তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, রাজীব আশরাফ কই!

কবি, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকবি রাজীব আশরাফ। ১ সেপ্টেম্বর মারা গেছেন এই প্রতিভাবান মানুষটি। তাঁর অকালপ্রয়াণের পর তাঁর দীর্ঘদিনের সহচর ‘বাংলা ফাইভ’ ব্যান্ডের ভোকালিস্ট সিনা হাসান লিখেছেন এই লেখা। লেখাটিতে ধরা পড়েছে বোহেমিয়ান এক শিল্পীর মুখ, নিজেকে যিনি সব সময় বলতেন, ‘আমি লাস্টবেঞ্চ, আমি ব্যাকডোর।’

রাজীব আশরাফছবি: রিয়েল এপারচার

আমি খুব দ্রুত তালা মারছি। সিঁড়িতে শুনতে পাচ্ছি পায়ের শব্দ। হাত কাঁপছে, তালা লাগছে না। ওদিকে সিঁড়ি ভাঙার শব্দটা বাড়ছে।

যেই তালা লাগল, অমনি এমন একটা ভাব ধরে সিঁড়ি বেয়ে নামা শুরু করলাম যে কিছুই জানি না। হঠাৎ দেখা হলো আন্টি, মানে রাজীব আশরাফের মায়ের সঙ্গে। তিনি ছয়তলা ভেঙে এই চিলেকোঠায় এসেছেন রাজীবকে খুঁজতে আমার কাছে। ‘আন্টি, স্লামালাইকুম।’

‘রাজীব কই?’
‘আমি তো জানি না, আন্টি। আমি তো আরও বের হচ্ছি বাসার বাইরে, দোকানে যাচ্ছি, এই যে বাসায় তালা মেরে বের হলাম।’

মায়ের ফোনটা না ধরে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজীব বলেছিল, ‘সিনা, আমি ভেতরে থাকলাম। তুই বাইরে থেকে তালা মেরে বের হ, আম্মা কনফার্ম আসবে খুঁজতে।’ যখনই সে আমাকে এমন বলত, তখনই ওর কথামতো আমি এভাবেই ওকে খোঁজার অভিনয় করতাম। সময়টা ২০০৭, জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি। মিরপুর, সাড়ে এগারো।

আমি রাজীব আশরাফকে ‘আপনি’–‘তুমি’—দুই–ই বলতাম। পরিচয়ের প্রথম দিকে তাকে ডাকতাম ‘রাজীব ভাই’ বলে। পরে ঘনিষ্ঠতা যখন বাড়ল, তখন ‘আপনি’ থেকে কীভাবে যেন ‘তুমি’তে নেমে এলাম। তার সঙ্গে আমার কত যে স্মৃতি!

আরেক দিনের কথা। বিহারি ক্যাম্পের একটা রুমে তালা মারলাম রাজীবকে। তারপর শুরু হলো অভিনয়, জানিই না সে কোথায়। রাজীবের তৎকালীন স্ত্রী জলি আপাকে নিয়ে রিকশা করে তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, রাজীব আশরাফ কই—রাজীব কই, রাজীব কই বলে! দোকানে, মোড়ে, গলিতে, সাংবাদিক প্লট, প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট ইত্যাদি নানা জায়গায়। তারপর ব্যর্থ ভঙ্গিতে জলি আপাকে বিদায় দিয়ে আবার সেই বিহারি ক্যাম্পের গলি-ঘুপচির ঘরের তালা খুলে ঢুকে তাকে বললাম, ‘চলে গেছে।’ সে তখন দেয়ালে সযত্নে স্কচটেপ দিয়ে একটা ম্যাচবক্স সাঁটছে। আর মার্কার দিয়ে লিখছে ‘In case of emergency’। এই কথা লেখার কারণ, বাসায় যদি ম্যাচ শেষ হয়ে যায়, তখন এটিই হবে শেষ দেশলাই।

২০০৪-০৫-০৬ সালে আমি তখন, প্লেটোনিক’ নামে একটা ব্যান্ড করে বুঝতে পরলাম, এটা করা এখন আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং নাটক বানানোর চেষ্টা করি। যেই ভাবা, সেই কাজ। ১০ টাকা ভাড়ায় মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নাটক-টেলিফিল্মের সিডি নিয়ে এসে দেখলাম। ব্যান্ড সংগীতে ইস্তফা দিয়ে ব্যর্থ মনোরথে ঘুরছিলাম। হঠাৎ একদিন চোখের সামনে দেখলাম রাজীব আশরাফকে। ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে তাকে দেখেছিলাম ফিরোজ মাল চরিত্রে। জানতাম, সে বন্ধু রিংকুর বড় ভাই। কিন্তু পরিচয় ছিল না।

