২০ শতকের বাংলা ভাষাচর্চা

অলংকরণ: আরাফাত করিম

১৯ শতকে ভাষাবিষয়ক একটি বড় তর্ক ছিল; ২০ শতকে এসে তার আপাত মীমাংসা হয়। বাংলা ভাষার আদর্শ রূপ কী হতে পারে, এই নিয়ে ১৯ শতকের মাঝামাঝি থেকে পণ্ডিতি তর্ক চলেছে। এর শুরু ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ পর্বে, যখন বাংলা গদ্য লেখার ভার পড়ে সংস্কৃত পণ্ডিতদের হাতে। তাঁরা বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের আদলে গড়তে চেয়েছেন; কিন্তু ওই শতকেই প্যারীচাঁদ মিত্র ও কালীপ্রসন্ন সিংহ বাংলা লিখিত সাহিত্যকে মুখের ভাষার ছাঁদে রূপ দিয়ে দেখালেন। ভাষারীতির তর্কে যোগ দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও। ২০ শতকের শুরুর দিকে প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র পত্রিকার মাধ্যমে ‘মুখের ভাষা’ সাহিত্যের লিখিত ভাষা হয়ে ওঠার স্বীকৃতি পায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ ক্ষেত্রে বিশাল সমর্থন জুগিয়েছেন, সবুজপত্র–এর কাল থেকেই তিনি চলিত গদ্যে লিখতে শুরু করেন। ১৯ শতকের আরেকটি ধারণা ২০ শতকে এসে বদলে যায়। আগে মনে করা হতো বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকে জন্মলাভ করেছে; কিন্তু ২০ শতকের প্রথম সিকিভাগেই প্রমাণিত হয়, বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে আসেনি। কথাটি প্রথম স্পষ্ট করেন জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন। এ সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষা ও উপভাষা সংগ্রহ করেন। ১৯০৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে গ্রিয়ারসন ইংল্যান্ডে ফিরে যান। এরপর সংগৃহীত তথ্য ও উপাদান নিয়ে দুই দশকের বেশি সময় ধরে গবেষণা করে তিনি বলেন, বাংলা ভাষা সংস্কৃত নয়; বরং বৃহৎ মগধ অঞ্চলের পূর্ব মাগধী রূপ থেকে এসেছে।

কাছাকাছি সময়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাপদ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর ভাষা নিয়ে গবেষণা করে দেখান এগুলো বাংলা ভাষায় রচিত। তিনিও প্রমাণ করেন, বাংলা ভাষা মাগধী প্রাকৃত থেকে এসেছে। ভাষার উৎপত্তি নিয়ে তাঁদের মতের সঙ্গে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র মতের ভিন্নতা আছে। তিনি এ অঞ্চলের প্রাচীন ভাষার রূপ বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দেন, গৌড় অঞ্চলের মুখের ভাষা থেকে বাংলা ভাষা জন্মলাভ করেছে। ২০ শতকের ভাষাবিদেরা প্রায় নিঃসংশয় যে বাংলা ভাষা সংস্কৃতের দুহিতা নয়, পূর্ব ভারতীয় কোনো প্রাকৃত থেকেই এর জন্ম। বাংলা ভাষার উৎপত্তিগত সিদ্ধান্ত বদলেছে, তবে ২০ শতকের প্রথাগত ব্যাকরণে এর প্রতিফলন ঘটেনি। ২০ শতকজুড়ে যেসব ব্যাকরণ রচিত হয়েছে, সেগুলোর সবই বর্ণনা করা হয়েছে সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলাভাষী শিক্ষার্থীর কথা চিন্তা করে ১৯ শতকে লেখেন সমগ্র ব্যাকরণ কৌমুদী। এটি সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ; কিন্তু প্রথাগত বাংলা ব্যাকরণের সঙ্গে এর বিশেষ ফারাক নেই। ২০ শতকজুড়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে হুমায়ুন আজাদ পর্যন্ত অনেকেই আদর্শ বাংলা ব্যাকরণের অভাবের কথা বলেছেন। তবে তাঁদের কেউই পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনায় উদ্যোগী হননি।

