শশী কেন চাঁদের মতো দ্রুত নিভে গেল!

দীর্ঘদিন কর্কট রোগে ভুগে স্বামী আবদুল্লাহ আল মামুন ও ফুটফুটে দুটি সন্তান রেখে আজ (১৬ মার্চ) সকালে মারা গেছেন উন্নয়নকর্মী আতিয়া আফরিন শশী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা মানুষটি গান গাইতেন, ছিলেন অনেকেরই প্রিয়জন। মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে শোকানুভূতি জানাচ্ছেন তাঁর বন্ধু-স্বজনেরা।

আতিয়া আফরিন শশীছবি: সংগৃহীত

১৯৯৪-৯৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার সময় বন্ধু টিপু অনুরোধ করল ওর এলাকার ছোট বোন একজন আসবে, তাকে রুমে রাখতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা হয়। পরীক্ষার্থীরা কোনো না কোনো পরিচয়ের সূত্র ধরে হলেই থাকে। টিপুর সূত্র ধরে আমার রুমে শশী এল—আতিয়া আফরিন শশী। পুতুল পুতুল চেহারার একটা মেয়ে। ছোট কোঁকড়ানো চুল। কথা বলার সময় কেমন ভাঙা ভাঙা গলায় আওয়াজ বের হয়। টিপু জানাল, নতুন কুঁড়িতে গানে প্রথম হয়েছিল শশী। এ খবর জানামাত্র আর কি ওর রেহাই আছে! প্রতিদিন পরীক্ষা দিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফেরে, চান্স পাবে কি না, সেই টেনশনে তটস্থ থাকে...কিন্তু সেসবের পরোয়া করি না আমরা। একের পর এক গান চলতে থাকে গভীর রাত পর্যন্ত। নজরুল আর আধুনিক, বিশেষ করে ভারতীয় বাংলা গানে ওর দখল ছিল অবিশ্বাস্য!

স্বামী আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে আতিয়া আফরিন শশী
ছবি: সংগৃহীত

ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। সরকার ও রাজনীতি বিভাগে পড়ার সুযোগ পেল শশী। আর সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার ছিল, ওর সিট হলো আমাদেরই জাহানারা ইমাম হলে। সিনিয়র আপুরা পূর্বপরিচিত হলে হলজীবন স্বর্গে পরিণত হয়! বিশেষ করে যে হলের সিনিয়র আপুরা করিডরে, ডাইনিংয়ে, সিঁড়িতে শশীর পুতুল পুতুল গালে একটা আদুরে টিপুনি দিয়ে যান, সে হলের সবাই ওর আপনজনে পরিণত হয়।

জাহানারা ইমাম হল তখন সবেমাত্র হয়েছে। নতুন হিসেবে জাহানারা ইমাম হলে সে সময় অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। কি সাধারণ অনুষ্ঠান, কি প্রতিযোগিতা—সবখানে শশীর গান থাকতেই হবে!

দুই সন্তানের সঙ্গে আতিয়া আফরিন শশী
ছবি: সংগৃহীত

১৯৯৬ সালে দুবার ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, পরে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে মিছিলের পাশাপাশি চৌরঙ্গীতে গান আর কবিতা ছিল প্রতিবাদের অন্যতম হাতিয়ার। তত দিনে শশীর সহপাঠী ও বন্ধু মামুন—আবদুল্লাহ আল মামুনও আমাদের প্রিয় হয়ে উঠেছে গানের জন্য। যেকোনো অনুষ্ঠানে-প্রতিবাদে মামুন-শশী বা শশী-মামুনের গান অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। আর এই গানই ওদের জড়িয়েছিল প্রেমের বন্ধনে। আমরা বলতাম, সুরের বাঁধনে বাঁধা ওরা। একসঙ্গে উচ্চারিত হতো ওদের নাম।

নাট্যকার সেলিম আল দীন যখন টিএসসি পরিচালকের দায়িত্ব নিলেন, তখন ক্যাম্পাসজুড়ে কথায় কথায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, গান-নাটক লেগেই থাকত। সেবারই প্রথম মহুয়া ফুল ফোটার উৎসব হয়। নয় দিনব্যাপী আন্তহল নাট্য প্রতিযোগিতা হলো। মামুন-শশী হাসিমুখে সবখানে! আমাদের বাংলা বিভাগের বসন্তের অনুষ্ঠানেও গান করেছে ওরা।

যেন গানেই বাঁচত ওরা দুজন!

কথা বলার সময় কেমন ভাঙা ভাঙা গলায় আওয়াজ বের হয়। টিপু জানাল, নতুন কুঁড়িতে গানে প্রথম হয়েছিল শশী। এ খবর জানামাত্র আর কি ওর রেহাই আছে! প্রতিদিন পরীক্ষা দিয়ে ক্লান্ত হয়ে ফেরে, চান্স পাবে কি না, সেই টেনশনে তটস্থ থাকে...কিন্তু সেসবের পরোয়া করি না আমরা। একের পর এক গান চলতে থাকে গভীর রাত পর্যন্ত। নজরুল আর আধুনিক, বিশেষ করে ভারতীয় বাংলা গানে ওর দখল ছিল অবিশ্বাস্য!

শশী প্রশান্ত মৃধাকে ভুল করে ‘প্রাঞ্জল দাদা’ ডাকত। আর প্রশান্তর বদলে তাঁকে ‘প্রাঞ্জল’ বলা দেখে আমরা হাসতাম। তো শশী আমাদের সেই হাসি দেখেই জিব কাটত! কিন্তু শশীর দেওয়া প্রশান্তর এই ‘প্রাঞ্জল’ নামটাই পছন্দ ছিল আমাদের। আমরা ওকে বলতাম ‘প্রাঞ্জল শশী’! প্রাঞ্জলই তো ছিল সে! কারও সঙ্গে বিরোধ হয়নি কখনো তো! সহপাঠী-সিনিয়র-জুনিয়র—সবার কাছেই সে প্রিয় প্রাঞ্জল মুখ শশী!

টিআইবি বা অন্য এনজিওগুলোয় শশী কাজ করেছে সুনামের সঙ্গে। কর্মক্ষেত্রে ওর দায়িত্বশীলতার খবর পেতাম ওরই সহকর্মীদের মুখে।

মেয়েটা কর্কট রোগের সঙ্গে লড়েছে তিন বছর। ওর দুটি ফুটফুটে সন্তান! আজ ওর চলে যাওয়ার খবর শুনে শশীকে যেমন মনে পড়ছে, মনে পড়ছে ওর সন্তানদের কথাও। বারবার ভাবছি, আমাদের সেই ছোট্ট শশী এত দ্রুত নিভে গেল! শশী মানে তো চাঁদ, শশী যে চাঁদের মতোই দ্রুতই ফুরিয়ে গেল। শশী কেন চাঁদের মতো দ্রুত নিভে গেল!

আজ কেবলই স্মৃতিরা হানা দিচ্ছে! আমাদের জাহানারা ইমাম হলে শশীর গাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বারবার অনুরোধে গাওয়া গান ছিল, ‘ওই গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি/ আমায় চমকে দাও, চমকে দাও, দাও, দাও, দাও/ আমার মন মানে না, দেরি আর সয় না/ গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি/ আমায় চমকে দাও, চমকে দাও, দাও, দাও, দাও...।’

মনে হয়, আমাদের সবাইকে আজও চমকে দিয়ে রোদের ঝিকিমিকিতে মিশে গেল শশী!

ফারজানা সিদ্দিকাঃ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যাপক