অবশেষে মার্চ মাসে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর পড়াশোনায় গ্যাপ দিয়ে ঘুরছি। তখন কথা হতো ‘ভাই ব্রাদার’–এর হুমায়ুন সাধু ভাইয়ের সঙ্গে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথা হলেও দেখা হতো না। কারণ, তিনি অনেক ব্যস্ত। সম্ভবত ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ নিয়ে।

রাজীব আর আমি—মোট চারটে বাসায় আমরা একসঙ্গে থেকেছি। বাসা মানে একটা রুম—ফ্লোরিং বিছানা, একটা ঘটর ঘটর টেবিল ফ্যান। কত রাত এক প্যাকেট ম্যাগি নুডলস দুভাগ করে খেয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। এর মধ্যে একটা বাসা ছিল, রাত ১১টায় যার প্রধান ফটক বন্ধ হতো। রাজীব অনেক দিনই রাত ১১টার পর এসে আর ঢুকতে পারেনি বাসায়। অগত্যা কেঁচিগেটের ওপাশ দিয়ে শুধু ম্যাগিটা পাস করে দিয়ে চলে গেছে ফাহিম ফেরদৌস ভাইয়ের বাসায় কিংবা অন্য কোথাও।

‘আমি নাটক, সিনেমা, ডকুমেন্টারি—এগুলার শুটিং কীভাবে করে, শিখতে চাই, আপনি তো নাটক করেন, আমি কাজ করতে চাই।’ এটা ছিল আমার রাজীব আশরাফের সঙ্গে প্রথম কথোপকথন। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাস। মিরপুর সাড়ে এগারো, বি ব্লক, ৪ নম্বর রোড, একটা চায়ের দোকানের পাশে।

সে সময় রাজীবের সঙ্গে পরিচয় হওয়া ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সে রাস্তার পাশ থেকে কুড়িয়ে নিল একটা কনডেন্সড মিল্কের টিন-খসা কাগজ, দোকান থেকে চেয়ে নিল কলম। তারপর লিখল, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’, ‘চিলড্রেন অব হ্যাভেন’, ‘ইভানস চাইল্ডহুড’, ‘মিরর’, ‘টেস্ট অব চেরি’, ‘রশোমন’সহ বারোটি সিনেমার নাম। বলল, ‘এইগুলা আগে দেখো।’

রাজীব আশরাফ
ছবি: সংগৃহীত

সে সময় সম্পর্কে যাঁদের ধারণা আছে, তাঁরা জানেন, তখন রাইফেলস স্কয়ারের চারতলা আর শাহবাগ আজিজ মার্কেটের একটি দোকানে অর্ডার করলে বেশ কিছুদিন সময় নিয়ে তারা ডিভিডি বানিয়ে দিত। আমি তাই করলাম। পরে বাটন ফোনে মেসেজ করে রাজীবকে একে একে লিখে পাঠালাম কোন সিনেমা দেখে কেমন লাগল। সব সময় অবশ্য ফোনে টাকা থাকত না। তখন দোকানে গিয়ে দুই টাকা মিনিটে ঠিক দুই দিন পরপর কল দিতাম, ‘রাজীব ভাই, ভালো আছেন? কবে দেখা হবে?’

কিন্তু সে লোক তো পিছলা মাছ, বহু কষ্টে ১০–১৫ দিন পরপর দেখা পেতাম। একেক দিন একেকটা সিলেবাস ধরিয়ে দিতেন, দেখতাম, পড়তাম।

রাজীব আর আমি—মোট চারটে বাসায় আমরা একসঙ্গে থেকেছি। বাসা মানে একটা রুম—ফ্লোরিং বিছানা, একটা ঘটর ঘটর টেবিল ফ্যান। কত রাত এক প্যাকেট ম্যাগি নুডলস দুভাগ করে খেয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। এর মধ্যে একটা বাসা ছিল, রাত ১১টায় যার প্রধান ফটক বন্ধ হতো। রাজীব অনেক দিনই রাত ১১টার পর এসে আর ঢুকতে পারেনি বাসায়। অগত্যা কেঁচিগেটের ওপাশ দিয়ে শুধু ম্যাগিটা পাস করে দিয়ে চলে গেছে ফাহিম ফেরদৌস ভাইয়ের বাসায় কিংবা অন্য কোথাও।