আগে মনে করা হতো বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকে জন্মলাভ করেছে; কিন্তু ২০ শতকের প্রথম সিকিভাগেই প্রমাণিত হয়, বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে আসেনি। বরং বৃহৎ মগধ অঞ্চলের পূর্ব মাগধী রূপ থেকে এসেছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রস্তাব করেছিলেন, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনার আগে এর একাধিক আঞ্চলিক উপভাষার ব্যাকরণ প্রণয়ন করা দরকার। তিনি বাংলা প্রত্যয়, শব্দরূপ ও ব্যাকরণের অংশবিশেষ নিয়ে নতুন আলোচনা করেছেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, মুহম্মদ এনামুল হক, জ্যোতিভূষণ চাকী—তাঁদের রচিত ব্যাকরণগ্রন্থ ২০ শতকে জনপ্রিয় হয়। তবে এসব ব্যাকরণে নয়; বরং বাংলা ভাষার আদর্শ কাঠামো ধরা পড়েছে ২০ শতকে কিংবা তার আগে-পরে রচিত বিদেশির ব্যাকরণ বইয়ে। অবশ্য এসব ব্যাকরণকেও পূর্ণাঙ্গ বলা যায় না।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে উদাহরণ ও যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, বাংলা ভাষা তো বটেই, এমনকি বাংলা শব্দও সংস্কৃত থেকে আসেনি। সরাসরিও আসেনি, প্রাকৃতের মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েও আসেনি; কিন্তু ২০ বা ২১ শতকের কোনো ব্যাকরণগ্রন্থে এই সিদ্ধান্ত আত্তীকৃত হয়নি। এখনো পর্যন্ত বাংলা ব্যাকরণে তৎসম শব্দের সংজ্ঞা দেওয়া হয় এভাবে—যেসব শব্দ সংস্কৃত থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় এসেছে, সেগুলো তৎসম শব্দ। অথচ শহীদুল্লাহ্‌র মতে এসব শব্দ প্রাচীন আর্য ভাষা থেকে এসেছে। আবার ব্যাকরণগ্রন্থে তদ্ভব শব্দের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়, এসব শব্দ সংস্কৃত থেকে প্রাকৃতের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় ঢুকেছে; কিন্তু সংস্কৃত থেকে প্রাকৃতের মাধ্যমে কোনো ভাষা বা শব্দের জন্ম হতে পারে না। কারণ, সংস্কৃত ও প্রাকৃত একই কালের দুটি ভাষা—একটি লিখিত ভাষা, আরেকটি কথ্য ভাষা।

২০ শতকের ভাষাচর্চায় প্রাচীন পুথি অনেকখানি অংশজুড়ে আছে। চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর ভাষা পরীক্ষা করতে গিয়ে ভাষাবিদেরা এগুলোর প্রাচীনত্বের খোঁজ পেয়েছেন। পুরোনো সব পুথির মধ্য দিয়ে প্রাচীন বাংলা ভাষার কাঠামো নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। পুথি আবিষ্কার ও পুথির ভাষা গবেষণায় বিশেষভাবে অবদান রেখেছেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বসন্তরঞ্জন রায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, সুকুমার সেন প্রমুখ। ২০ শতকের সূচনালগ্ন থেকেই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় অসংখ্য প্রাচীন পুথি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। প্রাচীন পুথির সূত্র ধরে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা লিপির ঐতিহাসিক বিবর্তনের রূপরেখা নির্দেশ করেন।

২০ শতকেই বানান-বিতর্ক চরম রূপ ধারণ করে। মধ্যযুগের বানান ছিল মূলত উচ্চারণমূলক। এ কারণে প্রায়ই একই শব্দের বানানে ই, ঈ, ন ও ণ ইত্যাদি বর্ণের প্রভেদ ছিল না। ১৯ শতকে সংস্কৃত পণ্ডিতদের হাতে বাংলা গদ্য লেখার দায়িত্ব পড়লে তাঁরা শব্দের বানানকে অভিন্ন করার চেষ্টা করেন। তাঁরা বানানে ব্যুৎপত্তির প্রাধান্য দিতে থাকেন। যেমন কান লেখা হতো মূর্ধন্য-ণ দিয়ে, যেহেতু কর্ণ বানানে মূর্ধন্য-ণ আছে। এভাবে প্রায় ১০০ বছর চলেছে। ২০ শতকে এসে মূলত রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাংলা বানানে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। তিনি বানানকে উচ্চারণমূলক করার পক্ষপাতী ছিলেন।

ভাষায় বর্ণ ব্যবহারের প্রয়োজন ও হার বিচার করে মুনীর চৌধুরী ২০ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বাংলা কিবোর্ড নতুন করে সাজান। এই শতকেই বাংলাদেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ভাষাবিজ্ঞান চর্চার আগ্রহ প্রবলভাবে দেখা যায়। 

