তবু কি দেশকে ছাড়া যায়, স্ব-ভাবকে ত্যাগ করা যায়
যুক্তরাষ্ট্রে দেশি ভাইবোনেরা নানা রকম ভিসায় এসে থেকে যান। পরে ওদের আত্তীকরণ হয় যুক্তরাষ্ট্রের আর্থসামাজিক কাঠামোর মধ্যে। কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে বিধায় এখানে আনন্দের সঙ্গে সবাই কষ্ট করে। অনেকে দেশে ফেরার কোনো ঠিকানাই আর বাকি রাখে না। মা–বাবা, ভাই–বোন, তাদের সম্প্রসারিত পরিজনসহ সবাই দেশান্তরি হয়। তবু কি দেশকে ছাড়া যায়, স্ব-ভাবকে ত্যাগ করা যায়?
আমরা কোনো দেশে বাস করছি না,
আমাদের বাস কালে, আমরা আধুনিক।
—ঋতুপর্ণ ঘোষ
তেজগাঁও এয়ারপোর্ট যেন আমার ছোটবেলার ঘরবাড়ি। আজকাল বিমানবন্দরের যে চেহারা, তার সঙ্গে সে এয়ারপোর্টের কোনো মিল নেই, কেবল রানওয়েতে কতগুলো উড়োজাহাজের ওঠানামা ছাড়া। আরও পরে আমার আম্মাকে কাজের জন্য চলে যেতে হয়েছিল অনেক দূরের কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে, যাকে এখন আমরা ‘হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ বলে চিনি।
আমি তখনো এবং এখনো তেজগাঁওয়ের ওই ছোট্ট নিজস্ব এয়ারপোর্টটিকে চোখে হারাই। জানি না বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এখন সেই এয়ারপোর্টকে কীভাবে সাজিয়ে রেখেছে।
যাত্রাপথের আনন্দগান কি সবার হয়? কত কারণে, কতভাবে আমরা রওনা করি—কেউ কেঁদে, কেউ হেসে, আর ‘ইন–বিটুইন’। তবে সবাইকে পৌঁছানোর একটি ঠিকানা নিয়ে বেরোতে হয়, সবার একটি গন্তব্য থাকতে হয়। ইবনে বতুতার মতো ভবঘুরে আজকাল আর পাবেন না, সন্দেহজনক ঘোরাফেরায় হাজতখানাই হবে তার অস্থায়ী ঠিকানা।
মনে হতো কোনো বন্দরের ভিড়ে নয়, কারও বাড়ির সবুজ আঙিনায় ঢুকে পড়েছি। বাগানের পাশে, পর্চের মধ্যে যাত্রীরা স্কুটারে, কখনো গাড়িতে এসে নামত। কয়েকটি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেই একটি খোলা লবি, তার চারপাশে তথ্যসেবা কেন্দ্র, বাংলাদেশ বিমানের কাউন্টার, কোনো ব্যাংকের শাখা। সোজা হেঁটে গেলেই বাথরুম, পাশে কলাপসিবল গেট পেরিয়েই ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস কাউন্টার।
আমার মা পরিপাটি চুল বেঁধে, সাদা ইউনিফর্মের শাড়ি পরে, কলার-ব্লাউজের কাঁধে তারার ব্যাচ লাগিয়ে এই কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কাজ করতেন। এদিক থেকে খোলা গাড়ি-বারান্দা পেরিয়ে দেশি যাত্রীরা, আর ওদিক থেকে খোলা রানওয়ে পেরিয়ে বিদেশি যাত্রীরা—সবাই হেঁটে হেঁটে নিজেদের ব্যাগ নিজেরাই, কখনো কোন লোডারের সাহায্যে, বহন করে আম্মার কাউন্টারের সামনে দাঁড়াত। আমি আম্মার হাঁটুর উচ্চতা থেকে ওদের দেখতাম কপালে চোখ তুলে। আম্মা, আবার ওরাও সাদা কাগজে কী যেন লিখত, তারপর চলে যেত। সবকিছু থেকে কেমন একটা অচেনা বিদেশ-বিদেশ সুন্দর গন্ধ ছড়াত।