রাজীবের হাতে আমার শুটিংয়ের হাতেখড়ি হয়েছিল। সে কী আনন্দ! প্রথম নাটক বানাচ্ছি আমরা, ‘শূন্যস্বর’। লোকেশন: আমার চিলেকোঠা, ডিওপি: নেহাল কোরায়শি ভাই, কাস্ট: অনম-প্রীতি, এডিটর: সামির ভাই ও রনি মাজহার ভাই।

রাজীব আশরাফ
ছবি: সংগৃহীত

ধীরে ধীরে রাজীবের থেকেই শেখা, ফিল্ম মানে ফিল্ম নয়, এটা একটা মাধ্যম। এর মাধ্যমে কথা ব্যক্ত করা যায়। তার কথা মেনে আমার সিনেমা দেখা চলতে লাগল। সেই সঙ্গে সে বলল, ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে চিত্রনাট্যের কোর্সটা ভালো আছে, করে আয়।’ কোর্স করলাম। তারপর আমাকে সে পাঠাল শর্টফিল্ম ফোরামে। সেখানেও কোর্স করলাম। এর সঙ্গে সঙ্গে চলল পড়া, ‘পড়, আরজ পড়, “যদ্যপি আমার গুরু” পড়...।’ পড়লাম, পড়ে চললাম, ‘মিলির হাতে স্টেনগান’, ‘খোয়াবনামা’, জঁ জেনে, আর্তুর র‍্যাবো, আলব্যের কামু, বিনয় মজুমদার, আবুল হাসান...পড়েই চললাম। একসময় বলল, ‘নৃবিজ্ঞানে পড়তে পারিস। আমি নৃবিজ্ঞানে পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু পরে চারুকলায় পড়ি।’

রাজীবের কথা না শুনে আমি চারুকলার কোচিং শুরু করলাম এক বছর গ্যাপে। রাজীব তার পেপার হোল্ডার দিয়ে দিল আমাকে—সকাল–বিকেল লাইন ড্রয়িং। তত দিনে সমানতালে অ্যাসিস্ট করছি, রাজীবের সঙ্গে প্রতিটা সেকেন্ড শেয়ার করেছি। পিপলু ভাই, সামির ভাই, তানভীর ভাই—কত যে শুটিং। এফডিসিতে ৩৫ মিমি শুটিং আমার প্রথম অভিজ্ঞতা, রাশেদ জামান ডিওপি। তখন এফডিসিতে কোনায় কোনায় আলমারিভরা কাটপিস পড়ে থাকে। কাটপিস কেটে কেটে আমাকে সে একটা টেবিল ল্যাম্প বানিয়ে দিল। এফডিসির ৪ নম্বর ফ্লোরের সেই কাজে চারটা বিজ্ঞাপনের শেষ দিনে আমার এল জ্বর, চলে গেলাম বাড়ি, বরিশাল। চারুকলায় পড়তে চেয়েছিলাম ভাস্কর্য বিভাগে, পরীক্ষা আর দেওয়া হলো না। ভর্তি হলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে।

তত দিনে রাজীব আমাকে চেনাল মুয়ীজসহ অনেককে, ‘ওই দ্যাখ রিপন, ছোটন। ছোটনের সঙ্গে ছড়ায় ছড়ায় এসএমএস লেখি।’ সে আরও বলল, ‘ওই দ্যাখ মুমু, ফাহিম, মঞ্জু...ওই দ্যাখ নির্লিপ্ত নয়ন, ওকে সেলিম আল দীন ছেলে ডাকে; নৃপ অনুপ, জয়েস, তানভীর, ফুয়াদ, কবি আরিফ, মাসুম, শ্যামল, গ্যারি।’ তখন আমাদের শাহবাগ-মিরপুর—সব একাকার হয়ে গেছে। চিনেছি ‘কালনেত্র’, ‘মাঞ্জাসুতা’—এই দ্রোহী ছোটকাগজগুলো। পলাশ চৌধুরী, লেহরি, বাপ্পি ভাই, সানজানা, কারিশমা, তরু, ইমন, সাদাফ জাফর, জাওয়াদ, মামুন, মনোজ—কত যে নাম জড়িয়ে আছে!

