নজরুল ও সেলবর্সী
বাঙালি মুসলমান চিন্তার মেরুকরণ
পশ্চিমা ভাবাদর্শে বামপন্থী ও ডানপন্থী যে মেরুকরণ, বাঙালি মুসলমান সমাজে তার উন্মেষ ১৯২০–এর দশকে। তারই উত্তরাধিকার নানা রঙে ও প্রতাপে পরে প্রবাহিত হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম ও ফযলুল হক সেলবর্সীর সূত্র ধরে এই লেখা সেই ভাবাদর্শিক মেরুকরণের অনুসন্ধান। লেখাটি প্রকাশিত হবে কয়েকটি পর্বে, ধারাবাহিকভাবে।
কিস্তি: ১
১৯২০ সালের কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলাম ও মুজফ্ফর আহ্মদ যখন এ কে ফজলুল হকের কাছে পত্রিকা করার নিয়ত নিয়ে সলা-পরামর্শ করতে গেলেন, হক চাইলেন পত্রিকার নামটি হোক মুসলমানি শব্দে। ‘হিন্দুরা তোমাদের কাগজ কিনবেন না। পক্ষান্তরে মুসলমানরাও বুঝতে পারবেন না যে কাগজখানা মুসলমানদের।’ মুজফ্ফর ও নজরুলের বুঝ ছিল ভিন্ন। তাঁরা পত্রিকার নামে আলাদা করে মুসলমানি চিহ্ন প্রকটিত না করে, এমন নাম দিতে চাইলেন যেন দুই সম্প্রদায়ের গ্রাহকই পত্রিকা কেনেন। অগত্যা পত্রিকার নাম হলো ‘নবযুগ’।
এভাবে ১৯২০ সালে নবযুগপত্রিকা শুরু হলো এ কে ফজলুল হকের অর্থায়নে। এই পত্রিকা চালুর আলোচনায় মুজফ্ফর ও নজরুল বাদেও ছিলেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, মোজাম্মেল হক, নবনূর পত্রিকার সাবেক ম্যানেজার উমেদ আলী মিয়া, নূর লাইব্রেরির মালিক মঈনুদ্দীন হুসয়ন, সিলেট নিবাসী ফযলুল হক সেলবর্সী প্রমুখ। পত্রিকায় কর্মী হিসেবে যুক্ত হলেন নজরুল, মুজফ্ফর ও সেলবর্সী; অর্থাৎ নজরুলের সাংবাদিক–জীবনের প্রথম দুই সহকর্মী হলেন মুজফ্ফর ও সেলবর্সী। খুবই চিত্তাকর্ষক এই সমাবেশ? কেন? সেটাই এই লেখার প্রতিপাদ্য। এই তিনজনের মধ্যে দুজন কীভাবে বামে চলে গেলেন আর অন্যজন গেলেন ডানে এবং দ্বন্দ্ব উঠল ঘনিয়ে, সে গল্পই এই প্রবন্ধের বিষয়।
বিশ শতকের শুরুর দিকে বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রবল নড়াচড়া শুরু হয়। উপনিবেশি-আধুনিক শিক্ষায় বিপুল সংখ্যায় শরিক হয় তারা। নতুন ধরনের যে শাসন সংশ্রয়; অর্থাৎ কলোনিয়াল প্রশাসন, মুদ্রণমাধ্যম ও লোকজমায়েত—তাতে তারা শামিল হয়। আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালার আল-এসলাম (১৯১৪-১৯১৯), নাসিরউদ্দীনের মাসিকসওগাত আর ত্রৈমাসিকবঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার মতো পত্রিকা নতুন ধরনের মধ্যস্থতা বা মেডিয়েশন সম্ভব করল। আরও এল ‘মোসলেম ভারত’, ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’, ‘মোসলেম’, ‘মোহম্মদী’ ইত্যাদি। মতামত ও চিন্তার এই বিপুল উৎপাদন ও সঞ্চালনের সঙ্গে সঙ্গেই এই সমাজের ভেতর নানা প্রবণতা আলাদা হয়ে প্রকটিত হলো। ভেদরেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল।