কোনো কোনো দিন আম্মা আমাকে সারা দিন ওঁর সঙ্গে কাজে রাখতেন। কেন জানি না, হয়তো বাসায় খালারা থাকত না। আমার সেদিন দারুণ সময় কাটত। ‘বলাকা’ রেস্তোরাঁয় বসে ডিম, রুটি, মাখনের মজার নাশতা খাইয়ে, আমাকে ছেড়ে দেওয়ার আগে আম্মা বলে দিতেন, ‘বেশি দূরে যেয়ো না।’
ছোট্ট আমি, কোন বয়সী হব? উনসত্তর থেকে তিয়াত্তরের স্মৃতি বয়ান করছি, সবে আমার বরাদ্দের প্রথম দশকটি পাড়ি দিচ্ছি। মনে আছে, সারা এয়ারপোর্ট ইতিউতি ঘুরে বেড়াতাম, কেউ কিচ্ছুটি বলত না। রানওয়েতে প্লেন নামলে সবচেয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। আম্মা আগেভাগেই ডেকে বলে দিতেন, ‘প্লেন নামবে, সীমা, যাও দেখো গিয়ে।’
পুরো দৃশ্যটি লাইভ দেখা যেত। ওই দূর আকাশের সীমানা থেকে ছোট্ট পাখির মতো প্লেনটি ধীরে ধীরে দৃষ্টির সামনে বড় হতে হতে সশব্দে মাটিতে নেমে গেল। তারপর তার পেট থেকে নানা রঙের পোশাকে যাত্রীরা একটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে, (যে সিঁড়িটি চাকা দিয়ে চালিয়ে, এই একটু আগেই প্লেনের দরজায় সেঁটে দেওয়া হয়েছে), আমার দিকেই হেঁটে আসছে।
আমি কখনো তারের বেড়ার এধারে দাঁড়িয়ে, কখনো ঘরের ভেতর এসির ঠান্ডা হাওয়ায়, বড় জানালার ধারে বসে ওদের দেখতাম। এমনও হতো ওদের কেউ কিছু বুঝতে পারছে না, আম্মা আমাকে বলতেন ‘ফরেন মানি এক্সচেঞ্জ’–এর ঘরটি চিনিয়ে দিতে। আমি সগর্বে ওদের আমার পেছন পেছন নিয়ে জায়গাটি চিনিয়ে দিতাম। ওরা কি তখন আমায় চকলেট দিত?
মনে পড়ে না। তবে সুন্দর একটা হাসি উপহার দিত। কাজ শেষে আম্মা লেডিস বাথরুমে অজু করে নামাজ পড়তেন, আমি বসে দেখতাম। তারপর আমি আর আম্মা হেঁটে হেঁটে এয়ারপোর্ট লাগোয়া বাগানটায় গিয়ে বসতাম। মালি এসে আম্মাকে ফুলের তোড়া বানিয়ে দিত।
আমি এই ঝোপ থেকে সেই ঝোপে প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াতাম। আম্মা বাগানের পুকুরঘাটে বসে সূর্যাস্ত দেখতেন। তারপর আমরা বড় রাস্তা পেরিয়ে হাবিবের দোকানে গিয়ে কিছু ফল কিনে স্কুটারে বাড়ি ফিরতাম। আজ যখন এত বয়সী হয়ে, জীবনযাত্রায় ক্ষতবিক্ষত ও বিধ্বস্ত হয়ে যখন ধ্যানের ক্লাসে বসি, তখন ধ্যানের গুরু বলেন, একটি মনছবি এঁকে নিতে, আমি ওই ছবিটি আঁকি। মনে হয় যত দিন বেঁচে থাকব, এই জায়গাটিই থাকবে আমার ফিরে যাওয়ার জায়গা, আমার স্বর্গ।
আমরা কেন ফিরে যেতে চাই? চলে যখন এসেছি! ফিরে যাওয়া কি চলে? নদীর স্রোত, সময়ের ধারা কি ফেরে? ফেরে না, কিন্তু ঘোরে। ঘুরে ঘুরে ঝরনা নদী হয়, নদী সাগর হয়, সাগর বাষ্প হয়, বাষ্প মেঘ হয়, মেঘ বৃষ্টি হয়, বৃষ্টি ঝরনা হয়…। সময় সকাল হয়, সন্ধ্যা হয়, দিন হয়, রাত হয়। একটা চক্র আছে, সব ঘুরেফিরে আসে, প্যাটার্নের মতো, প্রকৃতির মতো। এই পৃথিবীর আলো-অন্ধকার, উত্থান-পতন সবকিছুর শুধু যাওয়া-আসা, শুধু স্রোতে ভাসা!
