মাঠে উত্তাপ ছড়াচ্ছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। এই প্রহরে ঢুঁ দেওয়া যাক ক্রিকেটের এমন এক সবুজ আউটফিল্ডে, যেখানে ২২ গজের উইকেটের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে আছে সাহিত্যও
একটি কাভার ড্রাইভ কিংবা একটি ইনসুইং ইয়র্কারের মধ্যে কি কোনো সাহিত্য আছে? আছে কি কোনো গদ্য কিংবা কবিতা? সাদা চোখে দেখলে ক্রিকেটের সবুজ আউটফিল্ড এবং ২২ গজের উইকেটের সঙ্গে সাহিত্যের মতো সিরিয়াস বিষয়ের মিল পাওয়া যাবে সামান্য। কিন্তু সাহিত্য পড়ার মন নিয়ে মাঠের দিকে তাকালে আপনিও সেখান থেকে পেতে পারেন সাহিত্যরস। শচীন টেন্ডুলকারের স্ট্রেইট ড্রাইভ আপনাকে মনে করাতে পারে টি এস এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড পড়ার অভিজ্ঞতার কথা কিংবা ওয়াসিম আকরামের রিভার্স সুইং আপনাকে দিতে পারে বিভূতিভূষণের আরণ্যক-এর স্বাদ। নাহ্, এসবের মধ্যে আক্ষরিক কোনো মিল নেই। কিন্তু তূরীয় আনন্দের যে অনুভূতি, তাতে কোনো অমিলও নেই। তাই প্রিয় দলের হারে আপনি পেতে পারেন আর্তুর র্যাঁবোর নরকে এক ঋতুর যন্ত্রণাও। আর এসব আনন্দ ও যন্ত্রণার অনুভূতিগুলোই একজন সাহিত্যিকের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে পারে ক্রিকেটপ্রেম। আবার কাউকে টেনে নিয়ে আসতে পারে ক্রিকেটের সাহিত্য লেখার দুনিয়ায়।
একটা তথ্য দিয়েই শুরু করা যাক, একজন ক্রিকেটার নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন! এটুকু শুনেই আঁতকে উঠবেন না যেন! ক্রিকেটে কখনো নোবেল দেওয়া হয়নি। তবে অনেকের জানাও থাকতে পারে সেই নোবেলজয়ীর নাম—স্যামুয়েল বেকেট। ওয়েটিং ফর গডোর মতো প্রবল অস্তিত্ব সংকটের ধারণাজাত ‘ট্র্যাজিক কমেডি’র লেখক এবং ‘থিয়েটার অব দ্য অ্যাবসার্ড’-এর পথিকৃৎ বেকেট প্রবলভাবে ক্রিকেট–ভক্ত ছিলেন, যিনি শুধু ক্রিকেট ভালোই বাসতেন না, ভালো খেলতেনও। যদিও তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার খুব একটা লম্বা হয়নি। সেটা অবশ্য শিল্পের অন্য একটি জনরায় আরও বড় কিছু করবেন বলে। আর সেই বড় কিছু এতই বড় ছিল যে ১৯৬৯ সালে তাঁকে সাহিত্যে নোবেলও এনে দিয়েছিল।
সাহিত্যিকের ক্রিকেটার হওয়ার প্রসঙ্গে স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের নাম উল্লেখ না করা রীতিমতো অন্যায়। ‘শার্লক হোমস’–এর স্রষ্টার ১৮৯৯ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত ১০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার কথা জানা যায়।
ক্রিকেটার বেকেটের ক্রীড়াজীবনের খতিয়ান পাওয়া যাবে ক্রিকেটভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল ক্রিকইনফোতে গেলে। ১৯২৫–২৬ মৌসুমে ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে প্রথম শ্রেণির দুটি ম্যাচ খেলেছিলেন বেকেট। ছিলেন বাঁহাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলার এবং বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। পরিসংখ্যান বলছে, সাহিত্যের অমর এই স্রষ্টার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ক্যারিয়ার মাত্র দুই ম্যাচ স্থায়ী হয়েছিল। সে দুই ম্যাচেও বলার মতো কিছু করতে পারেননি। দুই টেস্টে ৪ ইনিংসে রান করেছেন মাত্র ৩৫। সর্বোচ্চ ১৮। আর বল হাতে ১৩৮ বল করে ৬৪ রান দিয়ে উইকেটশূন্য ছিলেন।