১৯২০ সালে নবযুগপত্রিকা শুরু হলো এ কে ফজলুল হকের অর্থায়নে। পত্রিকায় কর্মী হিসেবে যুক্ত হলেন নজরুল, মুজফ্ফর ও সেলবর্সী; অর্থাৎ নজরুলের সাংবাদিক–জীবনের প্রথম দুই সহকর্মী হলেন মুজফ্ফর ও সেলবর্সী। এই তিনজনের মধ্যে দুজন কীভাবে বামে চলে গেলেন আর অন্যজন গেলেন ডানে এবং দ্বন্দ্ব উঠল ঘনিয়ে, সে গল্পই এই প্রবন্ধের বিষয়।
বর্তমান লেখার চলতি অনুমান হলো, পশ্চিমকেন্দ্রিক আধুনিক দুনিয়ায় ফরাসি বিপ্লবের সিলসিলায় ভাবাদর্শিক দুই মেরু হিসেবে যে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী ভাগ করা হয়, সেটা বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রথম স্পষ্ট হয় বিশের দশকে। বাম-ডানের এই পরস্পরবিরোধী প্রবণতা বুঝতে ১৯২০ সালের নবযুগপত্রিকার দুই তরুণ সহকর্মী কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ও ফযলুল হক সেলবর্সী (১৮৯৫-১৯৬৮)—এই দুজনকে নিয়ে সংক্ষেপে এ প্রবন্ধের আলাপ। ১৯২০ সালে যখন দুজনে সহকর্মী হলেন, একজনের বয়স ২৫, আরেকজনের ২১। কলকাতার বুকে কর্মরত এই দুই তরুণ বুদ্ধিজীবীর নিয়ত ও নিয়তিতে পরের ১০ বছর যে মেরুকরণ ঘটে, তার হদিস নিলে বাঙালি মুসলমান সমাজে উদীয়মান ভাবাদর্শিক মেরুকরণের কুলুজিটা ভালোই বোঝা যাবে।
নজরুল আর সেলবর্সী—এ দুজনের মধ্যে তুলনা হয় না, আবার হয়ও। নজরুল বাঙালি জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ও অন্যতম প্রধান চরিত্র। আধুনিক বাঙালি মুসলমান সমাজের অনুভবিক আদর্শপুরুষ। অন্যদিকে সেলবর্সীকে ‘খ্যাতনামা মুজাহিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন উত্তরকালের এক লেখায় মুহম্মদ এনামুল হক। মূলধারার আধুনিক জাতীয় ইতিহাসে সেলবর্সী প্রায় বিস্মৃত চরিত্র। তবু উপনিবেশি বাস্তবতায় বাঙালি মুসলমান সমাজে আধুনিক সংশ্রয়ের উন্মেষে এই দুই ‘সাংবাদিক’ যুক্ত ও শরিক ছিলেন। দুটি পরস্পরবিরোধী প্রবণতার স্বর হিসেবে তাঁদের তুলনা করলে সেকালের সামাজিক মুখর বাহাসের পরিচয় পাওয়া যায়, তাই এই বিসদৃশ তুলনা।
তুর্কি-আফগান সমাচার
কৃষক অধ্যুষিত বাঙালি মুসলমান সমাজে উনিশ শতকের ফরায়েজি, তরিকায়ে মুহম্মদিয়া ইত্যাদি আন্দোলনের ফলে এই সমাজের বিশ্ববীক্ষা প্রসারিত হয়েছিল। বিশ শতকে এসে প্রথম মহাযুদ্ধ ও খেলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সমাজের উদীয়মান মধ্যবিত্ত অংশের চিন্তা ও তৎপরতার একটা নতুন পর্যায় শুরু হয়। উপনিবেশি সংশ্রয়ে ভদ্রলোক হিসেবে নিজের সংস্থান করা এবং প্রাধান্যশীল হিন্দু ভদ্রলোক সমাজের সঙ্গে অনুকরণ, সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা—এই ত্রিবিধ সম্পর্কে যুক্ত হয়ে যে বিম্ব-বিড়ম্বনার (মাইমেটিক কনফ্লিক্ট) জন্ম হলো, তা থেকেই বাঙালি মুসলমান সমাজে স্বাতন্ত্র্যের বোধ প্রবলতর হলো। এই সময়ে মুসলমান সমাজের বিশ্ববীক্ষার কল্পিত ভূগোলে দুটি অঞ্চলের স্থান উল্লেখযোগ্য: তুরস্ক ও আফগানিস্তান। বাংলা, তথা উপমহাদেশে মুসলমান রাজবংশগুলো জাতিগতভাবে তুর্কি ও আফগান বলেই বিবেচিত। ফলে কাকতাল নয় যে নজরুল ও সেলবর্সী নিয়ে আমাদের আলাপের সূচনাও তুরস্ক ও আফগানিস্তানকে ঘিরে।
