কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
বাংলাদেশ নিয়ে জর্জ হ্যারিসনের কথা
আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে ২০০৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত প্রথম আলোর বিশেষ আয়োজনে জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে আশরাফুল হকের এই লেখাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল। আমাদের বহু মূল্যবান লেখা শুধু মুদ্রণের পাতায় রয়ে গেছে; তেমনি একটি এই ‘বাংলাদেশ নিয়ে জর্জ হ্যারিসনের কথা’। তবে দীর্ঘদিন কেবল ছাপার পাতায় সীমাবদ্ধ থাকা এই লেখা বিজয়ের মাসে অনলাইনে উঠে এল নতুন পাঠকদের সামনে।
বিজয় দিবস ও মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনলাইনপূর্ব যুগে যত লেখা, সাক্ষাৎকার, স্মৃতিচারণ ও কবিতা ছাপা হয়েছিল, বিজয়ের পুরো মাসজুড়ে সেসব ধুলোঝরা পৃষ্ঠা আমরা প্রথমবারের মতো অনলাইনে তুলে আনছি।
‘বিটলস’ কেবল বিশ্ববিখ্যাত একটি সংগীতের ব্যান্ডদলই ছিল না, ষাটের দশকে নতুন প্রজন্মকে এই দল অনেক কিছুকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার, নানা বিষয়ে নতুনভাবে ভাবার পথ দেখিয়েছিল। আমেরিকা তথা বিশ্বের মানুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের চিন্তার জগতে প্রচণ্ড ঝড় তুলেছিলেন এই দলের সদস্যরা। দলটি একের পর এক অ্যালবাম বের করে পপ সংগীতে যে যুগান্তকারী ধারা সৃষ্টি করেছিল, অনেকের স্মৃতিতে সেই বিস্ময় আজও অম্লান। সেই দলের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসন ১৯৭১ সালের দুঃসময়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে। বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-বেদনা, দুর্ভোগ-দুর্দশা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার অন্যতম অংশীদার তিনি। ১৯৭১ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে ব্যতিক্রমী কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছিল, তার নাম ছিল কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। এই কনসার্টের অন্যতম আয়োজক ছিলেন জর্জ হ্যারিসন। সেই কনসার্ট, বিশেষ করে ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামের গানটি আমেরিকা তথা বিশ্বের অপরাপর এলাকার মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ব্যাপকভাবে সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীরাও সেই গানে খুঁজে পেয়েছিলেন অনুপ্রেরণা।
‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু এই কনসার্টকে সফল করার জন্য জর্জ হ্যারিসন কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, এর প্রস্তুতিপর্বটা কেমন ছিল, তা আমরা অনেকেই জানি না।
সেই ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু এই কনসার্টকে সফল করার জন্য জর্জ হ্যারিসন কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, এর প্রস্তুতিপর্বটা কেমন ছিল, তা আমরা অনেকেই জানি না। জর্জ হ্যারিসনের আত্মজীবনীমূলক বই আই মি মাইন (I ME MINE), যেখানে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, তার কিছু অংশ এ রকম:
‘...গীতিকার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে নয়, আমি মূলত গান লিখেছি মন থেকে কিছু বের করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
...আমি মনে করি এমন একধরনের লেখক আছেন, যাঁদের কাছে তাঁদের অনুভূতি কিংবা অভিজ্ঞতার বর্ণনাটা যথেষ্ট নয়, তাঁদের কাছে এটা একটা শৈলী।
যেসব ভারতীয় সংগীত এখন আমরা শুনছি, তা সরাসরি সংগীতজ্ঞের আবেগ বহন করে। তাই গান লেখাটা আমার কাছে সেই আবেগকে ছাপিয়ে ওঠার একটি মাধ্যম, ওই মুহূর্তের, ওই সময়ের।