আরও একজন নোবেলজয়ীর ক্রিকেট–ভালোবাসার কথা অবশ্য ফুটনোটে বলে রাখা যায়, তিনি হলেন হ্যারল্ড পিন্টার। মজার ব্যাপার হলো, বেকেটের মতো পিন্টারও মূলত নাট্যকার। তাঁর করা একটি উক্তিতেই ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটা বোঝা যাবে। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি মনে করি, ক্রিকেট হচ্ছে পৃথিবীতে ঈশ্বরের সৃষ্ট মহত্তম জিনিস। এমনকি সঙ্গমের চেয়েও বড়।’ আবার সাহিত্যের কথা বললে আসবে চার্লস ডিকেন্সের কথাও। ক্রিকেট প্রসঙ্গে তাঁর পিকউইক পেপারস বেশ আলোচিত একটি উপন্যাস। ডিকেন্সের প্রথম উপন্যাসও বটে। এই উপন্যাসে অল মাগলটন ও ডিংলি ডেলের নামক দুটি দলের ক্রিকেট ম্যাচের রুদ্ধশ্বাস বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যাবে। পড়তে পড়তে মনে হতে পারে, ম্যাচটা যেন চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে। তবে ফিকশনের আড়ালে নব্য বুর্জোয়ারা কীভাবে ক্রিকেটকে নিজেদের বিনোদনের অনুষঙ্গে পরিণত করেছে, সেই ধারণাও পাওয়া যাবে এখানে। সাহিত্যিকের ক্রিকেটার হওয়ার প্রসঙ্গে স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের নাম উল্লেখ না করা রীতিমতো অন্যায়। ‘শার্লক হোমস’–এর স্রষ্টার ১৮৯৯ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত ১০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার কথা জানা যায়। একইভাবে বলা যেতে পারে একজন নারী সাহিত্যিক ও ক্রিকেটারের কথা। তিনি আ রুমস অব ওয়ানস ওন–এর লেখক ভার্জিনিয়া উলফ। ক্রিকেট খেলার কারণে সে সময় ‘টম বয়’ বলেও ডাকা হতো উলফকে।
কিন্তু এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা সাহিত্যিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন শুধু ক্রিকেটকে ভালোবেসে। আর এসব নামের কথা ভাবলে প্রথমেই বলতে হয় নেভিল কার্ডাসের কথা। মূলত একজন সাংবাদিক হয়েও ক্রিকেটকে ভালোবেসে হয়ে উঠেছেন ক্রিকেট-সাহিত্যের পথিকৃৎ। এখনো কেউ ক্রিকেট নিয়ে সাহিত্য করতে চাইলে তাঁকে নিশ্চিতভাবে কার্ডাসের দুয়ার থেকে ঘুরে আসতে হবে। সেই কবে তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রিয়, ক্রিকেট সুন্দর একটি খেলা, যা আমাদের গভীরভাবে আলোড়িত করতে পারে। এটি আমাদের হৃদয়কে উদ্বেলিত করতে পারে এবং ভেঙেও দিতে পারে।’ ক্রিকেট নিয়ে এমন জীবনবোধসম্পন্ন কথা আমাদের চেয়ে ভালো আর কে জানে, আমরা যারা বাংলাদেশের ক্রিকেটের সমর্থক, এই হৃদয় ভাঙার যন্ত্রণা আমাদের চেয়ে আর কে ভালো বুঝতে পারে! কার্ডাসের দিগন্তবিস্তারী লেখার খোঁজ পাওয়া যাবে তাঁর ডেজ ইন দ্য সান বইয়ে। আধুনিক ক্রিকেট–সাহিত্যের এই মায়েস্ত্রো নিজের আনন্দময় অভিজ্ঞতাগুলোকে ধরে রাখতে বইটি লিখেছিলেন। যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘নিশ্চিতভাবে ক্রিকেটাররা হচ্ছেন সেই আকাঙ্ক্ষিত মানুষ, শিশুরা যাদের সম্পর্কে জানতে চায়। তা তারা যেখানেই থাকুন।... তারা সব সময় তার ভালো চায়। আর সে যখন ভাগ্যবিড়ম্বিত হয়, তখন শিশুরাও বেদনাহত হয় আর ভালো কিছু করলে হয় আনন্দিত।’
এই বইয়ে এমন অনেক কিছু আছে, যা হয়তো এই সময়ে এসে প্রাসঙ্গিক না–ও হতে পারে। কিন্তু যাঁরা ক্রিকেট নামের খেলাটিকে নিছক খেলার বাইরে গিয়ে দেখতে চান, তাঁদের জন্য অনেক কিছুই আছে। বইয়ে ক্রিকেট ইতিহাসের অসাধারণ একটা লাইন লিখেছেন কার্ডাস, ‘ক্রিকেটে আমাদের সব কাজের মধ্যে নিজেদের অজান্তেই প্রতিদিন পূর্ণ পাতার ইতিহাস লেখা হচ্ছে।’ কী দারুণ অভিব্যক্তি!