নজরুল বাঙালি জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ও অন্যতম প্রধান চরিত্র। আধুনিক বাঙালি মুসলমান সমাজের অনুভবিক আদর্শপুরুষ। অন্যদিকে সেলবর্সীকে ‘খ্যাতনামা মুজাহিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন উত্তরকালের এক লেখায় মুহম্মদ এনামুল হক। মূলধারার আধুনিক জাতীয় ইতিহাসে সেলবর্সী প্রায় বিস্মৃত চরিত্র।
প্রথম মহাযুদ্ধের কালে ১৯১৭-১৯ সাল উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নওশেরা হয়ে সিন্ধুর করাচিতে আবিসিনিয়া লাইনে হাবিলদার হিসেবে কায়েম ছিলেন নজরুল। যুদ্ধ শেষে বাঙালি পল্টন ভেঙে দিলে ১৯২০ সালের মার্চে নজরুল ফেরেন কলকাতায়। অন্যদিকে সিলেট থেকে আসা ফযলুল হক সেলবর্সী বিশের দশকের শুরু থেকেই কলকাতার বাঙালি মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলোতে কাজ করছিলেন।
প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশ ও ওসমানী সাম্রাজ্য ছিল পরস্পর প্রতিপক্ষ শিবিরের শক্তি। ইরাকসহ নানা স্থলে দুই বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এদিকে অন্তত শাহ ওয়ালিউল্লাহর সময় থেকে ওসমানি সাম্রাজ্য ভারতের মুসলমানদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করত। ফলে খেলাফত হেফাজতের জন্য মুসলমানদের মধ্যে আন্দোলন শুরু হলো। ভারতে গান্ধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনকে যুগপৎ জারি করলেন। এই সময়েই কলকাতায় ‘নবযুগ’ পত্রিকা চালু করছেন নজরুল, মুজফ্ফর ও সেলবর্সী। সেই সময় মুসলমানদের একাংশের মধ্যে আন্দোলনের অংশ হিসেবে হিজরত তৎপরতা চলছে; অর্থাৎ উনিশ শতকের তরিকায়ে মুহাম্মদিয়া ধারার হিজরত ও জিহাদ চিন্তার জেরে, ব্রিটিশ–শাসিত উপমহাদেশকে মুসলমানের ধর্ম পালনের অনুপযুক্ত মনে করে তারা এ দেশ থেকে হিজরত করে আফগানিস্তানের স্বাধীন মুসলিম-শাসিত দেশে চলে যাচ্ছে। আফগানিস্তান ভূরাজনীতিতে এমনিতেই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯১৯ সালে আফগানিস্তানের নতুন রাজা আমানুল্লাহ ব্রিটিশদের সঙ্গে এক দফা যুদ্ধ করেছেন। এর আগে উনিশ শতকের গোড়ায় সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরেলভির আফগান এলাকায় গমন তত সুবিধার হয়নি। ১৮ হাজার মুসলমান আফগানিস্তানে চলে যান বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন মুজফ্ফর।
