বৃষ্টি কেন মাটিতে পড়ার আগে ফেসবুকে পড়ে

এখন আকাশ মেঘলা হয়ে মাটিতে বৃষ্টি পড়ার আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা ফেসবুক বৃষ্টির স্ট্যাটাস আর ছবিতে সয়লাব হয়ে যায়। আমরাই নিজেদের ফেসবুক থেকে বৃষ্টিযাপনের বার্তা সবাইকে জানান দিই। কেন আমরা এমনটা করি?

কোলাজচিত্রপ্রথম আলো

সমকালীন দুনিয়ার প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী ইয়ুভাল নোয়া হারারে এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, এ যুগের মানুষ জানে না সে কী নিয়ে সুখী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের কাছ থেকে সে জানতে পারে, কোন জিনিসটা পেলে তার ভালো লাগবে, জীবন সুন্দর মনে হবে, হতাশা কমবে। নিজের বিবেক কিংবা বিবেচনাবোধ ব্যবহার না করে সবাই তখন ছোটে এমন কিছুর পেছনে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে তার গোচরে এসেছে। ভোগবাদিতা বা কনজিউমারিজমের এই দুর্দমনীয় প্রতিযোগিতার ব্যাপারে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল হলেও পুরোপুরি এড়াতে পারি না এ ব্যাপারকে। কিন্তু জাগতিক বিষয়-আশয়, গেজেট, গাড়ি, খাদ্য, পানীয়, পোশাক-আশাক, জুতা, ব্যাগ, ঘড়ির ব্যাপারটা না হয় বুঝলাম, বৃষ্টির উদ্‌যাপনও কেন ফেসবুকে করতে হচ্ছে আমাদের? বৃষ্টি কেন মাটিতে পড়ার আগে ফেসবুকে পড়ে?

সমুদ্রের পাশে গিয়ে, পাহাড়ে উপত্যকায় চড়ে, হাওরে, নদীতে নৌকায় বৃষ্টিবিলাস করে তার সচিত্র প্রতিবেদন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথা ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে না দিলে যেন এখন সম্পূর্ণই হয় না আমাদের উচ্ছ্বাস।

বৃষ্টি হলে এমন ছবি তুলে ফেসবুকে দেন অনেকেই
ছবি: মোছাব্বের হোসেন

অথচ বাস্তবে বৃষ্টি শহুরে জীবনকে বিপর্যস্তই করে। নগর পরিকল্পিত নয়, মফস্‌সলগুলোতেও উন্নয়নের ঊর্ধ্বমুখী চাপে নিচু ভূমি ভরাট হয়ে, রাস্তা উঁচু হয়ে বসতবাড়ি নিচু হয়ে গেছে। ১০ বছর আগে যেখানে সারা রাত বৃষ্টি পড়লেও পানি দাঁড়াত না, সেখানে ঘণ্টাখানেকের বর্ষণেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।

এখন বৃষ্টি শুধু দরিদ্র আর হতদরিদ্র মানুষের সমস্যা নয়, মধ্যবিত্তেরও সংকট।

কিন্তু আমাদের সমাজ আর সময় এত পাল্টে গেছে, ভোগবাদের সঙ্গে প্রদর্শনবাদিতাও এত বেড়েছে যে আমাদের সারাক্ষণ দেখাতে হয়—সাফল্য সুখের উদ্‌যাপন আর উল্লাস।

সমুদ্রের পাশে গিয়ে, পাহাড়ে উপত্যকায় চড়ে, হাওরে, নদীতে নৌকায় বৃষ্টিবিলাস করে তার সচিত্র প্রতিবেদন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথা ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে না দিলে যেন এখন সম্পূর্ণই হয় না আমাদের উচ্ছ্বাস।

বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতায় তৈরি হওয়া সংকট আর সমস্যা নিয়ে কোনো কথা না বলে আমরা দেখাই খুব ফুর্তি হচ্ছে, ফান হচ্ছে। বৃষ্টির গান-কবিতার সঙ্গে খিচুড়ি বা চানাচুরের ছবি তুলে পোস্ট দিই।

হয়তো আমরা জেনে গেছি, এসব অভিযোগ আর সমস্যা নিয়ে কথা বলে কোনো ফল হবে না। তাই আরও বিভিন্ন অমীমাংসিত বিষয়ের মতো বৃষ্টি–পরবর্তী জলাবদ্ধতা আর তাতে ডেঙ্গু মশার প্রকোপ বেড়ে যাওয়া, এক পরিবারের একাধিক শিশুর মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে চিন্তা করতে আমরা চাই না।

হয়তো এই বিলম্বিত শরতের বৃষ্টি আমাদের সামান্য স্বস্তি দেয়, আরাম দেয় বলে এ নিয়ে ফেসবুকে মাতামাতি করে আমরা কঠিন বাস্তব থেকে পালাই।