২০ শতকে ‘বিশ্বভারতী’ রবীন্দ্রনাথের বইয়ের জন্য অভিন্ন বানাননীতি প্রস্তাব করে। এর পরপরই বানানের বহুবৈচিত্র্য থেকে একটি রূপ নির্দিষ্ট করার জন্য রবীন্দ্রনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে উদ্যোগ নিতে বলেন। ১৯৩৬ সালের বানান সংস্কার উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে আছে। এই শতকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতার বাংলা আকাদেমি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকার বাংলা একাডেমিসহ একাধিক বানান কমিটি ও পত্রিকা বাংলা বানানের নিয়ম সুপারিশ করেছে। তবে এসব নিয়মের কোনোটিই তর্কাতীত থাকেনি। বানানের মূল সমস্যা এই—একই বানানের একাধিক বিকল্প থাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বানানের নিয়ম প্রস্তাব করতে গিয়ে বিকল্প আরও বেড়েছে। শব্দকে সূত্র বা নিয়মে ফেলতে গিয়ে অজস্র শব্দের বানানে নতুন করে বিকল্প তৈরি হয়েছে। অথচ ধ্বনিসূত্র মান্য করেই বানানকে অপরিবর্তিত রাখা যেত। যেমন ট বর্গের সঙ্গে মূর্ধন্য-ণ যুক্ত হবে—সব ক্ষেত্রে এই সূত্র গ্রহণ করা যেত। এ ক্ষেত্রে কোন শব্দটি তৎসম, কোনটি তদ্ভব আর কোনটি বিদেশি—এই রকম প্রশ্ন উঠত না।

২০ শতকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তর্ক ছিল রাষ্ট্রনৈতিক। স্বাধীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, সেই প্রশ্নে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই বিতর্ক শুরু হয়। তা ছাড়া পণ্ডিত, লেখক ও রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ বাংলাকে আরবি কিংবা রোমান হরফ দিয়ে লেখার প্রস্তাব করেন। তবে পূর্ববাংলার মানুষের গণদাবির কাছে পাকিস্তান সরকার বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করতে বাধ্য হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ‘জাতীয় ভাষা’র আন্দোলনে পরিণত হয়। এ সময় সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রয়োগের দাবি জোরালো হয়; কিন্তু সরকারের তরফ থেকে পর্যাপ্ত উদ্যোগ বা ব্যবস্থা দৃশ্যমান হয়নি।

২০ শতকে বাংলা বর্ণ নিয়েও অনেক প্রস্তাব আসে। বিশেষ করে ছাপাখানার কাজের সুবিধার জন্য বাংলা যুক্তবর্ণ ও জটিল বর্ণকে সরল করার প্রচেষ্টা দেখা যায়। যেমন উ-কারের অন্তত চারটি ভিন্ন রূপ ছিল। সব কটি রূপ বদলে প্রতিটি ক্ষেত্রে উ-কার বর্ণের নিচে নিয়ে আসা হয়। যুক্তবর্ণকে ভেঙে ফেলার কারণে অনেক বানানের চেহারা পাল্টে যায়। আবার মুহম্মদ আবদুল হাই, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীসহ কয়েকজন ধ্বনিবিজ্ঞানী উচ্চারণকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলা বর্ণমালা থেকে বর্ণ হ্রাসের প্রস্তাব করেছেন। কিছু বর্ণের চেহারা পাল্টানোরও প্রস্তাব আসে। যেমন ব্যঞ্জনের সঙ্গে যুক্ত স্বর যেহেতু পরে উচ্চারিত হয়, সেহেতু প্রতিটি কারচিহ্নকে ব্যঞ্জনের ডানে নিয়ে আসার প্রস্তাব করেছেন কেউ কেউ।

ভাষায় বর্ণ ব্যবহারের প্রয়োজন ও হার বিচার করে মুনীর চৌধুরী ২০ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বাংলা কিবোর্ড নতুন করে সাজান। এই শতকেই বাংলাদেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ভাষাবিজ্ঞান চর্চার আগ্রহ প্রবলভাবে দেখা যায়। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা করার জন্য তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে গেছেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সংস্কৃতে এমএ করতে না পেরে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি প্যারিস থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলা ধ্বনি নিয়ে আধুনিক কালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের। তিনি দুই বছর লন্ডনে থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। ২০ শতকে পৃথিবীজুড়ে বর্ণনামূলক ও সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা হয়েছে। এই ধারার বাংলা ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে আছেন হুমায়ুন আজাদ, রফিকুল ইসলাম, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, মহাম্মদ দানীউল হক প্রমুখ। বাংলা উচ্চারণ, ভাষা পরিকল্পনা, বাংলা লিপি, সমাজ ভাষাবিজ্ঞান ইত্যাদি ক্ষেত্রে এ সময়ে আরও অবদান রেখেছেন নরেন বিশ্বাস, মনসুর মুসা, এস এম লুৎফর রহমান, রাজীব হুমায়ুন প্রমুখ।

২১ শতকে এসে দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলা ভাষাচর্চার আগ্রহ কমেছে। ব্যাকরণ, অভিধান, বানান কিংবা ভাষাবিষয়ক গবেষণা ও প্রকল্পে এখন একসঙ্গে কয়েকজনকে কাজ করতে দেখা যায়। একুশ শতকে বাংলাচর্চাকে এগিয়ে নিতে হলে প্রযুক্তির সঙ্গে এই ভাষার ব্যবহার ও যোগ্যতা বাড়াতে হবে।