যাহোক, সেলবর্সী সরাসরি যুক্ত হয়ে গেলেন এই মুহাজির আন্দোলনে। ‘নবযুগ’–এর ‘কাজে তাঁর মন ছিল না। এসেই দু-চারটি নিউজ তরজমা করে দিয়ে তাড়াতাড়ি তিনি চলে যেতেন।’ ‘কলেজ স্কোয়ারে মাঝে মাঝে বক্তৃতা দিতেন’ সেলবর্সী। চিন্তাভাবনাও তাঁর গরম। তাঁর লেখা এমন গরম হতো যে লেখা ‘বার হলে কাগজের জামিনের টাকা আবারও নিশ্চিত বাজেয়াপ্ত হয়ে যেত।’ তাই মুজফ্ফর তাঁর লেখা পড়ে চেক করে দিতেন।
ঠিক কোন সময় সেটা স্পষ্ট নয়, সেলবর্সী কাউকে কিছু না বলে আফগানিস্তানে চলে গেলেন। পরবর্তীকালে এনামুল হক লিখেছেন, তিনি ‘১৯২২ সালে’ জেহাদ করতে গিয়েছিলেন। ‘খিলাফৎ আন্দোলনের সময় মুসলমানের পক্ষে পরাধীন ভারতে বাস করা অসমীচীন মনে করিয়া, স্বাধীন মুস্লিম-রাজ্য আফগানিস্তানে হিজরত করেন (সেলবর্সী) এবং তথায় দীর্ঘদিন বাস’ করেন। (মনীষা-মঞ্জুষা) তিনি নাকি মাওলানা আবুল কালাম আযাদের পরিচয়পত্র নিয়ে সীমান্তপ্রদেশ পার হয়ে ‘স্বাধীন জাতির ইলাকায়’ পৌঁছে যান। তবে আফগানদের এলাকায় তিনি বেশি দিন থাকেননি। মুজফ্ফর ফোড়ন কেটে লিখেছেন—‘হতে পারে সীমান্তের স্বাধীন ইলাকার কঠোর জীবন তাঁর নিকটে দুঃসহ হয়ে উঠেছিল।’ ভারতে ফেরার পথে পেশোয়ারের কাছে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন মুহাজির মুজাহিদ সেলবর্সী। পুলিশ তাঁকে একেবারে সিলেটে নিয়ে যায়। রাজদ্রোহ বা সিডিশনের বিচারে তাঁর এক বছর জেল হয়। (আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা)
এদিকে কলকাতায়ও বিপ্লবী সাংবাদিকতা করার রাস্তা প্রশস্ত ছিল না। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই ‘নবযুগ’ পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। পরে আবার তা চালু হলেও বেশি দিন চলতে পারেনি। (নজরুল রচনাবলী, প্রথম খণ্ড) এই পত্রিকায় নজরুলের একটা অবিস্মরণীয় লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, যার নাম ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে?’ আফগানিস্তানে হিজরত-উদ্যত কিছু মুহাজিরকে ভারতীয় সেনারা গুলি করে হত্যা করায় তার প্রতিবাদে নজরুল লেখেন এই লেখা। এই লেখায় ব্রিটিশ শাসনের প্রতিবাদে হিজরত করে চলে যাওয়া মুহাজিরদের প্রতি নজরুলের বিপ্লবী দরদ দেখা যায়।
‘তোমাদের অত্যাচারে, জুলুমে নিপীড়িত হইয়া, মানবাত্মা—মনুষ্যত্বের এত পাশবিক অবমাননা সহ্য করিতে না পারিয়া মানুষের মতো যাহারা স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিতে পারিল যে, এখানে আর ধর্ম কর্ম চলিবে না, এবং চিরদিনের মতো তোমাদের সংশ্রব ছাড়িয়া তোমাকে সালাম করিয়া বিদায় লইল,—সেই বিদায়ের দিনেও তাহাদের উপর সামান্য পশুর মতো ব্যবহার করিতে তোমাদের লজ্জা হইল না, দ্বিধা হইল না! সামান্য খুঁটিনাটি ধরিয়া, ছল করিয়া গায়ে পড়িয়া তাহাদের সাথে গোলমাল বাধাইলে, হত্যা করিলে! আবার হত্যা করিলে আমাদেরই ভারতীয় সৈন্য দ্বারা!’