রাজীব বলত, কীভাবে সে শামসুন্নাহার হলের আন্দোলন করেছে, সে ছিল দপ্তর সম্পাদক, মিরপুর ছাত্র ইউনিয়নের। তার নেতা আসাদুজ্জামান মাসুম। রাজীবের মৃত্যুর পর মাসুম ভাই ঠিক ওকে কবর দেওয়ার আগে উপস্থিত হন। আর আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। মাসুম ভাই ওর মুখটা দেখে ডান হাত ওপরে তুললেন। আমার কানে স্পষ্ট বেজে উঠল রাজীবের কণ্ঠ, ‘আমার লিডার ছিল মাসুম ভাই।’ আরও দুজনকে মানত বলে প্রায়ই বলত তাঁদের নাম—আরাফাত মহসীন নিধির বাবা-মা যথাক্রমে সামসুজ্জামান আকন্দ সাজন ও মাহমুদা বেগম আপন।

রাজীবের কাছে কোনো কিছু চাইতে গিয়ে খালি হাতে কেউ ফিরে এসেছে, এমন হয়নি। হয় তাকে নাগালেই পায়নি, নইলে যা চেয়েছে, তা পেয়েই ফিরে এসেছে।

রাজীবের শেষকৃত্যে আসা সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, এ জীবনে যা চিনেছি, যাঁদের চিনেছি, সবকিছুর মাধ্যম ওই লোকটা—ওই যে শুয়ে আছে। কত ফ্রেশ, ঠিক যেভাবে ঘুমাত, একটু থুতনিটা উঁচু করে, ওইভাবেই। ঘুমাচ্ছে।

শিল্পী অর্ণবের সঙ্গে নিজের কাব্যগ্রন্থ ‘ধরেছি রহস্যাবৃত মহাকাল’ হাতে রাজীব আশরাফ
ছবি: সংগৃহীত

একদিন একটা অ্যাকুয়াস্টিক গিটার নিয়ে বরিশাল থেকে লঞ্চে উঠেছিলাম আমি। গান গাইব, তাই ঢাকায় যাব। এখন গান গাচ্ছি। উপার্জনের জন্য শুটিং করছি। এ দুটোই যে করতে পারছি, এর সবই সম্ভব হয়েছে রাজীব আশরাফের জন্য।

আসলে যাঁরা এ লেখা পড়ছেন, বিশ্বাস করুন, ওকে নিয়ে যা লেখার, তা কিছুই লিখতে পারছি না। ও বলত, ‘আমার আত্মজীবনীতে তোর এই কথাটা আমি লিখবই’, সেটা ও হলেই লিখতে পারত। আমার দুনিয়ায় আর কারও সেটা লিখতে পারার কথা নয়, আমার পক্ষেও সেটা লেখা সম্ভব নয়; সেই হিম্মতও আমার নেই।

এই যে এত এত গল্প বুকে নিয়ে ঘুরি, ১০ পার্সেন্টও তো বলতে পারি না। যেটুকু পারি, তার জন্য অবদান একজনের—রাজীব আশরাফ। আমি ওর বেশ অনেকটা সময়ের চ্যালা থাকলেও তার ‘জলচর’ আর ‘একুরিয়াম’ সিনেমা দুটো আমার আগে বানানো। মুগ্ধ হয়েছিলাম ও দুটো দেখে।

আশরাফুল আনোয়ার রাজীব কিংবা যাযাবর ছাই বা জিপসি অ্যাশ, চিকু, পামেলা, রাজীব আশরাফ—কত নামে তাকে ডাকত মানুষ! ওর ক্লাস সেভেনে প্রকাশিত বইটা আর কখনো কাউকে দেখায়নি। কিন্তু একটা তামাম মহাকালকে মুঠোয় ধরে দেখিয়েছে। (রাজীব আশরাফের কাব্যগ্রন্থের নাম ‘ধরেছি রহস্যাবৃত মহাকাল’) সে আমার পরম গুরু, আমার শিক্ষক। তাকে নিয়ে যথার্থ কিছু লেখার ক্ষমতা আমার নেই। আর রাজীব এত দিন বেঁচে ছিল যাঁদের জন্য—সায়রাজ মেহেদি রিংকু ভাই, অর্ণব ভাইসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। ব্যক্তিগতভাবে ওর মৃত্যু আসলে ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

রাজীবের আর আমার একটা ট্যাটু করার কথা ছিল। ট্যাটুতে থাকবে দুটো মাছ। ওর ভাষায়, ‘একটা মাছ তুই, আরেকটা আমি।’ ডিজাইনও রেডি ছিল। তার আগেই একটা মাছ মরে গেল। ট্যাটুটা কি করব?