‘পেয়ারার সুবাস’ সিনেমাটি দাম্পত্য সম্পর্কে যেভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে

‘পেয়ারার সুবাস’ সিনেমার পোস্টারছবি : ফেসবুক থেকে

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক নূরুল আলম আতিকের সিনেমা মানেই ব্যতিক্রমধর্মী ও নতুনত্বের ছোঁয়া, যা হামেশাই দর্শকদের মনস্তত্ত্বে চিন্তার খোরাক জোগায়। ভিন্নধারা, আলাদা ভাবনা ও অন্য ধাঁচের চলচ্চিত্র নির্মাণে পরিচালক আতিকের জুড়ি নেই। ‘পেয়ারার সুবাস’ সে রকম একটি সিনেমা, যেটি সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল একটি বিষয়কে দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছে। পারিবারিক ধর্ষণ বা দাম্পত্য জীবনে সম্মতিহীন শারীরিক সম্পর্ক ও বৈবাহিক সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক দাম্ভিকতার জটিল সমীকরণকে উপজীব্য করে সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে।

নানান সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে দাম্পত্য জীবনে সম্মতিহীন শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে সমাজে আলোচনা বরাবরের মতোই হাজার বছর ধরেই উপেক্ষিত হয়ে আসছে। দাম্পত্য সম্পর্কের জটিল মেরুকরণের স্পর্শকাতরতার জন্য আমাদের সমাজে এই বিষয় নিয়ে কেউই খোলামেলা কিছুই বলতে চান না। এমন সংবেদনশীল বিষয়টি নিয়ে তাবৎ বিশ্বের বহু নারী নীরবে সহ্য হয়তো করেই জীবন পাড় করছেন। তবে হলিউড বা বলিউডে দাম্পত্য ধর্ষণ নিয়ে বেশ কয়েকটি সিনেমা ইতিমধ্যে নির্মিত হলেও বাংলাদেশে পরিচালক আতিকের হাত ধরেই যাত্রা শুরু করল এ ধরনের ভিন্নধারার সিনেমা।

সম্মতিহীন শারীরিক সম্পর্ক বিবাহিত নারীদের জন্য শুধু অবর্ণনীয় কষ্টেরই নয়, এটা বিবাহিত জীবনের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অমর্যাদাকর ও অসম্মানজনকও বটে। দাম্পত্যের এই দুর্বোধ্য সম্পর্ক বাংলা চলচ্চিত্রে আগে কখনো উঠে আসেনি, যা বাস্তবেই আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখাবে। এই সিনেমার মাধ্যমে পুরুষ সমাজ, স্ত্রী ও দাম্পত্য সম্পর্কের প্রতি অধিকতর সচেতন ও মানবিক হবেন।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, লক্ষ্যমাত্রার ৫.২.১ নম্বর সূচকে নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা ও বর্তমান বা সাবেক স্বামী কর্তৃক যৌন বা অন্য কোনো প্রকার নির্যাতন প্রতিরোধের কথা বলা আছে। সাধারণভাবে যুদ্ধ বা সামরিক অভিযানে নারী নির্যাতনের চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি নারীরা নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হন পরিবারে, চারদেয়ালের মধ্যে। শত শত কাহিনি নিয়ে সিনেমা তৈরি করা হলেও অন্তপুরের স্ত্রীদের হাজার বছর ধরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ নির্যাতন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়টি পরিচালকদের কাছে অজানা কারণেই অবহেলিত থাকছে বহু বছর ধরে। তবে এর মধ্যেও অনেক সাহসী পরিচালক বিভিন্ন সময় দাম্পত্য জীবনে স্বামী কর্তৃক যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের বিষয়কে উপজীব্য করে সিনেমা তৈরি করেছেন। উদাহরণ হিসেবে ১৯৮০ সালে বলিউড পরিচালক রবার্ট গ্রিনওয়াল্ডের ‘দ্য বার্নিং বেড’ সিনেমাটির কথা বলা সমীচীন মনে করি। যেখানে সম্ভবত প্রথম স্বামী কর্তৃক স্ত্রী ধর্ষণের বিষয়টি দর্শকদের সামনে একেবারে খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এরপর হলিউড পরিচালক নীল বুবয় টান ‘দ্য ম্যারিটাল রেইপ (২০০১)’, কানাডিয়ান পরিচালক এনি হুইলার ‘অ্যাজ অব ম্যাডনেস (২০০২)’এবং পিটার লেভিন ‘ম্যারেজ অ্যান্ড রেইপ: দ্য রাইডআউট কেস (১৯৮০)’ নামে দাম্পত্য ধর্ষণ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সমাজ সচেতনতা সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।

অপর দিকে, ভারতীয় উপমহাদেশে দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর সম্মতিবিহীন যৌনাচার নিয়ে ২০০১ সালে বলিউডে পরিচালক কল্পনা লাজমির ‘দামান’ সিনেমাটি বেশ আলোচিত ও দর্শক নন্দিত হয়েছে। এরপর জাগ মুন্ধার ‘প্রোভোকড (২০০৬)’, লীনা যাদবের ‘পার্চড (২০১৫)’ সাম্প্রতিক সন্দীপ রেড্ডি ভাংগার ‘অ্যানিমেল (২০২৩)’ প্রভৃতি বৈবাহিক ধর্ষণকেন্দ্রিক সিনেমাগুলো সাধারণ দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করে বেশ আলোচনার সৃষ্টি করেছে।