উনিশ শতকের ফরায়েজি, তরিকায়ে মুহম্মদিয়া ইত্যাদি আন্দোলনের ফলে মুসলমান সমাজের বিশ্ববীক্ষা প্রসারিত হয়েছিল। এই সময়ে মুসলমান সমাজের বিশ্ববীক্ষার কল্পিত ভূগোলে দুটি অঞ্চলের স্থান উল্লেখযোগ্য: তুরস্ক ও আফগানিস্তান। ফলে কাকতাল নয় যে নজরুল ও সেলবর্সী নিয়ে আমাদের আলাপের সূচনাও তুরস্ক ও আফগানিস্তানকে ঘিরে।
নজরুল ছিলেন উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের নানা প্রকরণ ও ধরনে আগ্রহী। প্রথম মহাযুদ্ধকালে তিনি যে বাঙালি পল্টনে যুক্ত হয়েছিলেন, এর পেছনে তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করে উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়া। তাঁর বন্ধু শৈলজানন্দ লিখেছেন যে ছকটা ছিল এই যে ‘নজরুল যুদ্ধবিদ্যা শিখে এসে ভারতবর্ষে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী গঠন করবে, তারপর দেশ থেকে ইংরেজ তাড়াবে।’ তিনি যখন করাচিতে, তখন আফগানিস্তানে রাজা হাবিবুল্লাহ খান নানা সংস্কার করছেন। সে খবর নজরুল রাখতেন। তারপর ১৯১৯ সালে তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ হচ্ছে আমানুল্লাহর সঙ্গে ইংরেজদের। তাতেও নজরুলের আগ্রহ ছিল। ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘ব্যথার দান’ গ্রন্থের ‘হেনা’ গল্পের নায়ক আফগান, গল্পের পটভূমিও আফগান সীমান্তের দিকেই। সেলবর্সীর আফগানিস্তানে হিজরত সম্ভবত নজরুলের এই লেখার পরের ঘটনা।
‘নবযুগ’ বন্ধ হওয়ার পর নজরুলের গন্তব্য ছিল ‘ধূমকেতু’। ১৯২২ সালে ‘ধূমকেতু’ প্রকাশের উদ্যোগ নেন দেওবন্দফেরত হাফেজ মসউদ। তাঁর দেওয়া ২৫০ টাকা দিয়ে নজরুল জুলাই বা আগস্ট মাসে ‘ধূমকেতু’ শুরু করেন।
সেলবর্সী যখন আফগানিস্তানে হিজরত করছেন, নজরুল তখন তুর্কি বিপ্লব নিয়ে উদ্বেলিত। ১৯১৯-২০ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাস্ত তুরস্কের সুলতান পরাজয় স্বীকার করেন এবং ইংরেজরা তুরস্কে প্রবেশ করে। তখন আঙ্কারায় যিনি প্রতিরোধশক্তি রচনা করলেন, তাঁর নাম মোস্তফা কামাল। (খান, নজরুল ইসলাম, বাঙ্গালি মুসলমান ও তুর্কি বিপ্লব)
সেলবর্সী ছিলেন নিখিল-ইসলামপন্থী বিপ্লবী জামালুদ্দিন আফগানি, উনিশ শতকের তরিকায়ে মুহাম্মদিয়ার ভাবগুরু ইসমাইল শহীদ, তুরস্কের ইসলামপন্থী ও সর্বতুর্কপন্থী বিপ্লবী আনোয়ার পাশা এবং মিসরের জগলুল পাশার অনুরাগী। (সেলবর্সী, ফযলুল হক—বাংলাপিডিয়া) এককথায় খেলাফতপন্থী ও প্যান-ইসলামপন্থী মতের পোষক ছিলেন সেলবর্সী। আনোয়ার পাশার নামে তিনি আনোয়ার সমিতি করেছিলেন—সম্ভবত আনোয়ারের নিখিল-ইসলামপন্থী মতে আকৃষ্ট হয়ে। নজরুলও আনোয়ার পাশাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, কিন্তু মোস্তফা কামাল পাশাই তাঁর কাছে হয়ে উঠবেন আসল নায়ক। সলিমুল্লাহ খানের মতে, আনোয়ার পাশা নজরুলের কাছে বিগত যুগের প্রতীক আর কামাল পাশা নতুন দিনের মেছাল।