তেমনি একটি গান ‘বাংলাদেশ’, যা ওই সময়ের। দুঃসময়ের, দুঃখভারাক্রান্ত সত্তরের।
সেটা ছিল ১৯৭১ সাল, যখন আমি লস অ্যাঞ্জেলেসে রাগা ছবির শব্দ সংযোজন করছিলাম। রবি (বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় সেতারবাদক রবিশঙ্কর) বলছিলেন, তিনি একটা কনসার্ট করতে চান। তিনি সাধারণত যে ধরনের কনসার্ট করেন, এটা হতে হবে তারচেয়ে বড়, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষুৎপীড়িত মানুষের জন্য হাজার পঁচিশেক ডলার সংগ্রহ করা যাবে। তিনি জানতে চাইলেন এর জন্য আমি কোনো উপায় বের করতে পারি কি না, আমি এসে অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারি কি না, পিটার সেলার্সকে নিয়ে আসতে পারি কি না কিংবা অন্য যেকোনোভাবে সাহায্যকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারি কি না।
তারপর তিনি আমাকে খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিনে যুদ্ধ ও দারিদ্র্যসংক্রান্ত প্রকাশিত প্রতিবেদনের অংশবিশেষ (Cuttings) দেওয়া শুরু করলেন। আমিও এ ব্যাপারে অবহিত হতে থাকলাম এবং পরে ভাবলাম—হ্যাঁ, তাঁকে সাহায্য করার জন্য অবশ্যই আমার কিছু করা উচিত।
শুরু থেকেই বিটলদের দৃষ্টিভঙ্গিটা এমন ছিল যে যদি কিছু করতে হয় তবে তা বড় করেই করা উচিত এবং সেটা মিলিয়ন ডলারেরই হবে না কেন।
রবি বলছিলেন, তিনি একটা কনসার্ট করতে চান। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষুৎপীড়িত মানুষের জন্য হাজার পঁচিশেক ডলার সংগ্রহ করা যাবে। তারপর তিনি আমাকে খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিনে যুদ্ধ ও দারিদ্র্যসংক্রান্ত প্রকাশিত প্রতিবেদনের অংশবিশেষ (Cuttings) দেওয়া শুরু করলেন। আমিও এ ব্যাপারে অবহিত হতে থাকলাম এবং পরে ভাবলাম—হ্যাঁ, তাঁকে সাহায্য করার জন্য অবশ্যই আমার কিছু করা উচিত।
এভাবেই আমি জড়িয়ে গেলাম এবং পরবর্তী তিন মাস ধরে টেলিফোনে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করেছিলাম, যা কনসার্ট ফর বাংলাদেশকে সফল করে তুলেছিল। লোকজনকে অনুপ্রাণিত করার জন্য আমাকে অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে, এরিকসহ অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়েছে, যাঁরা পরে কনসার্টে অংশ নিয়েছেন।
আমরা খুব সামান্য মহড়া করতে পেরেছিলাম। প্রকৃতপক্ষে সবাইকে নিয়ে কোনো মহড়াই হয়নি। আমরা অনেক কষ্টে এখানে-সেখানে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।
তারিখ ঠিক করেছিলাম আমরা একটি বিশেষ সময়সীমার মধ্যে। ভারতীয় একজন জ্যোতিষী আমাকে বলেছিলেন, ‘এটা একটা ভালো সময়’ এবং সেটা আগস্টের প্রথম দিকের কথা। তারপর আগস্টের যথাযথ দিনটি আমরা পেয়ে গেলাম এবং ওই দিনে ম্যাডিসন স্কয়ার ছিল ফাঁকা। আমরা তা ভাড়া নিলাম এবং শো করলাম। দুটি শো করেছিলাম। কারণ, প্রথমটার সব টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। আমাদের ভাগ্য এতটাই ভালো ছিল যে প্রায় সবকিছু ঠিকঠাকমতো হয়ে গিয়েছিল; ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ওই অনুষ্ঠান সত্যিই চমৎকার হয়েছিল।
আমাদের ব্যান্ডের লোকেরাই শব্দ গ্রহণ/নিয়ন্ত্রণ (Sound Mix) করেছিলেন, আলোকসজ্জায় ছিলেন চিপ মঙ্ক (Chip Monck) এবং অনুষ্ঠানটি সেলুলয়েডে ধারণ করেছিলেন অ্যালেন ক্লেইনের (Allen Klein) লোকজন। তবে ধারণের কাজটি ভালো হয়নি।
তীব্র আলোকসজ্জার মধ্যে কাজ করার ফলে আমরা প্রায় ভাজা ভাজা (Fried) হয়ে গিয়েছিলাম।
...বেশ কয়েকটি ক্যামেরা থাকা সত্ত্বেও অনুষ্ঠানটি ভালোভাবে ধারণ করা যায়নি। দুর্ভাগ্যক্রমে প্রতিটি ক্যামেরায়ই কোনো না কোনো সমস্যা ছিল বা সমস্যায় পড়েছিল।...