বাস্তবে এ ধরনের সিনেমা হলিউড বা বলিউড—যেখানেই নির্মিত হয়েছে, সেখানেই সিনেমার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগের তকমা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি এতটাই ব্যক্তিগত ও গোপনীয় যে অশ্লীলতা ছাড়া এ সম্পর্ক নিখুঁতভাবে সিনেমায় তুলে ধরা বেশ কঠিন। এ ক্ষেত্রে ‘পেয়ারার সুবাস’ সিনেমাটিতে অশ্লীলতার ছোঁয়া নেই, নেই যৌনতার উন্মুক্ত প্রকাশ, আছে শুধু গভীর অনুভূতির অন্বেষণ। আরও রয়েছে বিবেক জাগ্রত করার সীমাহীন প্রয়াস। এদিক দিয়ে পরিচালক আতিক ‘পেয়ারার সুবাস’ নির্মাণে সুপরিকল্পিতভাবে অসাধারণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন বলেই মনে হয়। পরিচালক সিনেমাটিতে পুরুষতান্ত্রিক অহমিকা ও দাম্পত্যে সম্মতিহীন শারীরিক সম্পর্কটিকে অত্যন্ত সুচারুরূপে তাত্ত্বিক ও দার্শনিকভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা বলিউড বা হলিউডের অনেক নামীদামি পরিচালকেরা করে দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে দাম্পত্য ধর্ষণকেন্দ্রিক সিনেমাগুলোয় নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে পরিশেষে বিদ্রোহী, প্রতিবাদী ও প্রতিশোধপরায়ণ হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায় এবং প্রায় সব কটি সিনেমাতে স্ত্রীরাই তাঁদের স্বামীদের হত্যা করে প্রতিশোধ নিয়ে থাকেন। ‘পেয়ারার সুবাস’ এদিক থেকে একটু আলাদা, এখানে অন্যান্য সিনেমার মতো পেয়ারা নিজে স্বামীকে হত্যা করে না; বরং তার প্রেমিক মিস্ত্রিই (আহমেদ রুবেল) মুনশিকে হত্যা করেছে। তা ছাড়া সম্ভবত সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই সিনেমা নির্মাতাদের পক্ষ থেকে শিশুদের ছবিটি দেখতে মানা করা হয়েছে, যা বাংলাদেশে এই প্রথম এবং এটা সত্যি অনুকরণীয় ও প্রশংসনীয় বটে।

পরিচালক নূরুল আলম আতিকের সিনেমায় আমরা প্রতীকের বহুমাত্রিক ব্যবহার লক্ষ করি, যা এই সিনেমাতেও দেখা যায়। শামুক, সাপ, ব্যাঙ, ঝিঁঝি পোকার শব্দ, আলতা, কবুতর, কবুতরের খাঁচা, ধুতরা ফল, কাঁঠালের কোয়া তোলার দৃশ্য, রক্তের ছাপ, ঝোড়ো রাত্রি, বিক্ষুব্ধ আবহাওয়া, বৃষ্টি, বন্যাসহ ব্যবহৃত প্রতীক এই সিনেমাকে দার্শনিকভাবে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ক্যামেরার লেন্সের মাধ্যমে এই সিনেমায় ব্যবহৃত প্রতীকগুলো সিনেমার মূল বিষয়কে ভীষণভাবে প্রভাবিত ও জীবন্ত করেছে। দৃশ্যায়ন ও ব্যবহৃত পোশাকপরিচ্ছদ চরিত্রায়ণের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে করা হয়েছে বলেই সিনেমাটিকে আরও বাস্তব মনে হয়েছে। তা ছাড়া এ সিনেমায় কলাকুশলীরা পারিবারিক সম্পর্কের জটিল সমীকরণ চরিত্রায়ণ করতে অসাধারণ অভিনয় করেছেন, বিশেষ করে জয়া আহসান, তারিক আনাম, সুষমা সরকার এবং সর্বোপরি সদ্য প্রয়াত অত্যন্ত মেধাবী অভিনেতা আহমেদ রুবেল।

একদম ভিন্ন ধাঁচের ‘পেয়ারার সুবাস’ সিনেমাটি পরিচালনা, চিত্রনাট্য, দৃশ্যায়ন, ভিডিওগ্রাফি ও নেপথ্য সংগীতসহ সব দিক দিয়ে প্রমাণ করল যে বাংলা চলচ্চিত্র ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এবং একটি অন্য ধারার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই সিনেমার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, এটি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মনস্তত্ত্বে একটি কাড়া নাড়াতে সক্ষম হয়েছে। নূরুল আলম আতিকের ‘পেয়ারার সুবাস’ সিনেমা পর অন্য পরিচালকেরা ব্যতিক্রমী সিনেমা নির্মাণে নিশ্চিতভাবেই একটি প্রত্যক্ষ চাপ ও তাড়না অনুভব করবেন।

নানান বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ভিন্নধারার অভিনব গল্প ও দর্শন নিয়ে বিনোদনের পাশাপাশি দর্শকদের হৃদয়ছোঁয়া সিনেমা আরও বেশি বেশি নির্মিত হোক, এই প্রত্যাশা রইল।