ঠিক কোন সময় সেটা স্পষ্ট নয়, সেলবর্সী কাউকে কিছু না বলে আফগানিস্তানে চলে গেলেন। পরবর্তীকালে এনামুল হক লিখেছেন, তিনি ‘১৯২২ সালে’ জেহাদ করতে গিয়েছিলেন। ‘খিলাফৎ আন্দোলনের সময় মুসলমানের পক্ষে পরাধীন ভারতে বাস করা অসমীচীন মনে করিয়া, স্বাধীন মুস্লিম-রাজ্য আফগানিস্তানে হিজরত করেন (সেলবর্সী) এবং তথায় দীর্ঘদিন বাস’ করেন।
মোস্তফা কামালের সংগ্রাম নজরুলের মনে বিপুল উৎসাহ জাগ্রত করে। ১৯২১ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে যখন তুর্কি বাহিনী গ্রিকদের শায়েস্তা করছে, তখন নজরুল লিখছেন ‘কামাল পাশা’ কবিতা। লিখছেন উচ্ছ্বসিত প্রবন্ধ ‘কামাল’। ব্রিটিশ উপনিবেশি ফন্দির মোকাবিলায় কামালের মর্দপনার তারিফ করে লিখছেন, ‘কামাল এল তার বিশ্বত্রাস মহা তরবারি নিয়ে সামাল সামাল করে রোজ কিয়ামতের ঝঞ্ঝার মতো, রুদ্রের মহারোষের মতো। অত্যাচারীর মুখে গোখরো সাপের বিষাক্ত চাবুক মেরে, মুখ ছিঁড়ে ফেললে খ্যাপা ছেলে।’
কামালকে ‘সত্যিকারের মুসলিম’ বলে প্রশংসা করে নজরুল বলেছেন, ‘এই তো ইসলামের রক্ত-কেতন।’ এতে বোঝা যায় যে কামাল ইসলাম, খেলাফত ও তুর্ক একসঙ্গে উদ্ধার করতে চান, এমনই জল্পনা ছিল খেলাফত আন্দোলনে শরিক ভারতীয় মুসলমানদের।
কামালের সামরিক বীর্য থেকে নজরুলের মীমাংসা ছিল গুরুতর। ইসলামের মৌলিক তাৎপর্য কি রাজনৈতিক, না চিহ্নতান্ত্রিক? নজরুল বললেন, ‘দাড়ি রেখে, গোশত খেয়ে নামাজ-রোজা করে যে খিলাফত উদ্ধার হবে না, দেশ উদ্ধার হবে না, তা সত্য মুসলমান কামাল বুঝেছিল, তা নাহলে সে এতদিন আমাদের বাঙলার কাছা-খোলা মোল্লাদের মতন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে কাছা না খুলে কাবার দিকে মুখ করে হর্দম ওঠবোস্ শুরু করে দিত। কিন্তু সে দেখলে যে বাবা, যত পেল্লাই দাড়িই রাখি আর ওঠবস করে যতই পেটে খিল ধরাই, ওতে আল্লার আরশ কেঁপে উঠব না। আল্লার আরশ কাঁপতে হলে হাইদরি হাঁক হাঁকা চাই, মারের চোটে স্রষ্টারও পিলে চমকিয়ে দেওয়া চাই। ওসব ধর্মের ভণ্ডামি দিয়ে ইসলামের উদ্ধার হবে না— ইসলামের বিশেষ তলোয়ার, দাড়িও নয়, নামাজ-রোজাও নয়।’
