খালিদের গান কেন শ্রোতাদের মন ছুঁয়েছিল

গতকাল ১৮ মার্চ মারা গেছেন সংগীতশিল্পী খালিদ। পুরো নাম খালিদ সাইফুল্লাহ। ‘সরলতার প্রতিমা’, ‘কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে’সহ অজস্র শ্রোতাপ্রিয় গানের গায়ক ছিলেন তিনি। তাঁর গান কেন মন ছুঁয়েছিল শ্রোতাদের, তাঁকে স্মরণ করে এ লেখায় তা বিশ্লেষণ করেছেন এ প্রজন্মের সংগীতশিল্পী জয় শাহরিয়ার

খালিদ সাইফুল্লাহ (১ আগস্ট ১৯৬৫—১৮ মার্চ ২০২৪)প্রথম আলো

নব্বইয়ের দশকে যাঁদের গান শুনে আমার বেড়ে ওঠা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম খালিদ ভাই। পুরো নাম খালিদ সাইফুল্লাহ হলেও সংগীতাঙ্গনে তিনি পরিচিত খালিদ নামেই। ব্যান্ড দল চাইমের মাধ্যমে শ্রোতাদের কাছে প্রথম পরিচিতি পান তিনি। পরবর্তী সময়ে মিশ্র অ্যালবামের যুগে তাঁর একক কণ্ঠে বিভিন্ন গান খালিদকে করে তুলেছিল বাংলা রক গানের জগতে অনন্য।

গতকাল ১৮ মার্চ ২০২৪। ইফতারের পর চা খাচ্ছি সন্ধ্যাবেলা। ফোন পেলাম সংগীতশিল্পী শফিক তুহিন ভাইয়ের। স্তব্ধ হয়ে গেলাম এক অকস্মাৎ মৃত্যুসংবাদে। সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন প্রিয় শিল্পী খালিদ—খালিদ সাইফুল্লাহ।

অবাক করা ব্যাপার হলেও সত্যি যে খালিদ ভাইয়ের গান শুনছি কৈশোর থেকে, কিন্তু তাঁর পুরো নাম জানতে পারলাম এ শিল্পীর জানাজায় দাঁড়িয়ে। ঢাকাস্থ গ্রিনরোডের কমফোর্ট হাসপাতালে মৃত ঘোষণার পর গতকাল রাত ১১টায় তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয় গ্রিনরোড জামে মসজিদে। তাঁকে শেষ দেখা দেখতে এসেছিলেন দুই প্রজন্মের অনেক শিল্পী। তাঁর সহকর্মী প্রিন্স মাহমুদ, মানাম আহমেদ, ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, কবির বকুলসহ আমাদের প্রজন্মের অনেকেই এসেছিলেন বুকভরা শোক নিয়ে। এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে অদ্ভুত রকমের বাস্তবতা হলো, এমন মন খারাপ করা মুহূর্তগুলোতেই হয়তো সুযোগ মেলে অনেক দিন পর অনেক প্রিয়মুখকে একসঙ্গে দেখার। যাঁদের সঙ্গে স্টুডিওতে কেটেছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত; এখন তেমন কোনো বন্ধুর বিয়োগেই হয়তো অন্যদের সঙ্গে দেখা হয় বহুদিন পর। বাস্তবতা কত নিষ্ঠুর!

খালিদ সাইফুল্লাহ
প্রথম আলো

খালিদ ভাই চলে যাওয়ার সংবাদে মাথায় ঘুরছে একের পর এক তাঁর গাওয়া সব হৃদয়ছোঁয়া গান।

চাইমের ‘নাতিখাতি বেলা গেল’ দিয়ে শুরু। তারপর ‘কালো মাইয়া’। বাংলা রক গানে বাংলা ফোকের সপ্রতিভ উপস্থাপন সর্বপ্রথম সফলভাবে করেছেন খালিদ ভাই তাঁর ব্যান্ড চাইমকে নিয়ে। তারপর যুগে যুগে বাংলা রকের সঙ্গে বাংলার লোকগান মিশেছে নানাভাবে। তবে শুরুর কৃতিত্বটা দিতে হবে এই খালিদ সাইফুল্লাহকেই। সে সময় তাঁর গাওয়া ফোকগানগুলোর রক অ্যারেঞ্জমেন্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ঠিকই, তবে পাশাপাশি ‘সেদিনও আকাশে ছিল চাঁদ’, ‘তোমাকে ভালোবেসে’, ‘নারী’, ‘নষ্ট-কষ্ট’ গানগুলোর মাধ্যমে তিনি নিজের জাত চিনিয়েছেন রক আর মেলো রকে তাঁর কণ্ঠের জাদু দিয়ে। আর এ কারণে যেন খুব সহজেই শ্রোতাদের মন ছুঁতে পেরেছিলেন এ শিল্পী।

খালিদ ভাই ছিলেন বাংলা রক গানের ‘আনসাং হিরো’। কেন যেন মিডিয়া ও তারকাখ্যাতির আলো যতটা প্রাপ্য, ততটা পাননি তিনি কখনোই। তাঁর সমসাময়িক অন্য রকাররা ভালো ও জনপ্রিয় গান শ্রোতাদের দিয়ে শ্রোতাপ্রিয়তার পাশাপাশি যে তারকাখ্যাতি এবং যে পরিমাণে গণমাধ্যমের আনুকূল্য পেয়েছেন, খালিদ ভাই সেটা কখনোই পাননি। কে জানে, হয়তো তিনি কখনো সেটা চানইনি। এড়িয়ে গেছেন অভিমানে কিংবা খেয়ালিপনায়।