আমাদের কেউ কেউ মানবিক অহংকারে সেটি মানতে চাই না। বলি, না, এই স্রোতে চিহ্ন রাখতে হবে! কিছু করে যেতে হবে, রেখে যেতে হবে চিরস্থায়ী কীর্তির মতো। সে কীর্তি যত বড় পরিসরে হয় তত কালের স্রোত এড়াতে পারে। যত বেশি লোকের কাজে আসে, তত স্মরণীয় হয়। আসলে ফিরে ফিরে আমাদের নিজেদের কাছেই আসতে হয়। যাওয়ার বা ফিরে আসার আর কোনো ঠিকানা নেই।
ইতিমধ্যে একসময় আমাদের নিজের নিজের ভাগ্যান্বেষণে পথে নামতে হয়। করে খেতে হবে তো, নাকি? কহিলেন নবী,‘যাও কাঠ কেটে খাও, দেখো খোদা করে কী যে, নবীর শিক্ষা করোনা ভিক্ষা, মেহনত করো সবে।’ মেহনতের জন্য, ভিক্ষুক হয়ে বিড়ম্বিত জীবন না যাপনের জন্য কবে থেকে এই যাত্রা শুরু হয়েছিল? আমারও জন্মের আগেই তো। ১৯৬২ সালে আম্মা মেহনত করে উন্নত, সম্মানিত জীবন পাওয়ার জন্যই ময়মনসিংহের গ্রাম্য জীবন ছেড়ে ঢাকা শহরে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। সংসার চলছিল চক্রের মতো, আম্মার সংসার। বিশ্বসংসার চলছিল মহাকালের মহাচক্রের মতো।
এবার আমার কাঁধে সে চক্রের জোয়াল চড়ে বসবে। আমি নিজেকে দেখব—সদ্য স্বাধীন দেশের অবগুণ্ঠিত নয়, বরং কুণ্ঠিত, নারী নয় নাগরিক হিসেবে। বই পড়ছি, নিজ চোখেও দেখছি দেশভাগ হচ্ছে বারবার। নেতাকে, পিতাকে গুলিবিদ্ধ করছি আমরা! কেন? একি তুঘলকি কাণ্ড! তার মধ্যেই কোলে এসে গেছে নবজাতক। ছাড়ো, দেশ-কাল সব ছাড়ো। ভাগো, ইহাসে ভাগো—লোকে বলা-কওয়া শুরু করবে, সৌভাগ্য গড়ে নিতে হয়, ঘরে বসে বসে কামনা করলে আসে না, তাই ছোটো, ছুটে চলো…এই আমি ‘বাহির হলেম তোমারই গান গেয়ে’ আর ‘এলেম নতুন দেশে।’ ১৯৯৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে গেল আমার কর্মস্থল, আমার দ্বিতীয় স্বদেশ।
প্রথমবার যখন দেশ ছেড়ে আসব, হায় আল্লাহ! আমার আর মঞ্জুর (আমার বর) দুদিকের দুটি একান্নবর্তী পরিবারই শুধু নয়, আমাদের বন্ধু-বান্ধবী, সস্ত্রীক-সস্বামী, বয়ফ্রেন্ডসহ বিশাল জনগোষ্ঠী ‘সি-অফ’ করতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। এখন যে কাজটি তারা ‘মুখো-সময়ে’ বিদায়ের আগের রাতেই সেরে ফেলেন।
আর আমি নদী, নিরবধি—এয়ারপোর্টের পথে পথে, বন্দরের বেষ্টনী পেরিয়ে, কাচের ঘরের প্লাস্টিকের চেয়ারের একটিতে বসে অপেক্ষায় থাকি—কখন নির্গমনের যাত্রীরা বিমান থেকে নেমে যাবে, আমি বহির্গমন করব। পশ্চিমাকাশের সূর্য তখন অস্তে যাওয়ার জন্য তৈরি হবে, সব রোদ ঝরে যাবে, ম্লানমুখো ওই সূর্যের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমার বুকে বিদায়ের করুণ কষ্ট অসহ্য হয়ে উঠবে—রবীন্দ্রনাথের চারি বৎসরের কন্যাটিকে ফেলে আসার মতো।
‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় পূজার ছুটি কাটিয়ে কর্মস্থল ফিরে যেতে যেতে রবীন্দ্রনাথের যেমন মানুষের শেষযাত্রার কথা মনে পড়েছিল, প্রতিবার এভাবে নিজের শিকড়ের কাছ থেকে ফিরে আসার অসহায়ত্বটিকে আমারও ছোট ছোট মৃত্যুর মতো মনে হয়। যেন এই আমি, সেই আমিকে মাটি চাপা দিয়ে চলে আসি। কেউ বলেছিল—এভাবে চলে যাওয়া, দূরে যাওয়া জীবনে একলা চলার শিক্ষার সুযোগ করে দেয়। যখন আদিতে আমাদের একলাই আসা, একলাই যাওয়া; তখন একলা চলা নিয়ে এত আফসোস কেন রবীন্দ্রনাথের?