উর্দুমিশাল ‘কামাল পাশা’ কবিতাটি যেন কলকাতার বহুজাতিক জনতার উদ্দেশে একধরনের নাটকীয় লীলাকলা। ১৯২২ সালের আগস্টের পর কামাল পাশা যখন ব্রিটিশ অনুগৃহীত গ্রিকদের দেশছাড়া করে চূড়ান্ত বিজয় হাসিল করলেন, তখন কবিতাটি গেয়ে কলকাতায় কামালের বিজয় মিছিল বের হয়েছিল।
১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘ভাঙ্গার গান’–এ ‘শহীদি ঈদ’ কবিতাতেও নজরুলের মূল সুর ছিল এই যে লড়াই ও ত্যাগ করেই মুক্তি, আচারে নয়। ‘নিজেদের দাও কোরবানি।/ বেঁচে যাবে তুমি, বাঁচিবে দ্বীন,/ দাস ইসলাম হবে স্বাধীন,/ গাহিছে কামাল এই গানই।’ সলিমুল্লাহ খান লিখেছেন যে নজরুলের কাছে তুরস্কের জাতীয় বিপ্লব বা স্বাধীনতাযুদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের কোনো বিরোধাভাস ছিল না। ‘দেশপ্রেম আর “বিশ্বের মঙ্গলসাধন” তাঁহার চোখে এক আকার হইয়া গিয়াছে।’ আবদুল কাদিরের সঙ্গে সহমত করে খান বলেছেন, নজরুল কমিউনিস্ট, প্যান-ইসলামিস্ট বা গান্ধীবাদী কংগ্রেসি ছিলেন না; বরং ছিলেন তুর্কি গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সমর্থক। (খান, নজরুল ইসলাম, বাঙ্গালি মুসলমান ও তুর্কি বিপ্লব)
উর্দুমিশাল ‘কামাল পাশা’ কবিতাটি যেন কলকাতার বহুজাতিক জনতার উদ্দেশে একধরনের নাটকীয় লীলাকলা। ১৯২২ সালের আগস্টের পর কামাল পাশা যখন ব্রিটিশ অনুগৃহীত গ্রিকদের দেশছাড়া করে চূড়ান্ত বিজয় হাসিল করলেন, তখন কবিতাটি গেয়ে কলকাতায় কামালের বিজয় মিছিল বের হয়েছিল। (খান, নজরুল ইসলাম, বাঙ্গালি মুসলমান ও তুর্কি বিপ্লব)
‘কামাল পাশা’ কবিতার আরেকটা খুঁটিনাটি হলো, বাংলার ইতিহাসে তুর্কিদের ‘দনুজ’ বলে শত্রু আকারে শনাক্ত করার যে চল রাজা গণেশের আমলে দেখা যায়, তুর্কি বিপ্লবের সময় নজরুল সেখানে দনুজ শব্দটা তুরস্কের ওপর আগ্রাসন চালানো বিলাতি সাম্রাজ্যবাদীদের বোঝাতে ব্যবহার করেছেন।
বাঙালি মুসলমান সমাজে তুরস্ক ও আফগানিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ থেকে এই যে নানা রকম প্রেরণা সঞ্চয়—একদিকে নজরুল কামালের আদর্শে দীক্ষিত হচ্ছেন, আরেক দিকে সেলবর্সী যাচ্ছেন জিহাদ করতে—এই পরিস্থিতিতে সমাজে নতুন মেরুকরণ ঘটে। কামাল পাশা যখন খেলাফত বিলুপ্ত করে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন ও নানা সংস্কার আরোপ করলেন, তারপর ইরানে রেজা শাহ ও আফগানিস্তানে আমানুল্লাহও নিজ নিজ দেশে নানা রকম সংস্কার আরোপের চেষ্টা করেন। খেলাফতের মেছাল বনাম আধুনিক রিপাবলিকের মেছালের দ্বন্দ্ব ঘনীভূত হয়, একই সঙ্গে রাজনৈতিক পরিসর বনাম ধর্মতাত্ত্বিক গরজ—এ দুটির টানাপোড়েনও প্রবল হয়। ফলে বাঙালি মুসলমান সমাজে মোল্লা ও তরুণ বলে দুটি দ্বান্দ্বিক বর্গের উদয় ঘটে।