নব্বই দশকের শেষ দিকে শুরু হয় বাংলা অডিও জগতে মিশ্র অ্যালবামের জোয়ার। সেই সময়ে মিশ্র অ্যালবামে সবচেয়ে সফল শিল্পীদের একজন খালিদ। তখন এ শিল্পীর দারুণ জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘সরলতার প্রতিমা’, ‘হয়নি যাবার বেলা’, ‘কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে’, ‘যতটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে’, ‘আবার দেখা হবে’, ‘আকাশনীলা’, ‘হিমালয়’। মাঝখানে একক অ্যালবাম ‘ঘুমাও’ ছিল বেশ আলোচিত। আমি ও আমার প্রজন্মের সব বাংলা গানপ্রিয় শ্রোতা এসব গানে বুঁদ হয়ে কাটিয়েছি অজস্র দিন ও রাত। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, খালিদ ভাই ছিলেন বাংলা রক গানের ‘আনসাং হিরো’। কেন যেন মিডিয়া ও তারকাখ্যাতির আলো যতটা প্রাপ্য, ততটা পাননি তিনি কখনোই। তাঁর সমসাময়িক অন্য রকাররা ভালো ও জনপ্রিয় গান শ্রোতাদের দিয়ে শ্রোতাপ্রিয়তার পাশাপাশি যে তারকাখ্যাতি এবং যে পরিমাণে গণমাধ্যমের আনুকূল্য পেয়েছেন, খালিদ ভাই সেটা কখনোই পাননি। কে জানে, হয়তো তিনি কখনো সেটা চানইনি। এড়িয়ে গেছেন অভিমানে কিংবা খেয়ালিপনায়। মঞ্চে এবং মঞ্চের বাইরে খালিদ ভাই সব সময়ই কাটিয়েছেন রকস্টারের জীবন। একটা কালো সানগ্লাস পরে গান গাওয়ার সময় তাঁর অ্যাটিচিউড ছিল সবার চেয়ে আলাদা। মৃত্যুর দিন বিকেলবেলাতেও বাইক চালিয়ে ফিরেছেন বাসায়।

একের পর এক হিট গান উপহার দিয়ে অল্প সময়েই খ্যাতি পান খালিদ, তাঁর গান এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে
কোলাজ

খালিদ সাইফুল্লাহ তাঁর দীর্ঘ সংগীতজীবনে সময়ের তুলনায় গান হয়তো একটু কমই করেছেন। তবে যা করেছেন তা–ই যথেষ্ট বাংলা গানের জগতে তাঁকে চিরস্থায়ী আসন দেওয়ার জন্য। বিভিন্ন মিশ্র অ্যালবামের বাইরে তাঁর প্রকাশিত স্টুডিও অ্যালবামগুলো হলো—‘চাইম’ (১৯৮৫), ‘নারী’ (১৯৯৫), ‘জন্ম’ (২০০২), ‘কীর্ত্তনখোলা’ (২০০৫)। এই অ্যালবামগুলো ব্যান্ড দল চাইমের। এর বাইরেও খালিদের একটি একক অ্যালবাম আছে, যার নাম ‘ঘুমাও’।

গান গাওয়ার পাশাপাশি একাধারে গান লেখা ও সুরকার হিসেবেও কাজও করেছেন তিনি। নিজের কণ্ঠে চাইমের বেশ কিছু গানের কথা ও সুর নিজেই করেছেন খালিদ। একবিংশ শতকের প্রথম দশকের শেষ দিকে এসে আস্তে আস্তে গানের জগতে অনিয়মিত হয়ে পড়েন এ শিল্পী। গত দেড় দশকে তাই নতুন গানে তাঁর তেমন কোনো উপস্থিতি ছিল না। হয়তো কোনো অজানা অভিমান ছিল, কে জানে! এখন আর তা জানার উপায় রইল না।

আমাদের দেশে শিল্পীদের কাজের সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। জীবনী, ডিসকোগ্রাফি সঠিকভাবে করা হয় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। খালিদ ভাইয়ের গানের ক্ষেত্রেও সেটা বাস্তব। আমরা আশা করব, খালিদ ভাইয়ের সব গান ও তথ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

খালিদ ভাই তাঁর গানের মাধ্যমেই থাকবেন সবার হৃদয়ে। এক অনন্য গায়কি তাঁকে সব সময় আলাদা করে রেখেছে বাকি সবার থেকে। রক মেজাজ কিন্তু অসম্ভব মেলোডিয়াস একটা কণ্ঠের অধিকারী খালিদ সাইফুল্লাহ এ জন্যই সবার মনের মধ্যে গানে সুরে বেঁচে থাকবেন জানি, তবে পৃথিবীর অমোঘ নিয়তিকে মেনেই তিনি মর্ত্যলোক ছেড়ে চলে গেলেন হঠাৎ করে। তাঁর গানের পঙ্‌ক্তিকেই যেন সত্যি করে গেলেন, তাই ‘কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে...’।