে গেল তা হলো, রিচার্ডের আক্ষেপ। একজন আদিবাসী হিসেবে বেড়ে উঠতে গিয়ে অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হাতে হয়েছে তাঁকে। তিনি বলেন ‘সিক্সটিজ স্কুপ’-এর কথা।

সিক্সটিজ স্কুপ কানাডার ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়ই বলা চলে। এটা এমন একটা সময়, যখন রাষ্ট্রীয় নীতির বলে শিশুকল্যাণ কর্তৃপক্ষ আদিবাসী শিশুদের তাদের পরিবারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে রাখত এবং শ্বেতাঙ্গ পরিবারগুলোকে উৎসাহিত করত এই শিশুদের দত্তক নিতে। ১৯৫০-এর মাঝামাঝি সময় থেকে আশির দশক পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের অর্থায়নে এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ সময় কানাডার প্রতিটি প্রদেশের আলাদা শিশুপালন কেন্দ্র ও দত্তক নীতিমালা ছিল। যেমন সাসকাচোয়ান প্রদেশে ছিল ‘অ্যাডপ্ট ইন্ডিয়ান অ্যান্ড মেতি’ বা ‘এইম’ প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় মিশ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের দত্তক নিতে মধ্যবিত্ত শ্বেতাঙ্গ পরিবারগুলোকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা হতো। পত্রিকা ও টিভিতে হাসিখুশি আদিবাসী শিশুদের দেখিয়ে প্রচার করা হতো বিজ্ঞাপন। বলা হচ্ছিল, ‘ফার্স্ট নেশনস’ ও মেতিদের মধ্যে অবৈধ সন্তান জন্মদান ও বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ায় এই শিশুদের দেখভাল করার কেউ নেই। অনেক সময় শিশুকল্যাণ কর্তৃপক্ষের তরফে দাবি করা হতো, এসব শিশু নিজেদের পরিবারে বেড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছে না। মোদ্দাকথা, আদিবাসী পরিবারগুলোর সন্তান প্রতিপালনের যোগ্যতা নেই। শ্বেতাঙ্গ পরিবারে নিজের পরিবার, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেড়ে উঠত এই শিশুরা। পালক মা–বাবার লিখিত অনুমোদন ছাড়া নিজের পরিবার বা সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার কোনো সুযোগ ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই পরিবার থেকে একাধিক শিশুকে আনার পর তাদের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশ বা অঞ্চলে পাঠানো হতো, যাতে যতটা সম্ভব সংশ্লিষ্টতা এড়ানো যায়।

বিভিন্ন প্রাদেশিক শিশুকল্যাণ কর্তৃপক্ষের মা–বাবা কিংবা পারিবারিক সম্মতি ছাড়াই যে কোনো শিশুকে যেকোনো স্থান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল। পুলিৎজারপ্রাপ্ত কানাডীয় আদিবাসী সাংবাদিক কনি ওয়াকার দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ ও নিহত আদিবাসী নারীদের নিয়ে কাজ করছেন। ২০১৮ সালে সিবিসিতে প্রচারিত তাঁর অপরাধ অনুসন্ধানী পডকাস্ট ‘মিসিং অ্যান্ড মার্ডার্ড: ফাইন্ডিং ক্লিও’তে তিনি বলেন, কীভাবে সাসকাচোয়ান প্রদেশের ক্রি গোষ্ঠীর এক মায়ের তিন সন্তানকে কেড়ে নেন সমাজকল্যাণকর্মীরা, তারপর ভিন্ন ভিন্ন শ্বেতাঙ্গ পরিবারে তাঁদের দত্তক দেওয়া হয়।

‘এইম’ প্রকল্পের বিজ্ঞাপন
ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘ চার দশক আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কাছে হার মেনে বোন ক্লিওর খোঁজ পেতে কনি ওয়াকারের দ্বারস্থ হন ক্রিস্টিন। বোনের একটি মাত্র ছবি ছিল তাঁর কাছে। ক্রিস্টিন বলছিলেন, যে শ্বেতাঙ্গ পরিবারে তিনি প্রতিপালিত হন, সেখানে তাঁকে সেখানো হয়, তিনি কতটা ভাগ্যশালী। কারণ, একটি অশ্বেতাঙ্গ পরিবারে তাঁকে বেড়ে উঠতে হচ্ছে না। তাঁকে নিজের শিকড়কে ঘৃণা করতে শেখানো হয়। অশ্রুসিক্ত চোখে ক্রিস্টিন বলে ওঠেন, নিজের জীবনের বড় একটা অংশজুড়ে কীভাবে তিনি নিজ গোষ্ঠীর মানুষদের, আপন মানুষদের ভয় পেয়েছেন।