‘চিরকাল ধরে যা পায়, তাই সে হারায়, তবু তো রে শিথিল হলো না মুষ্টি, তবু অবিরত চারি বৎসরের কন্যাটির মতো, অক্ষুণ্ন প্রেমের গর্বে কহিছে ডাকি ‘যেতে নাহি দিব’…যতবার পরাজয় ততবার কহে, আমি ভালোবাসি যারে, সেকি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে।’ যারা আমার মতো প্রবাসী তারা বলতে পারবেন, এভাবে বারবার চলে যাওয়া ওদের জীবনযাপনে তো বটেই, ব্যক্তিত্বের মধ্যেও কেমন কঠিন চিহ্ন এঁকে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রে দেশি ভাইবোনেরা নানা রকম ভিসায় এসে থেকে যান।
পরে ওদের আত্তীকরণ হয় যুক্তরাষ্ট্রের আর্থসামাজিক কাঠামোর মধ্যে। কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে বিধায় এখানে আনন্দের সঙ্গে সবাই কষ্ট করে। অনেকে দেশে ফেরার কোনো ঠিকানাই আর বাকি রাখে না। মা–বাবা, ভাই–বোন, তাদের সম্প্রসারিত পরিজনসহ সবাই দেশান্তরি হয়। একপর্যায়ে দেশের জমিগুলো বিক্রি করে শেষ বন্ধনটিও ছিন্ন করে আসে। তবু কি দেশকে ছাড়া যায়, স্ব-ভাবকে ত্যাগ করা যায়? তাই ফিরে ফিরে ‘লিটল-বাংলাদেশে’ আসা-যাওয়া। তাই বাংলা ভাষা, বাংলা গান, পয়লা বৈশাখ, পিঠা-পান্তা, শাড়ি-পাঞ্জাবি…ওই যে বলা হলো আমাদের নিজের কাছেই ফিরতে হয়, এও তা–ই।
এয়ারপোর্টগুলোতে দেখা পাওয়া যায় যাওয়া-আসার পথিকদের। আহা ‘সেকি চঞ্চলতা জাগে সবার মনে! ভালো লাগে বড় ভালো লাগে।’ এখানেও নানা দৃশ্য তৈরি হয় ক্ষণে ক্ষণে। ধৈর্য নিয়ে সব যাত্রী অপেক্ষমাণ বিমানে উঠবে বলে। উঠেই তাড়াহুড়ো—মাথার ওপরে বাক্সখানি রাখার জায়গাটি পেতে হবে। জায়গা দখলের এক্ষণে আমি বাস্তবের মাটিতে দাঁড়াই। পড়ন্ত সূর্য দেখে যে বিদায়ের কথায় চোখ ভিজে এসেছিল, সেটি মুছে ফেলতে হয়।
আমি ‘হেঁইও’ বলে নিজের কেরিওনটি কাঁধের ওপর তুলে, মাথার ওপর খালি জায়গাটিতে চালান করে, শান্তি শান্তি বলে সিটে বসে পড়ি। তারপর আশপাশটা দেখি। মাথার ভেতরে তখন আর যেতে নাহি চাই, বিচ্ছেদ–বেদনা, দেশ–দেশান্তর কোনো বোধ নেই। কেবল আছে—পাশের সিটের যাত্রীটি কেমন, তার চিন্তা। সেকি এল, সেকি এল? না, না, বেশ, বেশ! এটি ‘অর্থনীতি-শ্রেণি’র কাহিনি। ‘ব্যবসা-শ্রেণি’তে অন্য গল্প। সেখানে হুটোপুটি নেই, সহযাত্রীর জন্য অনর্থক উৎকণ্ঠা নেই, বরং সদা হাস্যময়ীর হাতে আপনার জন্য তৈরি আছে শীতল পানীয়। আপনি আরামে বসে পড়ুন, যাত্রা উপভোগ করুন।