‘তারা ক্রিকেটের কতটুকু জানে, যারা শুধু ক্রিকেটটাই জানে’—ক্রিকেটকে যতই ‘জেন্টলম্যান গেমস’–এর মুখোশ পরানো হোক, তার আড়ালের ঘোরতর বর্ণবাদকে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে একটু একটু করে খুলে দেখিয়েছেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট–সাহিত্যিক ও দার্শনিক সি এল আর জেমস তাঁর বিয়ন্ড অা বাউন্ডারি বইয়ে। ক্রিকেটের মোড়কে তিনি আমাদের কৃষ্ণাঙ্গদের লড়াইয়ের এক উপাখ্যান তুলে ধরেছেন। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে উনিশ শতকের শুরুর দিকে ক্লাবগুলো বিভিন্ন সামাজিক স্তরকে প্রতিনিধিত্ব করত। ক্রিকেটে জাতিগত বৈষম্যের স্বরূপকে তিনি উন্মোচন করেছেন এভাবে, ‘ক্রিকেটে জাতিগত বৈষম্য ছিল, জাতিগত বৈষম্য আছে, জাতিগত বৈষম্য ক্রিকেটে সব সময় থাকবে। কিন্তু থাকা উচিত নয়।’
ক্রিকেটের এই বৈষম্যের কথা উঠে এসেছে বাংলা ভাষায় ক্রিকেট নিয়ে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা বিখ্যাত দিশি গান বিলিতি খেলা নামে বইয়েও, ‘ইংল্যান্ডের সমাজ তখন শ্রেণি বিভাগ নিয়ে অত্যন্ত সচেতন, প্রোফেশনাল বা তথাকথিত পেশাদার ক্রিকেটাররা খেলাটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে বলেই তারা নিচের ধাপে, তা–ই নয়, তারা কেউ হবসের মতো (পরে স্যার জ্যাকস হবস) গ্রাউন্ডসম্যানের ছেলে, কেউ লর্ডসের মাঠে স্কোর বিক্রি করে মিডলসেক্স নার্সারিতে খেলা শিখেছে (ডেনিস কম্পটন), কেউবা ইয়র্কশায়ারের কয়লার খনির কুলি (হ্যারল্ড লারউড)—এককথায় তারা অভিজাত সমাজে মেশবার উপযুক্ত নয় কিন্তু একত্রে খেলতে পারে। তাদের ড্রেসিংরুম আলাদা এবং স্কোরকার্ডে তাদের নাম লেখার আগে মিস্টার লেখা হতো না।’ তবে এই বই শুধুই ক্রিকেটের রাজনৈতিক কোনো ইশতেহার নয়। সংগীত ও ক্রিকেটের যুগলবন্দীর অপূর্ব এক মূর্ছনা এখানে সুর হয়ে ঝরেছে।
আবার ক্রিকেটভিত্তিক উপন্যাসের কথা বললে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই শ্রীলঙ্কান লেখক শিহান করুনাতিলাকার উপন্যাস চায়নাম্যানকে। এক প্রান্তিক ক্রিকেটারের জীবনগাথা উঠে এসেছে বইটিতে। চায়নাম্যান (বাঁহাতি লেগ স্পিনার) প্রদীপ ম্যাথিউ ক্রিকেটার হতে চাওয়া সাধারণ মানুষের প্রতীকী চরিত্র। এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে শিহান আপনাকে একঝলকে দেখিয়ে দেবে ক্রিকেটে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা দুর্নীতি, অনিয়ম, গৃহযুদ্ধ ও রাজনীতিকে। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে একজন লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষের উপাখ্যান লেখা হয়েছে এ বইয়ে। কারও কারও কাছে বইটি শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের অন্যতম সেরা উপন্যাস।