ক্রিস্টিনকে বলা হয়েছিল, ক্লিওকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শ্বেতাঙ্গ পরিবারে দত্তক দেওয়া হয়। সেখান থেকে পালিয়ে সাসকাচোয়ানে ফেরার সময় ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে সে মারা যায়। এটা সত্য না হলেও প্রকৃত ঘটনা কম হৃদয়বিদারক নয়। নিউ জার্সির একটি পরিবারে ঠাঁই হয়েছিল ক্লিওর। সেখানে ভীষণ বিচ্ছিন্ন বোধ করতেন ক্লিও, বিষণ্ন থাকতেন, যেকোনোভাবে ফিরতে চাইতেন পরিবারের কাছে। শিক্ষকদের বলেছিলেন, সরকারের কোনো অধিকার ছিল না আমাকে যেতে দেওয়ার। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যা করেন।

ক্রিস্টিনের মতে, রাষ্ট্র ধরেই নিচ্ছিল আদিবাসীরা সন্তান প্রতিপালনে অযোগ্য।

কানাডার একটি আবাসিক স্কুলে ছেলেমেয়েরা
ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু এ ধারণার উৎস কোথায়? তা খুঁজতে আমাদের ঘেঁটে দেখতে হবে কানাডার উপনিবেশিক ইতিহাস। ইউরোপীয়রা বসতি স্থাপনের আগে কানাডার আদিবাসীদের শত শত স্বতন্ত্র অঞ্চলে বিন্যস্ত করা হয়। ‘ফার্স্ট নেশনস’ হিসেবে অভিহিত আদিবাসীদের সঙ্গে ইউরোপীয়দের মেলামেশার ফলে নতুন যে মিশ্র জাতিগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়, তাদেরই বলা হয় মেতি যা কানাডীয় সংবিধানেও স্বীকৃত। এ ছাড়া রয়েছে ইনুইট নামের একটি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী। ১৮৭৬ সালে কানাডার সংসদে পাস হয় ইন্ডিয়ান অ্যাক্ট, যার অধীন সব আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। তাদের নির্দিষ্ট সংরক্ষিত এলাকায় বসবাস করতে হতো, বাইরে বের হওয়ার অনুমোদন ছিল না। মূলত কানাডার প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর বসতি স্থাপনকারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ আইন পাস করা হয় বলে ধারণা করা হয়।

ইন্ডিয়ান অ্যাক্ট অনুযায়ী, আদিবাসী শিশুদের বিভিন্ন আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিশুনিবাসে পাঠানো হতো। বিশ শতকের প্রায় পুরোটা জুড়েই রাষ্ট্রীয় মদদে অন্তত ১৩৯টি আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়েছে, যেগুলোর দায়িত্বে ছিল ক্যাথলিক, অ্যাংলিকান ও ইউনাইটেড গির্জা। দ্য গার্ডিয়ান বলছে, আনুমানিক দেড় লাখ আদিবাসী শিশু এসব স্কুলে গেছে। তাদের স্কুলে কতৃত্বশীল ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ করতে, নিজের ভাষায় কথা না বলতে এবং নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা না করতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা মৌখিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হতো এবং হাজার হাজার শিশু রোগ, অবহেলা ও অযত্নে মারা যেত। একপর্যায়ে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মৃত্যুর পর স্কুলের গণ্ডির ভেতরেই শিশুদের গণকবর দেওয়া হতো।

‘এইম’ প্রকল্পের বিজ্ঞাপন
ছবি: সংগৃহীত

এসব আবাসিক স্কুল উদ্দেশ্যমূলকভাবে আদিবাসী সম্প্রদায়ের থেকে অনেক দূরে স্থাপন করা হতো, যাতে শিশুদের মা–বাবা কিংবা পরিবারের সদস্যরা তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে না পারেন। কিছু শিশুকে হাজার কিলোমিটার যাত্রাও করতে হয়েছে।

আবাসিক স্কুলব্যবস্থার শিকার হওয়া আদিবাসীদের হাজার হাজার ঘণ্টা সাক্ষ্য নিয়েছে কানাডার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন। ২০১৫ সালে এসব আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডকে ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’ নাম দেয় কমিশন। সিক্সটিজ স্কুপের শিকার যাঁরা, তাঁরা জানিয়েছেন, কীভাবে তাঁরা প্রজন্মান্তরে মানসিক অভিঘাত বয়ে চলেছেন। রাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাস নিয়ে নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে টিকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁরা। বৈষম্য আর বিভেদের যে নির্মমতম রূপ তাঁরা দেখেছেন, তা তাঁদের সঙ্গে ঘটানো হয়েছে তথাকথিত সভ্যতার নামে। কতৃত্ব আর ক্ষমতার এই অমোঘ চক্র ভেঙে বিভেদহীন মানবতার সংজ্ঞাকে অটুট রাখার দায়টা মানুষের ওপরই বর্তায়।