যাত্রাপথের আনন্দগান কি সবার হয়? কত কারণে, কতভাবে আমরা রওনা করি—কেউ কেঁদে, কেউ হেসে, আর ‘ইন–বিটুইন’। তবে সবাইকে পৌঁছানোর একটি ঠিকানা নিয়ে বেরোতে হয়, সবার একটি গন্তব্য থাকতে হয়। ইবনে বতুতার মতো ভবঘুরে আজকাল আর পাবেন না, সন্দেহজনক ঘোরাফেরায় হাজতখানাই হবে তার অস্থায়ী ঠিকানা। অভিজ্ঞতায় জানি, যাত্রা আনন্দময় হতে পারে সহযাত্রীর সহায়তায়। যাঁর সঙ্গে যাত্রা করছেন, অথবা যে অচেনা সহযাত্রীর পাশে সিট পেয়েছেন, তিনি সারাটি পথে কী আচরণ করছেন, তার সঙ্গে আপনি কীভাবে আচরণ করছেন—এই মিথস্ক্রিয়ার ওপরও আমাদের যাত্রার ‘কোয়ালিটি’ নির্ভর করে।
আপনারা কি পাশাপাশি চলে বিরক্ত হচ্ছেন? না সহজ, সহমর্মী আছেন, এমন ছোট ছোট মনোভঙ্গি দিয়েও আমরা পরস্পরের যাত্রাকে আনন্দময় বা যন্ত্রণাকাতর করে ফেলতে পারি। মাত্র ৯ ঘণ্টার বিমানযাত্রায়, আবার দীর্ঘ ৯০ বছরের জীবনযাত্রায় এই পারস্পরিকতা একইভাবে কার্যকর হয়।
আবার নিজের যাত্রার কথায় ফিরি। প্রথম দিকে আসা–যাওয়ার টিকিটের খরচা জোগাড় করতেই বছর ঘুরে যেত। চারটি সদস্যের পরিবার রওনা করবে, কত ঘট, কত পট, হাঁড়ি–সরা–ভাণ্ড নিয়ে। একজন নবীন প্রবাসীর পক্ষে তা সামলে নেওয়া কঠিন ছিল। পরে রোজগার বেড়ে সেটি একটু সহজ হলো। এবার ছেলেরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করল—ছুটি আর পয়সা জমলেই দৌড়ে কেবল একই দেশে যেতে হয় কেন? আমি ওদের ছেড়েই আসা–যাওয়া শুরু করি।
এ জন্য আমার কোনো অনুতাপও হয় না। তবে শিক্ষা হয়—যার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যেখানে, তার নাড়ির টান সেখানে। চাপিয়ে দিয়ে দেশপ্রেম শেখানো যায় না। কেবল আমার প্রাচীন আম্মা মাঝে মাঝে ঠ্যাস দিয়ে বলে উঠলে, ‘তোমার ছেলেরা কোনো দিনও এই দেশে আসবো না’—বাক্যটি হজম করতে আমাকে আরেকটু বেশি ধৈর্যশীল হতে হয়।
এভাবে ধৈর্য আর চলা, শুধু চলা, সামনে চলাকে সঙ্গে করে আমার ‘দিন যায়, রাত যায়, সব যায়।’ আমি বসে ঘর করি। আমার দৃষ্টির সামনে সে ঘর পূর্ণ হয়, আবার শূন্য হয়। আমি বুঝতে শিখি এরা সব দৃশ্য, কেবল ঘটনার মতো ঘটে চলেছে। এদের গতিমুখ বদলানো যায় না, তবে এদের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরানো যায়, নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া যায়, ডুবিয়েও দেওয়া যায়। আবার পাড়ে বসে এদের চলাচল দেখেও সুখানুভূতি পাওয়া যায়। এ যে জগতের আনন্দযজ্ঞ! আর আমি এখানে নিমন্ত্রিত।