এখন যে ফিল্মটি আপনারা দেখতে পান, তা অনেক ভোজবাজির কৌশলে তৈরি করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমার প্রথম গান ‘ওয়াহ ওয়াহ/WAH WAH’-তে ১২টি ‘কর্তন’ (Cuts) এবং ১২টি সংযোজন রয়েছে। এসবের তিনটি আসল আর অন্য নয়টি কৃত্রিম। আমাদের বিভিন্ন ধারণকৃত অংশ (Shots) বিভিন্ন জায়গা থেকে কেটে এনে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু অংশ ব্লো-আপ করতে হয়েছে। ফলে সেগুলো খুব ঝাপসা ও বাজে হয়েছে। এসব ছাড়া আরও কিছু নেতিবাচক ব্যাপার রয়েছে সেখানে।
আজও কোনো বাঙালি রেস্তোরাঁয় ঢুকলে ওয়েটাররা আমাকে বলে, ‘ওহ আপনিই হ্যারিসন, যখন জঙ্গলে যুদ্ধ করছিলাম, তখন আমরা জানতাম এখানেও আমাদের জন্য একজন ভাবছে।’ প্রায় সর্বত্রই কনসার্টটির শুভ প্রভাব পড়েছিল। এটা বাঙালিদের প্রচণ্ড অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল এবং এর দ্বারা পাকিস্তানি হিটলারদের কার্যক্রম বিশ্ববাসীর কাছে উন্মোচিত হয়ে পড়ছিল।
কিন্তু শিল্পীরা খুব ভালো ছিলেন। সবাই আন্তরিকভাবে এতে অংশ নিয়েছিলেন। আমি তাঁদের এই নিশ্চয়তা দিয়েছিলাম যে তাঁরা যদি এতে কাজ করতে পছন্দ না করেন, তাহলে চলে যেতে পারেন।...
...এটা ছিল একটা বিরাট দায়িত্ব এবং তা ভালোভাবেই সম্পাদিত হয়েছিল।
...যাহোক, চূড়ান্ত ফলাফল হলো, আমরা বাংলাদেশের জন্য এর মাধ্যমে ব্যাপক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম, কারণ আমরা যখন কনসার্টটি করছিলাম, তখন মার্কিন সরকার পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাচ্ছিল। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছিল, কিন্তু খবরের কাগজগুলোতে লেখা হচ্ছিল সামান্যই।...আমাদের অনুষ্ঠানের ফলে বাংলাদেশ অনেক প্রচার পেয়েছিল এবং ঘটনাপ্রবাহ ভিন্ন দিকে বইতে শুরু করেছিল।
আজও কোনো বাঙালি রেস্তোরাঁয় ঢুকলে ওয়েটাররা আমাকে বলে, ‘ওহ আপনিই হ্যারিসন, যখন জঙ্গলে যুদ্ধ করছিলাম, তখন আমরা জানতাম এখানেও আমাদের জন্য একজন ভাবছে।’
জর্জ হ্যারিসন ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে কখনো বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যেকোনো দেশপ্রেমিক বাঙালি যদি ব্যাপারটা একটু ভাবেন, তাহলে নিশ্চয়ই অনুতাপ অনুভব করবেন।
প্রায় সর্বত্রই কনসার্টটির শুভ প্রভাব পড়েছিল। এটা বাঙালিদের প্রচণ্ড অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল এবং এর দ্বারা পাকিস্তানি হিটলারদের কার্যক্রম বিশ্ববাসীর কাছে উন্মোচিত হয়ে পড়ছিল।...”
বি.দ্র.: জর্জ হ্যারিসন ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে কখনো বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যেকোনো দেশপ্রেমিক বাঙালি যদি ব্যাপারটা একটু ভাবেন, তাহলে নিশ্চয়ই অনুতাপ অনুভব করবেন। তিনি নিজের মতো করে এ দেশে আসতে পারতেন, কিন্তু যিনি হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে এ দেশ ও দেশের মানুষের সহমর্মী হয়েছিলেন, তাঁকে সপরিবার আমন্ত্রণ জানানোটাই হতো বাংলাদেশের জন্য সৌজন্যমূলক আচরণ। জীবিত অবস্থায় তাঁকে সম্মান জানাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। মন্দের ভালো হিসেবে কোনো একটা উপায় বের করে এখনো তাঁকে সম্মান দেখানো যেতে পারে। আশা করছি, সরকার ও দেশপ্রেমিক নাগরিকেরা ব্যাপারটি নিয়ে ভেবে কিছু একটা উপায় বের করবেন। সবশেষে বিজয়ের মাসে এই মহান শিল্পীর প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা। একই সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাই কনসার্ট ফর বাংলাদেশে অংশগ্রহণকারী অন্য (লিওন রাসেল, রিঙ্গো স্টার, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রবিশঙ্কর প্রমুখ) শিল্পীকেও।