বইটিকে অনেকে সামাজিক দলিল হিসেবে দেখলেও এর সাহিত্যিক গুরুত্বও সামান্য নয়। এক জায়গায় প্রদীপ বলছেন, ‘এক ওভার হচ্ছে বন্দুকের মধ্যে ছয়টি বুলেট। কয়েকটি ফাঁকা বুলেট ছুড়তে আমার আপত্তি নেই, যদি কয়েকটিতে লক্ষ্য শিকার করা যায়।’
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র এই বই পড়ার সময় আপনার কখনোই মনে হবে না কোনো ফিকশন পড়ছেন। বইটি কখনো কখনো মনে করিয়ে দেয় বোর্হেসের প্যারাবোলগুলোকে, যা পড়ার সময় আপনার একবারের জন্যও মনে হবে না কোনো ফিকশন পড়ছেন। তবে দুটোর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, বোর্হেস ফিকশনকে বাস্তবতার মোড়ক দিয়েছেন, আর শিহান বাস্তবতাকে পরিয়েছেন ফিকশনের জামা। আর এই সত্যভাষণের ইঙ্গিত বইয়ের শুরুতেই দিয়ে রেখেছেন লেখক, ‘একজন মিথ্যাবাদী যখন বলে তিনি মিথ্যা বলছেন। তিনি কি সত্যি বলছেন?’ এই দ্বিধা বা ধাঁধা আপনাকে তাড়া করবে পুরো বইয়ে।
ক্রিকেটের ভেতর দিয়ে ইতিহাসের গল্প বলার কাজটাও করেছেন অনেকে। ব্যক্তিগত পছন্দের কথা বললে সবার আগে আসবে রামচন্দ্র গুহ। বিশেষ করে তাঁর সাম্প্রতিকতম বই দ্য কমনওয়েলথ অব ক্রিকেট: দ্য লাইফলং লাভ অ্যাফেয়ার উইথ দ্য মোস্ট সাটল অ্যান্ড সফিস্টিকেটেড গেম নোন টু হিউম্যানকাইন্ড–এর কথা বলতে হবে সবার আগে। স্মৃতিচারণার ভঙ্গিতে ক্রিকেটের অনবদ্য ঐতিহাসিক গল্পই যেন বলেছেন গুহ। যেখানে নিজের ক্রিকেট দেখা, স্কুল-কলেজে ক্রিকেট খেলা, নিজের পছন্দের ক্রিকেটারদের সঙ্গে দেখা হওয়া (যেসব ভারতীয় ক্রিকেটারদের সঙ্গে তিনি হাত মিলিয়েছেন, তাঁদের একটি মজার একাদশও দিয়েছেন গুহ)। তবে এই বইকে শুধুই স্মৃতিচারণ আর মুগ্ধতার বয়ান ভেবে নিলে ভুল হবে। ‘ভ্যারাইটিজ অব ক্রিকেটিং শোভেনিজম’ অধ্যায় থেকে একটা অংশ তুলে দিলেই বিষয়টা স্পষ্ট হওয়া যাবে। গুহ লিখেছেন, ‘ক্রিকেটান্ধদের দুটি ধারা: জাতিগত ও ঐতিহ্যগত। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রত্যেক ক্রিকেট–ভক্তই এটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং বেশির ভাগ ক্রিকেট–ভক্ত এর বাইরে যেতে পারে না।’
সাহিত্যের ক্রিকেট নিয়ে তো বলা হলো, ক্রিকেটারদের সাহিত্যিক হয়ে ওঠার গল্পও কম নয়। যেখানে বেশির ভাগই মূলত আত্মজীবনীকেন্দ্রিক। তবে সবকিছু নিয়ে বলতে যাওয়া সমুদ্র সেঁচার মতো ব্যাপারই হবে। তবে এ মুহূর্তে আমার পছন্দের দুটি বই নিয়ে অল্প একটু বলে এই লেখার যবনিকাপাত টানব। একটি বই হচ্ছে সুনীল গাভাস্কারের সানি ডেজ। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। অর্থাৎ গাভাস্কারের টেস্ট অভিষেকের পাঁচ বছর পর। ক্যারিয়ারের অনেক কিছুই তখনো তাঁর দেখা বাকি। বইয়ের ভূমিকায় গাভাস্কার লিখেছেন, ‘একজন সক্রিয় ক্রিকেটারের জন্য লেখালেখির রাজত্বে প্রবেশ বেশ বিপজ্জনক ব্যাপারই বটে। বিশেষ করে এমন ক্রিকেটারের জন্য, যে কিনা টেস্ট–দুনিয়ায় প্রবেশ করেছে মাত্র পাঁচ বছর আগে।’ ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত তো বটেই। তবে গাভাস্কারের এই বই পড়তে পড়তেই তাঁর জন্ম–পরবর্তী সময়ের গল্পটা জানতে পেরেছিলাম। অনেকেরই হয়তো গল্পটা জানা, তবু বলছি। বইয়ের প্রথম অধ্যায় ‘দ্য ফার্স্ট স্টেপ’–এ গাভাস্কার লিখেছেন, ‘আমি হয়তো কখনো ক্রিকেটার হতে পারতাম না এবং এই বই লিখতে পারতাম না, যদি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন মিস্টার নারায়ণ মানুসুরেকার আমি পৃথিবীতে আসার প্রথম দিন (১০ জুলাই ১৯৪৯) আমার জীবনে না আসতেন। নানা-কাকা (তাঁকে আমি এই নামেই ডাকতাম), তিনি আমার জীবনের প্রথম দিন হাসপাতালে আমাকে দেখতে এসে খেয়াল করলেন, আমার বাঁ কানের ওপরের দিকে একটি ছিদ্র আছে। পরের দিন তিনি আবার এলেন এবং আমার মায়ের পাশে একটি দোলনায় শুয়ে রাখা শিশুটিকে তুলে নিলেন। তখন তিনি দেখলেন, এই বাচ্চার কানের ওপরে সেই ছিদ্র অনুপস্থিত। এরপর খুবই অস্থিরভাবে চারপাশের দোলনাগুলোতে খোঁজা হলো এবং আমাকে পরমানন্দে ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া গেল এক জেলেনির পাশে, যে কিনা পুরো ঘটনার কিছুই জানে না।’ পড়তে যতই রোমাঞ্চকর মনে হোক, পুরো ঘটনা বিভীষিকা জাগানো। যদি সেদিন গাভাস্কার সত্যি অদলবদল হয়ে যেতেন, তবে ক্রিকেট হয়তো ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক নক্ষত্রকে কখনোই পেত না।
ক্রিকেট নিয়ে লেখা অথচ সেখানে স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান আসবেন না, তা হয় নাকি! দ্য আর্ট অব ক্রিকেট বইয়ে ব্র্যাডম্যান ‘দ্য ভার্চু অব ক্রিকেট’ নামে অসাধারণ একটি অধ্যায় লিখেছেন। পৃথিবীর বিবর্তনের সঙ্গে ক্রিকেট কীভাবে বদলে যাচ্ছে এবং যেতে পারে, সেটাই এখানে লিখেছেন ব্র্যাডমান। কী অদ্ভুত! অনেকের কাছে তর্কাতীতভাবে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়টি কী দারুণভাবেই না খেলাটির ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন। এই অধ্যায়ের এক জায়গায় তিনি লিখছেন, ‘জীবনের ছন্দে এই বিপুল পরিবর্তন ক্রিকেটে কোনো প্রভাব ফেলল? আমার মনে হয়, সম্ভবত এটি দর্শক ও লেখকদের আরও আগ্রাসী কিছু চাওয়ার ব্যাপারে প্রভাবিত করেছে। যা মোটেই খারাপ কিছু নয়।’ পাশাপাশি উড়োজাহাজের মতো গতিময়তা মানুষকে তার প্রাত্যহিকতা থেকে ছিটকে দেবে কি না, সেই আশঙ্কাও তিনি করেছেন।
ভাবতে পারেন, ১৯৫৮ সালে ব্র্যাডম্যান পৃথিবীর পরিবর্তনের সঙ্গে ক্রিকেটকে মিলিয়ে নতুন এক আয়নার সামনে আমাদের দাঁড় করাচ্ছেন। আজ প্রায় ৬৫ বছর পর এসেও সেই আয়নায় আমরা যেন একই মুখকেই বারবার দেখতে পাচ্ছি।